আবহমানকাল ধরেই এদেশে গ্রাম থেকে শহরে নানা বিষয়ে অসংখ্য মিথ বা প্রচলিত রীতির চল দেখে এসেছি আমরা। এসব মিথের বিপরীতে অকট্য বৈজ্ঞানিক প্রমাণ বা যুক্তির প্রচলন খুব একটা না থাকায় মিথগুলো দিনে দিনে বিস্তৃত হয়েছে। মানুষও যাচাই না করেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সেসব মিথ বা রীতি পালনে। কিন্তু এসব মিথের সবই কি সত্য? সবগুলো মিথই কি বিজ্ঞান সম্মত? ২০২২ সালে বেশকিছু প্রচলিত মিথ নিয়ে অনুসন্ধান করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। বছরব্যাপী সর্বমোট ২০টি মিথের বিষয়ে ফ্যাক্টফাইল প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। এর মধ্যে থাকা বাছাইকৃত শীর্ষ পাঁচটি মিথ নিয়ে আজকের এই লেখা। তাছাড়া, এই লেখায় শেষে বাকি ১৫টি মিথ বিষয়ক ফ্যাক্ট ফাইলের তালিকাও দেয়া হয়েছে।
আলোচিত পাঁচ মিথ
১. খাদ্যে টেস্টিং সল্ট ব্যবহার কী ক্ষতিকারক?
টেস্টিং সল্ট বলতে মূলত মনোসোডিয়াম গ্লুটামেটকে বোঝানো হয়। সংক্ষেপে একে এমএসজি (MSG) নামেও ডাকা হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রান্নায় বৈচিত্র্যময় স্বাদ আনতে এই বিশেষ লবণ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই টেস্টিং সল্ট ঘিরে বহু বছর ধরে বিভ্রান্তিকর তথ্য ও ব্যাখ্যা প্রচার হয়ে আসছে। এই খাদ্য উপাদানকে এক শব্দে ক্ষতিকারক হিসেবেই রায় দিয়ে আসছেন চিকিৎসক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষরা।
তবে রিউমর স্ক্যানার টিম এ বিষয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখেছে, খাদ্যে অতিরিক্ত টেস্টিং সল্ট ক্ষতিকারক এমন তথ্যের কোনো ভিত্তি নেই।
এ বিষয়ে প্রকাশিত ফ্যাক্ট ফাইলে রিউমর স্ক্যানার জানিয়েছে, ১৯০৮ সালে উদ্ভাবিত এই উপাদান নিয়ে পরের ৬০ বছর কোনো অভিযোগ আসে নি। ‘চীনা রেস্তোরায় টেস্টিং সল্টযুক্ত খাবার খেয়ে বিভিন্ন উপসর্গে অসুস্থ হয়েছেন’ – ১৯৬৮ সালে একজন মার্কিনীর এমন অভিযোগের পর টেস্টিং সল্ট ঘিরে নিয়মিত অভিযোগ আসতে থাকে। এর প্রেক্ষিতে ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের দুইটি সংস্থা, ১৯৯১ সালে ইউরোপিয়ান কমিশনস সায়েন্টিফিক কমিটি ফর ফুড এবং ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) টেস্টিং সল্টের ব্যবহারকে নিরাপদ বলে স্বীকৃতি দেয়। সংস্থাগুলো এটি ব্যবহারের কোনো মাত্রাও ঠিক করে দেয় নি। তবে এফডিএ বলেছে, খালি পেটে তিন গ্রামের বেশি খেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। মার্কিন এক পুষ্টিবিদ মনে করেন, টেস্টিং সল্টকে যে উপসর্গগুলোর জন্য দায়ী করা হচ্ছে এমনও হতে পারে সেই উপসর্গের জন্য দায়ী একই খাবারে থাকা অন্য উপাদান। অর্থাৎ, টেস্টিং সল্ট ক্ষতিকারক নয়।
২. পরীক্ষার আগে ডিম খেলে কী পরীক্ষা খারাপ হয়?
ছোট বয়স থেকে শুরু করে বড় বেলায় এসেও আমরা শুনে এসেছি, পরীক্ষার আগে ডিম খাওয়া যাবে না। ডিম খেলে পরীক্ষা খারাপ হবে। পরীক্ষাভীতির সাথে ডিমের এই ভীতির সম্পর্ক বহু পুরনো।
তবে রিউমর স্ক্যানার টিম এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখেছে, ‘পরীক্ষার আগে ডিম খেলে পরীক্ষা খারাপ হয়’ এমন দাবি মিথ্যা।
এ বিষয়ে প্রকাশিত ফ্যাক্ট ফাইলে রিউমর স্ক্যানার জানিয়েছে, সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবে বহু বছর ধরে ‘পরীক্ষার আগে ডিম খেলে পরীক্ষা খারাপ হয়’ এমন একটি তথ্য প্রচার হয়ে আসছে। অথচ এই দাবির স্বপক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের বরাতে, পরীক্ষার দিন সকালে অন্যান্য খাবারের সাথে ডিম রাখতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিবিসি পরামর্শ দিয়েছে, পরীক্ষার দিনের সেরা সকালের নাস্তা হতে পারে ধীরে নিঃসরণ হয় এমন কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার। এটি হতে পারে, পুরো রোলড পোরিজ ওটস, গোটা শস্যের রুটি বা কম চিনিযুক্ত মুয়েসলি। প্রোটিন জাতীয় খাবারও তালিকায় রাখা যেতে পারে। যেমন দুধ, দই বা ডিম। অর্থাৎ, পরীক্ষার আগে এখন থেকে কোনো চিন্তা ছাড়াই স্বাচ্ছন্দ্যে ডিম খেতে পারেন আপনি।
৩. বাদুড়ের চোখে দেখতে না পাওয়ার দাবির সত্যতা কতটুকু?
বাদুড় চোখে দেখে না এমন একটি ভ্রান্ত ধারণা আমাদের সমাজে বহু বছর ধরেই বেশ প্রচলিত একটি মিথ। আবার এমন কথারও প্রচলন আছে যে, বাদুড় দিনে চোখে দেখতে না পারলেও রাতে চোখে দেখে। এই বিষয়টি নবম-দশম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়েও উল্লেখ রয়েছে।
তবে রিউমর স্ক্যানার টিম এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখেছে, বাদুড় চোখে দেখে না কিংবা শুধুমাত্র রাতেই চোখে দেখে এমন দাবিগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
এ বিষয়ে প্রকাশিত ফ্যাক্ট ফাইলে রিউমর স্ক্যানার জানিয়েছে, বাদুড়ের প্রায় ১৪০০ প্রজাতির মধ্যে কোনোটাই অন্ধ নয়। দৃষ্টিশক্তির কম বেশি পার্থক্য থাকলেও কোনো প্রজাতিই অন্ধ নয়। বরং আকারে বড় প্রজাতির বাদুড় মানুষের চেয়েও প্রখর দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন হয়। বাদুড় অন্ধ হয় এই ভুল ধারণাটি তাদের নিশাচর প্রকৃতি এবং উন্নত শ্রবণ ক্ষমতা থেকে আসে। কারণ তারা বেশিরভাগই রাতের শেষের দিকে শিকার করে, যখন আলোর অবস্থা অবশ্যই খুব অন্ধকার, বাদুড়রা শিকারের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করতে প্রতিধ্বনি বা ইকোলোকেশন এর ওপর নির্ভর করে। এর সাহায্যে বাদুড় অন্ধকারে চলাচল করতে পারে, পথে বাঁধা ও প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে চলতে পারে এবং কাঙ্খিত খাবার সংগ্রহ করতে পারে।
আমরা সবসময়ই লোকেমুখে শুনে এসেছি, সাপ দুধ খায়৷ সাপের দুধ পান করার তথ্যটি বহু বছরের পুরনো।
তবে রিউমর স্ক্যানার টিম এ বিষয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখেছে, সাপ দুধ পান করে এমন তথ্যের কোনো ভিত্তি নেই।
এ বিষয়ে প্রকাশিত ফ্যাক্ট ফাইলে রিউমর স্ক্যানার জানিয়েছে, সাপের ল্যাকটেজ এনজাইম না থাকায় পরিপাক প্রক্রিয়ায় দুধের মতো ল্যাকটোজ সমৃদ্ধ খাদ্য হজম হয় না। তাই সাপের পক্ষে দুধ হজম হওয়া সম্ভব নয়। তবে কিছুদিন তৃষ্ণার্ত থাকা সাপকে দুধ দিলে সে এটিকে পানি মনে করে পান করে। এতে করে সাপটির মৃত্যুর আশঙ্কা সৃষ্টি হয় বলে মত দিয়েছন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে গবেষণাকারী ইতালিয়ান গবেষক ডেভিড ইরমাকোরা রিউমর স্ক্যানারকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
৫. চোখ ওঠা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দিকে তাকালে সুস্থ ব্যক্তির চোখও কি আক্রান্ত হয়?
সমাজে প্রচলিত একটি ধারণা আছে যে, চোখ ওঠা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দিকে তাকালে সুস্থ ব্যক্তির চোখও আক্রান্ত হবে৷ আপনি নিজেও হয়ত এমনটাই ভেবে এসেছেন এতদিন।
তবে রিউমর স্ক্যানার টিম এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখেছে, চোখ ওঠা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দিকে তাকালে সুস্থ ব্যক্তির চোখও আক্রান্ত হবে এমন তথ্যটি সঠিক নয়।
এ বিষয়ে প্রকাশিত ফ্যাক্ট ফাইলে রিউমর স্ক্যানার জানিয়েছে, যখন চোখের সাদা অংশ লালচে বা গোলাপী হয়ে যায় এবং চুলকানি শুরু হয়, তখন এটিকে কনজাংটিভাইটিস হিসেবে ধরা হয়। যাকে বাংলায় বলে চোখ ওঠা রোগ। এটি বিভিন্ন কারণে যেমন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সংক্রমণ অথবা অ্যালার্জির কারণে হতে পারে। এদের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসজনিত কনজাংটিভাইটিস উভয়ই অত্যন্ত সংক্রামক বা ছোয়াঁচে। অ্যালার্জিজনিত কনজাংটিভাইটিস ছোঁয়াচে নয়। অপরদিকে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা অন্য কোনো জীবানুই আলোকরশ্মির সাহায্যে এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না যেহেতু তাই কনজাংটিভাইটিস প্রকৃতপক্ষে ছড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শের সাহায্যে। এই সময়ে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাবোধের মাধ্যমে যে কেউ এই সংক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন। বিপরীতে মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটি ধারণা চলে আসছে যে, চোখ ওঠা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দিকে তাকালে সুস্থ ব্যক্তির চোখও আক্রান্ত হয়। কিন্তু এই ধারণাটির কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই, এটি সমাজে বহুল প্রচলিত একটি মিথ মাত্র।
২০২২ সালে রিউমর স্ক্যানার প্রকাশিত অন্যান্য মিথভিত্তিক ফ্যাক্ট ফাইল দেখে নিন এক নজরে
১. ডেঙ্গু বিষয়ে প্রচলিত ধারণাগুলোর সত্যতা কতটুকু?
২. গাছ থেকেই কী পৃথিবীর বেশিরভাগ অক্সিজেন উৎপন্ন হয়?
৩. ঘন ঘন শেভ করলে কি দাড়ি গজায়?
৪. গোসলে মাথায় আগে পানি ঢাললে স্ট্রোক হয়?
৫. নবজাতককে কী তেল মালিশ করা উচিত?
৭. প্রতি একশ বছর পর পর মহামারি আসার সত্যতা কতটুকু?
৮. নবজাতককে মধু খাওয়ানো কী ঠিক?
৯. দুধ আর আনারস একসাথে খেলে মৃত্যু হয়?
১০. প্লাস্টিকের চাল; বাস্তব না মিথ?
১১. ষাঁড় কি লাল কাপড় দেখলে রেগে যায়?
১২. প্লাস্টিকের ডিম বাস্তব নাকি মিথ?
১৩. সুঁচ ফুটিয়ে আঙুলে ও কানে রক্তপাতে স্ট্রোক রোধ করা সম্ভব?
১৪. তেঁতুল খেলে কি বুদ্ধি কমে এবং রক্ত পানি হয়ে যায়?
১৫. জোড়া কলা খেলে কি যমজ সন্তান হয়?
সমাজে প্রচলিত মিথগুলো যে সবসময় সত্য বলে গণ্য হবে এমন ভাবার উপায় নেই। কোনো কোনো মিথ মানুষ হয়ত ভুল বিশ্বাসে সত্য বলেই মেনে এসেছে এতদিন কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে এখন আর ভুল বিশ্বাস আর প্রচলিত ভুল রীতি মেনে আসার উপায় নেই। কোনো মিথ সত্য বলে মেনে নেওয়া এবং সেই মিথ অনুযায়ী কাজ করার আগে অবশ্যই সত্যতা যাচাই করে নেওয়া অতীব জরুরি।