ম্যাথিউ মিলারের বক্তব্যে কোটা আন্দোলনে দুইজন মৃত্যুর ভুয়া দাবি

সকল গ্রেডের সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংস্কার করে কোটা ব্যবস্থার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা টানা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মাঝে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে গত ১৪ জুলাই আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়েও কথা বলেন। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেন, ”মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?”। তার এই মন্তব্যকে অপমানসূচক দাবি করে এরপর থেকেই শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। একাধিক ক্যাম্পাসে একই সময়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগও উঠেছে। এরই প্রেক্ষিতে ১৫ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাত ১১ টার পর অনুষ্ঠিত মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার দাবি করেছেন, তাদের তথ্যমতে এই বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত ২ জন নিহত হয়েছে।

ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে চলমান আন্দোলনে হাসপাতালে ঢুকেও শিক্ষার্থীদের ওপর নজিরবিহীনভাবে ছাত্রলীগের নামে সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগের প্রসঙ্গ তুলে ধরে স্টেট ডিপার্টমেন্ট করেসপন্ডেন্ট মুশফিকুল ফজল আনসারীর এক প্রশ্নের জবাবে জনাব মিলার এই দাবি করেন।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে দুই জন মারা যাওয়া সংক্রান্ত ম্যাথিউ মিলারের দাবিটি সঠিক নয় বরং মিলারের বক্তব্যের পূর্বে এই আন্দোলনে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। 

কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে এই আন্দোলন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আসছে রিউমর স্ক্যানার। দেশের বিভিন্ন স্থানে এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে একাধিক ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রমাণ পেয়ে সেসব বিষয়ে ফ্যাক্টচেকও প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। এই আন্দোলনকে ঘিরে প্রথম মৃত্যুর গুজব শনাক্ত হয় গত ১১ জুলাই। সেদিন পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে  ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করতে যাওয়ার পথে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে শিক্ষার্থীদের একজন মারা গেছেন শীর্ষক দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুকের কতিপয় পোস্টে দুইজন নিহতের দাবিও করা হয়। তবে রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, সেদিন শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে কোনো শিক্ষার্থী মারা যাননি। কুমিল্লার একই ঘটনায় একজন মৃত ব্যক্তির ছবি প্রচার করে এটি কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত কোনো শিক্ষার্থীর ছবি বলে প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার৷ তবে আমরা যাচাই করে দেখেছি, এটি ২০২২ সালে নারায়ণগঞ্জে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া শাওন প্রধানের ছবি।

এই ঘটনা প্রবাহের মধ্যেই সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে গত ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়েও কথা বলেন। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেন, ”মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?”। তার এই মন্তব্যকে অপমানসূচক দাবি করে সেদিন থেকে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। ১৪ এবং ১৫ জুলাই দেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। এর প্রেক্ষিতে দাবি করা হয়, কোটা আন্দোলনে গিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। তবে বিষয়টি ভুয়া বলে নিশ্চিত হয়েছে রিউমর স্ক্যানার। 

১৫ জুলাই বিভিন্ন সময়ে আরো একাধিক মৃত্যুর দাবি প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। সেদিন দেশের মূল ধারার গণমাধ্যম ডিবিসি নিউজের লোগো সম্বলিত একটি ফটোকার্ডে একজন নারীর আহত অবস্থাকালীন সময়ের ছবি সংযুক্ত করে তানিয়া আক্তার মীম নামের একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে শীর্ষক দাবি প্রচার হলেও আদতে এখন পর্যন্ত এই আন্দোলনে কোনো নারীর মৃত্যুর খবর আসেনি। যে ছবি এই দাবিতে প্রচার হয়েছে তা পুরোনো ও ভিন্ন ঘটনার। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের সাথে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের কয়েক শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। এরই প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢাবিতে শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী নিহতের বেশ কয়েকটি দাবি ছড়িয়ে পড়ে। এর কোনোটিরই সত্যতা মেলেনি। 

অর্থাৎ, কোটা সংস্কারের চলমান আন্দোলন শুরুর পর থেকে গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। মৃত্যুর যেসব দাবি ছড়িয়েছে তার সবই মিথ্যা বলে নিশ্চিত হয়েছে রিউমর স্ক্যানার। 

এরই মধ্যে সেদিন রাতে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার দুইজন মৃত্যুর আলোচিত দাবিটি করেছেন। মিলার তার বক্তব্যে এই দাবির পক্ষে কোনো সূত্র উল্লেখ করেননি। সেখানে উপস্থিত বাংলাদেশি সাংবাদিকরাও তার এই দাবির সূত্র জানতে চাননি। বাংলাদেশের মূল ধারার গণমাধ্যম বিডিনিউজ২৪ এ বিষয়ে ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের বক্তব্য নিয়েছে। দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা বলেন, “মুখপাত্র বলেছেন, আমরা এ সংক্রান্ত খবরগুলোতে নজর রাখছি। এটা আমরা অব্যাহত রাখব। আমরা সব সময় সবচেয়ে নির্ভুল তথ্যটাই চাই। সত্য উদঘাটনের জন্য সাংবাদিকদের প্রয়াসকে আমরা স্বাগত জানাই।” 

রিউমর স্ক্যানার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করেছে। আলোচিত দাবিটির সূত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র দফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি এবং ঢাকার মিডিয়া ও যোগাযোগের উপর নির্ভর করছি।” অথচ মিলারের বক্তব্যের পূর্বে গণমাধ্যমে মৃত্যুর কোনো তথ্যই আসেনি। 

রিউমর স্ক্যানার ম্যাথিউ মিলারের সাথে সরাসরি যোগাযোগেরও চেষ্টা করেছে। তবে এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার আগ পর্যন্ত তার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। 

উল্লেখ্য, মিলারের বক্তব্য পরবর্তী সময়ে গত ১৬ থেকে আজ ১৮ জুলাই সকাল সাড়ে ১১ টা পর্যন্ত এই আন্দোলনে সাতজনের মৃত্যুর নিশ্চিত তথ্য পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার৷ 

মূলত, চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১৫ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাত ১১ টার পর অনুষ্ঠিত মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার দাবি করেছেন, তাদের তথ্যমতে এই বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত ২ জন নিহত হয়েছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, মিলারের বক্তব্যের পূর্বে এই আন্দোলনে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। তবে পরবর্তী সময়ে সাত মৃত্যুর খবর মিলেছে। 

সুতরাং, চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে  গত ১৫ জুলাই রাতের বক্তব্যে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার দুইজন মৃত্যুর দাবি করেছেন; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।  

তথ্যসূত্র

  • Rumor Scanner’s own analysis 

আরও পড়ুন

spot_img