দুধ আর আনারস একসাথে খেলে মৃত্যু হয়?

পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে সারাবিশ্বেই দুধ এক বহুল পরিচিত নাম। বলা হয়ে থাকে, দুধ একটি পরিপূরক খাবার। বিশেষত গরুর দুধ বহু বছর ধরেই অনেক মানুষের জন্য একটি দৈনিক প্রধান খাদ্য। দুধের মতো নানা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ ফল হিসেবে সারাবিশ্বেই জনপ্রিয় আনারস। ফল ছাড়াও রান্না করে, সালাদ হিসেবে, জুস হিসেবেও আনারস খেতে পছন্দ করেন অনেকে। কিন্তু আপনি কি কখনো আনারস ও দুধ একসাথে খেয়েছেন? বহু বছর ধরে এই দুই খাবার একসাথে খাওয়াকে কেন্দ্র করে মিথ, আলোচনা, সমালোচনা চলে আসছে৷ 

দুধ-আনারস খেয়ে মৃত্যুতে বিভ্রান্তি ও আলোচনার নমুনা

১. জাতীয় দৈনিক The Daily Star এর ওয়েবসাইটে ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর Man dies after taking milk pineapple at a time (দুধ আনারস একসাথে খেয়ে পুরুষের মৃত্যু) শিরোনামে (আর্কাইভ) একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, “রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে বিয়ের অনুষ্ঠানে দুধ পান ও আনারস খেয়ে একই সঙ্গে গতকাল এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন,মারা যাওয়া ব্যাক্তি বিয়ের অনুষ্ঠানে মদ্যপ ছিল। মৃত্যুর আগে তার স্বামীর বরাত দিয়ে ইতি আক্তার বলেন, তিনি তার প্রতিবেশী নুর হোসেনের বিয়েতে মদ পান করেছিলেন এবং তারপর তার বন্ধুদের সাথে বাজি ধরেছিলেন যে তিনি দুধ পান করবেন এবং একই সাথে আনারস খাবেন।” 

Screenshot from The Daily Star website

২. জাতীয় দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই যে ফল ও খাবারগুলো একসঙ্গে খেতে মানা (আর্কাইভ) শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “দুধ এবং আনারস একসঙ্গে খেলে আপনি বমি, সংক্রমণ, ডায়রিয়া, মাথাব্যথা এবং এমনকি পাকস্থলীর ব্যথায় আক্রান্ত হতে পারেন। আনারসে থাকা ব্রোমালেইন এবং ল্যাকটিক এসিড একসঙ্গে মিশলে বিষক্রিয়া হয়।”। 

Screenshot from Kalerkantho website

৩. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ২০১২ সালে iSolution নামের একটি পেজ থেকে ‘আনারস আর দুধ এক সাথে খাওয়া যায় না!‘ (আর্কাইভ) শিরোনামে একটি পোস্ট করা হয়। পোস্টে উল্লেখ করা হয়, “কুসংস্কার: আনারস আর দুধ এক সাথে খাওয়া যায় না এখন পর্যন্ত আনারস এবং দুধের মাঝে এমন কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া খুঁজে পাওয়া যায়নি যার ফলে এদেরকে এক সাথে খেলে সেটা মানুষের জীবনহানি করবে।” 

Screenshot from iSolution facebook page

একই বিষয়ে আরো কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ দুধ-আনারস

দুধ বলতে আমরা সাধারণত গরুর দুধকেই বুঝিয়ে থাকি। পৃথিবীতে মানুষ বাদে কোনো প্রাণী অন্য প্রাণীর দুধ খায় না এটা যেমন সত্য তেমনি অন্য কোনো প্রাণী তার শিশুকাল পেরিয়ে আর কখনো দুধ খায় না। মানুষ বিভিন্ন প্রাণী বিশেষ করে গরুর দুধ খেয়ে আসছে ছোটবেলা থেকেই।  

স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট healthline এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এক কাপ দুধে ১৫২ ক্যালরি শক্তি রয়েছে, আছে প্রোটিন, কার্ব, সুগার, ফাইবার ও ফ্যাটের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। 

Screenshot source : healthline

দুধে আছে অ্যামিনো অ্যাসিড, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজ পদার্থ যেমন ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, কোবাল্ট, কপার, জিংক, আয়োডিন ও সেলেনিয়াম। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ক্যানসার ও হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধে দুধের শক্তিশালী ভূমিকা প্রমাণিত হয়েছে। মানবদেহের হাড় বিষয়ে গবেষণা করে এমন একটি ব্রিটিশ সংস্থার বরাত দিয়ে বিবিসি বলছে, তরুণ বয়সে যারা দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবার পরিহার করে তাদের জন্য ভবিষ্যতে বিপদ আছে। অ্যাপোলো হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ তামান্না চৌধুরী বলছেন, “ফুড পিরামিডে সব সময় এক গ্লাস দুধের ছবি দেওয়া থাকে। অর্থাৎ শরীর ভালো রাখতে হলে প্রতিদিন দুধ খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।”

অন্যদিকে ফল হিসেবে আনারস সমাদৃত এক খাদ্য। ১ কাপ আনারস খন্ডে ৮৩ ক্যালরি শক্তি থাকে৷ এই ফলে থাকা পুষ্টি উপাদানগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ফ্যাট, প্রোটিন, কার্বস, ফাইবার, ভিটামিন সি, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, থায়ামিন, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, নিয়াসিন, ফলেট ইত্যাদি।

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালের প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা হাসিনা আকতার বলছেন, “আনারস থাইরয়েড গ্রন্থির স্ফীত হওয়া প্রতিরোধ করে। নিয়ন্ত্রণ করে উচ্চ রক্তচাপ। তা ছাড়া কৃমিনাশক হিসেবে কাজ করে। ক্ষুদ্রান্ত্রের জীবাণু ধ্বংসে উপকারী। পাশাপাশি কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়। এটি জরায়ু, স্তন, ফুসফুস, অন্ত্র ও ত্বকের ক্যানসার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বার্ধক্যজনিত চোখের ত্রুটি প্রতিরোধে সাহায্য করে। আনারস জ্বর ও জন্ডিস রোগের জন্য বেশ উপকারী।”

Screenshot source : Prothom Alo

দুধ-আনারসে শারীরিক জটিলতাও আছে?

পুষ্টির প্রশ্নে দুধ ও আনারস অনবদ্য দুই নাম হলেও এগুলোর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পেয়েছেন গবেষকরা।

দুধের কথাই ধরা যাক। গরুর দুধে থাকা ল্যাকটোজ মানুষের পক্ষে হজম করা কঠিন হতে পারে, ফলে বমি বমি ভাব, বাধা, গ্যাস, ফোলাভাব ও ডায়রিয়া হয়।

Screenshot source : healthline

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সবচেয়ে বেশি গরুর দুধ খায় তাদের ফ্র্যাকচার হওয়ার হার তত বেশি। তাই আর্থ্রারাইটিসে যারা ভুগছেন, তাদের গরু দুধের বিকল্প দুধ খেতে বলা হয়। একটি সুইডিশ গবেষণায় দেখা গেছে, যে নারীরা প্রতিদিন দুগ্ধজাত ‘পণ্য’ গ্রহণ করেন, তাদের ওভারিয়ান ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা দ্বিগুণ। পুরুষদের হতে পারে প্রোস্টেট ক্যান্সার। এ ছাড়া গরুর দুধের জন্য ওজন বৃদ্ধি, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, অ্যানাফিল্যাক্সিস, শ্বাসকষ্ট, রক্তাক্ত মল, বাচ্চাদের অ্যালার্জি বাড়তে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদেরও দুধের অ্যালার্জি হতে পারে। ব্রণও ট্রিগার করতে পারে।

একইভাবে আনারসেও কিছু ক্ষতিকারক দিক থাকার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা৷ healthline এর আরেক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “আনারসকে ব্যাপকভাবে নিরাপদ বলে মনে করা হয়, যদিও অল্প সংখ্যক মানুষের এতে অ্যালার্জি থাকতে পারে। যাদের ডায়াবেটিস আছে বা রক্ত ​​পাতলা করার ওষুধ খাচ্ছেন তাদের আনারস খাওয়ার সময় আকারের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।” কিছু মানুষ দাবি করেন যে প্রচুর কাঁচা আনারস খেলে পেট খারাপ, বমি বমি ভাব এবং ডায়রিয়া হয়। এটি নিয়ে গবেষণা না হলেও পাকা আনারস নির্বাচন করাই সর্বদা ভাল বলে মত দেওয়া হয়েছে একই প্রতিবেদনে।

Screenshot source : healthline

দুধ-আনারস একসাথে খাওয়া বিষয়ে মিথের প্রচলন কীভাবে? 

দুধ আর আনারস একসাথে খেলে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয় – এমন তথ্য আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। বহুল প্রচলিত এই তথ্যটির উৎপত্তি ঠিক কবে তা সঠিকভাবে জানা যায় না। এ প্রসঙ্গে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকাকে বারডেমের সাবেক প্রধান পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার আলো জানালেন এক লোককাহিনির কথা। আনারস সাধারণত ঝোপঝাড়ের মধ্যেই হয়। আর ঝোপ মানেই সাপের আনাগোনা। প্রচলিত আছে, একবার এক বিষধর সাপ আনারসের ঝোপে ঘাপটি মেরে ছিল। কোনোভাবে সেই সাপ আনারসের গায়ে বিষ ঢেলে দিয়েছিল। এরপর সেই বিষাক্ত আনারস খেয়ে ফেলেন এক ব্যক্তি। এর পরপরই চুমুক দেন দুধের গ্লাসে। ব্যস, খানিক পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। ফলে লোকজন ধরে নেয়, আনারসের পর দুধ পান করায় তিনি প্রাণ খুইয়েছেন এবং তারপর থেকেই ছড়িয়ে পড়ে সেই কুসংস্কার—আনারস আর দুধ একসঙ্গে খেয়েছেন তো মরেছেন!

Screenshot source : Prothom Alo

দুধ-আনারস একসাথে খেলে কি মৃত্যু হওয়া সম্ভব?

২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশী গবেষক ড. মোঃ মাহবুবুর রহমান Food taboo of taking pineapple and milk at a time শিরোনামের একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ইঁদুরের উপর করা এই গবেষনায় ইঁদুরকে বিভিন্ন ঘনমাত্রায় দুধ ও আনারসের রস খেতে দেওয়া হয়েছিল। গবেষণায় এসেছে, একই সময়ে দুই পুষ্টি উপাদান খেয়ে ইঁদুরগুলো সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, “বিষাক্ততা সম্পর্কিত ক্লিনিকাল লক্ষণ, হেমাটোলজিকাল এবং জৈব রাসায়নিক প্যারামিটার, স্থূল এবং অণুবীক্ষণিক ফলাফল প্রস্তাব করে যে একইসময়ে আনারস এবং দুধ গ্রহণ অ-বিষাক্ত। সুতরাং, বাংলাদেশে এই খাদ্য নিয়ে প্রচলিত ট্যাবুটি ভুল।”

Screenshot source : Academia

ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে এক ব্যক্তির দুধ-আনারস খেয়ে মৃত্যুর তথ্য এই দুই পুষ্টি উপাদান বিষয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দেয়। তবে একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, “পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন মৃত ব্যক্তি মদ্যপ অবস্থায় বাজি ধরে দুধ ও আনারস খান এবং কিছুক্ষণ পর অসুস্থ্যবোধ করেন। হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি মারা যান।” মদের যেহেতু শরীরের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলার বিষয়টি প্রমাণিত সত্য তাই ঐ ব্যক্তির মৃত্যু মদ্যপানের কারণেও হওয়া সম্ভব বলে ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান যাচাই এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

Screenshot source : Jachai 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক এমরান কাইয়ুম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘আনারস আর দুধের মিশ্রণে বিষক্রিয়ায় মানুষ মারা যাওয়ার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এটা রাসায়নিকভাবে প্রমাণিত। দুধ হলো অ্যামাইনো এসিডের একটি পলিমার। আনারসে থাকে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও সুক্রোজ। এ দুটো খাবারের মিশ্রণ হলে সেটা বিষ হয়ে যাবে, এটা সত্য নয়।’

একই বিভাগের আরেকজন অধ্যাপক আব্দুল কাদেরের বরাত দিয়ে একই প্রতিবেদনে বলা হয়, “এটা অনেকের পেটে সহ্য হয় না এবং খেলে সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। এজন্য একসঙ্গে না খাওয়াই উত্তম। তবে মারা যাওয়ার আশঙ্কা নেই।’ 

এই দুই পুষ্টি উপাদানের মিশ্রণ খাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে healthline এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ,”আনারস এবং দুধের মিশ্রণ দুধের কেসিনে আনারসের ব্রোমেলিনের প্রভাবের কারণে দইযুক্ত, তিক্ত স্বাদযুক্ত দুধ হতে পারে। নষ্ট হয়ে গেলে সেই দুধ ক্ষতিকর হলেও টকযুক্ত দই অনিরাপদ নয়।”

Screenshot source : healthline

একই মত দিয়েছেন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. মোস্তফা কামাল। বললেন, “আনারসে ব্রোমেলেইন নামে একটি এনজাইম থাকে, যা দুধের ক্যাসিন নামক প্রোটিন ভেঙে ছানা বা দইয়ে পরিণত করতে পারে। এ ছাড়া তেমন কোনো সমস্যা হয় না।”

তবে এই পরিস্থিতিও এড়ানো সম্ভব বলে মত দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্ণওয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের লুই পাস্তুর প্রভাষক ও খাদ্য বিজ্ঞানী ড. ক্রিস্টোফার লস। তিনি বলছেন, “সৌভাগ্যবশত, আপনি আগে থেকে আনারস গরম করে বা রান্না করে এটি এড়াতে চেষ্টা করতে পারেন। তাপ ব্রোমেলিন এনজাইমকে বিকৃত করবে, এটিকে নিষ্ক্রিয় করবে।”

আনারসের সাথে নষ্ট দুধের মিশ্রণ খেতে নিষেধ করে ডা. মোস্তফা কামাল বলছেন, “নষ্ট হয়ে যাওয়া দুধ আর আনারস একত্রে খেলে সেটি ক্ষতিকর হয়। কারণ নষ্ট দুধে অনেক ব্যাকটেরিয়া থাকে। যা আনারসের ব্রোমেলেইনের সাহায্য নিয়ে দুধকে বিষাক্ত করে ফেলতে পারে। আর নষ্ট দুধ কোনো সুস্থ মানুষ খায় বলে আমার মনে হয় না।”

Screenshot source : Jagonews24

পুষ্টিবিদগণ কী বলছেন?

বারডেমের সাবেক প্রধান পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার আলো বলছেন, ‘দুধ আর আনারস একসঙ্গে খেলে মানুষের মৃত্যু হয়—কথাটির বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। এটি নিতান্তই প্রচলিত কুসংস্কার।’

যুক্তি হিসেবে তিনি কাস্টার্ডের কথা বললেন। এতে অন্যান্য ফলের সঙ্গে আনারস তো থাকেই, সঙ্গে থাকে দুধ। আবার আইসক্রিম কিংবা মিল্কশেকেও আনারসের সঙ্গে দুধ ব্যবহার করা হয় অহরহ। এসব খাবার খেলে মৃত্যু তো দূরে থাক, ছোটখাটো সমস্যার অভিযোগও কেউ করেছেন বলে শোনা যায় না। 

এই পুষ্টিবিদ জানালেন, আনারসে প্রচুর ফাইবার বা আঁশ থাকে। এ কারণে আনারস খেলে অনেকের অ্যাসিডিটির সমস্যা দেখা দেয়। অন্যদিকে অনেকেই দুধ হজম করতে পারেন না। ফলে বদহজম বা পেট খারাপ হয়। দুধে ল্যাকটোজেন নামের একটি উপাদান থাকে। অনেকের পেটে এই ল্যাকটোজেন সহ্য হয় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে ল্যাকটোজেন অসহনশীলতা বলা হয়। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, এই সমস্যাগুলোও দুধ আর আনারস একসঙ্গে খাওয়ার জন্য তৈরি হয় না। সমস্যাগুলো দেখা দেয় আমাদের শারীরিক কিছু সমস্যা বা সীমাবদ্ধতার কারণে। 

Screenshot source : Prothom Alo

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলছেন, “‘আনারস একটি এসিডিক এবং টকজাতীয় ফল। দুধের মধ্যে যেকোনো টকজাতীয় জিনিস দিলে দুধ ছানা হয়ে যেতে পারে বা ফেটে যেতে পারে। এটা কমলা ও দুধের বেলায় বা লেবু ও দুধের বেলাতেও ঘটে। ফেটে যাওয়া দুধ খেলে খুব বেশি হলে বদ হজম, পেট ফাঁপা, পেট খারাপ– এ ধরনের সমস্যা হতে পারে, তবে বিষক্রিয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। যাদের গ্যাসট্রিকের সমস্যা রয়েছে, খালি পেটে আনারস খেলে তাদের এই সমস্যা বেড়ে যেতে পারে।” 

অ্যাপোলো হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ তামান্না চৌধুরী বলেন, “দুধের সঙ্গে আনারসের সঠিক সমন্বয় না হলে শারীরিক সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য খাবারের বেলাতেও একই বিষয় হতে পারে।” 

ঢাবির খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইন্সটিটিউশনের অধ্যাপক খালেদা এবিদ বলেন, ‘একসঙ্গে খেলে বিষক্রিয়া হয় বা মারা যায়, এ ধারণার কোনও ভিত্তি নেই। এ দুটো খাবারের মিশ্রণ সামান্য টক্সিক হয়। এতে সামান্য অসুস্থতা হতে পারে। তবে, এটা মারাত্মক কিছু নয়। হয়তো ওই ধারণা থেকে মানুষের মধ্যে বিষক্রিয়া হওয়ার বিষয়টি কুসংস্কার হিসেবে প্রচলিত হয়ে আসছে।’

Screenshot source : Bangla tribune

ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘আনারস আর দুধ বিরতি দিয়ে খাওয়াই ভালো। দুই থেকে তিন ঘণ্টা বিরতি দিয়ে খাওয়া যেতে পারে। নয়তো অনেক সময় পেটে গিয়ে হজমের সমস্যা হতে পারে। তবে যদি সঠিক নিয়মে খাবার বানানো হয় এবং সঠিক খাদ্যের সমন্বয় থাকে তাহলে কোনো সমস্যা হবে না। দুধ ফুটিয়ে নিলে বা প্রসেস করে নিলে টক্সিটিক বিষয়টি আর থাকে না, তখন খাওয়া যেতে পারে। তাই আনারস-দুধ সঠিক নিয়মে এবং সঠিক খাদ্যের সমন্বয়ে খাওয়া যেতে পারে।

অর্থাৎ, সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবে বহু বছর ধরে দুধ আর আনারস একসাথে খেলে মৃত্যু হয় এমন একটি তথ্য প্রচার হয়ে আসছে। অথচ এই দাবির স্বপক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। আগে থেকে শারীরিক সমস্যা থাকলে কিংবা দুধ আর আনারসের মিশ্রণের অনুপাত ঠিক না থাকলে সেটি খেলে কিছু শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে কিন্তু সেই জটিলতা মৃত্যু পর্যন্ত গড়ানোর ব্যাপারে কোনো মত দেন নি বিশেষজ্ঞরা। সুতরাং, দুধ আর আনারস একসাথে খেলে মৃত্যু হয় এমন দাবি মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img