পরীক্ষার আগে ডিম খেলে কী পরীক্ষা খারাপ হয়? 

পরীক্ষা ব্যাপারটার সাথে আমাদের পরিচয় ছেলেবেলাতেই। সময়ের সাথে পরীক্ষা আমাদের মনে জায়গা করে নেয় এক প্রকার ভীতি হিসেবে। সেই ভীতির সাথে যুক্ত হয় আবহমান নানা মিথ। 

পরীক্ষা সম্পর্কিত যে মিথ প্রচলিত 

১. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবু্কে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর Koss Ki MofiZ

 নামক পেজ থেকে একটি পোস্ট (আর্কাইভ) করা হয়। ছবিযুক্ত পোস্টটির ক্যাপশনে উল্লেখ করা হয়, “পরীক্ষার আগে ডিম খেলে পরীক্ষায় ডিম পাবে। দিনগুলো আসলেই অসাধারণ ছিল।”

একইরকম ফেসবুকের আরো কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

২. ইউটিউবে ২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর Islamic Media TV নামক চ্যানেল থেকে পরীক্ষার দিন ডিম খেলে ডিম পাবেন (মিজানুর রহমান আজহারী) Mizanur Rahman Azhari New Lecture (আর্কাইভ) শিরোনামে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। সেখানে ইসলামী বক্তা মিজানুর রহমান আজহারী বলেন, “পরীক্ষার দিন সকালে কেউ যদি ডিম খেয়ে যায় তাহলে পরীক্ষায় নাকি ডিম পায়। এটা ভুয়া কথা। ডাহা মিথ্যা। আমি সবসময় ফাইনাল পরীক্ষার দিন সকালে ডিম খেয়ে যেতাম আর পরীক্ষা দিয়ে প্রথম হয়ে যেতাম। এজন্য ডিম খেয়ে গেলে কেই ডিম পায় না।”

একইরকম ইউটিউবের আরো কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

পরীক্ষার সাথে খাবারের সংযোগ কোথায়?

পরীক্ষার দিন সকাল কিংবা আগের রাতে পড়াশোনার চাপ অন্যান্য দিনের তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকে। এই চাপ সামলাতে মায়েরা খাবার নিয়ে ছোটেন সন্তানের পেছনে। সন্তানরা নিজেরাও বোধহয় পড়তে পড়তে ক্ষুধার তাড়না অনুভব করেন। বিবিসি বলছে, গবেষণায় দেখা গেছে যে পরীক্ষার্থীরা যারা সকালের নাস্তা খায় তারা পরীক্ষায় ভালো পারফর্ম করে।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হোমেরটন কলেজের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “একজন শিক্ষার্থী মাসের পর মাস রিভিশন করে পরীক্ষার দিন ঠিকমতো না খেয়ে থাকার কোনো মানে নেই। এটি তাদের পরীক্ষার সাফল্যজনক ফলাফলের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।”

এক্ষেত্রে ভারী খাবার না খেতেই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। “আমরা সকলেই ভারী খাবারের পরে ঘুমের অনুভূতি পেয়ে থাকি। কারণ আপনার শরীরের বেশিরভাগ অক্সিজেন আপনার পাকস্থলী এবং পরিপাকতন্ত্র আপনার খাওয়া খাবার হজম করতে ব্যবহার করছে। তাই আপনার মস্তিষ্ক কার্যকরভাবে কাজ করতে এবং মানসিকভাবে সজাগ থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন থেকে অনেকটাই বঞ্চিত হচ্ছে।” হালকা খাবারের সাথে একই প্রতিবেদনে পরামর্শ এসেছে পর্যাপ্ত পানি পানেরও।

ডিমের পুষ্টিগুণ

ডিম বলতে সাধারণত মুরগীর ডিমকে বোঝানো হয়। বাজারে এই ডিমের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। এর বাইরে হাঁসের ডিমেরও আছে চাহিদা। এছাড়া মাছের ডিমও অনেকে রান্না করে খেয়ে থাকেন। তবে আলোচনা হয়ে থাকে মুরগীর ডিম নিয়েই। তবে পুষ্টি বিবেচনায় হাঁসের ডিম মুরগির ডিমের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

বেশিরভাগ পুষ্টিকর উপাদান প্রাকৃতিকভাবে যেসব খাবারে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় তার মধ্যে অন্যতম হল ডিম। একটি সেদ্ধ ডিমে ৭৭ ক্যালরি শক্তি থাকে।

স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট Healthline বলছে, একটি সেদ্ধ ডিমে প্রোটিন, ফ্যাট,  ভিটামিন এ, ফোলেট, ভিটামিন বি (বি৫, বি১২, বি২, বি৬), ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক ও সেলেনিয়াম ইত্যাদি থাকে।

পারফেক্ট খাদ্য বলতে যা বোঝায় ডিম তা-ই। মানুষের প্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি পুষ্টি অবদানেরই অস্তিত্ব রয়েছে ডিমে।

২০১৮ সালে প্রকাশিত বিবিসি বাংলা‘র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “চীনে প্রায় ৫ লাখ লোকের ওপর এক গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিদিন একটা করে ডিম খেলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমতে পারে।”

ব্রিটিশ ডায়েটিক অ্যাসোসিয়েশনের ডা: ফ্র্যাঙ্কি ফিলিপস্ বলছেন, ”দিনে একটা – এমনকি দুটো ডিমও স্বাস্থ্যের জন্য ভাল।” ”বেশি ডিম খাওয়ায় ভয়ের কোন কারণ নেই।”

পরীক্ষাভীতির সাথে ডিম জড়ালো কবে?

 এমনিতে পরীক্ষা এক ধরনের ভীতি নিয়ে হাজির হয় শিক্ষার্থীদের মনে। এর সাথে খাওয়ার নানা বিধিনিষেধের রীতি পরীক্ষাভীতিকে রীতিমতো প্রকট করে তোলে। বাংলাদেশে এই রীতি পালনের শুরুটা সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। পরীক্ষাভীতির সাথে ডিমকে জড়ানো হলো কীভাবে সেটিরও নির্ভরযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ঢাকার ডেমরার নরাইবাগ ইসলামিয়া মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি রাশিদুল হক প্রিয়.কম’কে বলছেন (আর্কাইভ),“ডিমের আকৃতি ও শূন্যের আকৃতি অনেকটা এক রকম। এই সাদৃশ্যতার ভিত্তিতে অতীতে কোনো এক সময়ে হয়তো এই কুসংস্কারের উদ্ভব ঘটে এবং পরবর্তী সময়ে তা আরো ব্যাপকতা পায়।”

অনলাইন সংবাদমাধ্যম ডেইলি বাংলাদেশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ডিম আমাদের শরীরে খুব তাড়াতাড়ি গরম করে তোলে। এ সময় ডিম খেলে উত্তেজনা বা প্রেসার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে আর তার ফলে পরীক্ষার মতো শুভ কাজ পন্ড হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়। তাই শুভকাজে যাওয়ার আগে ডিম খেতে নিষেধ করা হয়।”

শুধু বাংলাদেশেই নয় পরীক্ষাভীতির সাথে ডিমকে জড়ানোর এই রীতি মানার উদাহরণ পাওয়া যায় ইউরোপ আমেরিকাসহ সারাবিশ্বেই। ভিয়েতনামে যেমন ছেলের পরীক্ষা শুরুর সপ্তাহখানেক আগে থেকেই মায়েরা ছেলেকে ডিম খেতে দেন না।

ভারতেও এই রীতি মানার খবর এসেছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে। দেশটিতে পরীক্ষার আগে এই খাবারকে অশুভ হিসেবে ধরা হয়।

ডিম খেলে কি পরীক্ষা খারাপ হয়? 

ডিম খেলে পরীক্ষা খারাপ হয় এই দাবির পেছনে দুইটি কারণ সামনে এসেছে। বলা হয়ে থাকে, ডিম আমাদের শরীর খুব তাড়াতাড়ি গরম করে তোলে। এর জন্য মায়েরা সন্তানদের পরীক্ষার আগে ডিম দিতে চান না। এই দাবিটি সত্য। ডিমে থাকা কোলেস্টেরলের কারনে এই সমস্যা হতে পারে। তবে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অফ ইন্ডিয়া এক প্রতিবেদনে বলছে, “সর্বোচ্চ দুইটার বেশি ডিম খেলে এমন হতে পারে।”

আরেক প্রতিবেদনে টাইমস অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছে, “ডিমে থাকা বিশেষ ভিটামিন সদৃশ পদার্থ – কোলিন মস্তিষ্কের কার্যকারিতা এবং স্মৃতিশক্তি উন্নত করতে সহায়তা করে। কোলিন অন্যান্য সাধারণভাবে খাওয়া খাবারে খুঁজে পাওয়া কঠিন।”

দ্বিতীয় কারণ, ডিম খেলে হজমে সমস্যা হয় এমন একটি আশঙ্কা করা হয়। তাই পরীক্ষার আগে ডিম খেতে দেওয়া হয় না। এই দাবিটি সত্য নয়। ঢাকার ইব্রাহিম মেমোরিয়াল হাসপাতালের প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা আখতার নাহার আলো বলছেন,  “সহজে হজম ও সম্পূর্ণরূপে শোষিত হয় বলে ডিম আদর্শ পুষ্টিকর খাবার।”

Screenshot source : kalerkantho

বিডিবিউজ২৪ এর এক প্রতিবেদনেও একই তথ্য দেওয়া হয়েছে, “ডিমের সাদা ও হলুদ অংশ সহজেই হজম করা যায়। ডিম পুষ্টির ভালো উৎস যা হজম শক্তি ভালোরাখার পাশাপাশি শরীর সুস্থ রাখতেও সহায়তা করে। ডিম সিদ্ধ করে খাওয়া ভালো। কারণ এটাহজম হওয়ার জন্য রান্নার উপাদানের প্রয়োজন নেই।”

চিকিৎসক সিদ্ধার্থ মজুমদার ২০১৩ সালে প্রথম আলো‘য় লেখা এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, “সাধারণত ৪০ বছর বয়সের পর থেকে মানুষের হজমশক্তি কমতে শুরু করে। কারও যদি ডিম খাওয়ার পর হজমে গোলযোগ দেখা দেয়, তাহলে তালিকা থেকে ডিম বাদ দিতে হবে। শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলে ৪০ বছর বয়সের পর থেকে প্রতিদিন কুসুম ছাড়া ডিম খেতে পারবেন।”

গবেষণা দেখা গেছে, “কিছু খাবার বিশেষ করে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য এবং মানসিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।” এর মধ্যে অন্যতম খাবার হিসেবে ডিমের নাম উল্লেখ করে স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট healthline বলছে, “পুষ্টির ঘনত্বের কারণে পুরো ডিম খাওয়া মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যকে উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে।”

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি পরীক্ষার আগের সকালের নাস্তায় নিদ্বির্ধায় ডিম রাখতে বলেছে। 

পরীক্ষার আগে কী খেয়ে যাওয়া উচিত?

বিবিসি পরামর্শ দিয়েছে, পরীক্ষার দিনের সেরা সকালের নাস্তা হতে পারে ধীরে নিঃসরণ হয় এমন কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার। এটি হতে পারে, পুরো রোলড পোরিজ ওটস, গোটা শস্যের রুটি বা কম চিনিযুক্ত মুয়েসলি। প্রোটিন জাতীয় খাবারও তালিকায় রাখা যেতে পারে। যেমন দুধ, দই বা ডিম।

healthline এর একটি প্রতিবেদনে পরীক্ষায় ভালো করার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে এমন খাদ্য তালিকায় ডিমের সাথে রেখেছে বেরি ফল, সাইট্রাস ফল (যেমন কমলা, জাম্বুরা, আঙ্গুর), ডার্ক চকলেট, বাদাম, অ্যাভাকাডো, মাছ (সামুদ্রিক মাছও অন্তর্ভুক্ত), বীট পালং, লাল-সবুজ-কমলা সবজি রাখার পরামর্শ দিয়েছে।

একই খাবারগুলোর কথা এসেছে এই সম্পর্কিত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হোমেরটন কলেজের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতেও। পরামর্শ দেওয়া হয়েছে চা এবং কফি পানে। এড়িয়ে যেতে বলা হয়েছে ভারী খাবারকেও।

ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিদ মেলিসা বেকার বলছেন, “নিশ্চিত করতে হবে যে পরীক্ষার্থী যে খাবার খাচ্ছেন সেটি সুষম। এর মানে সেসব খাবার শাকসবজি, প্রোটিন এবং পুরো শস্য ধারণ করে।” তিনি এনার্জি ড্রিংক এড়িয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে বলছেন।

অর্থাৎ, সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবে বহু বছর ধরে ‘পরীক্ষার আগে ডিম খেলে পরীক্ষা খারাপ হয়’ এমন একটি তথ্য প্রচার হয়ে আসছে। অথচ এই দাবির স্বপক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের বরাতে, পরীক্ষার দিন সকালে অন্যান্য খাবারের সাথে ডিম রাখতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, ‘পরীক্ষার আগে ডিম খেলে পরীক্ষা খারাপ হয়’ এমন দাবি মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img