- ফেসবুকে ‘চলো বদলে যাই’ নামে পেজে নিয়মিত নারী তারকাদের সম্পাদিত ছবি-ভিডিও প্রচারের প্রমাণ।
- গত সাত মাসে অন্তত ১১৬ অপতথ্য শনাক্ত।
- আগস্টেই শনাক্ত ৭৯ অপতথ্য।
- পেজটি ইমরান মিয়া নামে পঙ্গুত্ব বরণ করা গাজীপুরের এক ব্যক্তির।
- বিতর্কিত পোস্টের জেরে সম্মানহানি ঘটছে সেলিব্রিটি নারীদের।
ফেসবুক পেজটির দিনের কার্যক্রম শুরু হয় সকলকে ‘শুভ সকাল’ জানিয়ে। এরপর কখনো ধর্মীয় শুভেচ্ছা, কখনো-বা দুপুর, সন্ধ্যা কিংবা রাতের শুভরাত্রির পোস্ট দেখা যায় নিয়মিত। কিন্তু সাধারণ এসব পোস্টের ফাঁকে ফাঁকে প্রতিনিয়ত সেলিব্রিটি নারীদের ছবি-ভিডিও দাবি করে অসংখ্য ভুয়া কনটেন্ট প্রচার হচ্ছে। রিউমর স্ক্যানার ‘চলো বদলে যাই’ নামে এমন একটি ফেসবুক পেজের সন্ধান পেয়েছে যাতে পেজের নামের সাথে মিল রেখে নিয়মিত নারীদের চেহারা বদলে দেওয়ার মিশন চলছে। আপত্তিকর কনটেন্টগুলোর কারণে হরহামেশাই বিরূপ মন্তব্যের শিকার হতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট নারীদের। পেজটির পেছনে যে ব্যক্তি রয়েছেন তিনি পঙ্গুত্ব বরণ করা গাজীপুরের এক ব্যক্তি।
চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল ‘চলো বদলে যাই’ নামের পেজটির সন্ধান পায় রিউমর স্ক্যানার। নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে পাওয়া পেজটিতে সেদিন কিছু ছবি দিয়ে একটি পোস্টে দাবি করা হয়, ছবিগুলো ঢাকাই সিনেমার নায়িকা পরী মণির। পোস্টটিতে এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজারের অধিক রিয়েক্ট এবং প্রায় এক হাজারের অধিক কমেন্ট এসেছে। কমেন্টগুলোতে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই ধরনের মন্তব্যই করেছেন নেটিজেনরা। তবে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নেতিবাচক কমেন্টের পরিমাণই বেশি এবং এর সিংহভাগই বডি শেমিং ধরনের।

রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখতে পায়, এগুলো পরী মণির ছবিই নয়৷ ভারতের হিমাচল প্রদেশের শিমলার এক ভিন্ন নারীর ছবির ওপর ফেস সোয়াপ প্রযুক্তির ব্যবহার করে পরী মণির মুখমণ্ডল বসিয়ে দাবিটি প্রচার করা হচ্ছিল। ফেস সোয়াপ এমন একটি প্রযুক্তি যেখানে এক ব্যক্তির মুখ অন্য কারো মুখের সঙ্গে ডিজিটালভাবে বদলে দেওয়া হয়। এতে দেখা যায়, যেন প্রথম ব্যক্তি আসলে দ্বিতীয় ব্যক্তির মতো দেখাচ্ছে বা তার কাজ করছে। এই কাজটি সাধারণত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এআই টুলসের সহজলভ্যতার সুযোগে এর অপব্যবহারের দিকটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারই উদাহরণ হয়ে এসেছে ‘চলো বদলে যাই’ এর মতো পেজগুলো৷ এই পেজটি এপ্রিল থেকে নিয়মিত নজরদারিতে রেখেছিল রিউমর স্ক্যানার। পরবর্তী মাসগুলোতে পেজের বিভিন্ন পোস্টকে নিয়ে ফ্যাক্টচেকও করা হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পেজটির ৩৭টি পোস্টকে অপতথ্য হিসেবে শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।

আলোচিত এই পেজটি চালু করা হয় ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। শুরু থেকেই একই নাম অর্থাৎ ‘চলো বদলে যাই’ নামেই পরিচালিত হচ্ছে পেজটি। পেজটি বাংলাদেশ থেকে একজন এডমিনই পরিচালনা করছেন। পেজটির লোকেশন হিসেবে গাজীপুরের নাম উল্লেখ রয়েছে। ২৮ হাজার ফলোয়ারের পেজটি চালুর পর থেকেই নিয়মিত বিভিন্ন নারীর ছবি পোস্ট করা হচ্ছিল। অন্তত গেল বছর থেকে এআই ভিত্তিক ভুয়া ও সম্পাদিত কনটেন্ট প্রচারের বিষয়টি লক্ষ্য করা যায় পেজে। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছর এটির পরিমাণ বাড়তে শুরু করে।
এই পেজটি নিয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, পেজটির উদ্যোক্তা হিসেবে ইমরান মিয়া নামে এক ব্যক্তি রয়েছেন। তার বাড়ি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের সেনপাড়া গ্রামে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর এক ভিডিওতে তিনি নিজেই এসব তথ্য জানান। ভিডিওটি দেখুন এখানে। ভিডিওতে তিনি জানান, আজ থেকে ১৭ বছর আগে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে তার গলার নিচ থেকে হাত-পা অবশ হয়ে যায়। তিনি এরপর থেকে কোনোরকম চলাফেরা করতে পারেন না। নিজের হাতে খেতেও পারেন না। ভিডিওতে তিনি এই পেজটি তার নিজের বলে দাবি করেন।
১২ সেপ্টেম্বর পেজটিতে ইমরানের আরেকটি ভিডিও প্রচার করা হয়। ভিডিওটি দেখুন এখানে। ইমরানকে সামনে রেখে নিজের চাচাতো ভাই দাবি করে ভিডিওতে আরেক ব্যক্তি কথা বলেন। তবে উক্ত ব্যক্তিকে ক্যামেরার সামনে দেখা যায়নি। তিনি ভিডিওতে দাবি করেন, ইমরানকে মোবাইলও অন্যের সাহায্য নিয়ে ব্যবহার করতে হয়।
ইমরানের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের এক পোস্ট থেকে জানা যায়, ২০০৮ সালের ২২ ডিসেম্বর তিনি গাছ থেকে পড়ে গিয়ে আহত হন। তাকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হয়।
ইমরান এবং তার চাচাতো ভাইয়ের দাবি অনুযায়ী ইমরান নিজের হাতে কোনো কাজ করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে ‘চলো বদলে যাই’ পেজে পোস্টগুলো কে করেন তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ বিষয়ে জানতে ইমরানের সাথে আলাপ করেছে রিউমর স্ক্যানার। পেজের ভিডিওগুলো তিনি নিজেই বানান কিনা এমন প্রশ্নে শুরুতে আলাপ করতে আগ্রহী না হলেও পরে তিনি জানান যে, “আমার হাতে অল্প একটু শক্তি আছে সেটা দিয়ে কোনোরকম আস্তে আস্তে মোবাইল চালাতে পারি।”
ইমরান রিউমর স্ক্যানারকে জানান, তিনি ইউটিউব ফেসবুক দেখে ছবি এবং ভিডিও এডিট করে পেজে আপলোড দিয়েছিলেন। কিছু অর্থ উপার্জন করতে চেয়েছিলেন। সেজন্যই ভিডিও আর ছবিগুলো সম্পাদনা করেছিলেন। তিনি বলছিলেন, “অনেকদিন ছবি আর ভিডিও এডিট করে পেজে পোস্ট করেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত এক টাকা ইনকাম করতে পারি নাই। মনিটাইজেশনও পাই নাই।”
তিনি এখন এই ধরণের কনটেন্ট বানানো বন্ধ রেখেছেন। বলছেন, “ভাবছি নিজের কিছু ভিডিও বানাবো কিন্তু আমার সেরকম লোক নেই সেজন্য ভিডিও বানাতে পারছি না।”
ইমরান বলছেন, “এআই দিয়ে তো সবাই ভিডিও ছবি বানায় তো তাদের কিছু বলেন, তারা তো অনেক খারাপ খারাপ ছবি এডিট করে এবং ভিডিও বানায়।”
‘চলো বদলে যাই’ পেজটির কার্যক্রম পর্যালোচনা করতে গত আগস্টে প্রকাশিত পেজটির সকল পোস্ট বিশ্লেষণ করেছে রিউমর স্ক্যানার। এই এক মাসেই পেজে পোস্ট হয়েছে ২৩৮টি। আগস্টের প্রতিদিনই সর্বনিম্ন পাঁচটি থেকে সর্বোচ্চ ১১টি পোস্ট করা হয়েছে পেজে। এসব পোস্টের ১৩৫টি ছিল সাধারণ পোস্ট (শুভ সকাল, শুভ রাত্রিসহ এই ধরনের নানা পোস্ট)। বাকি পোস্টগুলোতে ছিল নারীদের নানা সাধারণ ও আপত্তিকর ছবি-ভিডিও। রিউমর স্ক্যানারের বিশ্লেষণে দেখা যায়, আগস্টে ৩৬ জন ভিন্ন ভিন্ন নারীকে নিয়ে ৯৭টি পোস্ট করা হয় পেজটিতে। এগুলোর মধ্যে ৭৯টি পোস্টেই সংশ্লিষ্ট নারী দাবিতে ভিন্ন নারীর ছবি-ভিডিও সম্পাদনা করে প্রচার করার প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার। এসব পোস্টের মধ্যে ছবি কেন্দ্রিক কনটেন্ট ৪৪টি এবং ভিডিও কেন্দ্রিক কনটেন্ট ৩৫টি। এছাড়া, ১৮টি পোস্টে থাকা ছবি-ভিডিওর মূল উৎসের সন্ধান না পাওয়ায় তা অপ্রমাণিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ বুফালো এবং ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের এআই ও ডিপফেক কনটেন্ট শনাক্তের যৌথ প্রজেক্ট ‘ডিপফেক ও মিটার’ এর মাধ্যমে এই ১৮টি কনটেন্ট যাচাই করে সবগুলোই সর্বনিম্ন ৪৬ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৭২ শতাংশ পর্যন্ত এআই এর মাধ্যমে সম্পাদনার সম্ভাবনার কথা জেনেছে রিউমর স্ক্যানার। বাকি চারটি কনটেন্ট আসল ছবি-ভিডিও (১, ২, ৩, ৪) বলে নিশ্চিত হয়েছে রিউমর স্ক্যানার।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভুয়া হিসেবে শনাক্ত হওয়া কনটেন্টগুলোতে সবচেয়ে বেশি জড়ানো হয়েছে বাংলাদেশের বিনোদন অঙ্গনের নারী তারকাদের। ৩৬ জন নারীর মধ্যে ২৯ জনই বাংলাদেশের। এর মধ্যে ২৮ জনই বিনোদন তারকা। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছয়টি করে অপতথ্যের শিকার বানানো হয়েছে ছোট পর্দার দুই অভিনেত্রী তানজিম সাইয়ারা তটিনী ও তাসনিয়া ফারিণকে।
বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের কলকাতার বিনোদন তারকাদের জড়িয়েও আটটি অপতথ্যের প্রচার দেখা গেছে পেজটিতে। আগস্টে টলিউডের নায়িকা নুসরাত জাহানকে জড়িয়ে সবচেয়ে বেশি (২টি) অপতথ্যের প্রচার ছিল পেজে।
পেজটির আগস্টের কনটেন্টগুলো বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায়, কোনো নারীকে জড়িয়ে প্রচার করা কনটেন্টগুলোর মূল উৎস হিসেবে একজন নারীর কনটেন্টই ব্যবহার হচ্ছে। তাসনিয়া ফারিণ এবং সাদিয়া আয়মানের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করা গেছে। ফারিণকে জড়িয়ে প্রচারিত দুইটি কনটেন্ট ভারতীয় নারী রাশি সিং এর ভিডিওকে সম্পাদনা করে বানানো হয়েছে। একইভাবে সাদিয়া আয়মানকে জড়িয়ে প্রচারিত দুইটি কনটেন্ট আরেক ভারতীয় নারী শায়রা জিলাওয়াত এর ভিডিওকে সম্পাদনা করে বানানো হয়েছে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, দিব্যিয়া পাচাল নামে ভারতীয় এক নারীর ছবিকে একবার আশনা হাবিব ভাবনা এবং আরেকবার মাহিয়া মাহি দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। সবমিলিয়ে, সে মাসে ৩৬ জন নারীকে জড়িয়ে যে ৭৯টি ভুয়া পোস্ট করা হয়েছে তাতে ৭৬ জন ভিন্ন ভিন্ন নারীর কনটেন্টকে সম্পাদনা করে অপপ্রচারের প্রমাণ মিলেছে।
কাজের পদ্ধতি
এই গবেষণাটি রিউমর স্ক্যানার টিমের তত্ত্বাবধানে করা হয়েছে। এর জন্য ‘চলো বদলে যাই’ নামের পেজটির প্রয়োজনীয় কনটেন্টগুলো নথিভুক্ত করে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা হয়েছে। এরপর কনটেন্টের বিপরীতে আসল কনটেন্ট খুঁজে বের করে তুলনা করা হয়েছে। সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে এআই শনাক্তকরণ টুলেরও। পরবর্তীতে সেগুলোকে ইনফোগ্রাফিক এবং লেখার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।





