কোটা সংস্কার দাবির পথ ধরে এক দফা: কেমন ছিল আন্দোলনের সময়ে অপতথ্যের প্রবাহ?

  • টানা ৩৬ দিনের আন্দোলনে ১৫৪ অপতথ্য শনাক্ত
  • সবচেয়ে বেশি অপতথ্য ছড়ায় ১৮ জুলাই
  • শহীদ এবং সম্মুখ সারির ব্যক্তিদের নিয়ে নিয়মিত অপতথ্য প্রচার
  • দায়িত্বশীল জায়গা থেকেও ছিল অপতথ্যের প্রচার
  • ইন্টারনেট শাটডাউনে বাধাগ্রস্ত হয় ফ্যাক্টচেকিং কার্যক্রম
  • আন্দোলন নিয়ে অপতথ্যের প্রচার এখনও চলছে

০৫ আগস্ট ২০২৪। সকাল গড়িয়ে দুপুর আসন্ন। চলছিল ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচী। রাজপথে মানুষের জমায়েত বাড়ছিল। এমন প্রক্ষাপটে ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর। রিউমর স্ক্যানারের কাছে এ সংক্রান্ত একটি ছবি আসে যেখানে দেখা যায়, উড়ার অপেক্ষা থাকা একটি হেলিকপ্টারের সামনে কিছু লাগেজ এবং দুইটি গাড়ি। কিছু মানুষের সাথে সেখানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় থাকা এসএসএফ সদস্যদেরও দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্র জানাচ্ছিল, শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন। দুপুর তিনটার কিছু পরে রিউমর স্ক্যানারও নিশ্চিত হয়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটেছে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার দাবির পথ ধরে সংঘর্ষ, হামলা আর শত শত মৃত্যুর একেকটা দিন পেরিয়ে এক দফার দাবিতে এসে স্থির হওয়া এই আন্দোলন যখন পরিণতি পেল, তখন পেছন ফিরে দেখা গেল, আন্দোলনের প্রতিটি দিন অপতথ্যও ছিল নীরব সঙ্গী। সেই দিনগুলোয় এসব অপতথ্য মোকাবিলায় নিরলস কাজ করে গেছে রিউমর স্ক্যানার।

আন্দোলনের দিনগুলোয় দেড় শতাধিক অপতথ্য 

কোটা সংস্কারের দাবিতে গেল বছর আন্দোলন শুরু হয় ৫ জুন। জুলাইতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে সংগঠিত হয় এবং সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের সরকারি বিজ্ঞপ্তি পুনঃবহালের দাবিতে টিএসসিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এরপর আন্দোলনকারীরা দাবি পূরণের জন্য ৪ জুলাই সময়সীমা নির্ধারণ করে। কিন্তু সেদিন আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেনি যা কিনা কোটা বাতিলের ২০১৮ সালের সার্কুলারকে অবৈধ করে দেয়। ফলে শিক্ষার্থীরা সারাদেশে তাদের বিক্ষোভ আরও তীব্র করে। ঠিক সেদিনই এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রথম একটি অপতথ্য প্রচার হতে দেখে রিউমর স্ক্যানার। একটি ডিজিটাল ব্যানারের মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছিল “এই কোটা আন্দোলন আমাকে ফেসবুক ইউটিউবে লাখ লাখ ফলোয়ারস দিয়েছে। চাইলে আমি যে কোন সময়ে বিকাশ/নগদের মাধ্যমে আয় করতে পারছি। তাই আমার চাকুরিতে যাওয়ার ইচ্ছা জাগেনি।” শীর্ষক মন্তব্যটি ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান করেছেন।  

Screenshot: Facebook 

তবে রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখে, রাশেদ খান এমন কোনো মন্তব্য করেননি। জাগোনিউজ২৪ এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রাশেদ খানের ভিন্ন প্রেক্ষিতে করা একটি মন্তব্যকে সম্পাদনা করে আলোচিত মন্তব্যটি প্রথমে হাস্যরসাত্মকভাবে প্রচার করা হলেও পরবর্তীতে তা সত্য ধরে নিয়ে অনেকেই প্রচার করতে থাকে। 

বিক্ষোভ চলতে থাকে পরের দিনগুলোতেও। ১১ জুলাই খবর আসে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করতে যাওয়ার পথে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আহত হন শিক্ষার্থীসহ অন্তত ২০ জন। সেদিনই প্রথম এই আন্দোলনে মৃত্যুর গুজব প্রচার হয়। ১৫ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলনে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ শহীদ হন, যা এই আন্দোলনে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা। সেদিন দ্বিতীয় শহীদ দাবিতে রংপুরের আরেক শিক্ষার্থীর ছবি প্রচার করা হয়। মিফতাহুল জান্নাত মিতা নামে এই শিক্ষার্থীর বড় বোন রিউমর স্ক্যানারকে জানান, মিতা আহত হলেও পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে ওঠেন। 

১৬ জুলাইয়ের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার দলীয় নেতা-কর্মীরা আন্দোলনে আরো বাধা হয়ে আসলে এই লড়াই সহিংসতায় রূপ নেয়। এতে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটে, আহত হন হাজার হাজার মানুষ। দিনগুলোতে অপতথ্যের প্রবাহও ছিল নিত্য সঙ্গী। ১৫ জুলাই থেকে সে মাসের বাকি প্রতিটি দিনই অপতথ্যের প্রবাহ দেখা গেছে। এমনকি ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনার পতনের পূর্ব সময় পর্যন্তও এই আন্দোলন নিয়ে ছড়িয়ে পড়া অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। টানা আন্দোলনের এই ৩৬ দিনে ১৫৪টি অপতথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার। 

Data: Rumor Scanner

বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি (১৭টি) অপতথ্য ছড়ায় ১৮ জুলাই। সেদিন সম্পূর্ণ ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির প্রেক্ষিতে ঢাকাসহ ৪৮টি জেলায় বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, পুলিশের গুলি ও হামলার ঘটনা ঘটে। শহীদ হন মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধসহ অন্তত ৪২ জন। শেখ হাসিনার পদত্যাগের আগের তিন দিনও অপতথ্যের ব্যাপক প্রচার ছিল। ০২ আগস্ট শুক্রবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জুমার নামাজের পর ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি পালিত হয় অন্তত ২৮ জেলায়। পরদিন আ’লীগ সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হন শিক্ষার্থীসহ হাজারো জনতা। ০৪ আগস্ট একই দাবিতে সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি শুরু হয়। প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, এদিন ১১৪ জনের মৃত্যু ঘটে। এই তিন দিনেই ৪৩টি অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে।   

সময়ে সময়ে বদলেছে অপতথ্যের ধরণ

জুলাইয়ের আন্দোলনে অপতথ্যের ধরণ সময়ের সাথে সাথে বদলাতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। শুরুর দিকে বিক্ষোভ, অবরোধ এবং ক্লাস বর্জনের মতো ঘটনাগুলোয় অপতথ্যের প্রবাহ দেখা যায়নি। ১১ জুলাই যখন আন্দোলন সহিংস রূপ নিতে শুরু করে তখন থেকে মৃত্যুর ভুয়া দাবি আসতে থাকে। ১৫ জুলাই পর্যন্ত ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের সাথে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষ হয়। বিশেষ করে নিজের চীন সফর নিয়ে ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়। এর প্রেক্ষিতে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। রাস্তায় নেমে আসেন শিক্ষার্থীরা। পরদিন দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এতে কোনো মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও বিভিন্ন মাধ্যমে সর্বমোট ১৩ জনের মৃত্যুর ভুয়া দাবি প্রচার করা হয়। এই আন্দোলনে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৬ জুলাই। এরপর প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর এসেছে গণমাধ্যমে। মৃত্যুর বাস্তব ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর মৃত্যু সংক্রান্ত ভুয়া দাবিগুলো কমতে শুরু করে। ১৬ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের মৃত্যুর দাবি প্রচার হলেও পরের দিনগুলোয় তৎকালীন সরকার পক্ষের ব্যক্তিদেরও মৃত্যুর ভুয়া দাবি ছড়াতে দেখা গেছে। ১৬ জুলাইতেই অন্তত দুইজন ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যুর দাবি আসে রিউমর স্ক্যানারের কাছে। যাচাই করে দেখা যায়, দুটো দাবিই ভুয়া। 

Collage: Rumor Scanner

১৬ জুলাই একটি বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে কিছু ব্যক্তিদের ফেলে দেওয়ার একটি ভিডিও বেশ ভাইরাল হয় যেটি ব্যবহার করে দাবি করা হয়, বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে শিক্ষার্থীদের ফেলে দিচ্ছে ছাত্রলীগ। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, চট্টগ্রামে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী পরিচয়ধারীদের কর্তৃক ছাত্রলীগের কর্মীদের ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য ছিল এটি।

আগেরদিন ঢাবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনার প্রেক্ষিতে এক নারী শিক্ষার্থীর ছবি ভাইরাল হয় ফেসবুকে। দাবি করা হচ্ছিল, তিনি নিহত হয়েছেন। তবে রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখে, সানজিদা আহমেদ তন্নি নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী সহিংসতায় আহত হলেও পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।

Collage: Rumor Scanner

মৃত্যুর এমন ভুয়া দাবিগুলোর মধ্যে গণমাধ্যমকে জড়িয়ে মৃত্যুর সম্মিলিত সংখ্যা নিয়ে ভুয়া দাবিও ছড়িয়েছে। এই আন্দোলনে ৯০০ জন মারা গেছেন দাবিতে ২২ জুলাই এবং এই সংখ্যা ১৭০০ ছাড়িয়েছে দাবিতে ২৪ জুলাই জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো’কে সূত্র হিসেবে দেখিয়ে প্রচার করা হয়। তবে প্রথম আলো’য় সে সময় (২৪ জুলাই) মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখ ছিল ২০৪ জন। আবার ২২ জুলাই আরেক জাতীয় দৈনিক কালবেলা’কে সূত্র হিসেবে দেখিয়ে প্রচার করা হয়, রাজধানীর হাতিরঝিল লেকে ১০০ ছাত্রের লাশ পাওয়া গেছে। যাচাইয়ে দেখা যায়, এ সংক্রান্ত দাবিতে যে ভিডিও ব্যবহার করা হয়েছে তা পুরোনো এবং ভিন্ন প্রসঙ্গের।

Collage: Rumor Scanner

১৬ জুলাই নারীদের ধর্ষণ সংক্রান্ত অন্তত দুইটি দাবি প্রচার হতে দেখা যায়। কোনো কোনো ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হয়, ঢাবির রোকেয়া হলে ২৭ জন নারী শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আবার কোনো পোস্টে একই দাবির ঘটনা রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বলে উল্লেখ করা হয়। আদতে এমন কিছুই ঘটেনি। একইদিন ‘সঞ্চিতা পাল দেবী’ নামের একটি ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্টের ভিত্তিতে তাকে ছাত্রলীগের কথিত নেত্রী পরিচয় দিয়ে তিনি কোটা আন্দোলনরত ছাত্রীদের প্রকাশ্যে গণধর্ষণের হুমকি দিয়েছেন শীর্ষক দাবিও প্রচার করা হয়। আগস্টে ছাত্রলীগ নেত্রী আতিকা বিনতে হোসাইনের নামে ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ক্রমাগত অশ্লীল কনটেন্ট পোস্ট করা হয়। 

১৭ জুলাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কক্ষ ভাঙচুর করে শিক্ষার্থীরা। এরই প্রেক্ষিতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের শিক্ষার্থীদের কক্ষ থেকে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার দাবিতে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। আদতে এসব অস্ত্র ও মদের বোতল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। ১৮ জুলাই ছাত্রলীগ নেত্রীর করুণ অবস্থার দৃশ্য দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মৌন প্রতিবাদমূলক নাটকে অভিনয়ের পুরোনো ভিডিও প্রচার করা হয়। এই ভিডিও দিয়ে চলতি বছরও ভুয়া দাবি প্রচার করা হয়েছে। এমন অপতথ্যের পরিমাণ ক্রমশই বাড়ছিল। ছিল ভিত্তিহীন দাবির প্রচারও। যেমন, ২৭ জুলাই প্রচার করা হয়, কোটা আন্দোলনে ছয় নেতা আটকের সময় তাদের হোটেল কক্ষ থেকে ৪৫ লাখ টাকা ও ৯ টি দেশিয় অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। অথচ এমন কিছুই ঘটেনি। অপপ্রচার চলেছে অভ্যুত্থানের আগের দিনও। ০৪ আগস্ট মধ্যরাত থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সে সময়ের সমন্বয়ক সারজিস আলমের নামে যমুনা টিভি ও কালবেলা’র আদলে তৈরি ফটোকার্ড ব্যবহার করে দাবি করা হয়, সারজিসের বাসা থেকে দুই কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখে, ফটোকার্ড দুটিই ভুয়া। 

Collage: Rumor Scanner 

এই আন্দোলনে তৎকালীন সরকার এবং আন্দোলনকারীদের বাইরে রাজনৈতিক বিভিন্ন দল নিয়েও অপতথ্যের প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। ১৭ জুলাই বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর কোটা বিরোধী আন্দোলনের বিষয়ে নওমি নামে এক ব্যক্তির সাথে ফোনালাপ শীর্ষক দাবিতে ২০১৮ সালের একটি কথিত অডিও ক্লিপ প্রচার করা হয়। ১৮ জুলাই ফেসবুকে একাধিক ডিজিটাল ব্যানার পোস্ট করে দাবি করা হয়, নারী কোটা বাতিলসহ চাকরিতে নারীদের প্রত্যাহার ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য ৩০% কোটা চেয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। আদতে দলটির পক্ষ থেকে এমন কোনো দাবিই করা হয়নি। 

Collage: Rumor Scanner

জুলাই জুড়ে অপতথ্যের প্রচারে ব্যবহার হতে দেখা যায় বিদেশি বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব এবং ভিন্ন ঘটনার ভিডিও ফুটেজও। ১৭ জুলাই ফেসবুকের বিভিন্ন পোস্টে দাবি করা হয়, আন্দোলন ইস্যুতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ড ও বলিউড অভিনেতা ইমরান হাশমি ফেসবুকে এবং ভারতীয় ইউটিউবার ধ্রুব রাঠি এক্সে পোস্ট করেছেন। তবে দাবিগুলো ছিল ভুয়া। ১৮ জুলাই একাধিক পোস্টে দাবি করা হয়, ৭২ ঘন্টার মধ্যে আন্দোলন কেন্দ্রিক সহিংস পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বাংলাদেশ সরকারকে ইউনেস্কোর তরফ থেকে বহিষ্কার করা হবে। অথচ এমন কোনো ঘোষণাই আসেনি সংস্থাটির পক্ষ থেকে। ১৮ জুলাই একটি ভিডিও দিয়ে দাবি করা হয়, বিদেশি নারী সংবাদ উপস্থাপিকা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সংঘাতের ভিডিও দেখে কেঁদেছেন। রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যাওয়া এই ভিডিও যাচাই করে দেখা যায়, ২০১৯ সালে সিরিয়ার একটি সংবাদ পাঠের সময় পাঠিকার কান্নার দৃশ্যের ভিডিও এটি। ২৭ জুলাই দাবি করা হয়, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সমর্থন করে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইতালির রাষ্ট্রদূত আন্তোনিও আলেসান্দ্রো তার এক্স অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন। রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখে, আলেসান্দ্রোর নামে চালু থাকা ভুয়া এক্স অ্যাকাউন্টের পোস্টকে রাষ্ট্রদূতের আসল পোস্ট দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। ২৫ জুলাই একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়, পাকিস্তানিরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে মিছিল করেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভিডিওটি ২০২২ সালের ভিন্ন ঘটনার।

Collage: Rumor Scanner 

প্রশাসনের ব্যক্তিদের নিয়েও এই আন্দোলনে অপতথ্যের প্রচার ছিল। ৩০ জুলাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি করা হয়, সেদিন সরকার ঘোষিত রাষ্ট্রীয় শোক পালনে অস্বীকৃতি জানায় ১০০ জন সরকারি কর্মকর্তা। মূলত, ভিত্তিহীন ভাবে ভুয়া দাবিটি ছড়িয়েছিল। 

কয়েক সপ্তাহের এই বিক্ষোভ আগস্টে গিয়ে আরো জনমুখী আন্দোলনে রূপ নেয়। এ সময় নির্দিষ্ট কোনো ধরণে আটকে ছিল না অপতথ্যের প্রবাহ। ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মিথ্যা দাবি, যুবলীগ নেতার পুরোনো ছবিকে শিবিরের বলে প্রচার, ভুয়া ফটোকার্ডের মাধ্যমে ছাত্রলীগের নেতাদের নামে অপপ্রচারের ঘটনা দেখা গেছে এই দিনগুলোয়। যেমন ০৩ আগস্ট একটি গণমাধ্যমের আদলে তৈরি ফটোকার্ডের মাধ্যমে প্রচার করা হয়, বোরকা পড়ে ঢাকা ছেড়েছেন ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম ও ইনান। পরদিন আবার একই কায়দায় আরেকটি গণমাধ্যমকে জড়িয়ে প্রচার করা হয়,  মাঠের কর্মসূচি রেখে ভারতে পালালেন ছাত্রলীগের ৪ নেতা সাদ্দাম, ইনান, সৈকত ও শয়ন। প্রকৃতপক্ষে, এই দুইটি ফটোকার্ডই ছিল ভুয়া। শেষদিকে এসে নিজেদের কর্মসূচী স্থগিতের ভুয়া দাবিরও শিকার হতে হয়েছে সরকার এবং আন্দোলনকারী দুই পক্ষকেই। 

Collage: Rumor Scanner

দায়িত্বশীল জায়গা থেকেও হয়েছে অপতথ্যের প্রচার

৩৬ দিনের টানা আন্দোলনে সাধারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা যেমন অপতথ্যের প্রচারে শামিল ছিলেন, তেমনি দায়িত্বশীল অনেক জায়গা থেকেও এসেছে অপতথ্য। এমনকি একাধিক গণমাধ্যমকেও ভুয়া তথ্যের প্রচার করতে দেখা গেছে। ১১ জুলাই “কুবি শিক্ষার্থীদের পেটাচ্ছে পুলিশ, ভিডিও করছেন প্রক্টর” শীর্ষক দাবিতে একটি ছবি একটি গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। অথচ, তিনি প্রক্টর ছিলেন না, ছিলেন ক্যাম্পাসের একজন সাংবাদিক। আন্দোলনে ভুয়া তথ্যের প্রচার করেছে এমন তালিকায় থাকা গণমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস (১টি), ফেস দ্যা পিপল (২টি), ঢাকা পোস্ট (১টি), বাহান্ন নিউজ (১টি)। অপতথ্য প্রচারে সরব ছিল ভারতীয় গণমাধ্যমও। ২১ জুলাই ‘ইন্ডিয়া টুডে এনই’তে দাবি করা হয়, “শেখ হাসিনাকে ঢাকায় তার বাসভবন থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার বর্তমান অবস্থান অজানা রয়ে গেছে।” অথচ সেদিন তিনি ঢাকাতেই ছিলেন। 

তবে সবচেয়ে চমক হয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে প্রচার হওয়া একটি ভুল তথ্য। ১৫ জুলাই নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার দাবি করেন, তাদের তথ্যমতে এই বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত ২ জন নিহত হয়েছে। রিউমর স্ক্যানার তাৎক্ষনিক মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করে। আলোচিত দাবিটির সূত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র দফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, “আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি এবং ঢাকার মিডিয়া ও যোগাযোগের উপর নির্ভর করছি।” অথচ মিলারের বক্তব্যের পূর্বে গণমাধ্যমে মৃত্যুর কোনো তথ্যই আসেনি। অথচ মিলারের বক্তব্যের পূর্বে গণমাধ্যমে মৃত্যুর কোনো তথ্যই আসেনি। 

Collage: Rumor Scanner

আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃস্থানীয় পর্যায় থেকেও যেমন অপতথ্যের প্রচার ছিল তেমনি দলগুলোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্লাটফর্মগুলোও হয়ে উঠেছিল অপতথ্যের সূত্র। এই আন্দোলনে প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও সমর্থন ছিল। তারা এর সমর্থনে বাংলাদেশ বৈধ পথে টাকা পাঠিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে বিরাট অবদান রাখার বদলে হুন্ডি বা অবৈধ পথে টাকা পাঠানোর ঘোষণা দেন। তার প্রেক্ষিতে ২৮ জুলাই আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়, যেখানে দেখা যায়, একজন চাকরিদাতা তার কর্মীদের বেতন দিয়ে তা বৈধ পথে ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠিয়ে রেমিট্যান্স হিসেবে অবদান রাখতে উৎসাহ দিচ্ছেন এবং এক পর্যায়ে প্রায় সবাই বৈধ পথে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাবেন বলে সায় দেন। তবে যাচাই করে দেখা যায়, ভিডিওটি সে সময়েরই নয়, গত বছরের এপ্রিলের। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের পেজ থেকেও আরো অন্তত চারটি অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ পায় রিউমর স্ক্যানার। পিছিয়ে ছিলেন না দলটির নেতা-নেত্রীরাও। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের সে সময়ের সরকার দলীয় মেয়র তাহসিন বাহার সূচনা কথিত একটি বিজ্ঞপ্তির ছবি দিয়ে ০২ আগস্ট এক ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, তিন সমন্বয়ক পাকিস্তান হাইকমিশনের সহযোগিতা চেয়েছেন। একই দাবি প্রচার করেন ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতও। যাচাই করে দেখা যায়, হাইকমিশন প্রকাশিত ভিন্ন একটি বিজ্ঞপ্তিকে সম্পাদনা করে ভুয়া বিজ্ঞপ্তিটি তৈরি করা হয়েছে। 

অন্যদিকে, ছাত্রদলের ফেসবুক পেজ থেকে ২৯ জুলাই ঢাকার মিরপুর-১০ এলাকা আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার দখলে নেওয়ার দৃশ্য দাবিতে একটি ছবি প্রচার করা হয়। আদতে ছবিটি ছিল ১৬ জুলাইয়ের। ৩১ জুলাই ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক এক ফেসবুক পোস্টে ফেস দ্যা পিপলের বরাত দিয়ে দাবি করেন, সেনাবাহিনীর ১৫ জনের বেশি সদস্য পদত্যাগ করেছেন। অথচ ‘ফেস দ্যা পিপল’ এমন কোনো তথ্যই প্রচার করেনি। 

কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতনের সময়কালে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠন। জুলাইতে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ৬৫ সদস্যের একটি সমন্বয়ক কমিটি গঠনের মাধ্যমে এই সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করেন। এই সংগঠনের অফিশিয়াল ফেসবুক গ্রুপ থেকেও অপতথ্য প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। ০৩ আগস্ট এক পোস্টে আরটিভির ডিজাইন সম্বলিত ফটোকার্ডের মাধ্যমে দাবি করা হয়, “রাজধানীতে আজ থেকেই মিষ্টির দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।” আদতে এমন কোনো সংবাদ দেয়নি গণমাধ্যমটি। একই গ্রুপের আরেক পোস্টে দাবি করা হয়, ০৩ আগস্ট কুমিল্লায় হামলায় ১২ জন শহীদ হয়েছেন। সংগঠনটির সে সময়ের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ০৩ আগস্ট ঢাকায় এক সমাবেশেও একই ঘটনা নিয়ে দাবি করেন, কুমিল্লায় একজন শহীদ হয়েছে। তবে যাচাই করে দেখা যায়, কুমিল্লায় সেদিনের বিক্ষোভ মিছিলকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি গুরুতর আহত হলেও কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। 

Collage: Rumor Scanner

শহীদ-সম্মুখ সারির ব্যক্তিদের নিয়েও অপতথ্য 

‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’কে জড়িয়ে নিয়মিত অপতথ্যের প্রচার ছিল আন্দোলনের দিনগুলোয়। ২২ জুলাই প্রচার করা হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি মারা গেছেন। দাবিটি ছিল ভুয়া। সংগঠনটির বর্তমান মুখপাত্র সিনথিয়া জাহিন আয়েশাও ২২ জুলাই মারা গেছেন বলে ভুয়া দাবি প্রচার হয় সামাজিক মাধ্যমে।

Collage: Rumor Scanner

আন্দোলনে সংঘর্ষে ১৮ জুলাই ফারহান ফাইয়াজ নামে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের এক শিক্ষার্থী নিহত হন। তাকে নিয়ে সেদিনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘কালবেলা’র বরাত দিয়ে প্রচার করা হয়, ফারহান ফাইয়াজের টিউশন শিক্ষক শিবির কর্মী এবং ফারহানকে খুনের সঙ্গে তার শিক্ষক জড়িত। অথচ কালবেলা এমন কোনো সংবাদই দেয়নি। একইদিন ঢাকার উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র মীর মাহফুজুর রহমান (মুগ্ধ)। পরবর্তীতে ফেসবুকে একজন নারীর সাক্ষাৎকারের ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়, তিনি মুগ্ধ এর মা। তবে যাচাই করে দেখা যায়, তিনি আন্দোলনের আরেক শহীদ তাহির জামান প্রিয় এর মা। 

০৪ আগস্ট আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও বাকের মজুমদারের ছবি যুক্ত করে ‘বোরকা পড়ে ঢাকা ছাড়লেন তিন সমন্বয়ক’ শীর্ষক শিরোনামে ‘কালবেলা’র ফটোকার্ডের ডিজাইন সম্বলিত একটি ফটোকার্ড প্রচার করা হয়। একইদিন আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলমের বাসা থেকে দুই কোটি টাকা উদ্ধার দাবিতে যমুনা টিভি ও কালবেলার আদলে তৈরি ফটোকার্ড প্রচার করা হয়। এসব ফটোকার্ড ছিল ভুয়া। 

আন্দোলন পরিণতি পেলেও থামেনি অপতথ্য 

০৫ আগস্ট টানা আন্দোলনের ফলাফল পায় ছাত্র-জনতা। শেখ হাসিনা বিদায় নেন মসনদ ছেড়ে। আন্দোলন পায় সফল পরিণতি। কিন্তু এরপরও থামেনি এই আন্দোলন নিয়ে অপতথ্যের প্রচার ও প্রসার৷ অভ্যুত্থানের এক বছর পর এসেও আন্দোলন নিয়ে নিয়মিত বিরতিতে অপতথ্যের প্রচার লক্ষ্য করেছে রিউমর স্ক্যানার। আ’লীগ সরকার পতন পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলনকে জড়িয়ে প্রচার হওয়া ৩৩টি অপতথ্য (৩১ জুলাই পর্যন্ত) শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। 

Collage: Rumor Scanner

এসব অপতথ্যের সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছেন রংপুরে শহীদ হওয়া শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। এর শুরুটা হয় ০৬ আগস্ট। সেদিন আবু সাঈদের কবরে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় সম্মান জানাচ্ছে দাবিতে একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে যাচাই করে দেখা যায়, এই ভিডিও আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পূর্ব থেকেই অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। গত ২৮ জুলাই পর্যন্ত তাকে নিয়ে আরো অন্তত ১৩টি অপতথ্যের প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। এগুলোর মধ্যে শেখ হাসিনার একটি ভুয়া দাবিও রয়েছে। ২৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে আবু সাঈদের মৃত্যু নিয়ে শেখ হাসিনার একটি অডিও রেকর্ড প্রচার করা হয়। সেখানে তিনি দাবি করেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর আবু সাঈদকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। তবে দাবিটি অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার জানতে পারে, ১৬ জুলাই দুপুর ২.১৮ মিনিটে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিস্তেজ হয়ে রাস্তায় ঢলে পড়ার পরই আবু সাঈদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয় এবং তিনটার দিকেই রিকশা করে তাকে হাসপাতালে পৌছাঁনো হয়। 

২০ নভেম্বর সামাজিক মাধ্যমে দাবি করা হয়, মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ (মুগ্ধর ভাই) আসলে একই ব্যক্তি এবং মুগ্ধ নামে কেউ ছিল না। তবে যাচাইয়ে দাবিটি ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়। 

আগস্টে সরকার পতনের পরপরই একটি দাবি বেশ ভাইরাল হয়। পাবনায় আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাফিউল ইসলাম রাফি নামের একজন মৃত্যুবরণ করেছেন এবং মারা যাওয়ার সময় সে তার বাবা নেই ও ছোটবোনকে দেখে রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন বলে ফেসবুকে দাবি করা হয়। তবে যাচাই করে দেখা যায়, রাফি গুলিবিদ্ধ হলেও পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে ওঠেন। রাফির মা নেই, তবে বাবা বেঁচে আছেন৷ ছোট বোনকে দেখে রাখার বিষয়েও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

গত জানুয়ারিতে ঢাবির বর্তমান প্রো-ভিসি ড. মামুন আহমেদ এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে একটি ফোনালাপের অডিও রেকর্ড ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। দাবি করা হয়, এটি গত জুলাই আন্দোলনে দিকনির্দেশনার ফোনালাপ। ফ্যাক্টচেক করে জানা যায়, এটি ২০১৮ সালের ঘটনা। 

অভ্যুত্থান পরবর্তী বিভিন্ন সময়েই পুলিশকে নিয়ে একটি অপতথ্য বেশ কয়েকবার প্রচার হয়েছে। দাবি করা হয়ে থাকে, ০৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে ১৫ জন নিহত পুলিশ সদস্যের মধ্যে একজন গর্ভবতী নারী পুলিশ সদস্য ছিলেন এবং তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই দাবিতে এক নারী পুলিশ সদস্যের ছবিও প্রচার করা হয়। ১০ আগস্ট প্রথম দাবিটি প্রকাশ্যে আসার পরদিনই এ বিষয়ে ফ্যাক্টচেক করে রিউমর স্ক্যানার জানায়, নিহত ১৫ জন পুলিশ সদস্যের মধ্যে কেউ নারী ছিলেন না এবং প্রচারিত ছবিটি ভিন্ন এক নারী পুলিশ সদস্যের। পৃথিবী চাকমা নামের এই নারী পুলিশ সদস্য বর্তমানে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত। গত এপ্রিলেও একই দাবি এআই দিয়ে তৈরি ছবির মাধ্যমে প্রচার হয়েছে ফেসবুকে। 

গত ১৪ অক্টোবর ফেসবুক আওয়ামী লীগের পেজ থেকে দাবি করা হয়, জুলাই-আগস্টে হওয়া উক্ত আন্দোলনে নিহত পুলিশের সংখ্যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশের সদর দপ্তর প্রকাশ করেনি। অথচ ১৮ আগস্টই নিহত পুলিশ সদস্যদের তালিকা প্রকাশ করে পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকা অনুযায়ী, ২০ জুলাই থেকে ১৪ আগস্টের মধ্যে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন। এর আগে অক্টোবরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদভিত্তিক ম্যাগাজিন ‘টাইম’ এর বরাতে দাবি করা হয়, আন্দোলনের সময় ছাত্রদের দ্বারা ৩২০৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। অথচ ‘টাইম’ এমন কোনো তথ্যই প্রকাশ করেনি। 

গত ডিসেম্বর থেকে তিনটি আলাদা দাবি নজরে আসে রিউমর স্ক্যানারের, যেগুলোতে বলা হচ্ছিল আন্দোলনে শহীদ হওয়া ভোলার নয়ন, কুমিল্লার দাউদকান্দিতে আব্দুল্লাহ মাহবুব নামে একজন এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাকিব নামে এক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর ফিরে এসেছে। এই তিনটি দাবিই ভুয়া বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। 

অপতথ্যের লাগামে নিরন্তর চেষ্টা 

একটি বড় ইস্যু যখন সামনে আসে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাকে ঘিরে গুজবের প্রচার ও প্রসার ঘটে। তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই পূর্ব অভিজ্ঞতা রিউমর স্ক্যানার কাজে লাগিয়েছে কোটা আন্দোলন ইস্যুতেও। আমরা শুরু থেকেই এই আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্রুততম সময়ে ভুয়া তথ্যের ফ্যাক্টচেক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রস্ততিও ছিল টিমের সদস্যদের। ওয়েবসাইটে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হওয়ায় তিনটি পন্থার প্রয়োগ করে রিউমর স্ক্যানার। 

প্রথমত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্লাটফর্মগুলোয় তাৎক্ষণিক ফ্যাক্টচেকের সারসংক্ষেপ পোস্ট করা হতো। যেমন, ১৮ জুলাই বিএনপি নেতা আমির খসরুর নামে কথিত কলরেকর্ডের দাবিটি ছড়িয়ে পড়ার পর তাৎক্ষণিক তা যাচাই করে গ্রুপে পোস্ট করা হয়৷ তবে ওয়েবসাইটে তা প্রকাশিত হয় ৩০ জুলাই। 

Screenshot: Facebook

শুধু ফ্যাক্টচেকই নয়, চাহিদা অনুযায়ী খবরও জানানো হতো রিউমর স্ক্যানারের গ্রুপে। যেমন, ১৬ জুলাই আবু সাঈদের মৃত্যুর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে গ্রুপে পোস্ট করা হয়েছিল সেদিন দুপুরেই৷ 

দ্বিতীয়ত, ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আমলে নিয়ে দ্রুততম সময়ে ফ্যাক্টচেক প্রকাশের জন্য রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে প্রথমবারের মতো লাইভ আপডেট ফিড চালু করা হয়। আন্দোলন নিয়ে সময়ে সময়ে ছড়িয়ে পড়া ভুল তথ্যের ফ্যাক্ট এবং এই আন্দোলন ঘিরে বিভিন্ন হালনাগাদ তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে এই ব্যবস্থা করেছিল রিউমর স্ক্যানার। নির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে এই আন্দোলনে মৃত্যুর সংখ্যাও প্রতিদিন হালনাগাদ করা হতো এই পাতায়। ০৫ আগস্ট সকাল পর্যন্ত এই ফিড চালু রাখা হয়। 

Collage: Rumor Scanner 

তৃতীয়ত, রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটের ফ্যাক্টচেকের প্রথাগত ফরমেট বদলে সংক্ষিপ্তকরণের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে ফ্যাক্টচেক প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়।  

তবে এমন উদ্যোগগুলোর পরও বাধাগ্রস্ত হয়েছে ফ্যাক্টচেকিং কার্যক্রম। জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময়ে অন্তত পাঁচবার ইন্টারনেট শাটডাউনের ঘটনা ঘটেছে। কখনো নির্দিষ্ট এলাকায়, কখনো-বা সারাদেশে একযোগে মোবাইল এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল এ সময়গুলোয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ জুলাই থেকে ০৫ আগস্টের মধ্যে পাঁচ দফায় ২২ দিন ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা ঘটেছে। নিয়ন্ত্রণ ছিল ভিপিএনের ওপরও। ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হওয়ায় তাৎক্ষণিক ভুল তথ্য শনাক্তে বেগ পেতে হয় ফ্যাক্টচেকারদের। 

কাজের পদ্ধতি 

এই গবেষণাটি রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর উপর ভিত্তি করে প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশের নিমিত্তে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন, ফেসবুকে রিউমর স্ক্যানারের প্লাটফর্মগুলোর পোস্টের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে একটি নির্দিষ্ট ডাটাবেজের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এরপর তথ্য-উপাত্তগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ঘটনার সাথে দাবির সম্পর্ক খুঁজে বের করতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সে সময়ের প্রতিবেদনগুলোও। পরবর্তীতে সেসব তথ্য-উপাত্ত পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে কয়েক ভাগে ভাগ করে ইনফোগ্রাফ, স্ক্রিনশট কোলাজ এবং লেখার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।  

Main Image in Feature: Zabed Hasnain Chowdhury 
Feature Design: Md. Shahajalal Mia

আরও পড়ুন

spot_img