সম্প্রতি, পর্তুগাল অধিনায়ক ও সৌদি আরবের আল নাসর ক্লাবের স্ট্রাইকার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো সিরিয়া ও তুরস্কের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য বিমান ভর্তি সাহায্য পাঠিয়েছেন শীর্ষক একটি দাবি ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
দেশীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো দেখুন প্রথম আলো, জুম বাংলা, বাংলা নিউজ২৪, বাহান্ন নিউজ, আমাদের সময়, ইত্তেফাক, বাংলা২৪ লাইভ নিউজপেপার, বাংলা ট্রিবিউন, ইনকিলাব, চ্যানেল আই, সময় নিউজ, চ্যানেল২৪, যুগান্তর, ঢাকা পোস্ট, নিউজ২৪, একাত্তর টিভি, মানবজমিন, প্রতিদিনের বাংলাদেশ, বিডি২৪ রিপোর্ট, এনটিভি, বিডি২৪ লাইভ, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, ডেইলি মেসেঞ্জার, নিরাপদ নিউজ, সংবাদ প্রকাশ।
ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত কিছু প্রতিবেদন দেখুন এবিপি লাইভ, টিভি৯ বাংলা।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত কিছু প্রতিবেদন দেখুন ESPN (USA), Goal (UK), Khaleej Times (UAE), Geo Tv (Pakistan)।
একই দাবিতে কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
একই দাবিতে ইউটিউবের কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
মূলত, গত ০৬ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ তুরস্ক এবং উত্তর সিরিয়ায় বিধ্বংসী এক ভূমিকম্পে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর খবর আসে গণমাধ্যমে। এই ভূমিকম্পের ঘটনার প্রায় মাসখানেক পর অতি সম্প্রতি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো সিরিয়া ও তুরস্কের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য বিমান ভর্তি সাহায্য পাঠিয়েছেন শীর্ষক একটি দাবি গণমাধ্যমসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কর্তৃক সিরিয়া ও তুরস্কের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য বিমান ভর্তি সাহায্য পাঠানোর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এছাড়া, তুরস্ক এবং সিরিয়ার একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র এবং তুরস্কের সরকারি সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সির রিলিফ ট্র্যাক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ীও রোনালদো কর্তৃক তুরস্ক বা সিরিয়ায় ত্রাণ ভর্তি বিমান পাঠানোর বিষয়ে কোনো প্রমাণ মেলেনি।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সূত্রের খোঁজ
বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত সকল প্রতিবেদনগুলো পর্যবেক্ষণ করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
রোনালদো সিরিয়া ও তুরস্কে ভূমিকম্প-দুর্গত মানুষের জন্য বিমানভর্তি ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছেন জানিয়ে জাতীয় দৈনিক ‘প্রথম আলো’ লিখেছে, দুটি দেশের যেসব এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেসব জায়গায় এই সাহায্য পাঠিয়েছেন তিনি।
স্কাই স্পোর্টসের বরাতে পত্রিকাটি লিখেছে, বাসস্থানের জন্য তাঁবু খাটানোর সামগ্রী, খাদ্যদ্রব্য, বালিশ, কম্বল, বিছানা, শিশুখাদ্য, দুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন রোনালদো।
‘মেইল অনলাইন (ডেইলি মেইল)’ ও ‘মার্কা’র বরাতে প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয় যে, পর্তুগিজ কিংবদন্তি অর্থ দিয়ে ত্রাণসামগ্রী কিনে সেসব পরিবহনের ভাড়াও দিয়েছেন। এতে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা) খরচ হয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কা।
এছাড়া, দেশীয় অন্য গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনের অধিকাংশই ডেইলি মেইল এবং মার্কাকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাছাড়া, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া অধিকাংশ পোস্টগুলোর সূত্র হিসেবেও ডেইলি মেইলকেই ব্যবহার করা হয়েছে।
অর্থাৎ, প্রায় সকল মাধ্যমেই সূত্র হিসেবে ডেইলি মেইল, মার্কা অথবা স্কাই স্পোর্টস এর নাম উল্লেখ রয়েছে।
খবরটির মূল সূত্রের খোঁজ
বিস্তর অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ০৫ মার্চ বাংলাদেশ সময় দুপুর ২ টা ৩৭ মিনিটে (08:37 GMT) যুক্তরাজ্যভিত্তিক ট্যাবলয়েড ম্যাগাজিন ‘Daily Mail’ এর ওয়েবসাইটে “Cristiano Ronaldo sends a plane full of care items to earthquake victims in Syria and Turkey with former Manchester United star deeply affected by tragic scenes that has left over 50,000 dead” শিরোনামে উক্ত দাবির প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। উক্ত প্রতিবেদনেই প্রথম দাবি করা হয় যে, সিরিয়া ও তুরস্কের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পরিচর্যা সামগ্রী ভর্তি একটি বিমান পাঠিয়েছেন রোনালদো।
ডেইলি মেইল তাদের প্রতিবেদনে আরো লিখেছে যে, পর্তুগিজ এই তারকা তাঁবু, খাবার প্যাকেজ, বালিশ, কম্বল, বিছানা, শিশুর খাবার, দুধ এবং চিকিৎসা সরবরাহ সংক্রান্ত মানবিক প্রচেষ্টায় সহায়তা করার জন্য এই অর্থ ব্যয় করছেন।
তাছাড়া, তুরস্ক ও সিরিয়া উভয় দেশেই বিমানভর্তি এই সাহায্য পণ্য পাঠানো হয়েছে বলে প্রতিবেদনটিতে দাবি করেছে তারা। তবে, রোনালদো কত তারিখে এই ত্রাণ পাঠাচ্ছে বা পাঠিয়েছে এই সংক্রান্ত কোনো বিষয়ের উল্লেখ নেই সেখানে। তাছাড়া, রোনালদো তার বর্তমান অবস্থান সৌদি আরব থেকে এই ত্রাণ পাঠিয়েছে নাকি তার দেশ পর্তুগাল থেকে ত্রাণের বিমান পাঠিয়েছে এবিষয়েও কোনকিছু উল্লেখ করেনি তারা।
ত্রাণের বিষয়টি নিয়ে এই স্পষ্ট কোনো তথ্য সূত্র উল্লেখ না করে ডেইলি মেইল তাদের প্রতিবেদনে, সিরিয়ান এক শিশুর সাথে গত ০৪ মার্চ রোনালদোর সাক্ষাতের বিষয়টি উল্লেখ করেছে।
অর্থাৎ, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিমান ভর্তি ত্রাণ পাঠিয়েছে এরূপ বাক্য উল্লেখ ব্যতীত ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনে এই সংক্রান্ত কোনো বিস্তারিত তথ্য কিংবা তথ্যটির সূত্র সেখানে উল্লেখ নেই।
স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম ‘Marca’ একইদিন (০৫ মার্চ) বাংলাদেশ সময় রাত ৯:৫৫ মিনিটে (9:55 CST) “Ronaldo’s $350k donation to earthquake victims in Syria and Turkey” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনেও রোনালদোর বিমান ভর্তি করে সাহায্য পাঠানোর বিষয়টি দাবি করেছে।
তবে মার্কা তাদের প্রতিবেদনে নতুন একটি তথ্য উল্লেখ করেছে যে, “পর্তুগিজ তারকা যে সাহায্য পাঠিয়েছেন সেই অনুদানের মূল্য সাড়ে তিন লাখ ডলার।”
এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, মার্কা’র প্রতিবেদনেও এই দাবিটির কোনো সূত্র উল্লেখ করা হয়নি।
একইভাবে, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই স্পোর্টসের প্রতিবেদনেও এ সংক্রান্ত দাবির প্রেক্ষিতে কোনো সূত্র উল্লেখ করা হয়নি।
সিরিয়ান শিশুর সাথে এই ঘটনার যোগসূত্র আছে?
রিউমর স্ক্যানারের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ডেইলি মেইল, স্কাই স্পোর্টসসহ একাধিক সংবাদমাধ্যমে রোনালদো কর্তৃক তুরস্ক ও সিরিয়ায় বিমান ভর্তি সাহায্য সামগ্রী পাঠানো বিষয়ক প্রতিবেদনগুলোতে সিরিয়ার এক শিশুর সাথে রোনালদোর দেখা করার প্রসঙ্গ বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত, শিশুটির সাথে রোনালদোর সাক্ষাতের ঘটনার পরই রোনালদো কর্তৃক সাহায্য পাঠানোর খবরটি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এর প্রেক্ষিতেই উক্ত ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছে রিউমর স্ক্যানার।
কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ‘Reuters’ কর্তৃক গত ০৬ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসেছে যে, সিরিয়ায় নাবিল সাইদ নামে এক ছেলে ফেব্রুয়ারিতে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পরে উদ্ধার কর্মীদের বলেছিল যে সে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সাথে দেখা করতে চায়। গত ০৩ মার্চ তার সেই আশা পূরণ হয়। নাবিল সৌদি আরবে আল নাসর ক্লাবের খেলা দেখার জন্য আমন্ত্রিত হওয়ার পরে রোনালদোর সাথেও দেখা করার সুযোগ পায়।
রয়টার্স এ বিষয়ে একটি ভিডিও যুক্ত করেছে প্রতিবেদনে, যেখানে দেখা যাচ্ছে রোনালদোর সাথে দেখা করে তাকে জড়িয়ে ধরেছেন নাবিল।
উক্ত ভিডিওতে রোনালদোকে নাবিলের সাথে কুশল বিনিময় করতে দেখা গেলেও, রোনালদো তুরস্ক ও সিরিয়ায় সাহায্য পাঠাবেন শীর্ষক কোনো মন্তব্য সেখানে করতে শোনা যায়নি। পরবর্তীতে ম্যাচ চলাকালীন নাবিল রয়টার্সকে বলেছেন, “আমি যখন রোনালদোকে দেখি, আমার মনে হচ্ছিল এটা হয়তো স্বপ্ন। আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি জানি না, কখন এই স্বপ্ন শেষ হবে। আমি আশা করি এটা স্বপ্ন নয় এটা সত্যই ছিল।”
তাছাড়া, কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘Al Jazeera’ এর টুইটার অ্যাকাউন্টে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত ভিডিওতেও নাবিলকে একই মন্তব্য করতে দেখা যায়। আল জাজিরার উক্ত টুইটেও রোনালদো কর্তৃক তুরস্ক ও সিরিয়ায় সাহায্য পাঠানোর বিষয়ে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সৌদি আরবের বিনোদন বিভাগের প্রধান তুর্কি আলালশিখ (Turki Alalshikh) নাবিলকে রোনালদোর সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম রোনালদোর সাথে নাবিলের দেখা করার মুহূর্তের ভিডিও তার টুইটার অ্যাকাউন্টে প্রকাশ করেন। উক্ত ভিডিওতেও রোনালদো কর্তৃক তুরস্ক ও সিরিয়ায় সাহায্য পাঠানোর বিষয়ে কোনো তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ, সিরিয়ান শিশুর সাথে দেখা করার সময়েও রোনালদো তুরস্ক ও সিরিয়ায় সাহায্য পাঠাবেন শীর্ষক কোনো মন্তব্য করেননি।
রিলিফ বিমানের খোঁজে রিউমর স্ক্যানার
ডেইলি মেইল গত ০৫ মার্চ বাংলাদেশ সময় দুপুর ২ টা ৩৭ মিনিটে রোনালদোর তুরস্ক ও সিরিয়ায় সাহায্য পাঠানো সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে এবং এই বিষয়ের প্রথম প্রতিবেদনটিও ডেইলি মেইলের ই।
আর তাই, উক্ত তথ্য ও সময়ের সূত্র ধরে রিউমর স্ক্যানার টিম সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক-সিরিয়ায় পৌছানো রিলিফ বিমানগুলোর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখেছে।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো যদি কোনো ত্রাণ ভর্তি বিমান পাঠিয়ে থাকেন এবং সেগুলো যদি তার নিজ দেশ পর্তুগাল থেকে অথবা তার বর্তমান অবস্থান সৌদি আরব থেকে হয়ে থাকে তবে সেই বিমান পৌছাতে কত সময় লাগতে পারে সেটাই সর্বপ্রথম অনুসন্ধান করেছি আমরা।
এই দুইটি তথ্যকে সামনে রেখে অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে রওনা হওয়া একটি বিমান তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুল পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টার কিছু বেশি সময় (১, ২) প্রয়োজন হয়।
Screenshot source: Trip
একইভাবে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ থেকে রওনা হওয়া একটি বিমান তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুল পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা (১, ২)।
অর্থাৎ, ডেইলি মেইলের প্রতিবেদন প্রকাশের সময় (০৫ মার্চ বাংলাদেশ সময় দুপুর ২ টা ৩৭ মিনিটে) থেকে যদি হিসাব করা হয়, তাহলে পর্তুগাল বা সৌদি আরব যেখান থেকেই বিমান রওনা দিক না কেন সেই বিমান সেদিনই (০৫ মার্চ) তুরস্কে পৌঁছে যাওয়ার কথা। আর যদি বিমানটি প্রতিবেদন প্রকাশের আগেরদিন পাঠানো হতো তবে সেটাও স্বাভাবিকভাবে আগেরদিনেই (৪ মার্চ) পৌছাতো।
তুরস্ক-সিরিয়া কি রোনালদোর পাঠানো ত্রাণ ভর্তি বিমান পেয়েছে?
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ‘আনাদোলু এজেন্সি’র ০৭ মার্চ দেওয়া তথ্যমতে, সৌদি আরব থেকে ০৬ মার্চ বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সর্বমোট ১৪ টি রিলিফ বিমান তুরস্কে নেমেছে।
পরবর্তীতে অনুসন্ধানের মাধ্যমে রিউমর স্ক্যানার টিম, আনাদোলু এজেন্সির গত ২৫ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন খুঁজে পায় যেখানে সৌদি আরব থেকে ১৪ টি রিলিফ বিমান তুরস্কে এসেছে বলে উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ, সৌদি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারির পর ত্রাণবাহী কোনো বিমান সেখানে যায়নি।
তাছাড়া, পর্তুগাল থেকে উক্ত সময়ের মধ্যে (৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ০৬ মার্চ দুপুর) কোনো রিলিফ বিমান তুরস্কে যাওয়ার তথ্য আসেনি পর্তুগাল সরকারের ওয়েবসাইটেও। দেশটির সরকারি ওয়েবসাইটে উল্লেখ রয়েছে যে, পর্তুগাল থেকে যে উদ্ধারকারী দলটি গত ০৮ ফেব্রুয়ারি তুরস্কে গিয়েছিল তারাও দেশে ফিরে গিয়েছে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি।
অর্থাৎ, রিলিফ বিমানের তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করেও দেখা যাচ্ছে যে, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কর্তৃক পাঠানো ত্রাণ ভর্তি কোনো বিমান তুরস্কে পৌছায়নি।
তুরস্ক ও সিরিয়ার গণমাধ্যম কী বলছে?
রোনালদো তুরস্কে সাহায্য সামগ্রী সমেত কোনো বিমান পাঠালে সেই বিষয়ে তুরস্কের গণমাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে সংবাদ প্রকাশিত হবে এবং ত্রাণ ভর্তি বিমানটি তুরস্কে পৌছানোর পরও একইভাবে সে বিষয়ে আপডেটেড সংবাদ থাকা স্বাভাবিক।
এজন্য, রিউমর স্ক্যানার টিম তুরস্কের একাধিক গণমাধ্যমের বিগত কয়েকদিনের খবরগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছে।
শুরুতে রিউমর স্ক্যানার টিম আনাদোলু এজেন্সির ওয়েবসাইটে ম্যানুয়ালি এবং ভিন্ন ভিন্ন কিওয়ার্ডের মাধ্যমে অনুসন্ধান করে দেখে, তবে রোনালদোর ত্রাণ ভর্তি বিমান পাঠানো সংক্রান্ত কোনো সংবাদ এই প্রতিবেদন প্রকাশ অবধি উক্ত সংবাদমাধ্যমটি প্রকাশ করেনি। তাছাড়া, আনাদোলু রোনালদোর বিষয়ে সর্বশেষ খবর প্রকাশ করেছে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি।
তবে, আনাদোলু নিয়মিতই বৈদেশিক বিভিন্ন সাহায্যের বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাচ্ছে। গত ০৪ মার্চ থেকে ০৮ মার্চ পর্যন্ত তুর্কিমেনিস্তান, কাতার, বসনিয়া-হার্জেগোবেনিয়া, জাপান, জর্ডান, বেলজিয়াম, গ্রিস, তাইওয়ান, সোমালিয়া সহ একাধিক দেশ ও সংস্থার সাহায্য প্রদানের খবর এসেছে উক্ত সংবাদমাধ্যমটির ওয়েবসাইটে।
এমনকি, রোনালদোর বিষয়ে ভাইরাল হওয়া এই দাবিটির ১ দিন পর অর্থাৎ গত ০৬ মার্চ তারিখে জর্ডানের একটি রিলিফ বিমান তুরস্কে পৌঁছানোর খবরও এসেছে আনাদোলুর ওয়েবসাইটে।
অর্থাৎ, আনাদোলুর ওয়েবসাইটে আলোচিত দাবিটির পূর্বে সর্বশেষ রিলিফ বিমান বিষয়ক আপডেট দেওয়া হয়েছিল ২৫ ফেব্রুয়ারি (সৌদির ১৪ বিমান যাওয়ার খবর) এবং রোনালদোর ত্রাণ বিষয়ক দাবিটি ভাইরালের পরে গত ০৬ মার্চও জর্ডানের একটি বিমান যাওয়ার খবর দিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি। তবে, পরবর্তী সময়ে এখন পর্যন্ত কোনো রিলিফ বিমান যাওয়ার তথ্য নেই আনাদোলুর ওয়েবসাইটে।
রোনালদোর বিষয়ে আনাদোলু এজেন্সির ওয়েবসাইটে কিওয়ার্ড সার্চ করে আমরা আরো দেখার চেষ্টা করেছি যে, তুরস্কের ভূমিকম্পের ঘটনায় রোনালদোর পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা প্রদানের অন্য কোন খবর সেখানে রয়েছে কিনা।
পরবর্তীতে, গত ০৭ ফেব্রুয়ারি সংবাদমাধ্যমটির এক প্রতিবেদনে খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে বলা হয়েছে তুর্কি পেশাদার ফুটবলার মেরিহ ডেমিরাল ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য রোনালদো, লিওনার্দো বনুচ্চি এবং পাওলো দিবালার জার্সি নিলামে তুলেছেন।
এছাড়া, ০৯ ফেব্রুয়ারির আরেক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উক্ত ৩ খেলোয়াড়ের স্বাক্ষরকৃত জার্সি নিলামের মাধ্যমে ২,৬৫,৫০০ ডলার উঠেছে, যা দান করা হয়েছে স্থানীয় একটি এনজিওতে। তবে উপরোক্ত সংবাদ দুইটি ছাড়া রোনালদোর ত্রাণ সংক্রান্ত আর কোনো সংবাদ সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তবে, বিস্তারিত অনুসন্ধানের মাধ্যমে রিউমর স্ক্যানার টিম তুরস্কের আরেক সংবাদমাধ্যম ‘A Haber’ এর ওয়েবসাইটে গত ০৫ মার্চ (ডেইলি মেইলে প্রকাশের একইদিনে) প্রকাশিত রোনালদোর বিমান ভর্তি ত্রাণ পাঠানো বিষয়ক একটি প্রতিবেদন খুঁজে পায়। তবে, তুরস্কে ত্রাণ পাঠানো সংক্রান্ত বিষয় হলেও তুরস্কের ‘A Haber’ নামের এই গণমাধ্যমটি উক্ত সংবাদ প্রকাশ করেছে ডেইলি মেইলকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে।
তাছাড়া, ‘A Haber’ নামের এই সংবাদমাধ্যমে গত ৫ মার্চে ‘রোনালদো ত্রাণ পাঠাচ্ছে’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হলেও সেই বিমান পরবর্তীতে পৌঁছেছে কিনা বা এ সংক্রান্ত সর্বশেষ কোনো তথ্য সংবাদমাধ্যমটির ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়নি।
A Haber এর মত একইভাবে এবং একই তারিখে তুরস্কের আরেকটি সংবাদমাধ্যম ‘ntv’ ডেইলি মেইলকেই সূত্র উল্লেখ করে তাদের ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে। উল্লেখ্য, তাদের ওয়েবসাইটেও ত্রাণ ভর্তি বিমান পৌছানোর কোনো আপডেট পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ, তুরস্কের দুইটি গণমাধ্যম রোনালদোর ত্রাণ পাঠানো সংক্রান্ত খবর ডেইলি মেইলকে সূত্র ধরে প্রকাশ করেছে, যেখানে ডেইলি মেইলের সংবাদেই কোনো সূত্রের উল্লেখ নেই।
তুরস্ক ও সিরিয়ার ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলো কী বলছে?
রিউমর স্ক্যানার টিমের পক্ষ থেকে পরবর্তীতে তুরস্ক এবং সিরিয়ার একাধিক ফ্যাক্টচেকারের সাথে বিষয়টি নিশ্চিতের জন্য যোগাযোগ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে তারা জানান যে, রোনালদো কর্তৃক তুরস্ক ও সিরিয়ায় সাহায্য পাঠানোর বিষয়ে ডেইলি মেইল ব্যতিত অন্য কোনো উৎস থেকে প্রকাশিত খবর তাদের নজরে আসেনি।
এই বিষয়ে রোনালদোর সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের এক্টিভিটি কী?
অনুসন্ধানে দেখা যায়, রোনালদোর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায় নিয়মিত টুইট করে থাকেন ইংলিশ ব্রডকাস্টার এবং সাংবাদিক পিয়ার্স মরগান।
ডেইলি মেইল গত ০৫ মার্চ রোনালদোর বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পরে রোনালদোর প্রসঙ্গে একাধিক (১,২,৩,৪) টুইট করেছেন মরগান। কিন্তু তুরস্ক ও সিরিয়ায় ত্রাণ ভর্তি বিমান পাঠানোর বিষয়ে তার কোনো টুইট খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তাছাড়া, মরগান ডেইলি মেইলেও কলাম লিখে থাকেন এবং গত ০৩ মার্চ তারিখেও তিনি ডেইলি মেইলের একটি প্রতিবেদনের লিংক টুইটারে শেয়ার করেছেন। তাই রোনালদোর ত্রাণ পাঠানো বিষয়ে ডেইলি মেইল বা অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর তার নজর এড়ানোর কথা নয়। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি কোনো টুইটই করেননি।
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া তুরস্কের পতাকাযুক্ত ত্রাণ সামগ্রী সহ বিমানের ছবিটির রহস্য কী তাহলে?
রোনালদো কর্তৃক তুরস্ক ও সিরিয়ায় সাহায্য পাঠানো সংক্রান্ত খবরের সাথে বেশকিছু ফেসবুক পোস্টে একটি ত্রাণবাহী বিমানের ছবি (আর্কাইভ) এবং তুরস্কের পতাকাযুক্ত ত্রাণ সামগ্রীর কিছু ছবি প্রচার করা হয়েছে।
কিন্তু রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখা যায়, ভাইরাল ছবিগুলো ২০২০ সালের (প্রথম ছবি, দ্বিতীয় ছবি, তৃতীয় ছবি)। ছবিগুলো প্রকৃতপক্ষে, তুরস্ক কর্তৃক করোনা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে পাঠানো পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুয়েপমেন্ট এর।
অর্থাৎ, রোনালদো কর্তৃক তুরস্ক ও সিরিয়ায় ত্রাণ পাঠানো সংক্রান্ত দাবির সাথে পুরোনো ও ভিন্ন ঘটনার ছবি জুড়ে দিয়েও ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে।
মূলত, গত ০৫ মার্চ যুক্তরাজ্যভিত্তিক ট্যাবলয়েড ম্যাগাজিন ‘Daily Mail’ এর এক প্রতিবেদনে সর্বপ্রথম দাবি করা হয় যে, সিরিয়া ও তুরস্কের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পরিচর্যা সামগ্রী ভর্তি একটি বিমান পাঠিয়েছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। পরবর্তীতে এই প্রতিবেদনের বরাতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু রিউমর স্ক্যানারের দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখা যায়, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তুরস্ক-সিরিয়ায় কোনো ত্রাণ ভর্তি বিমান পাঠাননি এবং দেশগুলোর সরকারি সংবাদ সংস্থাসহ একাধিক গণমাধ্যম এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে তুরস্ক ও সিরিয়া সম্প্রতি এমন কোনো ত্রাণ পায়নি। অর্থাৎ, সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবেই এই দাবিটি ইন্টারনেটে ছড়িয়েছে।
প্রসঙ্গত, গতমাসে আর্জেন্টাইন ফুটবল তারকা লিওনেল মেসির সংস্থা ‘লিও মেসি ফাউন্ডেশন’ তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৩৫ লাখ ইউরো দান করার ঘোষণা দিয়েছেন’ শীর্ষক একটি গুজব ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে উক্ত বিষয়টিকেও মিথ্যা জানিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
সুতরাং, সিরিয়া ও তুরস্কের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য রোনালদোর বিমান ভর্তি ত্রাণ পাঠানোর খবরটি ভিত্তিহীন ও গুজব।
তথ্যসূত্র
- Rumor Scanner own analysis
- Anadolu Agency: Turkey News
- Piers Morgan: Twitter
- Reuters: Syrian boy fulfils dream of meeting Ronaldo after quake
- Anadolu Agency: Arab countries stand by Türkiye after devastating earthquakes
- Governo da República Portuguesa: Portuguese rescue mission received on arrival from Turkey