সম্প্রতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু “হাসিনাকে আপনি গণহত্যাকারী বলতে পারেন না, কারণ এখনো কোর্টে তা প্রমাণ হয়নি।” শীর্ষক মন্তব্য করেছেন এমন একটি দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

এরূপ দাবিতে গণমাধ্যমের ফেসবুক পেজে প্রচারিত পোস্ট দেখুন : বিডি টুডে।
গণমাধ্যম ছাড়াও নানা ফেসবুক পেজ ও ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকেও আলোচিত দাবিটি প্রচার করা হয়েছে। দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
এরূপ দাবিতে ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসুকে উদ্ধৃত করে প্রচারিত মন্তব্যটি তার বক্তব্যের একটি খণ্ডিত অংশ। প্রকৃতপক্ষে, সবকিছুর জন্য কোর্টে প্রমাণিত হওয়া আবশ্যক না এমন বার্তা দিতে গিয়ে মেঘমল্লার উদাহরণস্বরূপ হাসিনাকে নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন। এক্ষেত্রে বক্তব্যের মূল প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে খণ্ডিত অংশ প্রচার বক্তব্যের ভুল বার্তা বহন করে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে ‘বিজনেস বাংলাদেশ লাইভ’ নামের একটি ফেসবুক পেজে গত ৫ আগস্টে “টিএসসি’তে শিবির-বাম ছাত্র সংগঠনের মধ্যে উ’ত্তে’জ’না॥ সরাসরি…” শীর্ষক ক্যাপশনে ১০ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের একটি লাইভ সম্প্রচার ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওটির ৩ মিনিট ১০ সেকেন্ড পরবর্তী সময়ে ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসুকে বলতে শোনা যায়, “..২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের পরবর্তী যেই বিচার, সেই বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে আপনার ১ হাজারটা অভিযোগ থাকতে পারে।..কিন্তু সবকিছু তো কোর্টে প্রমাণিত হওয়ার বিষয় না। আজকে পর্যন্ত কি প্রমাণিত হইছে শেখ হাসিনা কোনো কোর্টে গণহত্যাকারী, কিন্তু আপনার কাছে কেউ আইসা যদি বলে শেখ হাসিনা গণহত্যাকারী না, কারণ কোর্টে প্রমাণিত হয়নি, তাহলে আপনার তার কলিজাটা টাইনা ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করবে না?… ঠিক একইভাবে যদি কেউ একাত্তরের গণহত্যাকারীদের বিষয়ে বলে যে কোর্টটা ঠিক না.. একইভাবে যদি কেউ রাজাকারের ক্ষেত্রেও একই জিনিস করে তাহলে সেই জিনিসটা তো একইরকম ভয়াবহ। ৩০ লক্ষ মানুষের রক্তের দাগ তাদের হাতে নাই?”
এছাড়াও, ‘আমার মা-নানীকে যে ধ*র্ষণ করছে তাদের সাথে কীসের ঐক্য?: মেঘমল্লার বসু” শীর্ষক শিরোনামে অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা নিউজ২৪ এর ইউটিউব চ্যানেলেও গত ৫ আগস্টে প্রচারিত একটি ভিডিও পাওয়া যায়। ভিন্ন কোণ থেকে ধারণকৃত ভিডিওটিতে মেঘমল্লার বসুকে একই কথা বলতে শোনা যায়। অর্থাৎ, এ থেকে বুঝা যায় যে, মেঘমল্লার বসু বলেননি যে “হাসিনাকে আপনি গণহত্যাকারী বলতে পারেন না, কারণ এখনো কোর্টে তা প্রমাণ হয়নি।” তিনি বরং এরূপ একটি দৃশ্যপট দাঁড় করিয়ে বলেছেন এরূপ কেউ বলে থাকলে তার কলিজা ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করবে মেঘমল্লারের অর্থাৎ এরূপ বক্তব্যের প্রতিবাদ করবেন মেঘমল্লার যা স্পষ্টতই প্রচারিত দাবির বিপরীত।
এছাড়াও, মেঘমল্লার বসুর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট পর্যবেক্ষণ করলে গত ০৫ আগস্টে এ বিষয়ে তাকে একটি পোস্ট করতে দেখা যায়। পোস্টটিতে মেঘমল্লার বলেন, “”শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও তো কোর্টে কিছু প্রমাণ হয়নি। তাই জন্য যদি কেউ বলে সে গণহত্যা করেনি তাহলে তার কলিজা টেনে ছিড়ে নিতে আপনার ইচ্ছা করবে না? একই কথা একাত্তরের গণহত্যাকারীদের জন্যও প্রযোজ্য। গোলাম আজম রাজাকার এটা বলতে কোর্ট লাগে না।” এই কথাটিকে বিকৃত করে রাজাকারের বাচ্চারা প্রচার করছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।”
এ থেকেও নিশ্চিত হওয়া যায় যে, কোর্টে প্রমাণ না হওয়ায় শেখ হাসিনাকে গণহত্যাকারী বলা যাবে না এমনটা মেঘমল্লার বসু বুঝাতে চাননি বরং, তিনি এর বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু, মেঘমল্লারের পুরো বক্তব্যের পরিবর্তে আংশিক বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে যা বক্তব্যের মূল ভাবধারা পরিবর্তন করেছে।
পরবর্তীতে মেঘমল্লার বসুর এরূপ বক্তব্যের প্রেক্ষাপটের বিষয়ে অনুসন্ধান করলে জানা যায়, জুলাই গণ অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে গত ৫ আগস্টে “৩৬ জুলাই: আমরা থামবো না” শীর্ষক তিন দিনব্যাপী এক কর্মসূচি আয়োজন করে ইসলামী ছাত্র শিবির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের টিএসসির ভেতরে ওই কর্মসূচির অংশ হিসেবে ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’ শিরোনামে এক প্রদর্শনী রাখা হয় যেখানে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা, জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী, জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছবি প্রদর্শন করা হয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তারা সবাই একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হন। সাত জনের মধ্যে শুধু সাঈদী আমৃত্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত ছিলেন। কারাগারে থাকাবস্থায় মারা যান তিনি। বাকি ছয় জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে তাদের দণ্ড কার্যকর করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে গত ৫ আগস্ট বামপন্থী বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠন ‘চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী ও দণ্ডিতদের’ ছবি প্রদর্শনের প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ করে। উক্ত বিক্ষোভ ঘটনার এক পর্যায়ে মেঘমল্লার বসু তার বক্তব্যে উপরোল্লিখিত কথাগুলো বলেন।
সুতরাং, ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু বলেছেন “হাসিনাকে আপনি গণহত্যাকারী বলতে পারেন না, কারণ এখনো কোর্টে তা প্রমাণ হয়নি” শীর্ষক দাবিটি বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Business Bangladesh Live – টিএসসি’তে শিবির-বাম ছাত্র সংগঠনের মধ্যে উ’ত্তে’জ’না॥ সরাসরি…
- Banglanews24 – আমার মা-নানীকে যে ধ*র্ষণ করছে তাদের সাথে কীসের ঐক্য?: মেঘমল্লার বসু
- Meghmallar Bosu – Facebook Post
- BBC News Bangla – কী উদ্দেশ্যে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিতদের ছবি প্রদর্শন করেছে ইসলামী ছাত্র শিবির?