কলা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এক ফল। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এই ফলের উৎপত্তিস্থল হলেও এর চাষ উষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে বেশ উপযোগী। উপকারী নানা স্বাস্থ্যগুণের কারণে দেশে দেশে এই ফলের চাহিদাও থাকে বছরজুড়ে। কিন্তু এই ফল নিয়েও প্রচলিত আছে নানা মিথ বা গুজব যা বিভিন্ন সময়ে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য হিসেবে ছড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়।
কলা নিয়ে যে মিথ প্রচলিত
১. ইউটিউবে Islamic Media TV নামের একটি চ্যানেলে থেকে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী “হায় হায় একি শুনলাম! জোড় কলা খেলে জোড় সন্তান হবে | মিজানুর রহমান আজহারী | Mizanur rahman azhari waz (আর্কাইভ)” শিরোনামে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। ভিডিওতে ইসলামী আলোচক মিজানুর রহমান আজাহারী বলেন, ছোটবেলায় শুনতাম জট কলা খেলে নাকি জমজ বাচ্চা নাকি হয়……। যেখানে তিনি সমাজে এই ধরণের আরো কিছু প্রচলিত মিথ নিয়ে সচেতনতার জন্য আলোচনা করেন।
২. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে Nurul Afser নামের একটি আইডি থেকে ২০২২ সালের ২৩ জুন “দোয়াপ্রার্থী (আর্কাইভ)” শিরোনামে জোড়া কলা বিষয়ক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ছবিসহ পোস্ট করা হয়। পোস্টে উল্লেখ করা হয়, আম্মুর ধারনা এমন কলা খেলে নাকি আমারও একসাথে এমন যমজ যমজ বাচ্চা হবে……।
৩. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে হিমাদ্রী হিয়া নামের একটি আইডি থেকে ২০২১ সালের ২২ এপ্রিল “জোড়া কলা কিনলে (আর্কাইভ)” শিরোনামে একটি ট্রল করা ছবি পোস্ট করা হয়। ছবিতে উল্লেখ করা হয়, জোড়া কলা কিনলে যমজ বাচ্চা হবে……..।
উপকারী গুণে সমৃদ্ধ কলা
কলার বিভিন্ন উপকারী গুণের ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে বিশেষজ্ঞরা তাদের মত দিয়েছেন। HARVARD T.H. CHAN ওয়েবসাইটে কলা নিয়ে লেখা একটি ফিচারে বলা হয়েছে, একটি মধ্যম আকৃতির পাকা কলায় ১১০ ক্যালরি, ০ গ্রাম ফ্যাট, ১ গ্রাম প্রোটিন, ২৮ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১৫ গ্রাম সুগার, ৩ গ্রাম ফাইবার এবং ৪৫০ গ্রাম পটাশিয়াম রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ডিয়েগোর পুষ্টি বিশেষজ্ঞ লরা ফ্লোরস (Laura Flores) বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট Live Science কে বলেছেন, ” কলাতে উচ্চ মাত্রার ভিটামিন বি৬ থাকার ফলে এটি টাইপ-২ ডায়াবেটিস থেকে রক্ষায়, ওজন হ্রাসে, স্নায়ুতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে এবং শ্বেত রক্তকণিকা উৎপাদনে সাহায্য করে। তিনি জানান, “কলাতে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় এটি সূর্যের ফ্রি র্যাডিকেল থেকে আমাদের ত্বককে বাঁচায়। ”
Food and Drug Administration (FDA) এর বরাত দিয়ে Live Science এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “কলার উচ্চ পটাসিয়াম এবং কম সোডিয়াম উপাদান স্বাস্থ্যকর কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেম বজায় রাখতে এবং উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। “
কিছু প্রমাণ ইঙ্গিত করে যে পরিমিত পরিমাণে কলা খেলে সেটি কিডনির ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক হতে পারে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ক্যান্সারে ২০০৫ সালে প্রকাশিত একটি সুইডিশ গবেষণার বরাত দিয়ে Live Science এর প্রতিবেদনে বলা হয়, যেসব মহিলারা প্রতি মাসে ৭৫ টিরও বেশি ফল বা শাকসবজি খান তাদের কিডনি ক্যান্সারের ঝুঁকি ৪০ শতাংশ কমে যায় এবং ফল হিসেবে কলা বিশেষভাবে কার্যকরের কথা এসেছে সেখানে। মহিলারা সপ্তাহে চার থেকে ছয়টি কলা খেলে তাদের কিডনি ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অর্ধেক কমে যায়।
একাধিক কলা খেলে কী হবে?
ভারতের গণমাধ্যম এনডিটিভির ওয়েবসাইটে কলার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিষয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিদিন দুইটির বেশি কলা খাওয়া উচিত নয়। অতিরিক্ত কলা খেলে এতে থাকা চিনি দাঁতের ক্ষতি করতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।
Live Science এর প্রতিবেদনে অতিরিক্ত কলা খাওয়ার কুফল নিয়ে বলেছেন পুষ্টি বিশেষজ্ঞ লরা ফ্লোরস৷ তিনি জানান, অতিরিক্ত কলা খাওয়ার ফলে এতে থাকা ট্রিপটোফ্যান ঘুমকাতুরে করে তুলতে পারে। তিনি আরও বলেন, অতিরিক্ত কলা খেলে এতে থাকা অ্যামাইনো এসিড মাথা ব্যথার উদ্রেক ঘটাতে পারে।
একটি কলাতে ৪৫০ গ্রাম পটাশিয়াম রয়েছে। The University of Maryland Medical Center একটি রিপোর্টের বরাত দিয়ে Live science এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হচ্ছে, অতিরিক্ত পটাশিয়াম হাইপারক্যালেমিয়া নামক রোগের কারণ হতে পারে। এর ফলে পেশি দুর্বল হতে পারে, সাময়িক অবশের ঘটনা ঘটতে পারে এবং অনিয়মিত হ্রৎস্পদন হতে পারে। তবে যখন কেউ অল্প সময়ে ৪৩ টি কলা খাবে তখনই শুধু এই রোগের লক্ষণ দিতে পারে।
National Institutes of Health (NIH) বরাত দিয়ে একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিদিন ৫০০ মিলিগ্রামের বেশি ভিটামিন বি৬ গ্রহণ করলে হাত ও পায়ের স্নায়ুর ক্ষতি হতে পারে। তবে এই ক্ষতির মাত্রায় পৌঁছানোর জন্য আপনাকে হাজার খানেক কলা খেতে হবে।
তবে জোড়া কলা খেয়ে শরীরে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে – এমন কোনো তথ্য বা গবেষণা পাওয়া যায় না।
যমজ বাচ্চা হয় কীভাবে?
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইট Huggies এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, যমজ শিশু সাধারণত দুই ধরনের পদ্ধতিতে জন্ম নেয়। একটি হচ্ছে, আইডেন্টিক্যাল বা মনোজাইগোটিক বা নন-ফ্রাটার্নাল। অন্যটি হচ্ছে নন-আইডেন্টিক্যাল বা ডাইজাইগোটিক বা ফ্রাটার্নাল।
যখন একটি ডিম্বাণু একটি শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয় এবং জাইগোট দুটি ভাগে বিভক্ত হয় তখনই আইডেন্টিক্যাল টুইন শিশুর জন্ম হয়। এটি বিকাশের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে ঘটে, যখন জাইগোট কয়েকটি কোষের ক্লাস্টারের বেশি হয় না। একজন মহিলা যখন উর্বরতা সহায়তার (fertility assistance) মধ্য দিয়ে যায় তখনও তার আইডেন্টিক্যাল টুইন শিশুর জন্ম হতে পারে। সে সময় একটি নিষিক্ত ডিম্বাণু তার জরায়ুতে ফিরে আসে। যদি এই ডিম্বাণুটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়, তাহলে যমজ শিশু গর্ভে ধারণ করেন তিনি।
নন-আইডেন্টিক্যাল যমজ শিশু জন্মের ক্ষেত্রে ডিম্বাশয় থেকে একটি মাত্র ডিম্বাণু নির্গত হয়ে শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়। কিন্তু পরে কোষসংখ্যা বৃদ্ধির জটিল ক্রিয়ায় তার বিভাজন ঘটে এবং যমজ ভ্রূণে পরিণত হয়। এই ধরনের যমজ শিশু জন্ম নেওয়ার ঘটনা সাধারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের একটি প্রতিবেদনে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জিনোম বিষয়ক ওয়েবসাইট Genome.gov কে ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর বেনজামিন সলোমন বলেছেন, আইডেন্টিক্যাল যমজ শিশু একই জিন ভাগাভাগি করায় এরা একই লিঙ্গের (হয় ছেলে নয়তো মেয়ে) হয়। কিন্তু নন-আইডেন্টিক্যাল যমজ শিশু একই লিঙ্গেরও হতে পারে আবার বিপরীত লিঙ্গেরও হতে পারে। কারণ তারা অন্য ভাইবোনদের মতো ৫০ শতাংশ জেনেটিক কোড ভাগাভাগি করে।
কিন্তু ঠিক কী কারণে যমজ শিশুর জন্ম ঘটে তা এখনও রহস্য। কিছু জাইগোট কেন দুটি ভাগে বিভক্ত হয় এবং অন্যরা কেন হয় না তা খুঁজে বের করার জন্য অনেক বছর ধরেই প্রচুর গবেষণা এবং সময় ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু এর পেছনের সত্য আমরা এখনও জানি না। বাস্তবে, একটি নিষিক্ত ডিমের বিভাজন গর্ভধারণের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলির একটি বিকৃতি।
জোড়া কলা খেলে যমজ বাচ্চা হওয়ার তথ্য ছড়ালো কীভাবে?
জোড়া বা যমজ কলা খেলে যমজ বাচ্চা হয় এমন তথ্য প্রথম ঠিক কবে ছড়ালো সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা যায় না। তবে বলা হয়ে থাকে, যুগ যুগ ধরে গ্রাম বাংলায় ছড়াচ্ছে এই তথ্য। উপকথাগুলোতে দেখা যায় সন্তানহীনা নারীকে কোনো সন্ন্যাসী বা ফকির জোড়া ফল খেতে দিচ্ছেন। তারপর সেই ফল খেয়ে ওই নারী গর্ভবতীও হচ্ছেন। শুধু বাংলাদেশেই নয় পাশ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অনেক দেশেই এই মিথ বেশ প্রচলিত। ফিলিপাইনেও এই তথ্য ছড়ানোর খবর পাওয়া যায়।
জোড়া কলা খেলে কি যমজ বাচ্চা হয়?
জোড়া কলা খেলে যমজ বাচ্চা হয় এমন কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণার ব্যাপারে জানা যায় না। বাংলাদেশে ঢাকার হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল নাক-কান-গলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সজল আশফাক NTV online এ লেখা এক কলামে জানান, “প্রকৃত সত্য সম্পর্কে বলতে গেলে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, যমজ কলা কিংবা যমজ কোনো ফল খাওয়ার কারণে কারো যমজ সন্তান হয় না। জরায়ুতে যমজ সন্তান হওয়ার বিষয়টি নিতান্তই প্রকৃতির খেয়াল।” তিনি বলেন, “যমজ ফল যমজ সন্তানের জন্ম দেয়- এ রকম ধারণাকে সঠিক বলে মেনে নেওয়ার সপক্ষে একটিও বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই। “
বাংলাদেশের ইংরেজি জাতীয় দৈনিক The Financial Express তাদের অনলাইন সংস্করণে ২০২১ সালে ‘খাবার নিয়ে মিথ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, “অনেক সময় কলার কাঁদিতে এক সঙ্গে লেগে থাকা জোড়া কলা থাকে। প্রচলিত আছে, এসব কলা খেলে যমজ সন্তান হয়। কিন্তু বস্তুত এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, যমজ সন্তান হওয়ার পেছনে জাতিগত কিছু কারণ থাকতে পারে। যেমন-এশিয়ানদের চাইতে আফ্রিকানদের অনেক বেশি যমজ সন্তান হয়। এ ছাড়া মায়ের বয়সটা একটা ব্যাপার। যেমন মায়ের বয়স ৩০-৩৫ এর মধ্যে হয়, তাহলেও যমজ সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।”
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক ডা. রাতু রোমানার একটি সাক্ষাৎকারের বরাত দিয়ে জাতীয় দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, “জোড়া কলা বা জয়েন্ট কলা খেলে নাকি যমজ সন্তান হয়- এমন ধারণা নিতান্তই কুসংস্কার।”
মূলত, কোনো নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক তথ্য ছাড়াই ‘জোড়া কলা খেলে যমজ শিশু হয়’ এমন দাবি যুগ যুগ ধরে গ্রাম থেকে শহরে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছে। কিন্তু এই দাবির পক্ষে বৈজ্ঞানিক কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। একাধিক চিকিৎসকও এই তথ্যকে কুসংস্কার বলে জানিয়েছেন।
সুতরাং, যমজ সন্তান জন্ম নেওয়ার ব্যাপারে যমজ কলা কিংবা অন্য কোনো যমজ ফলের কোনো ভূমিকা নেই। যমজ কলা যমজ সন্তানের জন্ম দেয়- এ রকম ধারণাকে সঠিক বলে মেনে নেওয়ার স্বপক্ষে একটিও বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই। চিকিৎসকরাও এটিকে কুসংস্কার বলে জানিয়েছেন।