বৃহস্পতিবার, অক্টোবর 3, 2024
spot_img

কোটা আন্দোলনে সংঘর্ষের ঘটনায় ঢাবিতে নিহতের গুজবে সয়লাব ফেসবুক

সকল গ্রেডের সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংস্কার করে কোটা ব্যবস্থার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা টানা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মাঝে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে গতকাল আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়েও কথা বলেন। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেন, ”মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?”। তার এই মন্তব্যকে অপমানসূচক দাবি করে গেল ১৫ জুলাই রাত থেকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। পরবর্তীতে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের সাথে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের কয়েক শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। এরই প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢাবিতে শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী নিহতের বেশ কয়েকটি দাবি ছড়িয়ে পড়ে।

ফেসবুকে একাধিক পোস্টে একজন ব্যক্তির ছবি প্রচার করে দাবি করা হয়, কোটা আন্দোলনে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উক্ত শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। 

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)। 

এছাড়াও, কোনো ব্যক্তির ছবি বা সূত্র সংযুক্ত না করেও ফেসবুক দাবি প্রচার করা হচ্ছে, কোটা আন্দোলনে গিয়ে ঢাবির একজন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন।

এরকম দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন: এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ জন নিহত দাবিতে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ৫ জন সদস্য নিহত দাবিতে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ৪ জন সদস্য নিহত দাবিতে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

তাছাড়া, সময় টিভিকে সূত্র দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের একজন ছাত্র নিহত হয়েছেন শীর্ষক একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে । এমন পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

একইভাবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী তানিয়া আক্তার মীম মারা গিয়েছেন দাবিটিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। উক্ত দাবিতে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনায় ঢাবিতে নিহত শিক্ষার্থী দাবিতে প্রচারিত দাবিটি সঠিক নয় বরং উক্ত দাবিতে প্রচারিত ছবিটির ব্যক্তি আহত হয়েছেন এবং তিনি এখনও বেঁচে আছেন। তাছাড়া, চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকজন আহত হলেও এই প্রতিবেদন প্রকাশ অবধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ নিহত হয়নি বলে নিশ্চিত হয়েছে রিউমর স্ক্যানার। তবে, আজ (১৬ জুলাই) রংপুরে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে একজন আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন। এছাড়া, কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে ঢাকা ও চট্টগ্রামেও আরো মোট তিনজন নিহত হয়েছেন।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবির ব্যক্তির পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় রিউমর স্ক্যানার। এই ব্যক্তির নাম ইব্রাহীম নিরব। তিনি নিহত হননি। নিরব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ সমন্বয়ক। তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে প্রচারিত মূল ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়। ছবিটি পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখা হয়েছে, “কোটাসংস্কার আন্দোলনরত অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় আহত ইব্রাহীম নিরব মেডিকেলে! | পোস্ট: Niloy Badshah (ছোটভাই)”

এছাড়া, তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে আলোচিত দাবিটিকে মিথ্যা দাবি করে একটি পোস্টও পাওয়া গেছে।। পোস্টে তিনি জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নারকীয় সন্ত্রাসী হামলায় এখনো কেউ নিহত হয়নি। আর আমার নামে যে গুজব ছড়িয়েছে যে, ‘ঢাবি শিক্ষার্থী ইব্রাহীম নিরব মারা গেছে।” আসলে আমি মারা যাইনি বা এখনো পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি, আমি নিউজ পাইনি। তবে আমার অবস্থা এখনো ক্রিটিকাল, বাম পা এবং বাম হাত মচকে গিয়ে শরীরের বামপাশ পুরো অবশ হয়ে আছে। রিপোর্ট নরমাল ছিল, এখন ওষুধের উপর নির্ভরশীল যে কতদিন লাগে ঠিক হতে। তবে আমি আগামীকালই রাজপথে নামবো ইনশাআল্লাহ। হামলা করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না, ভয় দেখিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না।

তাছাড়া, ইব্রাহীম নিরবের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয় বরং পুরান ঢাকার শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজে অধ্যয়নরত।

অর্থাৎ, একজন ব্যক্তির ছবি প্রচার করে তিনি কোটা আন্দোলনে গিয়ে নিহত হয়েছেন দাবিতে প্রচারিত দাবি মিথ্যা। 

অতঃপর, ঢাবিতে অন্য কেউ নিহত হয়েছেন কি না তা জানতে অনুসন্ধান অব্যাহত রাখে রিউমর স্ক্যানার টিম। অনুসন্ধানে ঢাবিতে হামলার বিষয়ে খোঁজ খবর নেয় রিউমর স্ক্যানার। জাতীয় দৈনিক সমকাল জানাচ্ছে, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের চতর্মুখী হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসময় কয়েকস্থানে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষও হয়। গত ১৫ জুলাই বিকেল তিনটা থেকে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। তারপর হামলার অভিযোগ ওঠে। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরে নারী শিক্ষার্থীরা বাসে আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে তাদের নামিয়ে হামলা করতে দেখা যায় মহানগর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের। হামলা পরবর্তী ছত্রভঙ্গ হয়ে যান শিক্ষার্থীরা। এরপর দীর্ঘসময় ক্যাম্পাসে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় ছাত্রলীগ। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেছেন, তাদের অন্তত দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।


দেশের নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসের খবর প্রচারকারী অনলাইন সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর থেকেই উত্তপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাস। সোমবার (১৫ জুলাই) বিকেল সাড়ে তিনটার পর থেকেই এ হামলার শুরু হয় যা দফায় চলমান রয়েছে। ছাত্রলীগের হামলায় শতাধিক কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। আহতদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

উক্ত বিষয়ে দেশীয় আরেক অনলাইন  সংবাদমাধ্যম ঢাকা পোস্ট জানায়, রোববার (১৪ জুলাই) সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে আজ (১৫ জুলাই) দুপুরে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হতে শুরু করে। একইস্থানে বিকেল ৩টায় বিক্ষোভ সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছিল ছাত্রলীগ। পরে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ভিসি চত্বরের সামনে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এতে অন্তত ৮০ জন আহত হয়ে ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেছে বলে জানা গেছে।

অর্থাৎ ঢাবিতে হওয়া উক্ত হামলায় বিশ্বস্ত সূত্রে এখন পর্যন্ত কেউ নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।

তাছাড়া, ঢাবিতে দায়িত্বরত একাধিক সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ করে এই হামলার ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার খবর জেনেছে রিউমর স্ক্যানার। তবে কারো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। 

ঢাবিতে দায়িত্বরত মূলধারার গণমাধ্যম চ্যানেল২৪ এর সাংবাদিক মো: বোরহান উদ্দিন রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেছেন যে, ঢাবিতে কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কোনো শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি৷ 

অনলাইন সংবাদমাধ্যম ঢাকা ট্রিবিউনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মাহাথির মাহমুদ জানান, ঢাবিতে কোনো শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার মতো এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। মূলধারার সংবাদপত্র দৈনিক আমাদের সময় এর সাংবাদিক আশিকুল হক রিফাত এ বিষয়ে রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেছেন যে, কেউ মারা যায়নি। তবে অসংখ্য শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। 

সংবাদমাধ্যম বিজনেস পোস্টের ঢাবি প্রতিনিধি ইসমে আজমও জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাবিতে শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার দাবিটি গুজব। 

অনলাইন গণমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনের ঢাবি প্রতিনিধি আবিদ হাসান রাসেলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনিও আলোচিত দাবিটি গুজব বলে রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেন।

উল্লেখ্য, আজ (১৬ জুলাই) রংপুরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আবু সাঈদ নামে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের একজন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। এছাড়া, আজ (১৬ জুলাই) চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে দুইজন নিহত হয়েছেন। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার সাইফুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, নিহতদের একজন চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী। আরেকজন পথচারী। এবং ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে ২৫ বছর বয়সী অজ্ঞাতনামা আরেকজন নিহত হয়েছেন।

মূলত, গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের সাথে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের কয়েক শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। এরই প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ ঢাবিতে শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী নিহতের বেশ কয়েকটি দাবি ছড়িয়ে পড়ে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাবিতে শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের কর্মী নিহতের দাবিগুলো মিথ্যা। কতিপয় পোস্টে যে ব্যক্তির ছবি যুক্ত করে নিহতের দাবি করা হচ্ছে সে ব্যক্তি কোটা আন্দোলনে হওয়া হামলায় আহত হয়েছেন, নিহত হননি। এছাড়া, উক্ত হামলার ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত অন্য কেউও নিহত হননি। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে আজ রংপুর, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় মোট চারজন নিহত হয়েছেন।

উল্লেখ্য, কাল কোটা সংস্কার আন্দোলনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর নিহতের গুজব ছড়িয়ে পড়লে তা শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।

সুতরাং, চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনায় ঢাবিতে শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হয়েছে শীর্ষক দাবি ইন্টারনেটে প্রচারিত তথ্যগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img