সকল গ্রেডের সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংস্কার করে কোটা ব্যবস্থার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা গত পহেলা জুলাই থেকে টানা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মাঝে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে গত ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়েও কথা বলেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হন। এর প্রেক্ষিতে আন্দোলনের কর্মসূচিতে রাস্তায় নেমে আসেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে ঘটেছে সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা, এসেছে বহু হতাহতের খবরও।
এরই প্রেক্ষিতে মূলধারার সংবাদমাধ্যম কালবেলাকে সূত্র দাবি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দাবি প্রচার করা হচ্ছে, ঢাকার হাতিরঝিল এলাকায় আন্দোলনকারী প্রায় শতাধিক লাশ পাওয়া গেছে।
কালবেলার একটি ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার করে গত ২২ জুলাই তারিখ এই ১০০ ছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভিডিও প্রচারিত হচ্ছে।
উক্ত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়া অবধি, উক্ত ভিডিওটি ৫২ লক্ষেরও অধিক বার দেখা হয়েছে, ৫৬ হাজারেরও অধিক পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিওটিতে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে এবং ৮৬ হাজারেরও অধিক বার ভিডিওটি শেয়ার করা হয়েছে।
ভিডিও প্রচার পরবর্তী সময়ে বিষয়টি ফেসবুকে তথ্য আকারেও প্রচার করা হয়। ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর হাতিরঝিলে প্রাপ্ত শতাধিক লাশের সংবাদটি চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত নয় বরং দুই মাসেরও অধিক সময়ের পুরাতন সংবাদ। হাতিরঝিল উদ্বোধনের পর থেকে লেকটিতে আত্নহত্যা, ছিনতাই, দুর্ঘটনাসহ নানা কারণে এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক লাশ পাওয়া যাওয়ার তথ্য জানিয়ে জাতীয় দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত সংবাদকে সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে জড়িয়ে প্রচার করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানের শুরুতে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে কালবেলার ওয়েবসাইট, ইউটিউব চ্যানেল কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাকাউন্টগুলোতে আলোচিত দাবি সমর্থিত কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে, কালবেলার ইউটিউব চ্যানেলে গত ১৫ মে তারিখে “হাতিরঝিলে এত লা-শ আসে কোথা থেকে?” শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন পাওয়া যায়। সংবাদ প্রতিবেদনটির সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটিতে ব্যবহৃত দৃশ্যের এবং বক্তব্যের হুবহু মিল পাওয়া যায় যা প্রমাণ করে উক্ত সংবাদ প্রতিবেদনটির আলোকেই আলোচিত দাবিটি প্রচারিত হচ্ছে।
Comparison : Rumor Scanner
অতঃপর, কালবেলার ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত উক্ত সংবাদ প্রতিবেদনটি দেখলে জানা যায়, হাতিরঝিলে মাঝেমধ্যেই ভেসে ওঠে মানুষের মরদেহ। ২০১৩ সালে হাতিরঝিল উদ্বোধনের পর থেকে হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকা থেকে এখন পর্যন্ত শতাধিক মরদেহ উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যার মধ্যে ২০-২৫ জন প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করেছেন। আর হত্যার শিকার হয়েছেন ২০ জনের বেশি। তাছাড়া ছিনতাই, সড়ক দুর্ঘটনা, কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত থেকে শুরু করে অপরাধজনিত নানা অঘটন ঘটছে সেখানে। লেকের পানিতে প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে পরিচিত বা অপরিচিত মানুষের লাশ। তবে, হাতিরঝিল থানার ওসি আওলাদ হোসেনের মতে, ভেসে ওঠা এসব মৃতদেহ হত্যা নয় আত্মহত্যা বলে মনে করেন তিনি। মূলত সেই প্রেক্ষিতেই করা সংবাদ প্রতিবেদন এটি। উক্ত প্রতিবেদনে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহতের বিষয়ে কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি। এছাড়া কালবেলার ওয়েবসাইটেও একই শিরোনামে উক্ত প্রতিবেদন লিখিত আকারে পাওয়া যায় যেখানেও একই তথ্যই প্রচার করা হয়েছে।
অর্থাৎ, কালবেলায় গত মে মাসে প্রকাশিত এই ভিডিও প্রতিবেদনের একটি অংশ কাট করে সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনে হাতিরঝিল থেকে ১০০ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। যা ভিডিও পরবর্তী সময়ে ভিডিও ব্যতীত শুধু তথ্য আকারেও প্রচার হতেও দেখা যায়।
এ বিষয়ে অধিকতর নিশ্চিতে কালবেলার অনলাইন বিভাগের প্রধান পলাশ মাহমুদের সাথে কথা বলে রিউমর স্ক্যানার টিম। তিনিও আলোচিত দাবিটি সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কালবেলার একটি পুরনো ভিডিওর আংশিক কপি করে গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেন।
তাছাড়া, কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শতাধিক শিক্ষার্থীদের লাশ হাতিরঝিলে পাওয়ার মর্মে বিশ্বস্ত সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
মূলত, গত ২৫ মে কালবেলার ইউটিউব চ্যানেলে “হাতিরঝিলে এত লা-শ আসে কোথা থেকে?” শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যেখানে হাতিরঝিল উদ্বোধনের পর থেকে লেকটিতে আত্নহত্যা, ছিনতাই, দুর্ঘটনাসহ নানা কারণে এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক লাশ পাওয়া যাওয়ার তথ্য জানানো হয়। সম্প্রতি কালবেলার ঐ ভিডিও প্রতিবেদনের কিছু অংশ কাট করে গণমাধ্যমটিকে উদ্ধৃত করে কোটা সংস্কার আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় হাতিরঝিল লেক থেকে ১০০ ছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থাৎ কোটা সংস্কার আন্দোলনে হতাহতের ঘটনার প্রায় দুই মাস পূর্বে কালবেলায় প্রকাশিত সংবাদকে আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে জড়িয়ে কালবেলায় এমন কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়নি।
সুতরাং, কালবেলাকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনায় রাজধানীর হাতিরঝিল লেকে ১০০ ছাত্রের লাশ পাওয়া গেছে মর্মে প্রচারিত দাবি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Kalbela News – হাতিরঝিলে এত লা-শ আসে কোথা থেকে?
- Kalbela – হাতিরঝিলে এত লাশ আসে কোথা থেকে?
- Rumor Scanner’s own analysis