সম্প্রতি, বিমানের ভেতর একজন দাঁড়ি-টুপিওয়ালা মুসলিম যাত্রীকে অপর আরেক যাত্রীর থাপ্পড় মারার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। উক্ত ভিডিওটি প্রচার করে অনেকেই দাবি করছেন, মুসলিম ওই ব্যক্তিকে হেনস্তাকারী অপরযাত্রী হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিমানের ভেতর হিন্দু ব্যক্তির দ্বারা মুসলিম সহযাত্রীর হেনস্তার শিকার হওয়ার দাবিটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, দাঁড়ি-টুপিওয়ালা ওই মুসলিম যাত্রীকে হেনস্তাকারী হিন্দু নন; তিনিও মুসলিম। হেনস্তাকারী ওই ব্যক্তির নাম হাফিজুল রহমান।
অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ভিডিওটি পর্যালোচনা করে রিউমর স্ক্যানার। এতে ভিডিওটিতে উপস্থিত অন্যান্য যাত্রীদের এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শোনা যায়। তাদের অনেককেই ওই মুসলিম ব্যক্তিকে থাপ্পড় মারার প্রতিবাদ করতে দেখা যায়।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ভারতীয় বিমানসংস্থা ইন্ডিগো-এর মুম্বাই-কলকাতা-আসামগামী বিমান 6E-2387-তে উক্ত ঘটনাটি ঘটে। হেনস্তার শিকার ব্যক্তির নাম হুসেন আহমেদ মজুমদার। তিনি ভারতের আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলার নিবাসী। তিনি মুম্বাই থেকে বিমানে কাছাড় জেলার সদর শিলচরে যাচ্ছিলেন। যাত্রাকালে তার প্যানিক অ্যাটাক হলে বিমানবালারা তাকে বিমান থেকে বের হতে সহায়তা করতে আসেন। এমন সময় অভিযুক্ত ব্যক্তি হুসেনকে থাপ্পড় মারেন।
প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়, হুসেনকে হেনস্তাকারী ওই ব্যক্তির নাম হাফিজুল রহমান। বিমানটি কলকাতায় ল্যান্ড করলে হাফিজুল রহমান নামের ওই ব্যক্তিকে বিমান কর্তৃপক্ষ পুলিশে দেন বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়। তবে তাকে পরবর্তীতে ছেড়ে দেওয়া হয় বলেও জানা যায়। কিন্তু উক্ত ঘটনার পর থেকে হেনস্তার শিকার হুসেন আহমেদ মজুমদার নিখোঁজ রয়েছেন বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়। কলকাতায় নেমে তার শিলচরের ফ্লাইট ধরার কথা থাকলেও তিনি সেটি মিস করেন। তার ফোন বন্ধ থাকায় ভিডিওটি দেখে শিলচর বিমানবন্দরে তাকে রিসিভ করতে যাওয়া পরিবারের সদস্যরা তার সাথে আর যোগাযো করতে পারেনা বলেও প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়।
তবে পরবর্তীতে তাকে আসামের বারপেটা রেলস্টেশনে খুঁজে পাওয়া যায়। যা কলকাতা থেকে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূরে এবং তার গন্তব্য শিলচর থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
পরবর্তীতে কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে এ ঘটনায় কলকাতার বিধাননগর সিটি পুলিশের ফেসবুক পেজে প্রচারিত একটি বিবৃতিও খুঁজে পাওয়া যায়।
Screenshot: Facebook
বিবৃতিতেও বলা হয়, গত ১ আগস্ট ইন্ডিগো বিমানে হওয়া হেনস্তার ঘটনায় অভিযুক্ত ও হেনস্তার শিকার উভয় ব্যক্তিই মুসলিম। অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম হাফিজুল রহমান।
এ ঘটনায় হেনস্তাকারী ব্যক্তিকে ইন্ডিগো বিমান সংস্থার সকল প্রকার ফ্লাইটে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাদের এক্স অ্যাকাউন্টে একটি বিবৃতি প্রচার করা হয়।
Screenshot: X
সুতরাং, ভারতে বিমানের ভেতর মুসলিম ব্যক্তিকে হিন্দু ব্যক্তির থাপ্পড় মারার দাবিটি মিথ্যা।
সম্প্রতি ‘যুবদলের রুট লেভেলের একজন কর্মীর হিংস্রতা দেখুন,…’ ক্যাপশনে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।
ভিডিওতে মোটরসাইকেল আরোহী এক যুবককে আগ্নেয়াস্ত্র চালিয়ে একটি বিলিয়ার্ড ক্লাবে প্রবেশ করতে দেখা যায়, যেখানে সে আরেক যুবকের উপর আক্রমণ করে।
উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)৷
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদলের কোনো কর্মীর আগ্নেয়াস্ত্রসহ আক্রমণের ভিডিও নয় এবং ঘটনাটি বাংলাদেশেরও নয়। প্রকৃতপক্ষে, পাকিস্তানের ফয়সালাবাদের একটি স্নুকার ক্লাবের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজকে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে Agraprana Pahlawan – WWIII ALERT নামক এক্স হ্যান্ডেলে গত ২৪ জুলাই প্রকাশিত পোস্টে একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির সাদৃশ্য রয়েছে।
পোস্টটির ক্যাপশন থেকে জানা যায়, পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ফয়সালাবাদে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির একাধিক গুলি বর্ষণের ঘটনার ভিডিও এটি। ঘটনাটি গত ২২ জুলাইয়ের।
প্রতিবেদনে প্রচারিত ভিডিওটির অনুরূপ একটি সিসিটিভি ফুটেজের ভিডিও ক্লিপ যুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনের বিবরণী থেকে জানা যায়, পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ফয়সালাবাদের রাজা আবাদে একটি স্নুকার ক্লাবে আগ্নেয়াস্ত্রধারী এক যুবক একাধিক গুলি বর্ষণ একটি স্নুকার ক্লাবে প্রবেশ করে এবং পূর্ব শত্রুতার জেরে সেখানে আরেক যুবকের ওপর আক্রমণ করে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে আক্রমণকারীকে গ্রেফতার করে ও তার অস্ত্রটি জব্দ করে।
অর্থাৎ, প্রচারিত ভিডিওর ঘটনাটি বাংলাদেশের নয়।
সুতরাং, যুবদল কর্মী কর্তৃক আক্রমণের ভিডিও দাবিতে পাকিস্তানের স্নুকার ক্লাবে আক্রমণের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
সম্প্রতি, “আম্মাজান হাসিনা আপনার পায়ে পরি” শিরোনামে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের সাম্প্রতিক বক্তব্য দাবিতে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে।
উক্ত দাবিতে টিকটকে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, নুরুল হক নুর সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আম্মাজান ডেকে বক্তব্য দেননি। বরং, প্রায় ৩ বছর পূর্বে শেখ হাসিনার সমালোচনা করে নুরের দেওয়া একটি বক্তব্যের ভিডিওর খণ্ডিত অংশ আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে, আলোচিত ভিডিওটি থেকে প্রাপ্ত ইমেজ রিভার্স সার্চের মাধ্যমে ‘Discover বাংলা’ নামক ফেসবুক পেজে ২০২২ সালের ০৪ এপ্রিলে “আম্মাজান হাসিনা পায়ে পড়ি ভোটারাধিকার দেনঃ ভিপি নুর” শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর দৃশ্যাবলীর সঙ্গে আলোচিত দাবিতে থাকা ভিডিওর দৃশ্যাবলীর মিল রয়েছে।
Video Comparison by Rumor Scanner
ভিডিও’র ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ড সময় থেকে নুরুল হক নুর কে বলতে শোনা যায়, “আম্মাজান হাসিনা, আপনার পায়ে পরি আপনার জীবন দিতে হবেনা, আমি ভোটাধিকার দেন। আপনার জীবন আমরা রক্ষা করবো, আপনি এই দেশের গণতন্ত্র দেন।”
এছাড়া, ২০২২ সালের ১২ এপ্রিল Dhaka Express নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে “আম্মাজান হাসিনা পায়ে পড়ি, জীবন দিতে হবে না। আমাদের ভোটাধিকার ফেরত দেন” শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। এই ভিডিওটির একটি অংশের সাথেও আলোচিত ভিডিওটিতে থাকা নুরুল হক নুরের বক্তব্যের ফুটেজের মিল পাওয়া যায়।
অর্থাৎ, নুরুল হক নুরের বক্তব্যের এই ফুটেজটি সাম্প্রতিক সময়ের নয়। এছাড়া, মূল ভিডিওতে নুর শেখ হাসিনার প্রশংসা নয় বরং সমালোচনা করতে দেখা যায়।
উল্লেখ্য, একই ভিডিওটি ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে নুরুল হক নুরের বক্তব্য দাবিতে প্রচার করা হয়েছিল। সে সময়ে বিষয়টিকে মিথ্যা হিসেবে শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
সুতরাং, ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ভোটাধিকার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনার সমালোচনা করে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের দেওয়া একটি বক্তব্যের ভিডিওর খণ্ডিত অংশ সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনার পক্ষে নুরের বক্তব্য দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।
শহীদ এবং সম্মুখ সারির ব্যক্তিদের নিয়ে নিয়মিত অপতথ্য প্রচার
দায়িত্বশীল জায়গা থেকেও ছিল অপতথ্যের প্রচার
ইন্টারনেট শাটডাউনে বাধাগ্রস্ত হয় ফ্যাক্টচেকিং কার্যক্রম
আন্দোলন নিয়ে অপতথ্যের প্রচার এখনও চলছে
০৫ আগস্ট ২০২৪। সকাল গড়িয়ে দুপুর আসন্ন। চলছিল ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচী। রাজপথে মানুষের জমায়েত বাড়ছিল। এমন প্রক্ষাপটে ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর। রিউমর স্ক্যানারের কাছে এ সংক্রান্ত একটি ছবি আসে যেখানে দেখা যায়, উড়ার অপেক্ষা থাকা একটি হেলিকপ্টারের সামনে কিছু লাগেজ এবং দুইটি গাড়ি। কিছু মানুষের সাথে সেখানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় থাকা এসএসএফ সদস্যদেরও দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্র জানাচ্ছিল, শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন। দুপুর তিনটার কিছু পরে রিউমর স্ক্যানারও নিশ্চিত হয়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটেছে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার দাবির পথ ধরে সংঘর্ষ, হামলা আর শত শত মৃত্যুর একেকটা দিন পেরিয়ে এক দফার দাবিতে এসে স্থির হওয়া এই আন্দোলন যখন পরিণতি পেল, তখন পেছন ফিরে দেখা গেল, আন্দোলনের প্রতিটি দিন অপতথ্যও ছিল নীরব সঙ্গী। সেই দিনগুলোয় এসব অপতথ্য মোকাবিলায় নিরলস কাজ করে গেছে রিউমর স্ক্যানার।
আন্দোলনের দিনগুলোয় দেড় শতাধিক অপতথ্য
কোটা সংস্কারের দাবিতে গেল বছর আন্দোলন শুরু হয় ৫ জুন। জুলাইতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে সংগঠিত হয় এবং সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের সরকারি বিজ্ঞপ্তি পুনঃবহালের দাবিতে টিএসসিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এরপর আন্দোলনকারীরা দাবি পূরণের জন্য ৪ জুলাই সময়সীমা নির্ধারণ করে। কিন্তু সেদিন আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেনি যা কিনা কোটা বাতিলের ২০১৮ সালের সার্কুলারকে অবৈধ করে দেয়। ফলে শিক্ষার্থীরা সারাদেশে তাদের বিক্ষোভ আরও তীব্র করে। ঠিক সেদিনই এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রথম একটি অপতথ্য প্রচার হতে দেখে রিউমর স্ক্যানার। একটি ডিজিটাল ব্যানারের মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছিল “এই কোটা আন্দোলন আমাকে ফেসবুক ইউটিউবে লাখ লাখ ফলোয়ারস দিয়েছে। চাইলে আমি যে কোন সময়ে বিকাশ/নগদের মাধ্যমে আয় করতে পারছি। তাই আমার চাকুরিতে যাওয়ার ইচ্ছা জাগেনি।” শীর্ষক মন্তব্যটি ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান করেছেন।
Screenshot: Facebook
তবে রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখে, রাশেদ খান এমন কোনো মন্তব্য করেননি। জাগোনিউজ২৪ এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রাশেদ খানের ভিন্ন প্রেক্ষিতে করা একটি মন্তব্যকে সম্পাদনা করে আলোচিত মন্তব্যটি প্রথমে হাস্যরসাত্মকভাবে প্রচার করা হলেও পরবর্তীতে তা সত্য ধরে নিয়ে অনেকেই প্রচার করতে থাকে।
বিক্ষোভ চলতে থাকে পরের দিনগুলোতেও। ১১ জুলাই খবর আসে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করতে যাওয়ার পথে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আহত হন শিক্ষার্থীসহ অন্তত ২০ জন। সেদিনই প্রথম এই আন্দোলনে মৃত্যুর গুজব প্রচার হয়। ১৫ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলনে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ শহীদ হন, যা এই আন্দোলনে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা। সেদিন দ্বিতীয় শহীদ দাবিতে রংপুরের আরেক শিক্ষার্থীর ছবি প্রচার করা হয়। মিফতাহুল জান্নাত মিতা নামে এই শিক্ষার্থীর বড় বোন রিউমর স্ক্যানারকে জানান, মিতা আহত হলেও পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
১৬ জুলাইয়ের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার দলীয় নেতা-কর্মীরা আন্দোলনে আরো বাধা হয়ে আসলে এই লড়াই সহিংসতায় রূপ নেয়। এতে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটে, আহত হন হাজার হাজার মানুষ। দিনগুলোতে অপতথ্যের প্রবাহও ছিল নিত্য সঙ্গী। ১৫ জুলাই থেকে সে মাসের বাকি প্রতিটি দিনই অপতথ্যের প্রবাহ দেখা গেছে। এমনকি ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনার পতনের পূর্ব সময় পর্যন্তও এই আন্দোলন নিয়ে ছড়িয়ে পড়া অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। টানা আন্দোলনের এই ৩৬ দিনে ১৫৪টি অপতথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার।
Data: Rumor Scanner
বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি (১৭টি) অপতথ্য ছড়ায় ১৮ জুলাই। সেদিন সম্পূর্ণ ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির প্রেক্ষিতে ঢাকাসহ ৪৮টি জেলায় বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, পুলিশের গুলি ও হামলার ঘটনা ঘটে। শহীদ হন মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধসহ অন্তত ৪২ জন। শেখ হাসিনার পদত্যাগের আগের তিন দিনও অপতথ্যের ব্যাপক প্রচার ছিল। ০২ আগস্ট শুক্রবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জুমার নামাজের পর ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি পালিত হয় অন্তত ২৮ জেলায়। পরদিন আ’লীগ সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হন শিক্ষার্থীসহ হাজারো জনতা। ০৪ আগস্ট একই দাবিতে সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি শুরু হয়। প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, এদিন ১১৪ জনের মৃত্যু ঘটে। এই তিন দিনেই ৪৩টি অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে।
সময়ে সময়ে বদলেছে অপতথ্যের ধরণ
জুলাইয়ের আন্দোলনে অপতথ্যের ধরণ সময়ের সাথে সাথে বদলাতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। শুরুর দিকে বিক্ষোভ, অবরোধ এবং ক্লাস বর্জনের মতো ঘটনাগুলোয় অপতথ্যের প্রবাহ দেখা যায়নি। ১১ জুলাই যখন আন্দোলন সহিংস রূপ নিতে শুরু করে তখন থেকে মৃত্যুর ভুয়া দাবি আসতে থাকে। ১৫ জুলাই পর্যন্ত ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের সাথে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষ হয়। বিশেষ করে নিজের চীন সফর নিয়ে ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়। এর প্রেক্ষিতে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। রাস্তায় নেমে আসেন শিক্ষার্থীরা। পরদিন দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এতে কোনো মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও বিভিন্ন মাধ্যমে সর্বমোট ১৩ জনের মৃত্যুর ভুয়া দাবি প্রচার করা হয়। এই আন্দোলনে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৬ জুলাই। এরপর প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর এসেছে গণমাধ্যমে। মৃত্যুর বাস্তব ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর মৃত্যু সংক্রান্ত ভুয়া দাবিগুলো কমতে শুরু করে। ১৬ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের মৃত্যুর দাবি প্রচার হলেও পরের দিনগুলোয় তৎকালীন সরকার পক্ষের ব্যক্তিদেরও মৃত্যুর ভুয়া দাবি ছড়াতে দেখা গেছে। ১৬ জুলাইতেই অন্তত দুইজন ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যুর দাবি আসে রিউমর স্ক্যানারের কাছে। যাচাই করে দেখা যায়, দুটো দাবিই ভুয়া।
Collage: Rumor Scanner
১৬ জুলাই একটি বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে কিছু ব্যক্তিদের ফেলে দেওয়ার একটি ভিডিও বেশ ভাইরাল হয় যেটি ব্যবহার করে দাবি করা হয়, বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে শিক্ষার্থীদের ফেলে দিচ্ছে ছাত্রলীগ। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, চট্টগ্রামে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী পরিচয়ধারীদের কর্তৃক ছাত্রলীগের কর্মীদের ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য ছিল এটি।
আগেরদিন ঢাবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনার প্রেক্ষিতে এক নারী শিক্ষার্থীর ছবি ভাইরাল হয় ফেসবুকে। দাবি করা হচ্ছিল, তিনি নিহত হয়েছেন। তবে রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখে, সানজিদা আহমেদ তন্নি নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী সহিংসতায় আহত হলেও পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
Collage: Rumor Scanner
মৃত্যুর এমন ভুয়া দাবিগুলোর মধ্যে গণমাধ্যমকে জড়িয়ে মৃত্যুর সম্মিলিত সংখ্যা নিয়ে ভুয়া দাবিও ছড়িয়েছে। এই আন্দোলনে ৯০০ জন মারা গেছেন দাবিতে ২২ জুলাই এবং এই সংখ্যা ১৭০০ ছাড়িয়েছে দাবিতে ২৪ জুলাই জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো’কে সূত্র হিসেবে দেখিয়ে প্রচার করা হয়। তবে প্রথম আলো’য় সে সময় (২৪ জুলাই) মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখ ছিল ২০৪ জন। আবার ২২ জুলাই আরেক জাতীয় দৈনিক কালবেলা’কে সূত্র হিসেবে দেখিয়ে প্রচার করা হয়, রাজধানীর হাতিরঝিল লেকে ১০০ ছাত্রের লাশ পাওয়া গেছে। যাচাইয়ে দেখা যায়, এ সংক্রান্ত দাবিতে যে ভিডিও ব্যবহার করা হয়েছে তা পুরোনো এবং ভিন্ন প্রসঙ্গের।
Collage: Rumor Scanner
১৬ জুলাই নারীদের ধর্ষণ সংক্রান্ত অন্তত দুইটি দাবি প্রচার হতে দেখা যায়। কোনো কোনো ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হয়, ঢাবির রোকেয়া হলে ২৭ জন নারী শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আবার কোনো পোস্টে একই দাবির ঘটনা রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বলে উল্লেখ করা হয়। আদতে এমন কিছুই ঘটেনি। একইদিন ‘সঞ্চিতা পাল দেবী’ নামের একটি ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্টের ভিত্তিতে তাকে ছাত্রলীগের কথিত নেত্রী পরিচয় দিয়ে তিনি কোটা আন্দোলনরত ছাত্রীদের প্রকাশ্যে গণধর্ষণের হুমকি দিয়েছেন শীর্ষক দাবিও প্রচার করা হয়। আগস্টে ছাত্রলীগ নেত্রী আতিকা বিনতে হোসাইনের নামে ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ক্রমাগত অশ্লীল কনটেন্ট পোস্ট করা হয়।
১৭ জুলাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কক্ষ ভাঙচুর করে শিক্ষার্থীরা। এরই প্রেক্ষিতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের শিক্ষার্থীদের কক্ষ থেকে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার দাবিতে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। আদতে এসব অস্ত্র ও মদের বোতল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। ১৮ জুলাই ছাত্রলীগ নেত্রীর করুণ অবস্থার দৃশ্য দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মৌন প্রতিবাদমূলক নাটকে অভিনয়ের পুরোনো ভিডিও প্রচার করা হয়। এই ভিডিও দিয়ে চলতি বছরও ভুয়া দাবি প্রচার করা হয়েছে। এমন অপতথ্যের পরিমাণ ক্রমশই বাড়ছিল। ছিল ভিত্তিহীন দাবির প্রচারও। যেমন, ২৭ জুলাই প্রচার করা হয়, কোটা আন্দোলনে ছয় নেতা আটকের সময় তাদের হোটেল কক্ষ থেকে ৪৫ লাখ টাকা ও ৯ টি দেশিয় অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। অথচ এমন কিছুই ঘটেনি। অপপ্রচার চলেছে অভ্যুত্থানের আগের দিনও। ০৪ আগস্ট মধ্যরাত থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সে সময়ের সমন্বয়ক সারজিস আলমের নামে যমুনা টিভি ও কালবেলা’র আদলে তৈরি ফটোকার্ড ব্যবহার করে দাবি করা হয়, সারজিসের বাসা থেকে দুই কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখে, ফটোকার্ড দুটিই ভুয়া।
Collage: Rumor Scanner
এই আন্দোলনে তৎকালীন সরকার এবং আন্দোলনকারীদের বাইরে রাজনৈতিক বিভিন্ন দল নিয়েও অপতথ্যের প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। ১৭ জুলাই বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর কোটা বিরোধী আন্দোলনের বিষয়ে নওমি নামে এক ব্যক্তির সাথে ফোনালাপ শীর্ষক দাবিতে ২০১৮ সালের একটি কথিত অডিও ক্লিপ প্রচার করা হয়। ১৮ জুলাই ফেসবুকে একাধিক ডিজিটাল ব্যানার পোস্ট করে দাবি করা হয়, নারী কোটা বাতিলসহ চাকরিতে নারীদের প্রত্যাহার ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য ৩০% কোটা চেয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। আদতে দলটির পক্ষ থেকে এমন কোনো দাবিই করা হয়নি।
Collage: Rumor Scanner
জুলাই জুড়ে অপতথ্যের প্রচারে ব্যবহার হতে দেখা যায় বিদেশি বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব এবং ভিন্ন ঘটনার ভিডিও ফুটেজও। ১৭ জুলাই ফেসবুকের বিভিন্ন পোস্টে দাবি করা হয়, আন্দোলন ইস্যুতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ড ও বলিউড অভিনেতা ইমরান হাশমি ফেসবুকে এবং ভারতীয় ইউটিউবার ধ্রুব রাঠি এক্সে পোস্ট করেছেন। তবে দাবিগুলো ছিল ভুয়া। ১৮ জুলাই একাধিক পোস্টে দাবি করা হয়, ৭২ ঘন্টার মধ্যে আন্দোলন কেন্দ্রিক সহিংস পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বাংলাদেশ সরকারকে ইউনেস্কোর তরফ থেকে বহিষ্কার করা হবে। অথচ এমন কোনো ঘোষণাই আসেনি সংস্থাটির পক্ষ থেকে। ১৮ জুলাই একটি ভিডিও দিয়ে দাবি করা হয়, বিদেশি নারী সংবাদ উপস্থাপিকা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সংঘাতের ভিডিও দেখে কেঁদেছেন। রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যাওয়া এই ভিডিও যাচাই করে দেখা যায়, ২০১৯ সালে সিরিয়ার একটি সংবাদ পাঠের সময় পাঠিকার কান্নার দৃশ্যের ভিডিও এটি। ২৭ জুলাই দাবি করা হয়, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সমর্থন করে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইতালির রাষ্ট্রদূত আন্তোনিও আলেসান্দ্রো তার এক্স অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন। রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখে, আলেসান্দ্রোর নামে চালু থাকা ভুয়া এক্স অ্যাকাউন্টের পোস্টকে রাষ্ট্রদূতের আসল পোস্ট দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। ২৫ জুলাই একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়, পাকিস্তানিরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে মিছিল করেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভিডিওটি ২০২২ সালের ভিন্ন ঘটনার।
Collage: Rumor Scanner
প্রশাসনের ব্যক্তিদের নিয়েও এই আন্দোলনে অপতথ্যের প্রচার ছিল। ৩০ জুলাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি করা হয়, সেদিন সরকার ঘোষিত রাষ্ট্রীয় শোক পালনে অস্বীকৃতি জানায় ১০০ জন সরকারি কর্মকর্তা। মূলত, ভিত্তিহীন ভাবে ভুয়া দাবিটি ছড়িয়েছিল।
কয়েক সপ্তাহের এই বিক্ষোভ আগস্টে গিয়ে আরো জনমুখী আন্দোলনে রূপ নেয়। এ সময় নির্দিষ্ট কোনো ধরণে আটকে ছিল না অপতথ্যের প্রবাহ। ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মিথ্যা দাবি, যুবলীগ নেতার পুরোনো ছবিকে শিবিরের বলে প্রচার, ভুয়া ফটোকার্ডের মাধ্যমে ছাত্রলীগের নেতাদের নামে অপপ্রচারের ঘটনা দেখা গেছে এই দিনগুলোয়। যেমন ০৩ আগস্ট একটি গণমাধ্যমের আদলে তৈরি ফটোকার্ডের মাধ্যমে প্রচার করা হয়, বোরকা পড়ে ঢাকা ছেড়েছেন ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম ও ইনান। পরদিন আবার একই কায়দায় আরেকটি গণমাধ্যমকে জড়িয়ে প্রচার করা হয়, মাঠের কর্মসূচি রেখে ভারতে পালালেন ছাত্রলীগের ৪ নেতা সাদ্দাম, ইনান, সৈকত ও শয়ন। প্রকৃতপক্ষে, এই দুইটি ফটোকার্ডই ছিল ভুয়া। শেষদিকে এসে নিজেদের কর্মসূচী স্থগিতের ভুয়া দাবিরও শিকার হতে হয়েছে সরকার এবং আন্দোলনকারী দুই পক্ষকেই।
Collage: Rumor Scanner
দায়িত্বশীল জায়গা থেকেও হয়েছে অপতথ্যের প্রচার
৩৬ দিনের টানা আন্দোলনে সাধারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা যেমন অপতথ্যের প্রচারে শামিল ছিলেন, তেমনি দায়িত্বশীল অনেক জায়গা থেকেও এসেছে অপতথ্য। এমনকি একাধিক গণমাধ্যমকেও ভুয়া তথ্যের প্রচার করতে দেখা গেছে। ১১ জুলাই “কুবি শিক্ষার্থীদের পেটাচ্ছে পুলিশ, ভিডিও করছেন প্রক্টর” শীর্ষক দাবিতে একটি ছবি একটি গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। অথচ, তিনি প্রক্টর ছিলেন না, ছিলেন ক্যাম্পাসের একজন সাংবাদিক। আন্দোলনে ভুয়া তথ্যের প্রচার করেছে এমন তালিকায় থাকা গণমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস (১টি), ফেস দ্যা পিপল (২টি), ঢাকা পোস্ট (১টি), বাহান্ন নিউজ (১টি)। অপতথ্য প্রচারে সরব ছিল ভারতীয় গণমাধ্যমও। ২১ জুলাই ‘ইন্ডিয়া টুডে এনই’তে দাবি করা হয়, “শেখ হাসিনাকে ঢাকায় তার বাসভবন থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার বর্তমান অবস্থান অজানা রয়ে গেছে।” অথচ সেদিন তিনি ঢাকাতেই ছিলেন।
তবে সবচেয়ে চমক হয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে প্রচার হওয়া একটি ভুল তথ্য। ১৫ জুলাই নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার দাবি করেন, তাদের তথ্যমতে এই বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত ২ জন নিহত হয়েছে। রিউমর স্ক্যানার তাৎক্ষনিক মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করে। আলোচিত দাবিটির সূত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র দফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, “আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি এবং ঢাকার মিডিয়া ও যোগাযোগের উপর নির্ভর করছি।” অথচ মিলারের বক্তব্যের পূর্বে গণমাধ্যমে মৃত্যুর কোনো তথ্যই আসেনি। অথচ মিলারের বক্তব্যের পূর্বে গণমাধ্যমে মৃত্যুর কোনো তথ্যই আসেনি।
Collage: Rumor Scanner
আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃস্থানীয় পর্যায় থেকেও যেমন অপতথ্যের প্রচার ছিল তেমনি দলগুলোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্লাটফর্মগুলোও হয়ে উঠেছিল অপতথ্যের সূত্র। এই আন্দোলনে প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও সমর্থন ছিল। তারা এর সমর্থনে বাংলাদেশ বৈধ পথে টাকা পাঠিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে বিরাট অবদান রাখার বদলে হুন্ডি বা অবৈধ পথে টাকা পাঠানোর ঘোষণা দেন। তার প্রেক্ষিতে ২৮ জুলাই আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়, যেখানে দেখা যায়, একজন চাকরিদাতা তার কর্মীদের বেতন দিয়ে তা বৈধ পথে ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠিয়ে রেমিট্যান্স হিসেবে অবদান রাখতে উৎসাহ দিচ্ছেন এবং এক পর্যায়ে প্রায় সবাই বৈধ পথে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাবেন বলে সায় দেন। তবে যাচাই করে দেখা যায়, ভিডিওটি সে সময়েরই নয়, গত বছরের এপ্রিলের। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের পেজ থেকেও আরো অন্তত চারটি অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ পায় রিউমর স্ক্যানার। পিছিয়ে ছিলেন না দলটির নেতা-নেত্রীরাও। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের সে সময়ের সরকার দলীয় মেয়র তাহসিন বাহার সূচনা কথিত একটি বিজ্ঞপ্তির ছবি দিয়ে ০২ আগস্ট এক ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, তিন সমন্বয়ক পাকিস্তান হাইকমিশনের সহযোগিতা চেয়েছেন। একই দাবি প্রচার করেন ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতও। যাচাই করে দেখা যায়, হাইকমিশন প্রকাশিত ভিন্ন একটি বিজ্ঞপ্তিকে সম্পাদনা করে ভুয়া বিজ্ঞপ্তিটি তৈরি করা হয়েছে।
অন্যদিকে, ছাত্রদলের ফেসবুক পেজ থেকে ২৯ জুলাই ঢাকার মিরপুর-১০ এলাকা আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার দখলে নেওয়ার দৃশ্য দাবিতে একটি ছবি প্রচার করা হয়। আদতে ছবিটি ছিল ১৬ জুলাইয়ের। ৩১ জুলাই ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক এক ফেসবুক পোস্টে ফেস দ্যা পিপলের বরাত দিয়ে দাবি করেন, সেনাবাহিনীর ১৫ জনের বেশি সদস্য পদত্যাগ করেছেন। অথচ ‘ফেস দ্যা পিপল’ এমন কোনো তথ্যই প্রচার করেনি।
কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতনের সময়কালে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠন। জুলাইতে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ৬৫ সদস্যের একটি সমন্বয়ক কমিটি গঠনের মাধ্যমে এই সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করেন। এই সংগঠনের অফিশিয়াল ফেসবুক গ্রুপ থেকেও অপতথ্য প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। ০৩ আগস্ট এক পোস্টে আরটিভির ডিজাইন সম্বলিত ফটোকার্ডের মাধ্যমে দাবি করা হয়, “রাজধানীতে আজ থেকেই মিষ্টির দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।” আদতে এমন কোনো সংবাদ দেয়নি গণমাধ্যমটি। একই গ্রুপের আরেক পোস্টে দাবি করা হয়, ০৩ আগস্ট কুমিল্লায় হামলায় ১২ জন শহীদ হয়েছেন। সংগঠনটির সে সময়ের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ০৩ আগস্ট ঢাকায় এক সমাবেশেও একই ঘটনা নিয়ে দাবি করেন, কুমিল্লায় একজন শহীদ হয়েছে। তবে যাচাই করে দেখা যায়, কুমিল্লায় সেদিনের বিক্ষোভ মিছিলকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি গুরুতর আহত হলেও কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।
Collage: Rumor Scanner
শহীদ-সম্মুখ সারির ব্যক্তিদের নিয়েও অপতথ্য
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’কে জড়িয়ে নিয়মিত অপতথ্যের প্রচার ছিল আন্দোলনের দিনগুলোয়। ২২ জুলাই প্রচার করা হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি মারা গেছেন। দাবিটি ছিল ভুয়া। সংগঠনটির বর্তমান মুখপাত্র সিনথিয়া জাহিন আয়েশাও ২২ জুলাই মারা গেছেন বলে ভুয়া দাবি প্রচার হয় সামাজিক মাধ্যমে।
Collage: Rumor Scanner
আন্দোলনে সংঘর্ষে ১৮ জুলাই ফারহান ফাইয়াজ নামে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের এক শিক্ষার্থী নিহত হন। তাকে নিয়ে সেদিনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘কালবেলা’র বরাত দিয়ে প্রচার করা হয়, ফারহান ফাইয়াজের টিউশন শিক্ষক শিবির কর্মী এবং ফারহানকে খুনের সঙ্গে তার শিক্ষক জড়িত। অথচ কালবেলা এমন কোনো সংবাদই দেয়নি। একইদিন ঢাকার উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র মীর মাহফুজুর রহমান (মুগ্ধ)। পরবর্তীতে ফেসবুকে একজন নারীর সাক্ষাৎকারের ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়, তিনি মুগ্ধ এর মা। তবে যাচাই করে দেখা যায়, তিনি আন্দোলনের আরেক শহীদ তাহির জামান প্রিয় এর মা।
০৪ আগস্ট আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও বাকের মজুমদারের ছবি যুক্ত করে ‘বোরকা পড়ে ঢাকা ছাড়লেন তিন সমন্বয়ক’ শীর্ষক শিরোনামে ‘কালবেলা’র ফটোকার্ডের ডিজাইন সম্বলিত একটি ফটোকার্ড প্রচার করা হয়। একইদিন আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলমের বাসা থেকে দুই কোটি টাকা উদ্ধার দাবিতে যমুনা টিভি ও কালবেলার আদলে তৈরি ফটোকার্ড প্রচার করা হয়। এসব ফটোকার্ড ছিল ভুয়া।
আন্দোলন পরিণতি পেলেও থামেনি অপতথ্য
০৫ আগস্ট টানা আন্দোলনের ফলাফল পায় ছাত্র-জনতা। শেখ হাসিনা বিদায় নেন মসনদ ছেড়ে। আন্দোলন পায় সফল পরিণতি। কিন্তু এরপরও থামেনি এই আন্দোলন নিয়ে অপতথ্যের প্রচার ও প্রসার৷ অভ্যুত্থানের এক বছর পর এসেও আন্দোলন নিয়ে নিয়মিত বিরতিতে অপতথ্যের প্রচার লক্ষ্য করেছে রিউমর স্ক্যানার। আ’লীগ সরকার পতন পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলনকে জড়িয়ে প্রচার হওয়া ৩৩টি অপতথ্য (৩১ জুলাই পর্যন্ত) শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
Collage: Rumor Scanner
এসব অপতথ্যের সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছেন রংপুরে শহীদ হওয়া শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। এর শুরুটা হয় ০৬ আগস্ট। সেদিন আবু সাঈদের কবরে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় সম্মান জানাচ্ছে দাবিতে একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে যাচাই করে দেখা যায়, এই ভিডিও আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পূর্ব থেকেই অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। গত ২৮ জুলাই পর্যন্ত তাকে নিয়ে আরো অন্তত ১৩টি অপতথ্যের প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। এগুলোর মধ্যে শেখ হাসিনার একটি ভুয়া দাবিও রয়েছে। ২৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে আবু সাঈদের মৃত্যু নিয়ে শেখ হাসিনার একটি অডিও রেকর্ড প্রচার করা হয়। সেখানে তিনি দাবি করেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর আবু সাঈদকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। তবে দাবিটি অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার জানতে পারে, ১৬ জুলাই দুপুর ২.১৮ মিনিটে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিস্তেজ হয়ে রাস্তায় ঢলে পড়ার পরই আবু সাঈদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয় এবং তিনটার দিকেই রিকশা করে তাকে হাসপাতালে পৌছাঁনো হয়।
২০ নভেম্বর সামাজিক মাধ্যমে দাবি করা হয়, মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ (মুগ্ধর ভাই) আসলে একই ব্যক্তি এবং মুগ্ধ নামে কেউ ছিল না। তবে যাচাইয়ে দাবিটি ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়।
আগস্টে সরকার পতনের পরপরই একটি দাবি বেশ ভাইরাল হয়। পাবনায় আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাফিউল ইসলাম রাফি নামের একজন মৃত্যুবরণ করেছেন এবং মারা যাওয়ার সময় সে তার বাবা নেই ও ছোটবোনকে দেখে রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন বলে ফেসবুকে দাবি করা হয়। তবে যাচাই করে দেখা যায়, রাফি গুলিবিদ্ধ হলেও পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে ওঠেন। রাফির মা নেই, তবে বাবা বেঁচে আছেন৷ ছোট বোনকে দেখে রাখার বিষয়েও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
গত জানুয়ারিতে ঢাবির বর্তমান প্রো-ভিসি ড. মামুন আহমেদ এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে একটি ফোনালাপের অডিও রেকর্ড ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। দাবি করা হয়, এটি গত জুলাই আন্দোলনে দিকনির্দেশনার ফোনালাপ। ফ্যাক্টচেক করে জানা যায়, এটি ২০১৮ সালের ঘটনা।
অভ্যুত্থান পরবর্তী বিভিন্ন সময়েই পুলিশকে নিয়ে একটি অপতথ্য বেশ কয়েকবার প্রচার হয়েছে। দাবি করা হয়ে থাকে, ০৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে ১৫ জন নিহত পুলিশ সদস্যের মধ্যে একজন গর্ভবতী নারী পুলিশ সদস্য ছিলেন এবং তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই দাবিতে এক নারী পুলিশ সদস্যের ছবিও প্রচার করা হয়। ১০ আগস্ট প্রথম দাবিটি প্রকাশ্যে আসার পরদিনই এ বিষয়ে ফ্যাক্টচেক করে রিউমর স্ক্যানার জানায়, নিহত ১৫ জন পুলিশ সদস্যের মধ্যে কেউ নারী ছিলেন না এবং প্রচারিত ছবিটি ভিন্ন এক নারী পুলিশ সদস্যের। পৃথিবী চাকমা নামের এই নারী পুলিশ সদস্য বর্তমানে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত। গত এপ্রিলেও একই দাবি এআই দিয়ে তৈরি ছবির মাধ্যমে প্রচার হয়েছে ফেসবুকে।
গত ১৪ অক্টোবর ফেসবুক আওয়ামী লীগের পেজ থেকে দাবি করা হয়, জুলাই-আগস্টে হওয়া উক্ত আন্দোলনে নিহত পুলিশের সংখ্যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশের সদর দপ্তর প্রকাশ করেনি। অথচ ১৮ আগস্টই নিহত পুলিশ সদস্যদের তালিকা প্রকাশ করে পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকা অনুযায়ী, ২০ জুলাই থেকে ১৪ আগস্টের মধ্যে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন। এর আগে অক্টোবরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদভিত্তিক ম্যাগাজিন ‘টাইম’ এর বরাতে দাবি করা হয়, আন্দোলনের সময় ছাত্রদের দ্বারা ৩২০৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। অথচ ‘টাইম’ এমন কোনো তথ্যই প্রকাশ করেনি।
গত ডিসেম্বর থেকে তিনটি আলাদা দাবি নজরে আসে রিউমর স্ক্যানারের, যেগুলোতে বলা হচ্ছিল আন্দোলনে শহীদ হওয়া ভোলার নয়ন, কুমিল্লার দাউদকান্দিতে আব্দুল্লাহ মাহবুব নামে একজন এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাকিব নামে এক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর ফিরে এসেছে। এই তিনটি দাবিই ভুয়া বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
অপতথ্যের লাগামে নিরন্তর চেষ্টা
একটি বড় ইস্যু যখন সামনে আসে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাকে ঘিরে গুজবের প্রচার ও প্রসার ঘটে। তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই পূর্ব অভিজ্ঞতা রিউমর স্ক্যানার কাজে লাগিয়েছে কোটা আন্দোলন ইস্যুতেও। আমরা শুরু থেকেই এই আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্রুততম সময়ে ভুয়া তথ্যের ফ্যাক্টচেক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রস্ততিও ছিল টিমের সদস্যদের। ওয়েবসাইটে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হওয়ায় তিনটি পন্থার প্রয়োগ করে রিউমর স্ক্যানার।
প্রথমত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্লাটফর্মগুলোয় তাৎক্ষণিক ফ্যাক্টচেকের সারসংক্ষেপ পোস্ট করা হতো। যেমন, ১৮ জুলাই বিএনপি নেতা আমির খসরুর নামে কথিত কলরেকর্ডের দাবিটি ছড়িয়ে পড়ার পর তাৎক্ষণিক তা যাচাই করে গ্রুপে পোস্ট করা হয়৷ তবে ওয়েবসাইটে তা প্রকাশিত হয় ৩০ জুলাই।
Screenshot: Facebook
শুধু ফ্যাক্টচেকই নয়, চাহিদা অনুযায়ী খবরও জানানো হতো রিউমর স্ক্যানারের গ্রুপে। যেমন, ১৬ জুলাই আবু সাঈদের মৃত্যুর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে গ্রুপে পোস্ট করা হয়েছিল সেদিন দুপুরেই৷
দ্বিতীয়ত, ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আমলে নিয়ে দ্রুততম সময়ে ফ্যাক্টচেক প্রকাশের জন্য রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে প্রথমবারের মতো লাইভ আপডেট ফিড চালু করা হয়। আন্দোলন নিয়ে সময়ে সময়ে ছড়িয়ে পড়া ভুল তথ্যের ফ্যাক্ট এবং এই আন্দোলন ঘিরে বিভিন্ন হালনাগাদ তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে এই ব্যবস্থা করেছিল রিউমর স্ক্যানার। নির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে এই আন্দোলনে মৃত্যুর সংখ্যাও প্রতিদিন হালনাগাদ করা হতো এই পাতায়। ০৫ আগস্ট সকাল পর্যন্ত এই ফিড চালু রাখা হয়।
Collage: Rumor Scanner
তৃতীয়ত, রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটের ফ্যাক্টচেকের প্রথাগত ফরমেট বদলে সংক্ষিপ্তকরণের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে ফ্যাক্টচেক প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
তবে এমন উদ্যোগগুলোর পরও বাধাগ্রস্ত হয়েছে ফ্যাক্টচেকিং কার্যক্রম। জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময়ে অন্তত পাঁচবার ইন্টারনেট শাটডাউনের ঘটনা ঘটেছে। কখনো নির্দিষ্ট এলাকায়, কখনো-বা সারাদেশে একযোগে মোবাইল এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল এ সময়গুলোয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ জুলাই থেকে ০৫ আগস্টের মধ্যে পাঁচ দফায় ২২ দিন ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা ঘটেছে। নিয়ন্ত্রণ ছিল ভিপিএনের ওপরও। ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হওয়ায় তাৎক্ষণিক ভুল তথ্য শনাক্তে বেগ পেতে হয় ফ্যাক্টচেকারদের।
কাজের পদ্ধতি
এই গবেষণাটি রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর উপর ভিত্তি করে প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশের নিমিত্তে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন, ফেসবুকে রিউমর স্ক্যানারের প্লাটফর্মগুলোর পোস্টের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে একটি নির্দিষ্ট ডাটাবেজের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এরপর তথ্য-উপাত্তগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ঘটনার সাথে দাবির সম্পর্ক খুঁজে বের করতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সে সময়ের প্রতিবেদনগুলোও। পরবর্তীতে সেসব তথ্য-উপাত্ত পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে কয়েক ভাগে ভাগ করে ইনফোগ্রাফ, স্ক্রিনশট কোলাজ এবং লেখার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।
গত ১লা আগস্ট, “আমরা এই মুহুর্তে উত্তপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হঠাৎ একশনে ছাত্রলীগ, জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে হলে প্রবেশ করলো ছাত্রলীগের নেতারা, এক ধাওয়াতে মাঠ দখল ছাত্রলীগের।” ক্যাপশনে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটি সাম্প্রতিক সময়ের নয় বরং, এটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই ঢাবি ক্যাম্পাসের উত্তপ্ত পরিস্থিতির ভিডিও।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে ভিডিওটির কিছু কী-ফ্রেম রিভার্স সার্চ করে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম ‘somoynews.tv’ এর ফেসবুক পেজে ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই ‘উত্তপ্ত ঢাবি ক্যাম্পাস #quotamovement2024 #quotaprotest #somoytv #shorts #reels’ ক্যাপশনে প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির হুবহু মিল রয়েছে।
Comparison: Rumor Scanner
পরবর্তীতে, ‘MD Nayem’ নামক একজন সাংবাদিকের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই “উত্তপ্ত ঢাবি ক্যাম্পাস #ALjazerra #Bbcnews #CNN #TheWashingtonPost #TheNewYorkTimes #TheGuardian #BBC #AlJazeeraEnglish #TheWallStreetJournal #CNBC #DhruvRathee #UnitedNations #NewYorkTimesOpinion #ABCNews #NewYorkPost #ProjectNightfall
#AbhiandNiyu #DhakaUniversityUnderAttack #DUUnderAttack #QuotaReformMovement #Save_Bangladeshi_Students” ক্যাপশনে একই ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়।
এছাড়া, সেসময় একই ভিডিওটি বিভিন্ন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট (১, ২, ৩, ৪, ৫) হতে দেখা যায়।
সুতরাং, ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তপ্ত পরিস্থিতির ভিডিওকে সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগের মাঠ দখলের দৃশ্য দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
সম্প্রতি, ‘বিকেলে রাজধানীতে মিছিল করে জাতীয় পার্টি-আর সন্ধ্যায় কাকরাইল জাতীয় পার্টির অফিসে আ’গুন দেয় এনসিপি…!’ ক্যাপশনে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে।
অর্থাৎ, দাবি করা হচ্ছে গত ২ আগস্ট বিকেলে জাতীয় পার্টি রাজধানীতে মিছিল করে, আর সন্ধ্যায় কাকরাইলে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা-কর্মীরা আগুন ধরিয়ে দেয়।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটি গতকাল ২ আগস্টের (শনিবার) নয়। প্রকৃতপক্ষে, এটি ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের ভিডিওটি। এদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি।
একই তারিখে একই দাবিতে ভিডিওটি ফেসবুকে বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে প্রচার হতে দেখা যায়। দেখুন – এখানে, এখানে, এখানে, এখানে।
উক্ত পোস্টগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সূত্র প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড সার্চ করে মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর ওয়েবসাইট (১,২,৩) ও ইউটিউব চ্যানেলে (১,২,৩) সেই সময় প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর ঢাকার কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২০৪ সালের ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যার দিকে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র, শ্রমিক ও জনতা’র ব্যানারে একদল লোক একটি মিছিল নিয়ে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে যান। সেখানে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। এরপর তাঁদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির কর্মীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে ওই কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। তবে, পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেন দুই পক্ষই। জাতীয় পার্টি দাবি করেছে, তাদের ওপর আগে হামলা হয়েছে। অন্যদিকে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র, শ্রমিক ও জনতার ব্যানারে যাওয়া ব্যক্তিরা দাবি করেছেন, তাঁদের ওপর আগে হামলা করেন জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা।
ডেইলি স্টার -এর বাংলা ওয়েবসাইটে এই বিষয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডিউটি অফিসার রাশেদ বিন খালেদ ডেইলি স্টারকে জানান, সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটের দিকে (২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর) তারা কল পান এবং ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট আগুন নেভাতে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে যায়। এর আগে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘জাতীয় বেঈমান জাতীয় পার্টি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিজয়নগরে আমাদের ভাইদের পিটিয়েছে, অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। এবার জাতীয় বেঈমানদের উৎখাত নিশ্চিত।’
বাংলা ট্রিবিউন -এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যার পর রাজধানীর বিজয়নগরে জাতীয় পার্টির (জাপা) কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন দিয়েছে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-শ্রমিক-জনতা। সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাজু ভাস্কর্য এলাকায় ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-শ্রমিক-জনতার’ ব্যানারে মশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিল শেষে জাপাকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দেওয়ার পর কার্যালয় ঘেরাও করতে কাকরাইলের বিজয়নগর এলাকায় আসেন তারা। এসময় দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়।
সুতরাং, ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের ভিডিওকে গত ২ আগস্ট কাকরাইলে জাতীয় পার্টির অফিসে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আগুন দিয়েছে দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।
সম্প্রতি ‘কি মামা খেলা তো শুরু হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের আওয়ামী লীগের সকল কর্মীরা মাঠে নেমে গেছেন এখন আওয়ামী লীগ আমরা ক্ষমতায় আসতে চলেছে’ ক্যাপশনে ক্ষমতাচ্যুত ও দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক মিছিল দাবিতে একটি ভিডিও ইন্টারনেটের বিভিন্ন প্লাটফর্মে প্রচার করা হয়েছে।
উক্ত দাবিতে টিকটকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)৷
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক সময়ের কোনো মিছিলের নয় বরং, ২০২২ সালে দলটির একটি বিক্ষোভ মিছিলের ভিডিও উক্ত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম সময় টিভির ইউটিউব চ্যানেলে ২০২২ সালের ১৭ আগস্ট ‘প্রায় আড়াই বছর পর রাজপথে আওয়ামী লীগ!’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
Comparison: Rumor Scanner
ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এটির ০০:০১ থেকে ০০:৩২ সেকেন্ড পর্যন্ত অংশটি আলোচিত ভিডিওতে ব্যবহার করা হয়েছে।
ভিডিওটির বিস্তারিত বিবরণী থেকে জানা যায়, সেদিন ২০০৫ সালে সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলার প্রতিবাদে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ড থেকে আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী এ কর্মসূচিতে সমবেত হয়।
পরবর্তীতে, অনলাইন গণমাধ্যম Bangla News 24 এর ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ১৭ আগস্ট ‘দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকেও সেদিন ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশটি সম্পর্কে একই তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
সুতরাং, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মিছিলের ভিডিও দাবিতে দলটির ২০২২ সালের একটি বিক্ষোভ মিছিলের ভিডিও প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।
গত ৩১ জুলাই থেকে নেত্রকোনা-৩ (কেন্দুয়া-আটপাড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু কারাগারে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন- শীর্ষক একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, নেত্রকোনা-০৩ (কেন্দুয়া-আটপাড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু কারাগারে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাওয়ার দাবিটি সঠিক নয় বরং, গত ২৮ জুলাই তিনি ঢাকার নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেছেন তার পরিবারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে যুগান্তরের ওয়েবসাইটে গত ২৮ জুলাই “নেত্রকোনা-৩ আসনের সাবেক এমপি পিন্টু আর নেই” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, সাবেক এমপি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতায় ভুগছিলেন। এ অবস্থায় গত ২৮ জুলাই তিনি ঢাকার নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন তিনি।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, গত ৩১ জুলাই কারা অধিদপ্তরের মিডিয়া বিভাগের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক জান্নাত উল ফরহাদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নেত্রকোনা-৩ (কেন্দুয়া-আটপাড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার পিন্টুর কারাগারে মৃত্যু খবরটি সঠিক নয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নেত্রকোনা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইফতিকার উদ্দিন তালকদার পিন্টুর কারাগারে মৃত্যুর খবরটি সঠিক নয়। তিনি কারাগারে আটক ছিলেন না। বিষয়টি গুজব।
বিষয়টি অধিকতর যাচাইয়ের জন্য সদ্য প্রয়াত সাবেক সংসদ সদস্য ইফতিকার উদ্দিন তালকদার পিন্টুর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম।
ইফতিকার উদ্দিন তালকদার পিন্টুর ভাগ্নে জাকির হোসেন প্রবাল বলেন, ‘০৫ আগস্টের পর তিনি কারাগারে যাননি। অনেকদিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন। পরবর্তীতে বাসায় (ভাড়া বাসা) মৃত্যুবরণ করেন। কারাগারে মৃত্যুর যে বিষয়টি প্রচার করা হচ্ছে তা মিথ্যা।’
সুতরাং, নেত্রকোনা-০৩ (কেন্দুয়া-আটপাড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু কারাগারে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, “জুলাই আহতদের নামে রাস্তা অবরোধকারীরা সবাই মাদকাশক্ত, মাদকের টাকার জন্যই আন্দোলন” স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর- শীর্ষক তথ্যে বা শিরোনামে আরটিভি কোনো সংবাদ বা ফটোকার্ড প্রকাশ করেনি, এমনকি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও এসংক্রান্ত কোনো মন্তব্য করেননি। প্রকৃতপক্ষে, ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় আরটিভি ডিজাইন নকল করে আলোচিত ফটোকার্ডটি তৈরি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত ফটোকার্ডটি পর্যবেক্ষণ করলে তাতে আরটিভির লোগো ও ফটোকার্ডটি প্রচারের তারিখ হিসেবে ০১ আগস্ট, ২০২৫ উল্লেখ থাকতে দেখা যায়। উক্ত সূত্র ধরে অনুসন্ধানে আরটিভির ফেসবুক পেজ (১,২), ইউটিউব চ্যানেল এবং ওয়েবসাইটে এসংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এছাড়া আলোচিত ফটোকার্ডে ব্যবহৃত ফন্টের সাথে আরটিভি কর্তৃক প্রকাশিত ফটোকার্ডে ব্যবহৃত ফন্টের অমিল লক্ষ্য করা যায়।
Photocard Comparison By Rumor Scanner
পাশাপাশি, প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে অন্যকোনো গণমাধ্যমেও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এমন বক্তব্য দেওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, “জুলাই আহতদের নামে রাস্তা অবরোধকারীরা সবাই মাদকাশক্ত, মাদকের টাকার জন্যই আন্দোলন” স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর- শীর্ষক তথ্যে বা শিরোনামে আরটিভির নামে প্রচারিত ফটোকার্ডটি ভুয়া ও বানোয়াট।
গত ১৬ জুলাই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ব্যান্ড কোল্ডপ্লের একটি কনসার্টে এক অস্বস্তিকর ঘটনার জন্ম দেন মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাস্ট্রোনোমার কোম্পানির সিইও অ্যান্ডি বায়রন। কনসার্ট চলাকালীন তিনি নিজ কোম্পানির এইচআর-প্রধান এক নারী কর্মকর্তাকে জড়িয়ে ধরেন। এরই প্রেক্ষিতে অ্যান্ডি বায়রনের পরিবার দাবিতে একটি তুলনামূলক ছবি ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে।
উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ছবিটি অ্যান্ডি বায়রনের স্ত্রী’র নয়। প্রকৃতপক্ষে, পরিবারসহ প্রচারিত ছবিতে থাকা নারীর নাম এলিনা সালিয়াখোভা এবং তিনি একজন রুশ ইনফ্লুয়েন্সার। উল্লেখ্য, অ্যান্ডি বায়রনের স্ত্রী’র নাম মেগান কেরিগান।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে কোল্ডপ্লের কনসার্টে আলোচিত ঘটনা বিষয়ে বিস্তারিত জানতে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে “কোল্ড প্লে কনসার্টের ভিডিও ভাইরালের পর প্রধান নির্বাহীকে ছুটিতে পাঠিয়েছে মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি” শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদনটিতে ভিডিওতে থাকা পুরুষ ব্যক্তিকে অ্যাস্ট্রোনোমারের সিইও অ্যান্ডি বাইরন এবং নারীকে কোম্পানির চিফ পিপল অফিসার ক্রিস্টিন ক্যাবট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
পরবর্তীতে, অ্যান্ডি বাইরনের স্ত্রী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘New York Post’ এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। ‘Ex-Astronomer CEO Andy Byron’s wife holed up in $2.4M mansion since husband was caught canoodling with HR exec at Coldplay concert’ শিরোনামে প্রকাশিত উক্ত প্রতিবেদেনটিতে, অ্যান্ডি বায়রনের স্ত্রী হিসেবে মেগান কেরিগানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং আলোচিত এই ঘটনার পর তিনি (স্ত্রী) অ্যান্ডি বায়রনের থেকে দূরে সরে ২.৪ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রাসাদে আশ্রয় নিয়েছেন।
এছাড়া, অ্যান্ডি বায়রনের স্ত্রীর চেহারার সঙ্গে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবির নারীর চেহারার যথেষ্ট অমিল খুঁজে পাওয়া যায়।
Face Comparison by Rumor Scanner
পরবর্তী অনুসন্ধানে অ্যান্ডি বায়রনের পরিবারের ছবি দাবিতে থাকা নারীর পরিচয় খুঁজে দেখার চেষ্টা করে রিউমর স্ক্যানার টিম। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ছবির নারীর নাম এলিনা সালিয়াখোভা, যিনি একজন রুশ ইনফ্লুয়েন্সার। একটি ভাইরাল ছবির মাধ্যমে ইন্টারনেটে তিনি বেশ পরিচিতি পান। ছবিটিতে তাকে ও তার সন্তানদের একটি বিলাসবহুল ডিনার টেবিলে দেখা যায়, যেটি প্রথম ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরে তার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে প্রকাশ করা হয়েছিল।
অর্থাৎ, ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত এলিনা সালিয়াখোভার নামক এক পরিবারসহ নারীর ছবি অপ্রাসঙ্গিকভাবে মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাস্ট্রোনোমার এর সিইও অ্যান্ডি বায়রনের স্ত্রী দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।