সম্প্রতি, “সৌদি আরবের ফুটবল ক্লাব ‘আল-হিলাল’ মেসির জার্সি বিক্রি শুরু করেছে।” শীর্ষক একটি তথ্যের সাথে মেসির নাম সম্বলিত একটি জার্সির ছবি গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
উক্ত দাবিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন দেখুন যমুনা টিভি, সময় টিভি, ঢাকা মেইল, এবিনিউজ২৪, ঢাকা পোস্ট, প্রতিদিনের বাংলাদেশ, সংবাদ প্রকাশ, নয়া দিগন্ত, দৈনিক সংগ্রাম, জাগোনিউজ২৪, জুমবাংলা, একুশে সংবাদ, এমটি নিউজ।
একই দাবিতে ফেসবুকের কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
একই দাবিতে ইউটিউবের কিছু ভিডিও দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
ভিডিওগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
একই দাবিতে টিকটকের একটি ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আল-হিলালের অফিশিয়াল স্টোরে মেসির জার্সি বিক্রি করার কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ মেলেনি বরং মাত্র একটি ছবিকে কেন্দ্র করে উক্ত দাবিটি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে।
আর্জেন্টাইন তারকা ফুটবলার লিওনেল মেসি ২০২১ সালের আগস্টে বার্সেলোনা ছেড়ে ফ্রান্সের ফুটবল ক্লাব পিএসজিতে যোগ দেন। চলতি বছরের ৩০শে জুন লা প্যারিসিয়ানদের সঙ্গে মেসির দুই বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। অন্যদিকে আল-হিলাল সৌদি আরবের বহু পুরনো একটি পেশাদার ফুটবল ক্লাব। ক্লাবটির একটি ফিজিক্যাল স্টোরে মেসির নাম সম্বলিত ক্লাবটির জার্সি বিক্রি করা হচ্ছে শীর্ষক একটি দাবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে।
অনুসন্ধানের শুরু যেভাবে
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে আল-হিলালের ওয়েবসাইটে খুঁজে আল-হিলাল ক্লাব কর্তৃক মেসির জার্সি বিক্রি সংক্রান্ত কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তাছাড়া আল-হিলাল ক্লাবের অফিশিয়াল সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্টগুলোতে (ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম,ইউটিউব) খুঁজেও এ বিষয়ে কোনো তথ্য মেলেনি।
পরবর্তীতে অনুসন্ধান করে নির্ভরযোগ্য আন্তজার্তিক গণমাধ্যমেও (Marca, TYC Sports, Goal) এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ, আল-হিলাল সংশ্লিষ্ট সূত্র কিংবা নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক কোনো গণমাধ্যম সূত্রে এই তথ্য ছড়ায়নি।
ছবিটির সূত্রপাত ধরে অনুসন্ধান
আল-হিলাল সংশ্লিষ্ট সূত্র কিংবা নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক কোনো গণমাধ্যম সূত্রে উক্ত দাবি সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য না পেয়ে আলোচিত পোস্টগুলোর সাথে সংযুক্ত ছবিটির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে রিউমর স্ক্যানার টিম।
এডভান্স টুল এবং ম্যানুয়াল সার্চের মাধ্যমে অনুসন্ধানে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর টুইটারে ‘MnbrAlhilal’ নামক একটি অ্যাকাউন্টে উক্ত ছবিটি (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়। আলোচিত ছবিটির সাথে উক্ত টুইটের ক্যাপশনে আরবি ভাষায় যা লেখা ছিল তার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “মেসির জার্সি আল-হিলাল স্টোরে।” এছাড়া আর কোনো কোনো বিস্তারিত তথ্য দেওয়া ছিল না উক্ত টুইটে।
রিউমর স্ক্যানার টিম ছবিটি বিশ্লেষণ করে দেখে, ছবিটি যে স্থান থেকে তোলা হয়েছে সেটি আল-হিলাল স্টোরের একটি শাখা হতে পারে। কারণ, ছবিটি যে দোকান বা স্টোর থেকে তোলা হয়েছে সেই দোকানটির উপরের অংশে আল-হিলালের লোগো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
তবে ছবিটিতে কিছু অসঙ্গতি প্রতীয়মান হয়। ছবিতে হ্যাঙ্গারে যে জার্সিগুলো ঝুলছে সেগুলো সাইজে ছোট এবং সবগুলো জার্সি একই ফরমেটে একদিকে সাজানো। কিন্তু মেসির নাম সম্বলিত জার্সিটি অন্য জার্সিগুলোর তুলনায় বড় হলেও এই জার্সি ছোট সাইজের অন্য জার্সিগুলোর সাথে রাখা হয়েছে। তাছাড়া আলোচিত জার্সিটি অন্য জার্সিগুলোর ফরমেটে ঝুলিয়ে রাখা হয়নি। রাখা হয়েছে উল্টোভাবে ঝুলিয়ে।
‘MnbrAlhilal’ নামক টুইটার অ্যাকাউন্টটিও বিশ্লেষণ করে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
টুইটার অ্যাকাউন্টটি মূলত একটি ফ্যান পেজ (এই তথ্য অ্যাকাউন্টের বায়োতে লেখা রয়েছে)। উক্ত অ্যাকাউন্টে নিয়মিত আল-হিলাল বিষয়ক বিভিন্ন আপডেট পোস্ট করা হয়। তবে মেসির নাম সম্বলিত জার্সির বিষয়ে প্রকাশিত আলোচিত টুইটটি ছাড়া এ বিষয়ে আর কোনো টুইট খুঁজে পায়নি রিউমর স্ক্যানার টিম।
পরবর্তীতে উক্ত টুইটার অ্যাকাউন্টের বায়োতে দেওয়া তাদের ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টে গিয়েও এ বিষয়ে কোনো তথ্য পায়নি রিউমর স্ক্যানার টিম। টুইটার অ্যাকাউন্টে উল্লিখিত হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অ্যাকাউন্টটি একটি মার্কেটিং এজেন্সির।
এ বিষয়ে জানতে রিউমর স্ক্যানার টিমের পক্ষ থেকে উক্ত হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এই ছবি এবং টুইটকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে সামাজিক মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। তবে টুইটের বাইরে অতিরিক্ত কোনো তথ্য বা নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রের বরাতে কোনো তথ্য প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখ পায়নি রিউমর স্ক্যানার টিম।
ছবিটির বিষয়ে সৌদির সংবাদমাধ্যম কী বলছে?
আলোচিত দাবিটির বিষয়ে জানতে অধিকতর অনুসন্ধানে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কিওয়ার্ড সার্চ করে সৌদি আরবের পত্রিকা ‘Al-Marsd’ এর ওয়েবসাইটে গত ০১ জানুয়ারী “The secret behind the appearance of the controversial “Messi” T-shirt inside Al-Hilal store in Riyadh – photo” (আর্কাইভ) শিরোনামে (অনুবাদকৃত) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “সূত্র জানিয়েছে যে ক্লাবের (আল-হিলাল) একজন ভক্ত তার সাথে করে জার্সিটি নিয়ে এসেছিলেন। এরপর এটি ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন আল-হিলালের স্টোরে এবং সেটির ছবি তোলেন, যাতে আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়ের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের আশায় ক্লাব ম্যানেজমেন্টকে অনুরোধ করা যায়, যেমনটি আল-নাসর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সাথে করেছিলেন।”
রিউমর স্ক্যানার টিম এ বিষয়ে জানতে ‘Al-Marsd’ এর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। তবে এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে উত্তর মেলেনি।
আল-হিলাল স্টোরে খোঁজ নিয়ে যা জানা গেল
আল-হিলাল স্টোরে মেসির নাম সম্বলিত জার্সি বিক্রি হচ্ছে কিনা এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে ক্লাবটির অফিশিয়াল অ্যাপ ‘Blu’ তে গত ১৬ জানুয়ারী সাইন-ইন করে রিউমর স্ক্যানার টিম।
উক্ত অ্যাপে প্লেয়ার এবং ফ্যান জার্সি থাকলেও কোনো জার্সির পেছনেই কোনো খেলোয়াড়ের নাম উল্লেখ নেই।
অর্থাৎ, আল-হিলাল ক্লাবের অফিশিয়াল স্টোর ‘Blu’তে মেসির নাম সম্বলিত কোনো জার্সি বিক্রি হচ্ছে না।
পরবর্তীতে জর্ডানভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্যের ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান ‘Fatabyyano’ এর মাধ্যমে রিয়াদের প্রিন্স তুর্কি বিন আবদুল আজিজ রোডে অবস্থিত আল-হিলাল স্টোরে খোঁজ নিয়েছে রিউমর স্ক্যানার টিম। উক্ত স্টোরেও মেসির কোনো জার্সি প্রদর্শিত অবস্থায় পাওয়া যায়নি।
Fatabyyano এর ফ্যাক্টচেকার লওয়ি খেরিস (Loay Khreis) রিউমর স্ক্যানারকে জানিয়েছেন, “সৌদির কিছু অনানুষ্ঠানিক স্থানীয় সংবাদ সূত্র জানিয়েছে যে একজন ভক্ত জার্সিটি নিয়ে এসেছিলেন যাতে ক্লাবকে এখানে মেসির সাথে সই করার অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু ক্লাবের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি।”
Fatabyyano এর পক্ষ থেকেও রিউমর স্ক্যানারকে ‘Al-Marsd’ এর প্রকাশিত প্রতিবেদনের লিংক সরবরাহ করা হয়।
অর্থাৎ, আল-হিলাল স্টোরে মেসির নাম সম্বলিত কোনো জার্সি বিক্রি হচ্ছে না।
এক ক্লাবের সাথে চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়ের জার্সি কি অন্য ক্লাব বিক্রি করতে পারে?
ফুটবল বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘Goal’ বলছে, একটা সময় ফুটবল ক্লাবগুলো খেলোয়াড়দের শুধু খেলার জন্যই অর্থ প্রদান করতো। তবে সময় ও যুগ পাল্টানোর স্রোতে তাল মেলাতে এখন বিনোদন ও ব্র্যান্ড স্পেসের মাধ্যমে অর্থ আয়ের পথ বের করেছে ক্লাবগুলো। এর ফলে খেলোয়াড়দের বিভিন্ন বিষয় যেমন নাম, ছবি, স্বাক্ষর, অটোগ্রাফ, শারীরিক গঠন কিংবা জার্সি বিক্রির মতো বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘ইমেজ রাইটস’ নামে এক প্রথার প্রচলন শুরু হয়েছে।
এই প্রথার আওতায় কোনো ক্লাবের অধীনে থাকা খেলোয়াড়ের ইমেজ রাইটস অন্য ক্লাব কাজে লাগাতে পারবে না বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড় যদি থার্ড পার্টি কোনো কোম্পানির কাছে তার ইমেজ রাইটস বিক্রি করেন সেক্ষেত্রে উক্ত খেলোয়াড়ের ইমেজ রাইটসের উপর সংশ্লিষ্ট ক্লাবের কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না।
তবে মেসির ক্ষেত্রে তার ইমেজ রাইটস পিএসজির কাছেই রয়েছে। স্প্যানিশ ফুটবল বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ‘Football Espana’ জানিয়েছে, পিএসজিতে মেসির প্রথম মৌসুমে মেসির ইমেজ রাইটস, মার্কেটিং এবং ম্যাচ-ডে এর আয়ের মাধ্যমে পিএসজি ৭০০ মিলিয়ন ইউরো আয় করেছে
অর্থাৎ, মেসির ইমেজ রাইটস পিএসজির কাছে থাকায় পিএসজি ছাড়া অন্য কোনো ক্লাব মেসির জার্সি বিক্রি করতে পারবে না।
মূলত, সূত্রহীন একটি মাত্র ছবিকে কেন্দ্র করে সৌদি আরবের আল-হিলাল ফুটবল ক্লাব মেসির জার্সি বিক্রি শুরু করেছে শীর্ষক একটি দাবি ইন্টারনেটে প্রচার করা হলেও বিষয়টির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি এবং অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া যায় যে আল-হিলাল স্টোরের অ্যাপে, ওয়েবসাইট এবং রিয়াদের ফিজিক্যাল শপে এই জার্সি বিক্রি হচ্ছে না। ছবির বিষয়ে সৌদি গণমাধ্যম ও ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, একজন ভক্ত জার্সিটি স্টোরে নিয়ে এসেছিলেন যাতে ক্লাবকে মেসির সাথে সই করার অনুরোধ জানানো হয়।” অর্থাৎ, আল-হিলাল অফিশিয়াল স্টোরে মেসির জার্সি বিক্রি করছে এরূপ সংবাদটি ভিত্তিহীন।
উল্লেখ্য, লিওনেল মেসিকে পেতে আল-হিলালের ৩০ কোটি ডলার প্রস্তাব দেওয়ার একটি গুঞ্জন শোনা গেলেও আপাতত এমন কোনো চুক্তির সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন স্প্যানিশ ফুটবল বিশেষজ্ঞ গিলেম বালাগ। তাছাড়া, উইন্টারে আল-হিলালের ট্রান্সফার ব্যানও রয়েছে, যার কারণে রোনালদোকে কেনার ইচ্ছে থেকেও সরে আসতে হয়েছিল ক্লাবটিকে।
প্রসঙ্গত, পর্তুগালের ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর দুই বছরের জন্য সৌদি আরবের আরেক ক্লাব Al Nassr সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।
সুতরাং, সৌদি আরবের আল-হিলাল ক্লাবের অফিশিয়াল স্টোরে মেসির জার্সি বিক্রি করছে দাবিতে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত সংবাদটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Al-Hilal: Website
- MnbrAlhilal: Twitter
- Al-Marsd: The secret behind the appearance of the controversial “Messi” T-shirt inside Al-Hilal store in Riyadh – photo
- Al Hilal app: Blu
- Al-Hilal Store: Location
- Goal: What are image rights in football & how did they affect Dybala’s transfer to Tottenham?
- Statement from Fatabyyano
- Football Espana: Lionel Messi has generated Paris Saint-Germain €700m since joining the club
হালনাগাদ/ Update
০৭ জুলাই, ২০২৩ : এই প্রতিবেদন প্রকাশ পরবর্তী সময়েও কতিপয় গণমাধ্যমে একই দাবি প্রচার করার প্রেক্ষিতে সেসব গণমাধ্যমকেও দাবি হিসেবে প্রতিবেদনে যুক্ত করা হলো।