হজ ২০২৩ এ হাজিদের উপস্থিতির সংখ্যা নিয়ে গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য 

সম্প্রতি, অনুষ্ঠিত চলতি বছরের হজে অংশে নেওয়া  হাজিদের ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা ও এই হজকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হজ উল্লেখ করে গণমাধ্যম সূত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাধিক তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। 

চলতি বছরের হজে ৩০ লাখ হাজির উপস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন- দৈনিক আমাদের সময়.কম, ডেইলি ক্যাম্পাস, আরটিভি, সময় টিভি, কালবেলা, বায়ান্ন টিভি (আর্কাইভ)।

চলতি বছরের হজে ২৫ লাখ হাজির উপস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন- প্রথম আলো, ঢাকা মেইল, চ্যানেল আই(১), বাংলাদেশ জার্নাল,মানবজমিন, বাংলাদেশ টুডে, জুম বাংলা, বিডি২৪রিপোর্ট, সমকাল (১), ডিবিসি নিউজ, সমকাল (২),দৈনিক আমাদের সময়.কম, জাগরণ, চ্যানেল২৪, রিদমিক নিউজ, আলোকিত বাংলাদেশ, ঢাকা টাইমস, সময়ের আলো, কুমিল্লার কাগজ, যমুনা টিভি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি (১), ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি (২), চ্যানেল আই (২), কালের কণ্ঠ, একুশে টিভি, আমাদের সময়, রেডিও টুডে। 

চলতি বছরের হজে ২০ লাখ হাজির  উপস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন- এনটিভি, বাংলাদেশ জার্নাল, এটিএন বাংলা, বিডিনিউজ২৪, ডেইলি বাংলাদেশ, দৈনিক আজাদী, দৈনিক বাংলা, অর্থসূচক, দেশ রূপান্তর, এসএ টিভি, বৈশাখী টিভি, সময়ের আলো

চলতি বছরের হজে ২৩ লাখ হাজির  উপস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন- দেশ রূপান্তর। 

চলতি বছরের হজে ১৬ লাখ ৫ হাজার হাজির  উপস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন- প্রতিদিনের বাংলাদেশ

চলতি বছরের হজকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হজ উল্লেখ করে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন- ভোরের কাগজ, ঢাকা ট্রিবিউন, ডেইলি বাংলাদেশ, নয়া দিগন্ত, সিলেটের ডাক, ঢাকা পোস্ট, সময় টিভি, ডিবিসি, অর্থ সংবাদ, ইত্তেফাক, বাংলা ইনসাইডার, রাজশাহীর সময়, সংবাদ.নেট, দ্যা রিপোর্ট, তৃতীয় মাত্রা

গণমাধ্যমের ফেসবুক পেইজ সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন- এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ইউটিউবে প্রচারিত এমন কিছু ভিডিও দেখুন- এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস (বাংলা), এস নিউজ

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, চলতি বছরের হজে অংশগ্রহণকারী হাজিদের সংখ্যা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যগুলো সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে এই বছর হজে অংশগ্রহণকারী হাজির সংখ্যা ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫ জন। এছাড়া সদ্য সমাপ্ত হজটিও ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হজ নয়।

চলতি বছরের হজে অংশগ্রহণকারী হাজিদের প্রকৃত সংখ্যা

সদ্য সমাপ্ত চলতি বছরের হজে অংশগ্রহণকারী হাজিদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে অনুসন্ধানে মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীর দায়িত্বে থাকা হারামাইন শরিফাইনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে গত ২৭ জুন ‘BREAKING: A total of 1,845,045 Hujjaj have performed #Hajj this year‘ শীর্ষক একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Haramain Sharifain Facebook Page

সৌদি আরবের জাতীয় পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষের বরাতে পোস্টটিতে বলা হয়, এই বছর হজে অংশগ্রহণকারী মোট হাজির সংখ্যা ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫ জন। এর মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হজ করতে সৌদি গিয়েছেন ১৬ লাখ ৬০ হাজার ৯১৫ জন হাজি৷ বাকী ১ লাখ ৮৪ হাজার ১৩০ জন হাজি সৌদি আরবের নিজস্ব নাগরিক ও দেশটিতে অবস্থানরত বাসিন্দা।

এই পোস্টের সূত্রে পরবর্তীতে দেশটির জেনারেল অথরিটি ফর স্ট্যাটিসটিকসের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘Total Number of Pilgrims in 1444 H Reaches (1,845,045) (আর্কাইভ)’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকেও একই তথ্য জানা যায়।

Screenshot: General Authority for Statistics

উল্লেখ্য, জেনারেল অথরিটি অব স্ট্যাটিসটিকস বা GASTAT সৌদি আরবে পরিসংখ্যানগত তথ্য-উপাত্তের জন্য একমাত্র সরকারী উৎস। প্রতিষ্ঠানটি পরিসংখ্যান খাতের প্রযুক্তিগত তদারকি ছাড়াও পরিসংখ্যানগত অন্যান্য সকল কাজ করে। 

Screenshot: General Authority for Statistics 

এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি সদ্য সমাপ্ত হজ মৌসুমের পরিসংখ্যানগত তথ্য এবং সূচক জারি করার জন্য প্রশাসনিক তথ্যের উপর নির্ভর করে। 

অর্থাৎ দেশীয় গণমাধ্যমগুলোতে সদ্য সমাপ্ত হজে অংশগ্রহণকারী হাজিদের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন যেসব তথ্য (৩০, ২৫, ২৩, ২০, ১৬ লাখ ৫ হাজার) উপস্থাপন করা হয়েছে, সেগুলো সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে এই বছরের হজে অংশগ্রহণকারী হাজির সংখ্যা ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫ জন। 

২০ লাখ হাজির সংখ্যাটি যেভাবে এলো 

সদ্য সমাপ্ত হজে ২০ লাখ হাজির অংশগ্রহণ নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত সংবাদের সূত্রে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক গণমাধ্যম গালফ নিউজে গত ২১ জুন ‘Saudi Arabia prepares to welcome more than two million pilgrims from 160 countries’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ বিষয়ক মন্ত্রী ডা. তৌফিক আল রাবিয়ার একটি বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot: Gulf News

সেখানে তিনি বলেন, এই বছরের হজে বিশ্বের ১৬০ টি দেশ থেকে ২০ লাখের বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। 

এছাড়া সৌদি ভিত্তিক গনমাধ্যম সৌদি গেজেটে ২৫ জুন ‘What is new in Hajj 2023?’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকেও দেশটিতে ১৬০টি দেশের ২০ লাখের বেশি হজযাত্রী পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ প্রকাশ করতে দেখা যায়।

Screenshot: Saudi Gazette 

অর্থাৎ সৌদি কর্তৃপক্ষের আশাবাদকেই দেশীয় মূলধারার গণমাধ্যমে সিদ্ধান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। 

চলতি বছরের হজটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হজ নয় 

চলতি বছরের হজটিকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হজ উল্লেখ করে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর সূত্রে কাতার ভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরাতে গত ২৫ জুন ‘‘Largest Hajj pilgrimage in history’ begins in Saudi Arabia‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Al Jazeera

প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিবেদনটিতে সৌদি আরবের হজ ও উমরাহ মন্ত্রনালয়ের এক কর্মকর্তার বরাতে উল্লেখ করা হয়, ‘চলতি বছরের হজে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।’ পাশাপাশি প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয় সদ্য সমাপ্ত হজে ২৫ লাখ মানুষের সমাগম হতে পারে। এসবের ভিত্তিতে গণমাধ্যমটি ‘Largest Hajj pilgrimage in history’ শীর্ষক শিরোনামে প্রতিবেদন করে এবং শিরোনামে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হজ’ অংশটি উদ্ধৃতি চিহ্নের ভিতরে রেখেছে। 

Screenshot: Al Jazeera

তবে এ সূত্রে বাংলাদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে কোনো  উদ্ধৃতি চিহ্ন ছাড়াই সরাসরি চলতি বছরের হজটিকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। 

কিন্তু এ নিয়ে অনুসন্ধানে সৌদি আরবের গণমাধ্যম আরব নিউজে ২০২২ সালের ১৩ জুলাই ‘Hajj numbers below pre-pandemic levels despite relaxed travel restrictions’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Arab News

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাজির সমাগম হয়েছিল ২০১২ সালে। সে বছর ৩১ লাখ ৬১ হাজার ৫৭৩ জন হাজি হজ পালন করেছিলেন।

Screenshot: Arab News

পরবর্তীতে এই প্রতিবেদনের সূত্রে জেনারেল অথরিটি অব স্ট্যাটিসটিকস বা GASTAT এর ওয়েবসাইটে  ‘Hajj Statistics 2019 – 1440’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকেও একই তথ্য জানা যায়। 

Screenshot: General Authority for Statistics

এই প্রতিবেদনটি থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০১০ সাল (হিজরি বর্ষ ১৪৩১) থেকে ২০১৯ সাল (হিজরি বর্ষ ১৪৪০) পর্যন্ত সময়কালে সবচেয়ে বেশি হাজির সমাগম হয়েছিল হিজরি বর্ষ ১৪৩৩ তথা ২০১২ সালে। সে বছর সারা বিশ্ব থেকে হজ করতে সৌদি গিয়েছিলেন সে বছর ৩১ লাখ ৬১ হাজার ৫৭৩ জন হাজি। এছাড়া এর আগের দুই বছরও হজ করতে হাজিদের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২০১০ সালে ২৭ লাখ ৮৯ হাজার ৩৯৯ জন এবং ২০১১ সালে ২৯ লাখ ২৭ হাজার ৭১৭ জন। 

এ প্রতিবেদন অনুসারে চলতি বছরের হজটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হজ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। 

অর্থাৎ কাতার ভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা সৌদি কর্তৃপক্ষের বরাতে চলতি বছরের হজটিকে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হজ’ হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়ে বিষয়টিকে উদ্ধৃতি চিহ্নের ভিতরে রেখে সংবাদ প্রচার করলেও দেশীয় গণমাধ্যমগুলো চলতি বছরের হজটিকে সরাসরি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হজ হিসেবে উল্লেখ করে সংবাদ প্রচার করে। 

উল্লেখ্য, এই প্রসঙ্গে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে গিয়ে কিছু কিছু গণমাধ্যম ভোরের কাগজ, ঢাকা ট্রিবিউন, ঢাকা পোস্ট, অর্থ সংবাদ, বাংলাদেশ ইনসাইডার, সংবাদ.নেট ২০১২ সালের পরিসংখ্যানটি উল্লেখ করলেও শিরোনামে চলতি বছরের হজটিকেই সরাসরি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হজ হিসেবে উল্লেখ করে।

মূলত, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে চলতি বছরের হজ, যা ছিল করোনা মহামারীর পরে স্বাস্থ্যবিধির কোনো ধরনের কড়াকড়ি ব্যতীত প্রথম হজ। তাই সৌদি কর্তৃপক্ষ আশা করেছিল, এবারের হজযাত্রীর সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ লাখের বেশি হবে এবং এটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হজ হবে। তবে পরবর্তীতে দেশটির জেনারেল অথরিটি অব স্ট্যাটিসটিকস বা GASTAT জানায়, এই বছর হজে অংশগ্রহণকারী মোট হাজির সংখ্যা ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫ জন। এর মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হজ করতে সৌদি গিয়েছেন ১৬ লাখ ৬০ হাজার ৯১৫ জন হাজি৷ বাকী ১ লাখ ৮৪ হাজার ১৩০ জন হাজি সৌদি আরবের নিজস্ব নাগরিক ও দেশটিতে অবস্থানরত বাসিন্দা। এছাড়া সৌদি কর্তৃপক্ষের আশাবাদকেই সরাসরি সিদ্ধান্ত জানিয়ে এই হজটিকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হজ হিসেবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করলেও অনুসন্ধানে জানা যায়, ইতোপূর্বে ২০১২ সালে  ৩১ লাখ ৬১ হাজার ৫৭৩ জন অর্থাৎ আরও বিশাল সংখ্যক হাজি নিয়ে হজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।  

সুতরাং, গণমাধ্যমে এই বছরের হজে অংশগ্রহণকারী হাজিদের সংখ্যা ও এই হজকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হজ দাবি করে প্রচারিত তথ্যগুলো সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img