চলতি বছরের (২০২৩) প্রথম ছয় মাসে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় একটি করে ভুল তথ্য সম্বলিত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অবাক হচ্ছেন? এটাই বাস্তব সত্য। রিউমর স্ক্যানারের সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসের গণমাধ্যম কর্তৃক প্রচারিত ভুল তথ্যের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এমন তথ্যই পাওয়া গেল।
এক নজরে…
পরিসংখ্যান কী বলছে?
রিউমর স্ক্যানার টিম উক্ত ছয় মাসের তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত এই পরিসংখ্যানে দেশের নিবন্ধিত ১৭৬ টি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলো যাচাই করেছে। এই সংবাদমাধ্যমগুলোতে সর্বোচ্চ ৩৮ টি থেকে সর্বনিম্ন একটি ভুল তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া গেছে।
পরিসংখ্যানে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য প্রচারের দরুণ প্রথম স্থানে রয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম ‘সময় টিভি’। ভুল তথ্য ছিল এমন শনাক্ত হওয়া ১৭৯ টি প্রতিবেদনের মধ্যে ৩৮ টি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মূলধারার এই সংবাদমাধ্যম। ক্ষেত্র বিবেচনায় শুধু টেলিভিশনের তালিকাতেও সময় টিভিই প্রথম। পত্রিকার তালিকায় ২৬ টি ভুল সংবাদ প্রচার করে প্রথম অবস্থানে রয়েছে ইনকিলাব। অনলাইন সংবাদমাধ্যমের তালিকায় শীর্ষ স্থানে এসেছে ডেইলি বাংলাদেশ। গণমাধ্যমে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে মে মাসে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য প্রচার হতে দেখা গেছে। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ভুল সংবাদ প্রচারিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিষয়ে। পরিসংখ্যানে বেসরকারি গণমাধ্যমের পাশাপাশি ভুল সংবাদ প্রচারের তালিকায় যেমন রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমও রয়েছে তেমনি বাদ যায়নি বিদেশী গণমাধ্যমগুলোও।
প্রথম ছয় মাসের পরিসংখ্যান দেখুন এখানে।
মে মাসে ভুল তথ্য বেশি
গণমাধ্যমে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১৭৯ টি প্রতিবেদনকে ভুল হিসেবে শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৫ টি ভুল তথ্য (১৯ শতাংশ) শনাক্ত হয়েছে মে মাসে। মার্চে শনাক্ত ৩১ টি (১৭.২২ শতাংশ)। তবে এর পূর্বের দুই মাস অর্থাৎ, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ভুল তথ্য শনাক্তের সংখ্যা একই (৩০)।
তবে প্রথম তিন মাসে গণমাধ্যমে ভুল তথ্যের সংখ্যা সমান বা উর্ধ্বমুখী হলেও এপ্রিলে সংখ্যাটি নিম্নমুখী হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। এ মাসে গণমাধ্যমে প্রচারিত ভুল তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদনের সংখ্যা ২৪ টি যা আগের মাসের চেয়ে ৭ টি কম। এরপরের মাসে গিয়ে অবশ্য লাফিয়ে বেড়েছে এ সংখ্যা, গিয়ে ঠেকেছে ৩৫ এ। তবে জুন মাসে সংখ্যাটি ফের নিম্নমুখী (২৯) হতে দেখা গেছে।
ছয় মাসের সর্বমোট ১৮১ দিনে ১৭৯ টি ভুল সংবাদ শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার, যা গড়ে প্রতিদিন অন্তত একটি!
মিথ্যা আর বিভ্রান্তিকর সংবাদের ছড়াছড়ি
২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি থেকে জুন) মোট ১৭৯ টি ঘটনায় ৯৮ টি মিথ্যা, ৭৭ টি বিভ্রান্তিকর, ০১ টি আংশিক মিথ্যা, ০১ টি অধিকাংশই মিথ্যা, ০১ টি স্যাটায়ার এবং ০১ টি বিকৃত তথ্যকে সত্য তথ্য হিসেবে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।
এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ১৭৯ টি ঘটনায় মিথ্যা তথ্য প্রচারের হার ছিল প্রায় ৫৪.৭৪ শতাংশ। তাছাড়া, বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর হারও নেহায়েত কম নয়, প্রায় ৪৩.০১ শতাংশ। তবে একটি করে স্যাটায়ার এবং বিকৃত তথ্য সম্বলিত সংবাদকে সত্য হিসেবে গণমাধ্যমে প্রচার নিঃসন্দেহে শঙ্কার জায়গা তৈরি করে দিয়েছে।
১৭৬ টি গণমাধ্যমের অবস্থান দেখুন এখানে।
সময় টিভি যেভাবে প্রথম
গণমাধ্যমের ভুল সংবাদের এই পরিসংখ্যানে ছয় মাসের তথ্য বলছে, তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে দেশের অন্যতম ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম সময় টিভি। সংবাদমাধ্যমটির ওয়েবসাইট, ইউটিউব চ্যানেল এবং ফেসবুক পেজে প্রকাশিত সংবাদগুলো বিশ্লেষণ করে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৩৮ টি ভুল সংবাদ প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৫ টি ভুল সংবাদ প্রচার হয়েছে আন্তর্জাতিক বিষয়ে, শতাংশের হিসেবে যা প্রায় ৩৯.৪৭। খেলার বিষয়ে প্রচারিত ১০ টি ভুল সংবাদের মধ্যে ক্রিকেট বিষয়ক ভুল ছিল ০৩ টি এবং ফুটবল বিষয়ে ভুল ছিল ০৭ টি। এই দুই বিষয় মিলিয়ে ভুলের হার প্রায় ৬৫.৭৯ শতাংশ। এছাড়া, ধর্মীয় বিষয়ে ০৪ টি, শিক্ষা বিষয়ক ০৩ টি, বিনোদন বিষয়ক ০২ টি এবং জাতীয়, রাজনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য বিষয়ে ০১ টি করে ভুল সংবাদ প্রচার করেছে সময়।
ক্যাটাগরি বা বিষয়ের বাইরে ধরনভিত্তিক ভুল সংবাদ বিবেচনায় সময় টিভির সবচেয়ে বেশি ভুল ছিল তথ্য কেন্দ্রিক ভুল (১৯), যা মোট ভুলের অর্ধেক। এছাড়া, প্রকাশিত সংবাদে সময় টিভি সংশ্লিষ্ট ঘটনায় পুরোনো বা ভিন্ন স্থানের ভুল ছবি ব্যবহার করেছে ১৩ টি, যা মোট ভুলের ৩৪.২১ শতাংশ। এর বাইরে ভিডিও কেন্দ্রিক ভুল সংবাদ প্রকাশের হার ১৫.৭৯ শতাংশ।
তবে ‘সময়’ যে এবারই প্রথম শীর্ষস্থান পেয়েছে এমন নয়, রিউমর স্ক্যানার কর্তৃক প্রকাশিত ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসের পরিসংখ্যান, ২০২২ সালের শেষ ছয় মাসের পরিসংখ্যান (যৌথভাবে) এবং ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসের পরিসংখ্যানেও যথারীতি প্রথম অবস্থানে দেখা গেছে এই সংবাদমাধ্যমকে।
কোন মাধ্যমে বেশি ভুল তথ্য?
রিউমর স্ক্যানার কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদভিত্তিক এই পরিসংখ্যান প্রকাশের ক্ষেত্রে তিন ক্ষেত্রের সংবাদমাধ্যমের সংবাদগুলো যাচাই করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, পত্রিকা, টেলিভিশন এবং অনলাইন সংবাদমাধ্যম। যদিও এই তিন ধরণের মাধ্যমেরই ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর তথ্যই যাচাই করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সার্বিক বিবেচনায় তালিকার শীর্ষ পাঁচে যারা আছে তাদের নাম উপরে উল্লিখিত টেবিলেই দেখতে পাচ্ছেন।
ক্ষেত্র বিবেচনায় পত্রিকার তালিকায় ২৬ টি ভুল সংবাদ প্রচার করে প্রথম অবস্থানে রয়েছে ইনকিলাব। পরের অবস্থানে যুগান্তর, যাদের ভুল সংবাদের সংখ্যা ২৪ টি৷ ২৩ টি ভুল সংবাদ প্রচার করে যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে দেশ রূপান্তর এবং দৈনিক আমাদের সময়। পরের অবস্থানে রয়েছে কালের কণ্ঠ (২২ টি)। পঞ্চম অবস্থানে ভাগ বসিয়েছে তিনটি পত্রিকা – মানবজমিন, কালবেলা, ভোরের কাগজ, যাদের ভুলের সংখ্যা ১৯ টি।
একইভাবে ভুল সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে টেলিভিশনের তালিকায় শীর্ষ স্থানে আছে সময় টিভি (৩৮ টি)। পরের অবস্থানে দেখা যাচ্ছে ডিবিসি নিউজকে (২৭ টি)। তৃতীয় অবস্থানে যৌথভাবে রয়েছে যমুনা টিভি এবং বাংলাভিশন, যাদের ভুল সংবাদ প্রচারের সংখ্যা ২৪ টি। চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে চ্যানেল২৪ (২২ টি) এবং একাত্তর টিভি (১৮ টি)।
অনলাইন সংবাদমাধ্যমের তালিকায় শীর্ষ স্থানে এসেছে ডেইলি বাংলাদেশ (৩৫ টি)। পরের চার অবস্থানে যথাক্রমে রয়েছে ঢাকা মেইল (৩২ টি), জুম বাংলা (২৭ টি), ঢাকা পোস্ট (২৬ টি) এবং আমাদের সময়.কম (২৩ টি)।
Banner: Rumor Scanner
কোন ক্যাটাগরিতে বেশি ভুল?
গণমাধ্যমগুলো চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে প্রচারিত ভুল সংবাদের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি ভুল সংবাদ প্রচারিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিষয়ে (৭২ টি), শতকরার হিসেবে যা ৪০.২২ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাধূলা বিষয়ে ভুল সংবাদ প্রচার হতে দেখা গেছে এর মধ্যে ফুটবল বিষয়ক ভুল সংবাদ ছিল ২৪ টি এবং ক্রিকেট বিষয়ে ছিল ০৯ টি। জাতীয় বিষয়ে ভুল সংবাদ প্রচারের সংখ্যা ছিল ২৩ টি, যা তৃতীয় সর্বোচ্চ। এর বাইরে শিক্ষা বিষয়ে ১৪ টি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে ১২ টি ভুল সংবাদ প্রচার করা হয়েছে। ধর্মীয় ও বিনোদন বিষয়ে সমানসংখ্যক (০৯ টি) ভুল সংবাদ প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। তবে সে তুলনায় স্বাস্থ্য বিষয়ক ভুল সংবাদ প্রচারের সংখ্যা ছিল বেশ কম (০১ টি)। নির্বাচনের এই বছরে নির্বাচন কেন্দ্রিক ভুল সংবাদ প্রচারের হার বাড়ার শঙ্কা ছিল, তবে প্রথম ছয় মাসে এ বিষয়ে মাত্র ০১ টি ভুল সংবাদ প্রচার হতে দেখা গেছে। কিন্তু রাজনীতি বিষয়ে পাঁচটি ভুল সংবাদ প্রচার করেছে গণমাধ্যম। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে শেষ দুই ক্যাটাগরিতে ভুল সংবাদ প্রচারের হারও বাড়তে দেখা অমূলক হবে না।
কী ধরনের ভুল বেশি?
ধরনভিত্তিক ভুল সংবাদ বিবেচনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে গণমাধ্যমগুলোয় সবচেয়ে বেশি ভুল সংবাদ ছিল তথ্য কেন্দ্রিক (৯৬ টি), যা মোট ভুলের ৫৩.৬৩ শতাংশ। এছাড়া, প্রকাশিত সংবাদে গণমাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ঘটনায় পুরোনো বা ভিন্ন স্থানের ভুল ছবি ব্যবহার করেছে ৬১ টি, যা শতকরা হিসেবে ৩৪.০৮ শতাংশ। এর বাইরে ভিডিও কেন্দ্রিক ভুল সংবাদ প্রচারিত হয়েছে ২২ টি।
কোন খবরে বেশি ভুল?
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে একাধিক বিষয়েই অর্ধশতাধিক গণমাধ্যমে ভুল সংবাদ প্রচার হতে দেখা গেছে। এর মধ্যে গত মে মাসে ঘূর্ণিঝড় মোখা বিষয়ে গণমাধ্যমে একাধিক ব্যক্তির মৃত্যুর খবর আসলে সেসব বিষয়ে অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, মোখা’য় কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনাই ঘটেনি। অনুসন্ধান শেষে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে দেশের ৬২ টি গণমাধ্যমে ভুল তথ্য প্রচারের বিষয়টি উল্লেখ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
বেশি গণমাধ্যম ভুল তথ্য প্রচার করেছে এমন তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চলতি বছরের হজ বিষয়ক একটি ফ্যাক্টচেক। এই প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, এই বছরের হজে অংশগ্রহণকারী হাজিদের সংখ্যা ও এই হজকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হজ দাবি করে ভুল তথ্য প্রচার করেছে ৫৫ টি সংবাদমাধ্যম। এসব গণমাধ্যমে অংশগ্রহণকারীদের হাজিদের ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা উল্লেখ করলেও প্রকৃতপক্ষে এই বছর হজে অংশগ্রহণকারী হাজির সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫ জন।
তালিকার তৃতীয় অবস্থানে থাকা ফ্যাক্টচেকটি ছিল বহুল আলোচিত বগুড়া-৪ আসনের নির্বাচন কেন্দ্রিক৷ গত ০১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বগুড়া-৪ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোঃ আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম ৩৯৯, ৫৯১, ৯০৪, ৯৫১, ১০০১ ও ১২৪৬ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন দাবিতে ৫১ টি গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যগুলো যাচাই করে সত্যতা পায়নি রিউমর স্ক্যানার। হিরো আলম মূলত ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন এই নির্বাচনে।
গত ফেব্রুয়ারিতে গণমাধ্যমের সংবাদে দাবি করা হয় সূর্যের একটি অংশ ভেঙে পড়েছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার অনুসন্ধানে দেখেছে, দাবিটি সঠিক নয় বরং সেসময় সূর্যের প্রমিনেন্স বা প্লাজমা বিচ্ছিন্ন হয়ে সূর্যের উত্তর মেরুতে ঘুরতে থাকে। কিন্তু সূর্যের কোনো অংশই “ভাঙেনি”। প্লাজমার এই ঘটনা স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। তাছাড়া, সংবাদগুলোয় ড. তামিথাকে নাসার কর্মকর্তা এবং ছবিটি জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা বলে যে দাবি করা হয়েছিল সেটিও সঠিক ছিল না। এ বিষয়ে ৪৮ টি গণমাধ্যম ভুল সংবাদ প্রচার করেছে, ফলে এই সংক্রান্ত ফ্যাক্টচেক প্রতিবদনটি এই তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।
তালিকার পঞ্চম অবস্থানে দেখা যাচ্ছে, বিনোদন বিষয়ক একটি ফ্যাক্টচেক। গত এপ্রিলে কেডি- দ্য ডেভিল নামক একটি সিনেমার শুটিংয়ে ব্যাঙ্গালোরে অবস্থানরত বলিউড অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হয়েছেন শীর্ষক একটি দাবি দেশের ৪২ টি সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হয়। তবে সঞ্জয় দত্ত নিজেই এক টুইট বার্তায় বিষয়টি পুরোপুরি ভিত্তিহীন বলে নিশ্চিত করেছেন। এ বিষয়ে রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদন দেখুন এখানে।
কোন ইস্যুতে বেশি ভুল?
গত ০৬ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ তুরস্ক এবং উত্তর সিরিয়ায় বিধ্বংসী এক ভূমিকম্পে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর খবর আসে গণমাধ্যমে। পরবর্তীতে এ বিষয়ে একাধিক গুজব ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায় গণমাধ্যমসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে। রিউমর স্ক্যানার টিম তুরস্কের ভূমিকম্পের শুরু থেকেই গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরগুলোয় নজরে রেখেছে। তারই ধারাবাহিকতায় এই ঘটনা কেন্দ্রিক সর্বমোট ১০ টি ভুল সংবাদ শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করা হয়েছে। ফ্যাক্টচেকগুলো দেখুন ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে একক কোনো ঘটনা বিবেচনায় তুরস্কের ভূমিকম্পেই সর্বোচ্চ ভুল সংবাদ প্রচার করেছে গণমাধ্যমগুলো।
কার বিষয়ে বেশি ভুল?
পর্তুগাল এবং বর্তমানে সৌদি আরবের আল নাসর ক্লাবের ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো চলতি বছরের শুরু থেকেই একাধিক খবরের শিরোনাম হয়েছেন। নিজ দেশের খেলা কেন্দ্রিক সংবাদ নয় অবশ্য, তাকে বারবার শিরোনাম হতে হয়েছে ক্লাব ফুটবলের কারণেই। রিউমর স্ক্যানারের চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের গণমাধ্যমের ভুল সংবাদের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, একক কোনো ব্যক্তি হিসেবে রোনালদোর বিষয়েই সবচেয়ে বেশি ভুল সংবাদ প্রচারিত হয়েছে গণমাধ্যমে, সংখ্যার হিসেবে যা নয়ে (৯) গিয়ে ঠেকেছে। এ বিষয়ে রিউমর স্ক্যানারের ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলো দেখুন ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯।
তবে এই বিষয়ে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাও দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। রোনালদোর চেয়ে একটি কম ভুল সংবাদ প্রচার করা হয়েছে আর্জেন্টিনার ফুটবল তারকা লিওনেল মেসির বিষয়ে। মেসির বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত ভুল সংবাদ শনাক্ত করে প্রকাশিত রিউমর স্ক্যানারের ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলো দেখুন ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮।
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমেও ভুল তথ্যের প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)’ এর ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজ এবং ওয়েবসাইট থাকলেও এসব প্লাটফর্মে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ভুল সংবাদ প্রচার হতে দেখেনি রিউমর স্ক্যানার। তবে রাষ্ট্রীয় আরেক সংবাদমাধ্যম ‘বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)’ এর ওয়েবসাইটে প্রথম ছয় মাসে পাঁচটি ভুল সংবাদ প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। সেসব সংবাদের ফ্যাক্টচেক দেখুন ১, ২, ৩, ৪, ৫।
প্রচারিত ভুল সংবাদগুলোর মধ্যে চারটিই ছিল ছবি কেন্দ্রিক ভুল, একটি ছিল তথ্য কেন্দ্রিক ভুল।
বিদেশী গণমাধ্যমগুলোও বাদ যায়নি
বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা বিদেশি গণমাধ্যম বিবিসি বাংলা এবং ডয়চে ভেলে বাংলা’র ওয়েবসাইটে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে একটি করে ভুল সংবাদ প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।
গত ফেব্রুয়ারিতে তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের ছবি দাবিতে বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে একটি ছবি প্রচার করা হয়৷ ছবিটির ক্যাপশন ছিল এমন, “তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে বহু ভবন বিধ্বস্ত কিংবা হেলে পড়েছে।”
রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধানে দেখেছে, এটি ১৯৯৯ সালে তুরস্কের ডুজসে শহরে হওয়া ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের ছবি।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে আলোচিত ছবিটির ক্যাপশনে ফাইল ফটো বা পুরোনো ছবি শীর্ষক কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। ফেব্রুয়ারির ঘটনার বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ছবিগুলো ব্যবহার করে পুরোনো ছবি শীর্ষক কোনো তথ্য উল্লেখ না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই ছবিটি তুরস্কের ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পের ঘটনার বলে প্রতীয়মান হয়। এতে করে নেটিজেনদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়া অমূলক নয়।
অন্যদিকে ডয়চে ভেলে বাংলা’র ওয়েবসাইটে গত এপ্রিলে প্রকাশিত একটি ফটো স্টোরিতে দাবি করা হয়, ১৯৩৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কর্ম’ সিনেমায় বলিউডের প্রথম স্ক্যান্ডাল ছিল এবং চার মিনিট স্থায়ী ছিল এই চুম্বন।
কিন্তু রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ধারাবাহিকভাবে দুই মিনিটের কম সময়ের উক্ত চুম্বনের দৃশ্যের পূর্বে বলিউডের অন্য সিনেমায়ও চুম্বনের দৃশ্য ছিল।
অর্থাৎ, দেশীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি এই দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বিদেশী গণমাধ্যমও ভুল সংবাদ প্রচার করেছে।
গণমাধ্যমে কেন এত ভুল?
গণমাধ্যমের ভুল সংবাদের পরিসংখ্যান নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে রিউমর স্ক্যানার টিমের কাছে ভুলগুলোর পেছনে একাধিক কারণ নজরে এসেছে। প্রথমটি মূল সূত্রে না পৌঁছানো।
গত ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন স্পেস ওয়েদার পদার্থবিদ ড. তামিথা স্কোভ এক টুইটে জানান, সূর্যের উত্তরের প্রমিনেন্স (অঞ্চল) থেকে আসা উপাদান মূল ফিলামেন্ট থেকে ভেঙ্গে দূরে সরে গেছে এবং তখন সূর্যের উত্তর মেরুতে একটি বিশাল মেরু ঘূর্ণিতে সঞ্চালিত হচ্ছিল। তামিথার টুইটের বরাতে ভারতের NDTV, যুক্তরাষ্ট্রের Space সহ একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। Space এর প্রতিবেদনে আলোচিত ভিডিওটি নাসার সোলার ডায়নামিক অবজারভেটরির তোলা বলা হলেও এনডিটিভি বলেছে, এটি নেওয়া হয়েছে নাসার জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ থেকে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো পড়ে দেখা যায়, অধিকাংশ গণমাধ্যম ‘Space’ এবং ‘NDTV’ এর প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সংবাদ প্রকাশ করেছে। এর প্রেক্ষিতে গণমাধ্যমে এই ঘটনাকে সূর্যের একটি অংশ ভেঙে পড়েছে বলে দাবি করা হয়। অর্থাৎ, মূল সূত্র ব্যবহার কিংবা মূল সূত্রে দেওয়া তথ্য ক্রসচেক না করেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বরাতে দেশীয় গণমাধ্যমগুলো সংবাদ প্রকাশ করে এ বিষয়ে।
রিউমর স্ক্যানার অনুসন্ধানে দেখেছে, সূর্যের একটি প্রমিনেন্স বা প্লাজমা বিচ্ছিন্ন হয়ে সূর্যের উত্তর মেরুতে ঘুরতে থাকে। কিন্তু সূর্যের কোনো অংশই “ভাঙেনি”। প্লাজমার এই ঘটনা স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। তাছাড়া, ড. তামিথাকে নাসার কর্মকর্তা এবং ছবিটি জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা বলে যে দাবি করা হয়েছিল তাও সঠিক নয়। কিন্তু এই তিন ভুল তথ্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বরাতে দেশীয় প্রায় অর্ধশতাধিক গণমাধ্যম প্রচার করেছে। এমন একাধিক বিষয়ে একই ধরণের ভুল করতে দেখা গেছে দেশীয় গণমাধ্যমগুলোকে।
গণমাধ্যমে ভুলের ধরণে দ্বিতীয় যে বিষয়টি নজরে এসেছে আমাদের তা হলো কোনো একটি ঘটনার খবরে ঐ ঘটনার ছবি ভেবে পুরোনো ছবি ব্যবহার। প্রকাশিত সংবাদে গণমাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ঘটনায় পুরোনো বা ভিন্ন স্থানের ভুল ছবি ব্যবহার করে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে ৬১ টি, যা শতকরা হিসেবে মোট ভুল সংবাদের ৩৪.০৮ শতাংশ। প্রতিবেদনগুলোতে প্রচারিত ছবিগুলোর ক্যাপশনে ফাইল ফটো বা পুরোনো ছবি শীর্ষক কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই ছবিগুলো সংশ্লিষ্ট ঘটনার বলেই প্রতীয়মান হবে যার ফলে নেটিজেনদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়া অমূলক নয়।
পরিসংখ্যানটি বিশ্লেষণে তৃতীয় যে বিষয়টি নজরে এসেছে, সেটি কিছুটা শঙ্কারই বলতে হবে। সারাবিশ্বেই গণমাধ্যমগুলো সংবাদ প্রচার করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘নির্ভরযোগ্য’ গণমাধ্যমের উপর আস্থা রাখে, প্রকাশ করে তাদের দেওয়া তথ্য। কিন্তু তারাই যদি ভুল তথ্য দেয়? এমনটিই ঘটছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে ২০২২ সালের ফিফার বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পান লিওনেল মেসি। সেসময় ফরাসি ফুটবলার অহেলিয়া চুয়ামেনির নামে তৈরি একটি ভেরিফাইড ভুয়া ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে সর্বকালের সেরা উল্লেখ করে একটি পোস্ট করা হয়। সে পোস্টকে চুয়ামেনির আসল ফেসবুক প্রোফাইলে করা পোস্ট ভেবে চুয়ামেনি রোনালদোকে নিয়ে ফেসবুকে এমন পোস্ট করেছেন দাবি করা হয় খোদ ইএসপিএনের পেজে। এ বিষয়ে রিউমর স্ক্যানারের ফ্যাক্টচেক এখানে। যদিও দেশীয় গণমাধ্যমে সংবাদটি আসেনি তবে এটি একটি সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা যেতে পারে৷
Banner: Rumor Scanner
ভুলের বৃত্ত থেকে বের হওয়া কতটা কঠিন?
গণমাধ্যমে ভুল সংবাদের পরিসংখ্যান প্রকাশের উদ্দেশ্য একটাই, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন করা। গণমাধ্যম তার আস্থার জায়গা হারিয়ে ফেলুক, এমন প্রত্যাশা আমরা করি না। সেই লক্ষ্যে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার বিকল্প নেই। সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে একাধিক সূত্র থেকে ক্রসচেক করে নেওয়া, প্রয়োজনে মূল সূত্র থেকেই সংশ্লিষ্ট বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে নিতে পারে গণমাধ্যমগুলো। প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট ঘটনার ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রে রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতির ব্যবহার করে ছবিটি পুরোনো কিনা সে বিষয়ে সহজেই নিশ্চিত হয়ে নেওয়া সম্ভব (এই পদ্ধতির বিস্তারিত এখানে)।
তবে কিছু সংবাদের ক্ষেত্রে সাধারণ ক্রসচেক কিংবা প্রচলিত অনুসন্ধান কাজে দেয় না। এ ধরণের সংবাদ যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সারাবিশ্বেই ফ্যাক্টচেকিং সংস্থাগুলোর সহায়তা নেওয়া একটি সাধারণ বিষয়। বাংলাদেশেও এ বিষয়টির চর্চা শুরু হতে দেখেছি আমরা। দেশের একাধিক গণমাধ্যম তথ্য যাচাইয়ে বিগত সময়ে রিউমর স্ক্যানারের সহায়তা নিয়েছে। রিউমর স্ক্যানার টিম এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতারই আশ্বাস দিয়ে থাকে।