আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি মেজর পদমর্যাদার সাদেকুল হক সাদেক নামে এক সেনাকর্মকর্তাকে হেফাজতে নিয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। গত ৩১ জুলাই ঢাকা সেনানিবাসে অফিসার্স মেস ‘এ’-তে আয়োজিত একসংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনী সদর দপ্তরের মিলিটারি অপারেশনস পরিদফতরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা এ তথ্য জানান।
এরই প্রেক্ষিতে, যমুনা টিভি, বাংলাদেশ প্রতিদিন, একুশে টেলিভিশন, আমার দেশ -এর সংবাদ দাবিতে গণমাধ্যমগুলোর কিছু ফুটেজ যুক্ত করে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে।
এর মধ্যে যমুনা টিভির ফুটেজে আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ ওঠা, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান পদত্যাগ করেছেন – এমন অডিও শুনা যায়। বাংলাদেশ প্রতিদিনের ফুটেজে আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগে আটক সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান – এমন অডিও শুনতে পাওয়া যায়। এবং আমার দেশের ফুটেজে আওয়ামী লীগ কর্মীদের গোপনে নাশকতার ট্রেনিংয়ে সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তা সেনাপ্রধান জেনালে ওয়াকার-উজ-জামানকে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করা হচ্ছে – এমন অডিও শুনতে পাওয়া যায়।

উক্ত দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। এই প্রতিবেদন লেখা অব্দি ইউটিউবে ভিডিওটি দেখা হয়েছে প্রায় ১ মিলিয়নেরও বেশি।
ভিডিওটিতে শুরুতে গণমাধ্যমগুলোর ফুটেজে অডিও হিসেব শুনা যাচ্ছে,
যমুনা টিভির সংবাদ ফুটেজে শুনা যায়, “আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ ওঠা, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান পদত্যাগ করেছেন সম্পর্কের কথা শিকার করে। আধিপত্য কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না বলেও জানান সেনাকর্মকর্তারা।”
বাংলাদেশ প্রতিদিনরে সংবাদ ফুটেজে শুনা যায়, “কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হচ্ছেন আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগে আটক সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তার বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে একটি তদন্ত আদালত গঠন করেছে সেনাবাহিনী। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।”
একুশে টেলিভিশনের সংবাদ ফুটেজে শুনা যায়, “রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা সংলগ্ন কেবি কনভেনশন সেন্টার এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। সারা দেশ থেকে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের তৃনমূল কর্মীদের সংঘটিত করে গোপনে সেখানে নাশকতার প্রশিক্ষণ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় গ্রেফতার কৃতদের জেরা করে প্রাথমিকভাবে এমন তথ্যই পেয়েছেন গুয়েন্দারা। আর ট্রেইনার সেনাকর্মকর্তাকে আটক করে তদন্ত শুরু হয়েছে।”
আমার দেশ -এর সংবাদ ফুটেজে শুনা যায়, “আওয়ামী লীগ কর্মীদের গোপনে নাশকতার ট্রেনিংয়ে সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তা সেনাপ্রধান জেনালে ওয়াকার-উজ-জামানকে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করা হচ্ছে। প্রাথমিক তদন্তে তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার পর সেনাবাহিনীর তরফ থেকে দুটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ঘটনার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়াই ইতমধ্যে তাকে সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়। বিবিসি জানিয়েছে রাজনৈতিক বৈঠকে সেনা কর্মকর্তাদের অংশগ্রহনের অভিযোগ কৌতুহলেন জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে ওই কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে নেয়ার পর তার বিচার প্রক্রিযা কি হবে তা নিয়েও চলছে নানা আলোচনা।”
টিকটকে প্রচারিত প্রায় একই ধরনের ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। টিকটকে ভিডিওটি প্রায় ৩ লক্ষ ৯০ হাজারেরও বেশি দেখা হয়েছে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণের অভিযোগে সেনাপ্রধান জেনালে ওয়াকার-উজ-জামানকে আটক করা হয়নি এবং তিনি পদত্যাগও করেননি। প্রকৃতপক্ষে, আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি সেনাবাহিনী মেজর সাদিককে হেফাজতে নেওয়ার ঘটনার বিষয়ে গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত সংবাদ প্রতিবেদন সম্পাদনা করে আলোচিত দাবির ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।
অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার। ভিডিওটির কয়েকটি গণমাধ্যমের সংবাদের ফুটেজ দেখানো হয়। তারপর একজন ব্যক্তিকে কথা বলতে দেখা যায়।
তিনি বলেন, “দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আর্মি অফিসারের পক্ষ থেকে গোপনে ট্রেইনিং দেওয়া হবে এটা এই দেশের মানুষ কখনও কল্পনায়ও ভাবেনি। যদিও অনেক সময় অনেকে বলতো এই সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তিনি শেখ হাসিনার নিয়োগ করা এবং তার আত্মীয় সে কারনে তিনি গোপনে হলেও শেখ হাসিনার হয়ে কাজ করবেন। যে কারনেই এইবার এই দেশের মানুষ বলছে, আর্মি অফিসারের কাছ থেকে শুধু মাত্র ক্ষমতার চেয়ার টেনে নিলেই হবে না। পাশাপাশি তাকে কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে এবং বিচারের মুখোমুখি করতে হবে যাতে করে ভবিষ্যতে কোনো বাহিনীর সদস্যরা এই দেশের বিরুদ্ধে কোনো ধরনে ষড়যন্ত্র বা নাশকতা
দুঃসাহস না করে। ইতোমধ্যেই এই আর্মি অফিসারকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। তো এই বিষয়ের কিছু অংশ ভিডিওর শুরুতে শিরোনামে আপনারা দেখেছেন বিস্তারিত দেখবেন পুরো ভিডিও জুড়ে…”
এরপর ভিডিওটিতে আমার দেশ -এর একটি ক্লিপ এর দীর্ঘ সংষ্করণ দেখানো হয়। কিন্তু সংবাদ প্রতিবেদনটিতে ‘আওয়ামী লীগ কর্মীদের গোপনে নাশকতার ট্রেনিংয়ে সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তা সেনাপ্রধান জেনারেলওয়াকার-উজ-জামানকে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করা হচ্ছে।’ এমন কোনো তথ্য বা অডিও ছিলনা।
যমুনা টিভির ভিডিও ক্লিপ যাচাই
এই বিষয়ে অনুসন্ধানে যমুনা টিভির ইউটিউব চ্যানেলে গত ৩১ জুলাই ‘পাহাড়ি এলাকায় কেএনএফ’র আধিপত্য কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না’ শিরোনামের একটি সংবাদ প্রতিবেদ খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনের শুরুর ১২ সেকেন্ড অংশের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে। তবে, ভিডিও প্রতিবেদনটিতে ‘আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ ওঠা, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান পদত্যাগ করেছেন সম্পর্কের কথা শিকার করে।’ এমন কোনো তথ্য ছিল না।
প্রতিবেদনটিতে শুরুর অংশে বলা হয়, “আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ উঠা মেজর সাদিকুল হক সাদিকের বিষয়ে অবগত সেনাবাহিনী। তাঁর বিষয়ে তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন মিলিটারি অপারেশনস পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ নাজিম উদ্দৌলা।”
এছাড়াও প্রতিবেদনটিতে কেএনএফ -এর আধিপত্য বিষয়ে বলা হয়, “স্বাধীন বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায় কেএনএফ -এর আধিপত্য কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না বলেও জানান সেনাকর্তারা।”
অর্থাৎ, এটি নিশ্চিত যে যমুনার টিভির প্রতিবেদনের ভিডিও ক্লিপ সম্পাদনা করে আলোচিত ক্লিপটি তৈরি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের ক্লিপ যাচাই
এই বিষয়ে অনুসন্ধানে বাংলাদেশ প্রতিদিনের ইউটিউব চ্যানেলে গত ১ আগস্ট ‘আওয়ামী লীগকে প্রশিক্ষণ দেয়া সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল সামরিক আদালত | Major Sadik’ ক্যাপশনে প্রচারিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিও প্রতিবেদনে ‘কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হচ্ছেন আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগে আটক সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।’ এমন কোনো তথ্য ছিল না।
প্রতিবেদনটিতে শুরুর অংশে বলা হয়, কোর্ট মার্শেলের মার্শালের মুখোমুখি হচ্ছেন আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগে আটক সেনা কর্মকর্তা মেজর সাদেকুর রহমান সাদেক। তাঁর বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে একটি তদন্ত আদালত গঠন করেছে সেনাবাহিনী। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
অর্থাৎ, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সংবাদ প্রতিবেদন সম্পাদনা করে আলোচিত ক্লিপটি তৈরি করা হয়েছে।
একুশে টেলিভিশনের ক্লিপ যাচাই
এই বিষয়ে অনুসন্ধানে একুশে টেলিভিশনের ইউটিউব চ্যানেলে গত ১ আগস্ট ‘রাজধানী দখলে গোপন প্রশিক্ষণ, ট্রেনার সেনা কর্মকর্তা আ’ট’ক’ শিরোনামে একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিও প্রতিবেদনের শুরুর অংশের সাথে আলোচিত ক্লিপটির মিল রয়েছে। তবে, আলোচিত ক্লিপটিতে কোনো সেনাকর্মকর্তার নাম উল্লেখ করতে শুনা যায়নি। একুশে টেলিভেশনের প্রতিবেদনটিতে, ট্রেইনার সেনাকর্মকর্তা সাদিককে আটক করে তদন্ত শুরু হয়েছে।”
অর্থাৎ, একুশে টেভিশনের প্রতিবেদন সম্পাদনা করে ক্লিপটি তৈরি করা হয়েছে।
আমার দেশ -এর ফুটেজ যাচাই
এই বিষয়ে অনুসন্ধানে আমার দেশ -এর ইউটিউব চ্যানেলে গত ২ আগস্ট ‘আওয়ামী না’শ’ক’তা’য় সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তারা কোর্ট মা’র্শা’লে’র মুখোমুখি’ শিরোনামে একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। তবে, উক্ত প্রতিবেদনে ‘আওয়ামী লীগ কর্মীদের গোপনে নাশকতার ট্রেনিংয়ে সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তা সেনাপ্রধান জেনালে ওয়াকার-উজ-জামানকে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করা হচ্ছে।’ এমন তথ্য ছিল না।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “আওয়ামী লীগ কর্মীদের গোপনে নাশকতার ট্রেনিংয়ে সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তা মেজর সাদেক ও তার সুপিরিয়র কমান্ডকে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করা হচ্ছে।…”
তবে, আলোচিত ভিডিওটিতে দেখানো দীর্ঘতম সংষ্করণেও সম্পাদনা করে সাদেকের নাম কেটে দেওয়া হয়।
অর্থাৎ, আমার দেশ -এর এই প্রতিবেদন সম্পাদনা করে আলোচিত ফুটেজটি তৈরি করা হয়েছে।
উল্লিখিত তথ্যপ্রমাণ থেকে এটি নিশ্চিত যে, আলোচিত ভিডিওটি বিভিন্ন গণমাধ্যমের ভিডিও প্রতিবেদনেরফুটেজগুলো সম্পাদনা করে তৈরি করা হয়েছে।
ইউটিউব থাম্বনেইল যাচাই
এই বিষয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের পদত্যাগ পত্র হাতে ছবিটি সম্পাদনা বা এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে যাএই ছবিতে বুকে যে ব্যাচ দেখা যাচ্ছে তা থেকে স্পষ্ট হওয়া যায়। এছাড়াও, আমাদের অনুসন্ধানে পুলিশের হাতে আটক ছবিটি প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
সুতরাং, আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ সেনাপ্রধান আটক হয়েছেন এবং পদত্যাগ করেছেন শীর্ষক দাবিগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Jamuna TV : পাহাড়ি এলাকায় কেএনএফ’র আধিপত্য কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না
- Bangladesh Pratidin : আওয়ামী লীগকে প্রশিক্ষণ দেয়া সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল সামরিক আদালত | Major Sadik
- Ekushey Television – ETV : রাজধানী দখলে গোপন প্রশিক্ষণ, ট্রেনার সেনা কর্মকর্তা আ’ট’ক
- Daily Amar Desh : আওয়ামী না’শ’ক’তা’য় সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তারা কোর্ট মা’র্শা’লে’র মুখোমুখি
- Dhaka Tribune : Lt Gen Waker-Uz-Zaman appointed army chief