নবজাতককে কী তেল মালিশ করা উচিত?

একটা শিশু যখন জন্ম নেয়, তখন তার যত্নের পুরোটা জুড়েই থাকে একেকটা পরিবারের নানান রীতি। শিশুর সুস্থতা এবং সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিতে আবহমানকাল ধরেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের ঘরোয়া নানান পরিচর্যার সাথে সখ্যতা দেখা যায়। এই রীতির সবগুলোই কি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী কি না তা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিশেষত নবজাতককে (জন্মের দিন থেকে পরবর্তী ২৮ দিনের শিশুদের নবজাতক বলা হয়) তেল মালিশের মতো রীতির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলছে।

নবজাতককে তেল মাখানোর যে রীতি প্রচলিত

১. বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ‘আওয়ামী লীগ‘ এর ওয়েবসাইটে ২০২১ সালের ২৯ জুলাই দলটির সভাপতি শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মদিন উপলক্ষে ‘জয় : জন্ম এবং কর্মে সার্থক যে নাম’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জয়ের ছোটবেলার বিষয়ে বলা হয়, “একদিন নবজাতককে গোসল করিয়ে শরীরে তেল মাখতে মাখতে বেগম মুজিব ছেলে সন্তানের নাম কী হবে সেটা নিয়ে জল্পনা কল্পনা করছিলেন।”

Screenshot source : Awami League Website

২. জাতীয় দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে ২০২০ সালের ১ নভেম্বর ‘শীতে নবজাতকের গায়ে কোন তেল মাখাবেন‘ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশ কয়েকটি তেল রয়েছে, যা নবজাতকের ত্বকের জন্য উপকারী।

Screenshot source : Jugantor website

ইমোলিয়েন্ট পদ্ধতির প্রাথমিক পাঠ

জন্মের পর থেকে শুরু করে জীবনের বিভিন্ন সময়েই নানা কারণে দেহের ত্বক শুষ্ক ও রুক্ষ থাকতে দেখা যায়। ত্বকের উপরের স্তরে পর্যাপ্ত পানি না থাকলে এমন ঘটতে পারে। এর ফলে ত্বকে ফাটল ধরতে পারে, হতে পারে ত্বকের নানা রোগ। এক্ষেত্রে ইমোলিয়েন্ট (Emollient) নামে একটি পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতির ব্যবহারের ফলে লিপিড জাতীয় পদার্থের উপস্থিতির কারণে ত্বক মসৃণ ও নরম হয় এবং ত্বকের উপর তৈলাক্ত পাতলা আবরণ তৈরি হয় যা ত্বককে দীর্ঘক্ষণ সিক্ত করে রাখে। অনেকে ময়েশ্চারাইজার এবং ইমোলিয়েন্টকে একই জিনিস মনে করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ইমোলিয়েন্ট হচ্ছে ময়েশ্চারাইজারের একটি উপাদান মাত্র। সাধারণত তিন ধরনের ইমোলিয়েন্ট পদ্ধতি রয়েছে। প্রথমটি ওয়েন্টমেন্ট (বিভিন্ন তেল), দ্বিতীয়টি ক্রিম এবং তৃতীয়টি লোশন। এই পদ্ধতিগুলো বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহু বছর ধরেই প্রচলিত।

শিশুকে তেল মাখানোর ঐতিহ্যে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিনের অধ্যাপক গ্যারি ডার্মস্ট্যাডট শিশুকে তেল মাখানোর বিষয়ে অনেকদিন ধরেই গবেষণা করছেন। তিনি এই কাজের জন্য বাংলাদেশ এবং ভারতও ঘুরে গেছেন। তিনি দেখেছেন এই অঞ্চলের মা-দাদিরা নবজাতকদের মালিশ করার জন্য অনেক সময় ব্যয় করেন। তখন তিনি এই রীতি নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বিবিসি’কে তিনি জানান, “যখন আমি জানতে পারলাম যে এই পদ্ধতিটি শতাব্দী ধরে এখানকার মা-দাদিরা করে আসছে, তখন আমি এই বিষয়টি নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করি।”

Screenshot source : BBC website

মূলধারার গণমাধ্যম Ekushey Tv এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছোট্ট বাচ্চাদের তেল মালিশের রেওয়াজ সেই প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। গোসলের ঠিক আগে ছোট্ট সোনাকে রোদে শুইয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত যত্ন নিয়ে তেল মালিশ করেন মা-দাদিরা। এখনও ঘরে ঘরে সেই রীতি প্রচলিত আছে। এই মালিশে থাকে আদর, ভালবাসার স্পর্শ।

শিশুদের তেল মাখানোয় উপকারিতার প্রমাণ আছে?

২০১৩ সালে প্রকাশিত ২৮-৩১ দিন বয়সী শিশুদের উপর করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শিশুকে সঠিকভাবে তেল মালিশ করলে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ প্রতিরোধ করে শিশুর ওজন বৃদ্ধিতে কার্যকরভাবে সহায়তা পাওয়া যায়।

Screenshot source : BMC Public Health

অধ্যাপক গ্যারি ডার্মস্ট্যাডট ও তার দল বাংলাদেশ ও ভারতে একই বিষয়ে গবেষণা করে দেখেছেন, সূর্যমুখীর বীজ থেকে পাওয়া তেল ও অ্যাকোয়াফোর ওয়েন্টমেন্টের ব্যবহারে ৩৩ সপ্তাহে জন্ম নেওয়া শিশুদের মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ কমাতে সাহায্য করে। ইমোলিয়েন্ট পদ্ধতির এমন ব্যবহার যে জীবন রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে এ বিষয়ে প্রথম জানা যায় এই গবেষণা থেকেই।

অকালে জন্ম নেওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে অনেকদিন হাসপাতালে অবস্থান করতে হয়। এই সময়টায় বাচ্চা নানা চাপ এবং ব্যথার মধ্যে দিয়ে যায়। ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই সমস্যাগুলোয় কার্যকর ভূমিকা পালন করে ইমোলিয়েন্ট পদ্ধতি।

তেল মাখানোর প্রক্রিয়াটি শারীরিক উপকারিতার পাশাপাশি সাহায্য করে শিশুর মানসিক উন্নতিতেও। স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট healthline বলছে, নিয়মিত শিশুকে বিভিন্ন উপায়ে করা মালিশ শিশু ও তার মায়ের (সাধারণত মায়েরাই মালিশের কাজটি করেন) মধ্যে বন্ধন তৈরিতে সাহায্য করে। স্পর্শ একটি ভাষা যা প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশু উভয়ই বুঝতে পারে। একটি শিশুকে মালিশের সময়, আপনি এবং আপনার শিশু একে অপরের মুখোমুখি হচ্ছেন এবং চোখের যোগাযোগ করছেন। এটি আপনার শিশুকে আপনার মুখের অভিব্যক্তি শিখতে এবং তাদের যোগাযোগ দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করে।

Screenshot source : healthline

শিশুকে নিয়মিত মালিশ করলে তাদের “হ্যাপি হরমোনের” (যেমন সেরোটোনিন এবং ডোপামিন) নিঃসরণ বৃদ্ধি পায় যা শিশুর আরও ভাল ঘুম হতে সাহায্য করতে পারে।

২০১৭ সালের একটি গবেষণায় এসেছে, একটি শিশুর সুস্থ মস্তিষ্ক এবং মানসিক বিকাশের জন্য পিতামাতা বা যত্নশীলের সাথে নিয়মিত স্পর্শ এবং সংযুক্তি প্রয়োজনীয়। এর উপকারিতা আজীবন। এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে মালিশের মতো পদ্ধতিগুলো।

তেল মালিশ করলে ঠান্ডা লাগার প্রবণতা কমে?

অনেক মা-বাবা-ই মনে করেন, তেল মালিশ করলে শিশুর ঠান্ডা লাগার প্রবণতা কমে। এমন ধারণার কোনো ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাঈদা আনোয়ার। একই মত জানিয়েছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক মো. মুজিবুর রহমান।

ঠান্ডা লেগে নাক বন্ধ হলে অনেকে নাকের ফুটোয় সরিষার তেল লাগান। এটা ঠিক নয় বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক মুজিবুর। আবার জ্বরজনিত ফোস্কা (জর ঠোসা) হলেও সেখানেও অনেকে তেল লাগান – এ ধারণাও সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন তিনি। এতে নিউমোনিয়া হতে পারে বলে মত দিয়েছেন অধ্যাপক সাঈদা আনোয়ার।

Screenshot source : Prothom Alo

শিশুর বয়স কত হলে তেল মাখানো শুরু করা যায়?

জন্মের সময় শিশুর ত্বকের উপরের স্তর খুবই পাতলা থাকে এবং সহজেই এই ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রথম মাসে (নবজাতকদের ক্ষেত্রেই বেশি), একটি শিশুর ত্বক পরিপক্ক হয় এবং তার নিজস্ব প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষামূলক বাধা বিকাশ লাভ করে। যুক্তরাজ্যের সরকারি সংস্থা National Health Service (NHS) এর বরাত দিয়ে দেশটির সর্ববৃহৎ অভিভাবক বিষয়ক দাতব্য সংস্থা National Childbirth Trust (NCT) বলছে, জন্মের প্রথম মাসে শিশুকে কোনো তেল বা লোশন মালিশ করা উচিত নয়।

Screenshot source : NST

healthline এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক বাবা-মা তাদের বাচ্চাদের ৬ সপ্তাহ বয়স না হওয়া পর্যন্ত তেল মালিশ করেন না।

ভারতের শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট Baby Center এক প্রতিবেদনে বলেছে, কখন শিশুর মালিশ শুরু করতে হবে সে সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশিকা নেই।  কিছু বিশেষজ্ঞ শিশুর উপর তেল বা লোশন মাখানো শুরু করার আগে ১০ দিন থেকে দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তোফাজ্জল হোসেন খান বলছেন, ১৫ দিন বয়স পার হওয়ার পর শিশুর জন্য তেল ব্যবহার করা যায়।

আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক ও নিউনেটাল আইসিইউ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাসিম জাহান বলছেন,” শিশুর দেড় মাস হওয়ার আগে তেল না দেওয়াই ভালো। কারণ শিশুদের ত্বক পাতলা থাকে এবং বিভিন্ন ধরনের র‍্যাশ হয়। এ সময় তেল দিলে অনেকের ক্ষেত্রে র‍্যাশ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বলি, দেড় মাস পরে তাকে তেল, লোশন দেওয়া যাবে। গোসলের আগে তেল দিয়ে গোসল করিয়ে দিতে হবে।”

Screenshot source : NTV website

মায়ামি ইউনিভার্সিটি অব মেডিসিনে শিশু বিশেষজ্ঞ, সাইকোলজি এবং সাইকিয়াট্রির অধ্যাপক টিফানি ফিল্ড বিভিন্ন দেশের অকাল নবজাতকের মালিশের গবেষণাগুলো পর্যালোচনা করেছেন। অধ্যাপক টিফানি ফিল্ডের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি রিউমর স্ক্যানার’কে জানান, “প্রসবের পর মা শিশুকে তেল মালিশ করার জন্য প্রস্তুত হওয়া মাত্রই আমরা এটা করতে পরামর্শ দিয়ে থাকি।”

সরিষার তেল কি ক্ষতিকর?

উত্তর ভারতের উত্তর প্রদেশে কেবল অকালে জন্ম নেওয়া শিশু নয় এমন ২৬ হাজার নবজাতকের ওপর অধ্যাপক গ্যারি ডার্মস্ট্যাডট ও তার গবেষক দল গবেষণা করেছেন। এখনও প্রকাশিত না হওয়া এই গবেষণার বিষয়ে ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর বিবিসিকে ডার্মস্ট্যাডট বলেছেন, ওই শিশুদের অর্ধেক সূর্যমুখী তেল এবং বাকি অর্ধেক সরিষার তেল দিয়ে মালিশ করা হয়েছিল। গবেষকরা সব শিশুর বৃদ্ধির উন্নতি লক্ষ করেছেন। তারা দেখেছেন, স্বাভাবিক জন্ম নেয়া শিশুদের মৃত্যুহারের ওপর বড় কোনো প্রভাব পড়েনি। অর্থাৎ, এই গবেষণায় শিশুদের সরিষার তেল ব্যবহারে ক্ষতিকর কোনো প্রভাব দেখেননি গবেষকরা। 

কিন্তু ২০১৭ সালে শিশুদের উপর করা যুক্তরাষ্ট্র ও নেপালের গবেষকদের এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিতভাবে সরিষার তেল দিয়ে মালিশ করা নবজাতকদের মধ্যে জীবনের প্রথম দুই সপ্তাহে ত্বকে জ্বালা/ক্ষতির কারণ হয়। গবেষকরা বলছেন, এই ফলাফল সম্ভবত উত্তর ভারত, পাকিস্তান, উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশ এবং নেপাল জুড়ে বিশাল জনসংখ্যার জন্য প্রযোজ্য। তবে এই তেল মালিশের চর্চা সাংস্কৃতিকভাবে নিবিষ্ট তাই এরিথেমা (Erythema – স্কিনের দাগ) এবং ফুসকুড়ির উপস্থিতি “স্বাভাবিক” হিসাবে গ্রহণ করা হয় অঞ্চলগুলোতে। 

Screenshot source : NHS

healthline’ও সরিষার তেল ব্যবহারের বিপক্ষে জানিয়ে বলছে, এই “মশলাদার” তেল আপনার শিশুর ত্বকে জ্বালাপোড়া ও তাপ বাড়িয়ে দিতে পারে।

তবে সৌদি আরবের জাযান জেনারেল হাসপাতালের (Jazan General Hospital) সাবেক আবাসিক চিকিৎসক ডাক্তার খন্দকার মো. আনোয়ারুল হক বলেন, শিশুদের রোদে বসিয়ে সরিষার তেল মাখালে তা ত্বক ও স্বাস্থ্যের জন্য খুবই কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

তিনি বলেন, যদি পর্যাপ্ত রোদ না থাকে তাহলে সরিষার তেল নয়, বাজারে প্রচলিত লোশন দিতে হবে। তবে শিশু বা বয়স্ক সবার জন্য সরিষার তেল মুখে দেয়া যাবে না।

২০২০ সালের এপ্রিলে Baby Center প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি আপনার শিশুর শুষ্ক, সংবেদনশীল ত্বক, একজিমা বা ভাঙা ত্বক থাকে, তাহলে তাকে মালিশ করার জন্য সরিষার তেল, পরিষ্কার মাখন (ঘি) বা অলিভ অয়েল ব্যবহার না করাই ভালো।

অলিভ অয়েল, ঘি এবং সরিষার তেলে অলিক অ্যাসিড বেশি থাকে। অলিক অ্যাসিড শিশুর ত্বকের কিছু স্তরকে আরও প্রবেশযোগ্য করে তুলতে পারে। ফলে তেল প্রয়োগ করার ফলে শিশুর ত্বক আরও শুষ্ক এবং কোমল হয়ে উঠতে পারে।

তবে মালিশের জন্য তেলের ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত হতে আরও গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করে বেবি সেন্টার। বর্তমান গবেষণা দেখায় যে, এই তেলটি ত্বকে দীর্ঘক্ষণ থাকে এবং গোসলে ধুয়ে যায় না।

তবে এটা হওয়া সম্ভব যে, আপনি ইতিমধ্যেই আপনার শিশুর মালিশের জন্য ঘি, অলিভ বা সরিষার তেল ব্যবহার করেছেন এবং তার ত্বকে কোনো শুষ্কতা বা অন্য কোনো প্রতিক্রিয়া দেখেননি। এইগুলো খুব জনপ্রিয় মালিশ করার তেল এবং হয়ত, সেগুলো আপনার শিশুর ত্বককে খারাপভাবে প্রভাবিত করেনি কারণ আপনি তার গোসলের সময় তেলটি ভালভাবে ধুয়ে ফেলেছেন।

Screenshot source :  Baby center

অধ্যাপক ডা. নাসিম জাহান বলছেন, “আসলে সরিষার তেল দিতে আমরা নিষেধ করি। কারণ, এটি খুব পুরু থাকে। এর জন্য র‍্যাশ হয়। বাচ্চার শরীর ময়লা হয়ে যায়। সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সরিষার তেলের ঝাঁজ বেশি। আমরা সাধারণত বলি, সরিষার তেল না দেওয়াই ভালো। যদি বেবি অয়েল দিই বা অলিভ অয়েল দিই, সেটা দেওয়া যাবে। তবে সেটাও দেড় মাসের পরে।”

Screenshot source : NTV website

অধ্যাপক টিফানি ফিল্ড রিউমর স্ক্যানার’কে বলেছেন, সরিষার তেল কিছু শিশুর ক্ষেত্রে এলার্জির সমস্যা সৃষ্টি করে। তাই এটি ব্যবহারে পরামর্শ দেন না তারা।

শিশুদের কোন তেল মাখানো উচিত?

২০০৪ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শিশুদের জন্য ব্যবহারে সূর্যমুখী বীজের তেল, নারকেল তেল এবং তিলের তেলে সবচেয়ে বেশি উপকার পাওয়া যায়। গবেষকরা বলছেন, এই তেলগুলোতে উচ্চ পরিমাণে লিনোলিক অ্যাসিড রয়েছে, যা আপনার শরীর তৈরি করতে পারে না এবং ত্বকে এমন রিসেপ্টর রয়েছে যা সেই ফ্যাটি অ্যাসিডটিকে বিশেষভাবে আবদ্ধ করে, যাতে এটি বিপাক হয়৷ এমন প্রমাণও রয়েছে যে তেলের ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো ত্বকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে উদ্দীপিত এবং উন্নত করতে পারে।

Screenshot source : BBC

২০২০ সালে প্রকাশিত এক মেডিকেল গবেষণায় দেখা গেছে যে অকাল নবজাতকের উপর কুমারী নারকেল তেল প্রয়োগ করা তাদের ত্বকের উন্নতি এবং শক্তিশালী করতে সহায়তা করে। এটি নবজাতক এবং বয়স্ক শিশুদের জন্য একটি মালিশ করার তেল এবং ময়েশ্চারাইজার হিসাবে একই কাজ করতে পারে।বেশ কিছু অন্যান্য গবেষণাও এই ফলাফলগুলোকে সমর্থন করে, তবে আরও গবেষণা প্রয়োজন।

২০২০ সালের আরেক গবেষণায় বাদাম তেলের (almond oil) উপকারিতা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ভিটামিন ই সমৃদ্ধ এই উপাদান তেল মালিশ হিসেবে বেশ কার্যকর। গবেষকরা দেখেছেন যে অকাল শিশুদের উপর বাদাম তেল ব্যবহার করা তাদের ত্বকের পুরুত্ব এবং শক্তি উন্নত করে এবং কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। একইভাবে কুসুম ফুলের তেলও ব্যবহারের পরামর্শ এসেছে healthline এর এক প্রতিবেদনে।

শিশুদের তেল মালিশের ক্ষেত্রে আঙ্গুর বীজ তেল, জোজোবা তেল, বোরেজ বীজ তোল, রোজ হিপ তেল, ওট তেলের উপকারী গুণের কথা এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়। 

Screenshot source : healthline

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. আবু সাঈদ শিমুল বলছেন, “শিশুর ত্বকের ধরন অনুযায়ী একেকজনের জন্য একেকটা মাখানো উচিত। যাদের ত্বক খুব বেশি শুষ্ক, তাদের তেল না মেখে ভেসলিন মাখাই ভালো।”

তার মতে, সবচেয়ে ভালো হয়, যদি লিনোলেইক (Linoleic acid) এসিডসমৃদ্ধ তেল ব্যবহার করা যায়। এটি এক ধরনের ফ্যাটি এসিড, যা ত্বকের সুরক্ষা দেয়। সূর্যমুখী তেলে এটি বেশি থাকে, তাই শিশুর জন্য সূর্যমুখী তেল ভালো। অলিভ অয়েল মাখলেও ক্ষতি নেই। তবে অলিভ অয়েলে অলেইক এসিড (Oleic acid) থাকায় অ্যাকজিমায় আক্রান্ত শিশুদের এটি না ব্যবহার করাই ভালো।

কোন তেল এড়িয়ে যাওয়া উচিত?

অলিভ অয়েল ব্যবহার না করার বিষয়ে ডা. আবু সাঈদ শিমুলের দেওয়া পরামর্শের সাথে মিল পাওয়া যায় healthline এর একটি প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, অলিভ অয়েলে থাকা অলেইক এসিড ত্বকের উন্নতির পরিবর্তে ভেঙে ফেলতে পারে। আগে থেকে শিশুর একজিমা বা ত্বকে ফুসকুড়ি থাকলে অলিভ অয়েল বিশেষভাবে নিরাপদ নয়। একই প্রতিবদনে অ্যাভাকাডো তেল, চিনাবাদাম তেল, সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, চাপাতা গাছের তেল ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

অধ্যাপক টিফানি ফিল্ড রিউমর স্ক্যানার’কে বলেছেন, আমরা সাধারণত সিন্থেটিক (বিভিন্ন উপাদানের মিশ্রণ) তেল ব্যবহারে পরামর্শ দিয়ে থাকি।

তেল মালিশের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন? 

শিশুকে তেল মালিশের উপকারি গুণ শুনে অনেক পরিবারই এর পরিমিত ব্যবহার ভুলে যান। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, তেল মালিশের ক্ষেত্রে সতর্কতা জরুরি। বংশ পরম্পরার ঐতিহ্যকে অনুসরণ না করে তেল বাছাই এবং মালিশের ক্ষেত্রে সচেতন হতে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

দক্ষিণ ভারতে ১৯৪ জন শিশুর উপর করা ২০১৩ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঐ শিশুদের প্রায় সকলকেই মায়েরা তেল মাখিয়েছিলেন। দেখা গেছে, অর্ধেকেরও বেশি মায়েরা শিশুদের কানে এবং চোখে তেল প্রয়োগ করেছেন। গবেষকরা সতর্ক করেছেন যে এটি সংক্রমণের কারণ হতে পারে।

ভারতের ম্যাঙ্গালোরের কাস্তুরবা মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক নিতিন জোসেফ বলছেন, “এটি এড়াতে এবং সঠিক কৌশলগুলো অনুশীলন করার জন্য আমাদের আরও ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান দরকার।” 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাঈদা আনোয়ার জানালেন, শিশুদের ত্বক ও চুলে তেল মালিশের ক্ষেত্রে ঝাঁঝালো তেল (যেমন, শর্ষের তেল) এড়িয়ে চলা উচিত। বিশেষ করে নবজাতকের জন্য। কোনো তেল ব্যবহারে র‌্যাশ বা অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিলে সেটি পরিহার করা উচিত। সমস্যায় পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

অধ্যাপক টিফানি ফিল্ড মনে করেন, এই অনুশীলনটি সঠিক ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। তবে সাবধান থাকতে হবে বলে  জানালেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘মাঝারি চাপ প্রয়োগ অনেক শিশুর সুড়সুড়ি অনুভব করাতে পারে। অধিকাংশ শিশু এটি উপভোগ নাও করতে পারে। তিনি মনে করেন এই প্রাচীন পদ্ধতিটি সবসময়ের জন্য সেরা নির্দেশিকা নয়।

অর্থাৎ, বহু বছর ধরে নবজাতক বয়সেই তেল মাখানোর রীতি শুরুর প্রচলন হয়ে আসছে। এতে শারীরিক ও মানসিক উন্নতির প্রমাণ থাকলেও তেল মালিশ শুরুর বয়স নিয়ে আছে বিতর্ক। বিভিন্ন গবেষণা এবং বিশেষজ্ঞরা জন্মের পরের ১০ দিন থেকে দেড় মাস বয়সী শিশুদের তেল মালিশ করতে নিষেধ করেন। শিশুকে সরিষার তেল ও অলিভ অয়েল মাখানোর বিপক্ষে মত এসেছে অধিকাংশ গবেষণায়। তবে রোদে বসিয়ে এবং গোসলের সময় ভালোভাবে ধুয়ে ফেলার শর্ত মানলে সরিষার তেল ব্যবহারে ক্ষতি হয় না বলেও মত দিয়েছেন কিছু বিশেষজ্ঞ। শিশুর মালিশে লিনোলেইক এসিড সমৃদ্ধ তেল (যেমন সূর্যমুখী) ব্যবহার করতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা৷ তবে এসব ক্ষেত্রেই ডাক্তারের পরামর্শ মানতে বলা হয়েছে বিভিন্ন গবেষণায়।

সুতরাং, জন্মের পরপরই শিশুকে তেল মালিশ করা উচিত নয়।

প্রসঙ্গত, বহু বছর ধরে মঙ্গল কামনায় নবজাতককে মধু খাওয়ানোর রীতিও প্রচার হয়ে আসছে। অথচ এই রীতির স্বপক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে রিউমর স্ক্যানার প্রকাশিত ফ্যাক্ট ফাইল পড়ুন এখানে। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img