তেঁতুল খেলে কি বুদ্ধি কমে এবং রক্ত পানি হয়ে যায়?

আপনাকে যদি জিভে পানি এনে দেবে এমন একটি ফলের নাম বলতে বলা হয় তাহলে অবধারিতভাবেই আপনার মনে তেঁতুলের নাম আসবেই। টক ফল হিসেবে সারাবিশ্বেই কমবেশি পরিচিত এই ফলের আদিনিবাস আফ্রিকার সাভানা অঞ্চলে। বাংলাদেশে ঠিক কবে এর চাষ শুরু হয়েছে তার কোনো সঠিক তথ্য জানা না গেলেও ধারণা করা হয় সুদান থেকে বীজ এনে দেশে প্রথম এর চাষ শুরু হয়। এ দেশের মানুষের কাছে তেঁতুলকে ঘিরে বহু বছর ধরে কিছু মিথ প্রচলিত রয়েছে। 

Image by Thanachot Pongpanich from Pixabay

তেঁতুল বিষয়ে কোন মিথগুলো প্রচলিত 

১. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘ঐতিহ্যবাহী ময়মনসিংহ’ নামক ফেসবুক পেজে ২০১৬ সালে ‘তেতুল নিয়ে তেতুল নিয়ে আর ভ্রান্তি নয়, এতে আছে চমকপ্রদ গুণাবলি” (আর্কাইভ) শিরোনামে একটি পোস্ট করা হয়। পোস্টে উল্লেখ করা হয়, “তেঁতুল নিয়ে আমাদের মাঝে অনেক ভ্রান্ত ধারণা আছে, অনেকে আবার মনে করেন তেতুল খেলে শরীরের রক্ত জল হয়ে যায় বুদ্ধি কমে যায় ইত্যাদি।” 

একই রকম ফেসবুকের আরো কিছু পোস্ট দেখুন এখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে এবং এখানে

২. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে The Girly নামক ফেসবুক পেজে ২০২০ সালে ছোটবেলায় বাবা মা তেতুল খেতে নিষেধ করে নাই এমন কাওকে মনে হয় না খুঁজে পাওয়া যাবে। (আর্কাইভ)  শিরোনামে একটি পোস্ট করা হয়। পোস্টে তেঁতুল নিয়ে বেশ কিছু মিথের ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়। যেমন, তেঁতুল খেলে বুদ্ধি কমে যায়, তেঁতুল খেলে রক্ত পানি হয়ে যায়, পিরিয়ডে পেট ব্যাথা করে আর ব্লিডিং বেশি হয়, ক্ষত শুকাই না, ছেলেদের যৌন ক্ষমতা কমে যায়। 

একই রকম ফেসবুকের আরো কিছু পোস্ট দেখুন এখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে এবং এখানে। 

তেঁতুলের উপকারী গুণ কতটা? 

তেঁতুলে এমন অনেক স্বাস্থ্যগুণ থাকার কথা জানা যায় যা শরীরের একাধিক রোগ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। BBC good food ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “প্রতি ১০০ গ্রাম তেঁতুলে ২৩৮ কিলোক্যালরি শক্তি রয়েছে।” প্রতিবেদনে বলা হয়, “একই পরিমাণ তেঁতুলে ৬২.৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৫ গ্রাম ফাইবার, ২.৩ গ্রাম প্রোটিন।” এছাড়া ফ্যাট, নিয়াসিন, ফোলেট, ভিটামিন এ ও সি, পটাসিয়াম,  ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং আয়রন ইত্যাদি থাকার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। 

ভারতের কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে গত ০৬ এপ্রিল প্রকাশিত এক প্রতিবদনে তেঁতুলের স্বাস্থ্যকর দিকগুলোর ব্যাপারে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “তেঁতুলের মধ্যে থাকা অ্যাসকরবিক অ্যাসিড খাবার থেকে আয়রন সংগ্রহ করে শরীরের বিভিন্ন কোষে তা পরিবহণ করে। ফলে মস্তিষ্কের কার্যকারীতা বেড়ে যায়। তেঁতুলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি আর অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল উপাদান যেগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়।” 

এছাড়া ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে, হৃদ্‌যন্ত্র সুস্থ রাখতে, ওজন নিয়ন্ত্রণে, বদহজম দূরকরণে, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থেকে মুক্তি ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে তেঁতুল কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। 

বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে একই উপকারী গুণের কথা বলা হয়েছে Oraganic Facts ওয়েবসাইটের একটি প্রতিবেদনে। 

তেঁতুলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে? 

তেঁতুলের নানা উপকারী গুণ থাকলেও এই ফল পরিমিত পরিমাণে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন পুষ্টিবিদগণ।Oraganic Facts ওয়েবসাইটের একই প্রতিবেদনে যাদের রক্তচাপের সমস্যা আছে তারা তেঁতুল খেলে রক্তচাপ কমে যাওয়ার সমস্যায় পড়তে পারেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 

তেঁতুলের রক্ত পাতলা করে দেওয়ার বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। তবে এই সমস্যা অ্যাসপিরিনের মতো ওষুধের কারণেও হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। 

অনেক তেঁতুল ক্যান্ডি ব্র্যান্ডে ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) লেভেল অব কনসার্ন দ্বারা নির্দিষ্ট করা থেকে বেশি সীসা রয়েছে বলে দেখা গেছে।

তেঁতুল খেলে সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেকের ক্ষেত্রে এলার্জিঘটিত সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট Lybrate এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। এমন অনেক মানুষ রয়েছে যাদের তেঁতুলে থাকা বিভিন্ন উপাদানের কারণে ফুসকুড়ি, চুলকানি, প্রদাহ, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, শ্বাসকষ্ট এবং অজ্ঞান হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। 

তেঁতুল নিয়ে মিথগুলোর প্রচলন কবে থেকে? 

তেঁতুল নিয়ে মিথগুলোর প্রচলন বহু বছর ধরেই। প্রথম কখন ছড়িয়েছিলো সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা যায় না। বলা হয়ে থাকে, যুগ যুগ ধরে গ্রাম বাংলায় লোকেমুখে ছড়িয়েছে তেঁতুল নিয়ে নানা মিথ। শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশেই তেঁতুল নিয়ে মিথগুলোর প্রচলন দেখা যায়। 

জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাকে ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “এক সময় সাধারণের মধ্যে ধারণা ছিল, অতিরিক্ত টক খাওয়ার কারণে ব্রেনে গোলমাল দেখা দেয় অর্থাৎ বুদ্ধিশুদ্ধি কমে। টক সম্পর্কে এই ভ্রান্ত ধারণায় অনেকেই তাঁদের সন্তানদের বিশেষ করে ১২-১৩ বছর বয়স পর্যন্ত টক জাতীয় ফল খেতে দেন না !” 

তেঁতুল খেলে কি বুদ্ধি কমে? 

ঢাকার বেসরকারি ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের সমন্বয় কর্মকর্তা মোহাম্মদ আসিফ হোসেন ২০১১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, “তেঁতুলে থাকা পর্যাপ্ত আয়রন মস্তিষ্কে চিন্তার গতি বাড়ায়। পরিমাণ মতো তেঁতুল খেলে বুদ্ধি কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। “

জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে ২০১৯ সালে প্রকাশিত একই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “টক জাতীয় ফল নিয়ে নেতিবাচক কথার শেষ নেই। টক খেলে গলা ভাঙে, রক্ত পানি হয়ে যায়, বুদ্ধি কমে…। আসলে এ ধারণাগুলো মোটেই ঠিক নয়। অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক এই ধরনের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল বলে প্রমাণ করেছেন। টক খেলে কিছুই হয় না। টক খেলে বুদ্ধি কমে—এ কথার কোনো ভিত্তি নেই।”

কোন খাবারে বুদ্ধি কমে? 

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম Hindustan Times বাংলা-এর ওয়েবসাইটে গত ০৯ এপ্রিল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ” কিছু খাবার বুদ্ধি কমিয়ে দিতে পারে। ” প্রতিবেদনে বুদ্ধি কমে যাওয়ার পেছনে অতিরিক্ত চিনি, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মাংস, মাখন, ফাস্টফুড, বেশি লবণযুক্ত খাবার এবং মদ-সিগারেট কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু টক জাতীয় কিছু খেলে বুদ্ধি কমে এমন কোনো তথ্য দেওয়া হয় নি প্রতিবেদনে। 

জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে ২০২১ সালের ১৭ জুন প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সকালে না খেলে আইকিউ কমে যাওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। আর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা অনেক বেশি দেখা যায়।  

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার কয়েকজন বিজ্ঞানীর গবেষণার বরাত দিয়ে জাতীয় দৈনিক আমার সংবাদ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে ২০১৫ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “গভীর রাত করে খাবার খেলে আমাদের বুদ্ধিসুদ্ধি কমে যায়, যা শিখেছি তা আমরা ভুলতে বসি এবং নতুন কিছু শেখার প্রতি তৈরি হয় অনীহা। “

তেঁতুল নিয়ে অন্য মিথগুলোর সত্যতা কতটুকু? 

বুদ্ধি কমা ছাড়াও তেঁতুল নিয়ে আরও বেশ কিছু মিথ প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো, তেঁতুল খেলে রক্ত পানি হয়। প্রখ্যাত নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডা. সজল আশফাক ২০১৬ সালে ntv online এর ওয়েবসাইটে লেখা একটি কলামে উল্লেখ করেন, রক্তকে পানি করে দেওয়ার মতো কোনো উপাদানই তেঁতুলের মধ্যে নেই। তেঁতুল খেলে রক্ত পানি হয় না। এটাই ঠিক কথা। তেঁতুল খেয়ে রক্তকে পানি করা সম্ভব নয়।

তেঁতুল খেলে ক্ষত বা ঘা শুকায় না এমন একটি মিথও বেশ প্রচলিত। ডা. সজল আশফাক একই ওয়েবসাইটে লেখা আরেক কলামে উল্লেখ করেন, “তেঁতুলের মতো টক জাতীয় ফলে থাকা ভিটামিন সি সংযোজক কলার কোলাজেন তৈরিতে সাহায্য করে। কোলাজেনের উৎপাদন সহজে কাটা বা ক্ষতস্থানকে মাংসপেশির তন্তুতে ভরাট করে ফেলে এবং ঘা শুকিয়ে যায়। কাজেই দেখা যাচ্ছে, টক জাতীয় ফল খেলে ঘা পাকে না। বরং এটি ঘা শুকাতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। ” 

তেঁতুল নিয়ে আরেকটি প্রচলিত মিথ হচ্ছে, এই ফল খেলে নারীদের পিরিয়ডে সমস্যা হয়। এই দাবি সম্পর্কে ইউনিসেফের ওয়েবসাইটে ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “আপনি যে খাবার খান তা আপনার পিরিয়ডের প্রবাহ নির্ধারণ করে না। আপনার মাসিকের সময় আপনি খেতে পারবেন না এমন কিছু নেই।” 

দাবি করা হয়ে থাকে, তেঁতুল খেলে নাকি যৌন স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম The Times of India-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ” তেঁতুল বা এর বীজ খেলে যৌন স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না বরং তেঁতুলে থাকা ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডন্যাট কামশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।” তেঁতুলে ভিটামিন সি থাকার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “বেশ কয়েকটি গবেষণা অনুসারে, ভিটামিন সি অণ্ডকোষের ভিতরে শুক্রাণুর মৃত্যু রোধ করতে সাহায্য করে এবং পুরুষদের শুক্রাণুর সংখ্যা বৃদ্ধি করে।” 

তেঁতুল

মূলত, কোনো নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক তথ্য ছাড়াই ‘তেঁতুল খেলে বুদ্ধি কমে’ এমন দাবি যুগ যুগ ধরে গ্রাম থেকে শহরে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছে। কিন্তু এই দাবির পক্ষে বৈজ্ঞানিক কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। বরং এই ফল খেলে মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তি বাড়ে। তেঁতুল নিয়ে প্রচলিত অন্য মিথগুলোরও কোনো ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।  

সুতরাং, তেঁতুল খাওয়ার সাথে বুদ্ধি কমে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। তেঁতুল খেলে বুদ্ধি কমে- এ রকম ধারণাকে সঠিক বলে মেনে নেওয়ার স্বপক্ষে একটিও বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই। তেঁতুল নিয়ে প্রচলিত অন্য মিথগুলোরও কোনো ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তথ্যসূত্র

  1. ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়
  2. ইত্তেফাক
  3.  Hindustan Times বাংলা
  4. প্রথম আলো
  5.  দৈনিক আমার সংবাদ 
  6. ntv online 1
  7. ntv online 2
  8. ইউনিসেফ
  9. The Times of India

আরও পড়ুন

spot_img