গত ১২ অক্টোবর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এর ফেসবুক পেজে এনসিপির সংগঠক মুনতাসির মাহমুদ বরাবর কারণ দর্শানোর নোটিশ ও অব্যাহতির চিঠি পোস্ট করা হয়। চিঠিতে বলা হয়, ‘আপনার বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এমতাবস্থায় আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যাওয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি’র আহবায়ক জনাব নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব জনাব আখতার হোসেনের নির্দেশ মোতাবেক আপনাকে দলের সকল প্রকার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড থেকে এতদ্দ্বারা সাময়িক অব্যাহতি প্রদান করা হলো। এ অব্যাহতি আদেশ আজ হতে কার্যকর হবে।’ একই সঙ্গে কেন মুনতাসিরকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতি দেওয়া হবে না, তার লিখিত ব্যাখ্যা দলের কেন্দ্রীয় শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান জনাব অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ আল-আমিনের নিকট ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দিতে বলা হয়।
এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি প্রচার করা হয়েছে, ‘সমকামিতার অভিযোগে সমালোচনার মুখে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তাদের কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক মুনতাসির মাহমুদকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দিয়েছে।’ এছাড়াও, মুনতাসির মাহমুদের ছবি দাবিতে একজন ব্যক্তির ছবিও প্রচার করা হয়েছে।

এরূপ দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদন : ঢাকা প্রকাশ, বার্তা বাজার, নয়া সংবাদ, জাগো বাংলা, আন্তঃবাণী, মতবাদ, পিএনএস নিউজ২৪, সাভার নিউজ২৪।
এছাড়াও, আলোচিত দাবিতে সংবাদ প্রকাশ করে পরবর্তীতে পরিবর্তন করে জাগোনিউজ২৪।

এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
এরূপ দাবিতে ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সংগঠক মুনতাসির মাহমুদকে সমকামিতার অভিযোগে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়নি বরং, দলীয় শৃ্ঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে এরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া, মুনতাসির মাহমুদের ছবি দাবিতে প্রচারিত ছবিটি প্রকৃতপক্ষে মোহাম্মদ মুনতাসির রহমান নামে ভিন্ন এক ব্যক্তির, যিনি এনসিপির প্রতিষ্ঠাকালে শুরুর দিকে যুগ্ম সদস্য সচিব পদ লাভ করলেও ‘এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের সাথে জড়িত’ থাকার অভিযোগে সমালোচনা শুরু হলে এক পর্যায়ে তাকে এনসিপি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে মুনতাসির মাহমুদের ছবি দাবিতে প্রচারিত ছবিটি নিয়ে অনুসন্ধানে ‘Md Muntasir Rahman’ নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে গত ২৭ সেপ্টেম্বরে প্রচারিত একটি পোস্ট পাওয়া যায়। পোস্টটিতে দুইটি ছবিরও সংযুক্তি পাওয়া যায়, যার সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবিটির তুলনা করলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে দুজন একই ব্যক্তি।

পোস্টটির ক্যাপশনে মুনতাসির রহমান লিখেন, ‘২০২৫ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি—আমার এনসিপিতে যুগ্ম সদস্যসচিব হিসেবে অন্তর্ভুক্তির পর, টানা দুই দিন ধরে আমার ছবি ও পরিচয়কে ঘিরে নিরন্তর জনসমক্ষে বুলিং, হয়রানি ও হুমকির শিকার হতে হয়। শেষ পর্যন্ত আমাকে এনসিপি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপরও এক মাসেরও বেশি সময় ধরে হয়রানি চলতে থাকে। তবুও আমি আবার উঠে দাঁড়িয়েছি, এবং নিজের মত আমার জীবন চালিয়ে যাব।..’
পরবর্তীতে এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে গত ২৮ ফেব্রুয়ারিতে একাধিক গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে সেসময় জাতীয় নাগরিক পার্টির আংশিক কমিটির তালিকা পাওয়া যায়। উক্ত কমিটিতে যুগ্ম সদস্যসচিব হিসেবে মুনতাসির রহমানের নামও উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও, অনুসন্ধানে জানা যায়, সে সময় ‘এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের সাথে জড়িত’ থাকার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীতে গত ২ মার্চে জাতীয় নাগরিক পার্টির ফেসবুক পেজে ১ বছরের জন্য অনুমোদিত কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির তালিকা প্রকাশ করা হলে সেখানে যুগ্ম সদস্য সচিব পদ থেকে মুনতাসির রহমানের নাম বাদ পড়ে। অপরদিকে উক্ত তালিকায় সংগঠক পদে মুনতাসির মাহমুদ নামে একজনের নাম পাওয়া যায়।
এরই সূত্র ধরে অনুসন্ধানে এনসিপির কেন্দ্রীয় সংগঠক ‘মুনতাসির মাহমুদ’ এর ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি পাওয়া যায়। অ্যাকাউন্টটি পর্যবেক্ষণ করলে এনসিপির ফেসবুক পেজে মুনতাসির মাহমুদকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়ার পোস্টটি অ্যাকাউন্টটি থেকে গত ১৪ অক্টোবরে শেয়ার করতে দেখা যায়। শেয়ার করে মুনতাসির মাহমুদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘আসসালামু আলাইকুম। আমি আজ সন্ধ্যা ৭টায় বাংলামোটর কেন্দ্রীয় অফিসে যাবো, কারণ দর্শানো নোটিশের লিখিত জবাব দিতে। সাংবাদিক এবং যারা যোগাযোগ করতেছেন, চাইলে আসতে পারেন।’ এছাড়াও, গত ১৫ অক্টোবরে অ্যাকাউন্টটি থেকে পোস্ট হওয়া আরো দুইটি পোস্টেও শোকজ নোটিশের জবাব দিয়েছেন বলে জানানো হয়। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে প্রকৃতপক্ষে এই ফেসবুক অ্যাকাউন্টটিই এনসিপি থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি পাওয়া ব্যক্তি মুনতাসির মাহমুদের। অ্যাকাউন্টটিতে মুনতাসির মাহমুদের ছবিও পাওয়া যায়, যার সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবির সাথে স্পষ্টত বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, যা প্রমাণ করে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত সংবাদে সংযুক্ত মুনতাসির রহমান ও সম্প্রতি এনসিপি থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি পাওয়া মুনতাসির মাহমুদ দুজন ভিন্ন ব্যক্তি।

পরবর্তীতে মুনতাসির মাহমুদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি পর্যবেক্ষণ করলে এনসিপি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়ে তাকে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ ও মাহফুজের ভাইকে দায়ী করে নানা পোস্ট দিতে ও রেড ক্রিসেন্টের নাম উল্লেখ করতে দেখা যায়।
এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো’র ওয়েবসাইটে ‘দুপুরে রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ, সন্ধ্যায় এনসিপি থেকে অব্যাহতি’ শিরোনামে গত ১২ অক্টোবরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করে বিক্ষোভ করা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক মুনতাসির মাহমুদকে অব্যাহতি দিয়েছে দলটি। আজ রোববার (১২ অক্টোবর) দুপুরে ওই বিক্ষোভের পর সন্ধ্যায় এনসিপি এ সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. আজিজুল ইসলামের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের লোকজনকে পুনর্বাসনের অভিযোগ তুলে একদল লোক নিয়ে দুপুরে মগবাজারে সংস্থাটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মধ্যে ঢুকে বিক্ষোভ করেন মুনতাসির মাহমুদ।এরপর সন্ধ্যায় মুনতাসির মাহমুদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ও অব্যাহতির চিঠি পাঠিয়েছে এনসিপি। সেটি দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রকাশ করা হয়েছে।… অবশ্য মুনতাসির মাহমুদের বিরুদ্ধে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ এনসিপির চিঠিতে উল্লেখ করা হয়নি। চিঠিতে দপ্তর সেলের সদস্য সাদিয়া ফারজানা দিনার স্বাক্ষর রয়েছে। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি (মুনতাসির) দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন। এ জন্য তাঁকে এই চিঠি দেওয়া হয়েছে। রেড ক্রিসেন্টের ঘটনাতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এমন নয়। এখন আপাতত দলের শৃঙ্খলা কমিটি থেকে তাঁকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। তদন্ত চলাকালে আমরা এর বাইরে খুব বেশি কথা বলতে পারব না।’ এই চিঠি ও অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে এনসিপি নেতা মুনতাসির মাহমুদকে হোয়াটসঅ্যাপে কল করা হলে তিনি কল কেটে দেন।’
এছাড়াও, এ বিষয়ে প্রথম আলো’র ওয়েবসাইটে গত ১৩ অক্টোবরে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদন পাওয়া যায় যেখানে বলা হয়, ‘..রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে আসলে কী ঘটছে, মুনতাসির কেন এনসিপি থেকে অব্যাহতি পেলেন, এখন কেন তিনি উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ভাইকে দুষছেন—এসব বিষয়ে জানতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাতে জানা গেছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর মুনতাসির রেড ক্রিসেন্টে উপপরিচালক পদে চাকরি পেয়েছিলেন। আর উপদেষ্টা মাহফুজের ভাই মাহবুব রেড ক্রিসেন্টের ব্যবস্থাপনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রেড ক্রিসেন্টে মুনতাসির মাহমুদের চাকরিটি ছিল অস্থায়ী। কয়েক দিন ধরে তিনি রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছিলেন। এনসিপির পক্ষ থেকে নিষেধ করার পরও গতকাল তিনি সেখানে বিক্ষোভ করেন। ওই দিন রেড ক্রিসেন্টের বোর্ড সভায় তাঁকে চাকরি থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত হয়।’
প্রথম আলো’র প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ভাই মাহবুব আলম প্রথম আলোর জিজ্ঞাসায় বলেন, প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা না থাকার পরও ‘বিশেষ বিবেচনায়’ রেড ক্রিসেন্টের উপপরিচালক পদে চাকরি নিয়েছিলেন মুনতাসির। তিনি কয়েক দিন ধরে রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ করছিলেন। এর মধ্যে গত শনিবার রাতে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সঙ্গে কথা বলেন মুনতাসির ও এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক মাহমুদা মিতু (রেড ক্রিসেন্টের আরেক বোর্ড সদস্য)। নাহিদ তাঁদের আন্দোলনের পরিবর্তে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু মুনতাসির তারপরও বিক্ষোভ চালিয়ে যান।’ পরবর্তীতে মুনতাসির মাহমুদ প্রথম আলোর প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১৪ অক্টোবরে আরেকটি পোস্ট করেন। এছাড়াও, আরো নানা গণমাধ্যমেও মুনতাসির মাহমুদ ও রেড ক্রিসেন্টের ইস্যুর বিষয়ে সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়। তবে কোথাও তার বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ, এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে মুনতাসির মাহমুদের ছবি দাবিতে প্রচারিত ছবিটি প্রকৃতপক্ষে মুনতাসির রহমান নামে ভিন্ন এক ব্যক্তির এবং মুনতাসির মাহমুদের বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগে অব্যাহতির বিষয়টি সঠিক নয়।
সুতরাং, ভিন্ন ব্যক্তির ছবিকে মুনতাসির মাহমুদ দাবি করে সমকামিতার অভিযোগে মুনতাসির মাহমুদকে এনসিপি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে শীর্ষক দাবি বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Md Muntasir Rahman – Facebook Post
- Somoy TV – জাতীয় নাগরিক পার্টির আংশিক কমিটি ঘোষণা
- Bangla News24 – এনসিপির আহ্বায়ক কমিটিতে কোন পদে কে
- National Citizen Party – Facebook Post
- National Citizen Party – Facebook Post
- Muntasir Mahmud – Facebook Post
- Muntasir Mahmud – Facebook Post
- Muntasir Mahmud – Facebook Post
- Prothom Alo – দুপুরে রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ, সন্ধ্যায় এনসিপি থেকে অব্যাহতি
- Prothom Alo – চাকরি-এনসিপির পদ হারিয়ে মুনতাসির কেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ভাইকে দুষছেন
- Rumor Scanner’s analysis