সম্প্রতি তুরস্কের ধ্বংসস্তূপে কোরআন পেয়ে চীনা উদ্ধারকর্মী জং সান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন দাবিতে একটি তথ্য মূলধারার গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
গণমাধ্যমে প্রচারিত এরকম কিছু প্রতিবেদন দেখুন; ইনকিলাব (আর্কাইভ), নয়া দিগন্ত (আর্কাইভ), আজকের বাংলাদেশ (আর্কাইভ)।
ভুইফোঁড় অনলাইন পোর্টালে প্রচারিত এরকম কিছু প্রতিবেদন দেখুন পুবের কলম (আর্কাইভ), পাঠক নিউজ (আর্কাইভ)।
ফেসবুকে প্রচারিত এরকম কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, তুরস্কের ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপে মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরীফ পেয়ে চীনা উদ্ধারকর্মী জং সান এর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার তথ্যটি সঠিক নয় বরং উক্ত ব্যক্তি আগে থেকে ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিলেন এবং জন্মসূত্রেই তিনি মুসলমান বলে জানা যায়।
তুরস্কের ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপে কোরআন পেয়ে চীনা উদ্ধারকর্মী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে দাবিতে দেশীয় মূলধারার গণমাধ্যম ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, প্রতিবেদনটির নিচে “আল জাজিরা, খিদমত সনদ ও অন্যান্য” সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা আছে।
পরবর্তীতে উক্ত তথ্যের সূত্র ধরে বিভিন্ন কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে আল জাজিরা প্যালেস্টাইনের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে গত ১৫ ফেব্রুয়ারী চীনা উদ্ধারকর্মীর ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ব্যাপারে একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত পোস্টটির অনুবাদিত অংশ থেকে জানা যায়, ভূমিকম্পের উদ্ধারকাজে অংশগ্রহণের সময় উক্ত চীনা ব্যক্তিকে একটি কোরআন উপহার দেয়া হয় এবং উক্ত ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
তবে আল জাজিরা প্যালেস্টাইনের উক্ত পোস্টটিতে বিস্তারিত কিছু লেখা না থাকায় উক্ত তথ্যটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি, যা থেকে ঘটনাটির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো পর্যবেক্ষণ করে চীনা উদ্ধারকর্মীর তুরস্কে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের তথ্য সম্পর্কে কোনো প্রতিবেদন খুঁজে পায়নি রিউমর স্ক্যানার টিম।
তবে তুরস্কের বেশকিছু স্থানীয় গণমাধ্যমে উক্ত তথ্যের ভিত্তিতে চীনা উদ্ধারকর্মীটি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার দাবিতে বেশকিছু প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। এরকম কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
একইসাথে চীনা উদ্ধারকর্মী জং সানের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার তথ্যটিকে মিথ্যা দাবি করে এবং উক্ত দাবির সাথে কোরআন হাতে একজন ব্যক্তির ছবিগুলোকে প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি অবাস্তব বা কাল্পনিক ছবি দাবি করে তুরস্কের বেশকিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে খুঁজে পাওয়া যায়। এরকম কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে এবং এখানে।
পরবর্তীতে অনুসন্ধানে তুরস্কের সরকারি সংস্থা Directorate of Communications এর ওয়েবসাইটে গত ১৫ ফেব্রুয়ারী “Disinformation Bulletin on earthquake dated February 15, 2023, released” শীর্ষক শিরোনামের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনা উদ্ধারকর্মীর ইসলাম ধর্ম গ্রহণের দাবিতে প্রচারিত ছবিগুলো প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরির দাবিটি সত্য নয় বরং ছবিগুলো বাস্তব ও আসল ছবি। এছাড়াও চীনা উদ্ধারকর্মী জুং সান যে অঞ্চলে উদ্ধারের কাজ করছিলেন সেখানকার সরকারি সূত্রে জানানো হয়, জুং সান উদ্ধারকাজের অংশ হিসেবে উক্ত অঞ্চলের একটি মসজিদ পরিদর্শন করেন এবং সেখানেই উক্ত ছবিগুলো তোলা হয়।
এছাড়াও উক্ত প্রতিবেদনে তুরস্কের METU ইউনিভার্সিটির সাইবার সিকিউরিটি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক Cihangir Tezcan এর বরাতে জানানো হয়, ছবিগুলো প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি এডিটেড কোনো ছবি নয় বরং এগুলো বাস্তব ঘটনার ভিত্তিতে তোলা প্রকৃত ছবি।
উক্ত তথ্যের ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া যায় ছবিগুলো এডিটেড ছবি নয়। তবে উক্ত প্রতিবেদনের কোথাও জুং সানের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় নি।
পরবর্তীতে তুর্কী গণমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সি গত ১৬ ফেব্রুয়ারী “Çinli kurtarıcıyı yapay zekayla Müslüman yaptılar” iddiası” শীর্ষক শিরোনামের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে চীনা উদ্ধারকর্মী জুং সান এর একটি মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়,
তিনি (জুং সান) এবং তার পরিবার মুসলিম, তিনি তুরস্কে এসে মুসলিম হননি, তিনি ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধারকৃত কোরআন হাতে নিয়ে ছবি তুলেছিলেন এবং ওই ছবি তার দাদীর কাছে পাঠিয়েছিলেন।
গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জুং সান বলেন, .
“I was a Muslim in China, my family is Muslim. I took out the Qur’an. The reason I took the photo is my grandmother, who is over 80 years old. Her biggest dream is to go to mosques and the Kaaba. She cannot go because of health problems. Every mosque here I take a photo of it and send it to him. The reason I took that photo is in honor of him.”
মূলত, চীনা উদ্ধারকর্মী জুং সান সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তুরস্কের ভূমিকম্পে একজন উদ্ধারকর্মী হিসেবে দায়িত্বপালন করছিলেন। উদ্ধারকাজের এক পর্যায়ে তিনি ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে একটি কোরআন উদ্ধার করেন এবং উক্ত কোরআন হাতে নিয়ে ছবি তুলে তার বৃদ্ধা দাদীকে পাঠান। চীনা উদ্ধারকর্মী জুং সানের উক্ত ছবি ব্যবহার করে তুরস্কের ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপ থেকে কোরআন উদ্ধারের পর চীনা উদ্ধারকর্মীর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ দাবিতে একটি তথ্য গণমাধ্যম ও ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, চীনা উদ্ধারকর্মী জুং সান আগে থেকেই মুসলিম ছিলেন এবং তিনি মুসলিম পরিবারেরই সন্তান।
সুতরাং, তুরস্কের ভূমিকম্পে উদ্ধারকাজে নিয়োজিত চীনা উদ্ধারকর্মী জুং সান জন্মসূত্রে একজন মুসলিম হলেও ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপে কোরআন পেয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন দাবি করে ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- ওয়েবসাইট : Directorate of Communications
- Anadolu Agency : Çinli kurtarıcıyı yapay zekayla Müslüman yaptılar” iddiası