জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির রায়ের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে আগামী ১৩ নভেম্বর। এই রায়কে ঘিরে ১৩ নভেম্বর রাজধানী ঢাকায় ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এরই প্রেক্ষাপটে সামাজিক মাধ্যমে ঢাকায় লকডাউন শুরু হয়েছে দাবিতে অন্তত চারটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে।

দাবি ১
একটি মহাসড়কে ককশিট সদৃশ বস্তু পোড়ানোর দৃশ্যযুক্ত একটি ভিডিও ‘লকডাউন শুরু ঢাকায় জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ ক্যাপশনে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ, ভিডিওটি আওয়ামী লীগের আসন্ন লকডাউন কর্মসূচির অংশ হিসেবে সড়ক অবরোধের দৃশ্য দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। ভিডিওটি ছড়িয়েছে ফেসবুক এবং টিকটকে।

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে বাংলা ট্রিবিউনের ওয়েবসাইটে ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে সংযুক্ত ছবির সঙ্গে আলোচিত ভিডিওটির শুরুর অংশের হুবহু মিল রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেদিন বিএনপির নেতাকর্মীরা তৃতীয় দিনের মতো অবরোধ পালনকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। এটি সে ঘটনারই ছবি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের একটি প্রতিবেদনেও ছবিটি সম্পর্কে একই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

ভিডিওটি বিশ্লেষণেও কয়েকটি অসংগতি ধরা পড়ে। দেখা যায়, একজন ব্যক্তি আগুন থেকে একটি বস্তু টেনে বের করছেন, কিন্তু সেটিতে কোনো আগুন নেই। এ ধরনের অসংগতি সাধারণত এআই দিয়ে তৈরি ভিডিওতে দেখা যায়। এছাড়া, ভিডিওটি বাস্তব হলে আগুনের ভেতরে হাত দেওয়া স্বাভাবিক নয়। তাছাড়া, ২০২৩ সালের ঘটনার ছবি পাওয়া গেলেও একই ঘটনার কোনো ভিডিও অনলাইনে পাওয়া যায়নি।
এসব তথ্য বিশ্লেষণে নিশ্চিত হওয়া যায়, ২০২৩ সালের বিএনপির সড়ক অবরোধের ছবি ব্যবহার করে এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে আলোচিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।
দাবি ২
একটি সড়কে আগুন জ্বালানোর দৃশ্যযুক্ত একটি ভিডিও ‘ঢাকায় লকডাউন শুরু আসল খেলা শুরু হবে ১৩ তারিখে’ ক্যাপশনে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ, ভিডিওটি আওয়ামী লীগের আসন্ন লকডাউন কর্মসূচির অংশ হিসেবে সড়কে আগুন জ্বালানোর দৃশ্য দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। ভিডিওটি ছড়িয়েছে ফেসবুকে।

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে সংযুক্ত ছবির সঙ্গে আলোচিত ভিডিওটির শুরুর অংশের দৃশ্যের মিল পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের কর্তৃক সড়কে আগুন জ্বালানোর দৃশ্য। সেদিন প্রথম আলোর আরেকটি প্রতিবেদনেও একই ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল।

ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করেও কয়েকটি অসংগতি ধরা পড়ে। দেখা যায়, বিভিন্ন ফ্রেমে ভিডিওতে থাকা ব্যক্তিদের অবস্থান ও পোশাকের রঙ হঠাৎ পরিবর্তিত হচ্ছে এবং তাদের হাঁটার ভঙ্গিতেও অস্বাভাবিকতা রয়েছে। এ ধরনের বৈশিষ্ট্য সাধারণত এআই দিয়ে তৈরি ভিডিওতে দেখা যায়। তাছাড়া, ঘটনার ছবি পাওয়া গেলেও এর সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো ভিডিও অনলাইনে পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ, জানুয়ারির ঢাবি ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের একটি ছবি ব্যবহার করে এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে আলোচিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।
দাবি ৩
একটি সড়কে আগুন জ্বালিয়ে ‘জয় বাংলার জয়’ স্লোগান দিতে দিতে আগুনের পেছনে সমবেত হওয়ার একটি ভিডিও আওয়ামী লীগের আসন্ন লকডাউন কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ (১০ নভেম্বর) ভোরে ঢাকার দৃশ্য দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। ভিডিওটি ছড়িয়েছে ফেসবুক এবং টিকটকে।

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে সময় টিভির ওয়েবসাইটে গত ৩ নভেম্বর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে সংযুক্ত ছবির সঙ্গে আলোচিত ভিডিওটির শুরুর অংশের দৃশ্যের হুবহু মিল রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছবিটি মাদারীপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী লাভলু মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার পর তার কর্মী-সমর্থকদের ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভের সময়ের দৃশ্য। ৪ নভেম্বর ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদনেও ছবিটি ব্যবহৃত হয়েছে।

সেদিনের ঘটনার একাধিক ভিডিও (১,২) পাওয়া গেলেও আলোচিত ভিডিওটির সঙ্গে তাদের হুবহু মিল পাওয়া যায়নি এবং সেখানে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানও শোনা যায়নি। ভিডিওটিতে আরও কিছু অসংগতি দেখা যায়, যেমন একই ভঙ্গিতে একাধিক ব্যক্তি স্লোগান দিতে দিতে আগুনের পেছনে গিয়ে সমবেত হচ্ছেন এবং স্লোগানের শব্দেও কৃত্রিমতা লক্ষ্য করা যায়। এগুলোও এআই দিয়ে তৈরি ভিডিওর বৈশিষ্ট্য।
অর্থাৎ, মনোনয়ন বঞ্চিত বিএনপি নেতার কর্মী-সমর্থকদের অবরোধের ছবি এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে ভিডিওতে রূপান্তর করে আওয়ামী লীগের আসন্ন লকডাউন কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে ছড়ানো হয়েছে।
দাবি ৪
একটি সড়কে আগুন জ্বলতে থাকার দৃশ্যযুক্ত একটি ভিডিও ‘এই মুহূর্তে চলছে, ১৩ তারিখ ঢাকা লকডাউন করে দেওয়া হবে এই থেকে ঢাকা আন্দোলন সংগ্রাম চলবে আপনারা সবাই উপস্থিত থাকেন’ ক্যাপশনে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ, ভিডিওটি আওয়ামী লীগের আসন্ন লকডাউন কর্মসূচির অংশ হিসেবে সড়কে আগুন জ্বালানোর দৃশ্য দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। ভিডিওটি ছড়িয়েছে ফেসবুকে।

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে আরব নিউজের ওয়েবসাইটে ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে সংযুক্ত ছবির সঙ্গে আলোচিত ভিডিওটির শুরুর অংশের দৃশ্যের হুবহু মিল রয়েছে। ছবিটির ক্যাপশন অনুযায়ী এটি ঢাকায় অনুষ্ঠিত কোটা বিরোধী আন্দোলনের দৃশ্য। ছবিটি এএফপির সৌজন্যে প্রকাশিত, যা পরবর্তীতে এএফপির ওয়েবসাইটেও পাওয়া যায়।

ভিডিওটি পর্যবেক্ষণেও অসংগতি দেখা যায়। ভিডিওর শুরুর দিকে নীল টি-শার্ট পরা একজন ব্যক্তিকে পানি বিক্রি করতে দেখা গেলেও পরবর্তী ফ্রেমগুলোতে তার মাথার উপরের পানির বোতলগুলো অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখা যায়।
অর্থাৎ, গত বছরের কোটা বিরোধী আন্দোলনের একটি ছবি ব্যবহার করে এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে ভিডিওতে রূপান্তর করে তৈরি করে আওয়ামী লীগের আসন্ন লকডাউন কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে ছড়ানো হয়েছে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, আলোচিত চারটি ভিডিওর প্রতিটিই ছয় সেকেন্ড দীর্ঘ এবং ভিডিওগুলোর প্রথম দৃশ্যের সঙ্গে প্রাপ্ত ছবিগুলোর মিল রয়েছে, যা ইঙ্গিত করে এগুলো তৈরিতে কোনো নির্দিষ্ট এআই টুল ব্যবহার করা হয়েছে।
সুতরাং, ভিন্ন সময়ের চারটি আলাদা ঘটনার ছবি সংগ্রহ করে এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে ভিডিওতে রূপান্তরিত করে ১৩ নভেম্বর ঢাকায় আওয়ামী লীগের ডাকা ‘লকডাউন’ কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে প্রচার করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Rumor Scanner’s analysis.
- Bangla Tribune: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়ি ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণ
- Prothom Alo: সোমবার ঢাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত, সাত কলেজের সামনে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা শিক্ষার্থীদের
- Somoy Tv: মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ
- Arab News: Street clashes in Bangladesh leave 702 people injured, among them 104 police and 30 journalists

























