বাদুড়ের চোখে দেখতে না পাওয়ার দাবির সত্যতা কতটুকু?

বাদুড় চোখে দেখে না এমন একটি ভ্রান্ত ধারণা আমাদের সমাজে বেশ প্রচলিত। আবার এমন কথারও প্রচলন আছে যে, বাদুড় দিনে চোখে দেখতে না পারলেও রাতে চোখে দেখে।

Photo by René Riegal on Unsplash
এমন কিছু দাবি নিচে তুলে ধরা হলো-

১.  জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রণীত ৯/১০ শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞান বইয়ে ২০১৭ সালের এডিশন পর্যন্ত ধারবাহিকভাবে বাদুড়ের চোখে দেখতে না পারার বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করে এসেছে। ততদিন পর্যন্ত বহু শিক্ষার্থী বাদুড়ের চোখে না দেখতে পারাকেই ভুলভাবে শিখেছে। ২০১৭ এডিশনের ১২৯ পৃষ্ঠায় ‘তরঙ্গ ও শব্দ’ অধ্যায়ে সরাসরি উল্লেখ করা হয় যে বাদুড় চোখে দেখেনা।

চোখে

২. দৈনিক জনকণ্ঠে ২০১৯ এর ২২ জুন “শেরপুরের নাঙ্গলপাড়ায় বাদুড়ের সঙ্গে এক যুগ” শিরোনামে প্রকাশিত একটি কলামে উল্লেখ করা হয়,

“বাদুড় দিনের বেলা এরা চোখে দেখে না তাই রাতে খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়।”

Screenshot Janakantha

৩. ফেসবুকে ব্যক্তিগত ওয়াল থেকে সাইদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি পোস্ট করেন, বাদুড় যদি দিনের বেলা চোখে না দেখে, তাহলে সূর্যের দোষ কি?। তার এমন পোস্টে বাদুড় চোখে দেখেনা দাবিটির পরোক্ষ ইঙ্গিত।

৪. বাদুড়ের চোখে দেখা, না দেখা নিয়ে সরকারি ওয়েবসাইট শিক্ষা বাতায়নে ‘বাদুড়ের পথ চলা’ শীর্ষক একটি কলাম লিখেন যতীন্দ্র মোহন দাস নামের একজন প্রাথমিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। কলামে তিনি উল্লেখ করেন,

আমরা জানি বাদুড় চোখে দেখতে পায় না। প্রতিধ্বনির সাহায্যে বাদুড় পথ চলে। বাদুড়দের সারা শরীরে রয়েছে অসংখ্য শ্রাব্যকোষ থাকে এবং সেগুলো দিয়ে বাদুড় অনেক দূরের শব্দ অনেক তাড়াতাড়ি শুনতে পায়। উৎপন্ন এসব শব্দ থেকে সৃষ্ট  প্রতিধ্বনির মাধ্যমে সে তার পথ খুঁজে পায়।
Screenshot শিক্ষা বাতায়ন

অনুসন্ধান

রিউমর স্ক্যানার টিমে অনুসন্ধানে জানা যায়, বাদুড় চোখে দেখে না কিংবা শুধুমাত্র রাতেই চোখে দেখে এমন দাবিগুলো সত্য নয় এবং সব প্রজাতির বাদুড়ই কম-বেশি চোখে দেখতে পারে। এমনকি কিছু কিছু বাদুড় রয়েছে যাদের দৃষ্টিশক্তি মানুষের চেয়েও উন্নত।

জনপ্রিয় অ্যানিম্যাল অ্যাডভোকেসি সাইট পেট নিউজ অ্যান্ড ভিউসের প্রতিষ্ঠাতা এবং দ্য এভরিথিং গাইড টু ওয়ার্কিং উইথ অ্যানিমেলস এর লেখক মিশেল সি. হোলোর মতে,

যেহেতু বাদুড় অন্ধকার গুহায় চলাচল করতে সোনার একটি রূপ ব্যবহার করে, কিছু লোক অনুমান করে যে বাদুড় অন্ধ। বাস্তবে, বাদুড় বেশ ভালোভাবে দেখতে পারে-এমনকি অন্ধকারেও। বাদুড় তাদের মুখ বা নাক দিয়ে উচ্চ-পিচ শব্দের স্রোত পাঠায়। এই শব্দগুলি কাছাকাছি বস্তুগুলিকে বাউন্স করে এবং প্রতিধ্বনি ফেরত পাঠায়। এই প্রতিধ্বনিগুলো শুনে বাদুড় কোনো বস্তুর অবস্থান, দূরত্ব, আকার, টেক্সচার এবং আকৃতি বের করতে পারে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে তারা আমাদের মতো করে দেখতে পাচ্ছে না।
Screenshot Parade

মূলত, বাদুড় অন্ধ হয় এই ভুল ধারণাটি তাদের নিশাচর প্রকৃতি এবং উন্নত শ্রবণ ক্ষমতা থেকে আসে। কারণ তারা বেশিরভাগই রাতের শেষের দিকে শিকার করে, যখন আলোর অবস্থা অবশ্যই খুব অন্ধকার, বাদুড়রা শিকারের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করতে প্রতিধ্বনি বা ইকোলোকেশন এর ওপর নির্ভর করে। প্রতিধ্বনির সাহায্যে কোনো বস্তুর অবস্থান শনাক্ত করার নামই হলো ইকোলোকেশন। এর সাহায্যে বাদুড় অন্ধকারে চলাচল করতে পারে, পথে বাঁধা ও প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে চলতে পারে এবং কাঙ্খিত খাবার সংগ্রহ করতে পারে।

সুস্থ গ্রহ নিশ্চিতে বাদুড়ের বিভিন্ন জাতকে রক্ষা নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক সংস্থা ‘ব্যাট কনজার্ভেশন ইন্টারন্যাশনাল’ এর তথ্যমতে বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ১৪০০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে। 

বাদুড়ের প্রায় ১৪০০ প্রজাতির মধ্যে কোনোটাই অন্ধ নয়। দৃষ্টিশক্তির কম বেশি পার্থক্য থাকলেও কোনো প্রজাতিই অন্ধ নয়। বরং আকারে বড় প্রজাতির বাদুড় মানুষের চেয়েও প্রখর দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন হয়। 

Also Read: জলবায়ু পরিবর্তন কী? কীভাবে এবং কেন ঘটছে?

তাছাড়া, Science Direct নামের একটি ওয়েবসাইটে ২০১৫ সালে “Bats regulate biosonar based on the availability of visual information” শিরোনামে প্রকাশিত একটি জার্নাল থেকে জানা যায়, 

বাদুড় চলাফেরার ক্ষেত্রে দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করে। একটি হলো দৃষ্টিশক্তি, অপরটি হলো ইকো-লোকেশন। দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করায় তাদের আশেপাশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বেশি ধারণা পেয়ে থাকে। যা তাদের চলাফেরার কাজে সহায়তা করে। কারণ শুধুমাত্র চোখে দেখে মাঝেমধ্যে সঠিক দূরত্ব নির্ণয় করা সবসময় সম্ভব হয় না। তাছাড়া, উক্ত জার্নালে এটাও উল্লেখ আছে যে পোকামাকড় খেয়ে যেসব বাদুড় বেঁচে থাকে তারাও দৃষ্টিশক্তির ওপর নির্ভরশীল।

সুতরাং, বাদুড় চোখে দেখে না কিংবা শুধুমাত্র রাতেই চোখে দেখে এমন দাবিগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img