ডেঙ্গু বিষয়ে প্রচলিত ধারণাগুলোর সত্যতা কতটুকু? 

বাংলাদেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়েছিল ২০০০ সালের দিকে। একসময় ধারণা ছিল, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মূলত ঢাকা মহানগরকেন্দ্রিক। কিন্তু ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটার পর এই রোগ নতুন করে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইসাথে ডেঙ্গু বিষয়ে প্রচলিত নানা মিথ রোগটি সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর বার্তা দিচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

ডেঙ্গু কতটা ভয়াবহ?

ডেঙ্গু জ্বরের উৎপত্তি হয় ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে। স্বাস্থ্য বিষয়ক মার্কিন সরকারি সংস্থা ‘Centers for Disease Control and Prevention (CDC)’ এর ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু ছড়ায় মূলত এডিস মশার একটি প্রজাতির (Aedes aegypti) কামড়ের মাধ্যমে। একই প্রজাতি জিকা, চিকনগুনিয়া এবং সমজাতীয় ভাইরাসগুলো ছড়ানোর জন্যও দায়ী। তাছাড়া, এডিস প্রজাতির আরও তিনটি মশার জাতেরও (Aedes albopictus, Aedes polynesiensis, Aedes scutellaris) ডেঙ্গু ছড়ানোতে ভূমিকা রয়েছে।

বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে এমন এলাকায় বাস করছে। সিডিসি’র হিসাবে, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ডেঙ্গুর ভয়াবহতায় মারা যান ৪০ হাজার রোগী।

পানিতে এডিস মশা ব্যাপকহারে ডিম পাড়ে এবং হাজার হাজার মশার জন্ম হয়৷ মশার লার্ভা দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে বড় হয়৷ এদের মধ্যে যে সব মশা স্ত্রী জাতীয় তা ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে৷ এ মশায় কামড়ালে ডেঙ্গু জ্বর হয়৷ ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি চার থেকে ছয়দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আগে ঢাকায় বেশি থাকলেও এখন দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে৷ 

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বহু বছর ধরে থাকলেও ২০১৯ সালে এই রোগে আক্রান্তের হার এবং মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে শুরু করে। চলতি বছরও ইতোমধ্যেই এই রোগে মৃতের সংখ্যা রেকর্ড দুইশত ছাড়িয়েছে বলে খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। 

ডেঙ্গু বিষয়ে নানান মিথ

ডেঙ্গু বিষয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই নানা মিথ প্রচলিত রয়েছে। 

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মিথ – 

১/ এডিস মশা শুধু সকালে কামড়ায়।
২/ এডিস মশা আকারে বড় হয়, ছোট মশা এডিস হয় না। 
৩/ এডিস মশা শুধু পায়ে কামড়ায়।
৪/ কারো দুইবার ডেঙ্গু হয়না।
৫/ দুইবার ডেঙ্গু হলে নিশ্চিত মৃত্যু।
৬/ এডিস মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু হয়।
৭/ প্লাটিলেট কমে গেলে পেঁপের পাতার রস খেলে ডেঙ্গু রোগীর উপকার হয়।

এডিস মশা কি শুধু সকালে কামড়ায়?

আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ‘Reuters’ এর এক প্রতিবেদনে এসেছে, এডিস মশা বেশিরভাগ দিনের বেলাতেই সক্রিয় থাকে।

২০১৯ সালে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু বিষয়ক কর্মসূচির ব্যবস্থাপক এম. এম. আখতারুজ্জামান বিবিসি বাংলা’কে জানান, শুধুমাত্র দিনের আলো থাকাকালীন সময়েই এডিস মশা কামড়ায়।

“সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এডিস মশা কামড়ায়। তবে কামড়ানোর হার সবচেয়ে বেশি থাকে সূর্যোদয়ের পর দুই-তিন ঘন্টা এবং সূর্যাস্তের আগের কয়েক ঘন্টা।”

রাতে এডিস মশা কামড়ায় না বলে নিশ্চিত করেন মি. আখতারুজ্জামান।

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। সংস্থাটির কমিউনিকেশন অফিসার জেমস আল্ডওর্থ (James Aldworth) রিউমর স্ক্যানারকে জানান, এডিস মশা দিনের বেলায় কামড়াতে পছন্দ করে, বিশেষত পিক টাইম হিসেবে ভোর ও সন্ধ্যায় এরা বেশি কামড়ায়।

অর্থাৎ, এডিস মশা শুধু সকালে কামড়ায় এমন দাবি সত্য নয়। এই মশা দিনের আলোতে সবচেয়ে বেশি কামড়ায়, বিশেষত পিক টাইম হিসেবে ভোর ও সন্ধ্যায় এরা বেশি কামড়ায় বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। 

ডেঙ্গু শুধু বড় মশা হয়, ছোট মশা ডেঙ্গু মশা নয়?

বিজ্ঞান বিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘Nature’ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “এডিস এজিয়েপ্টি জাতের মশাগুলো আকারে ছোটই হয়। এর পায়ে সাদা ব্যান্ড এবং শরীরে একটি রূপালী-সাদা আঁশ দ্বারা এদের চিহ্নিত করা যায়।”

এডিস এজিয়েপ্টি ছাড়াও এডিস আলবোপিকটাসও আকারে ছোট এবং কালো রংয়ের প্রজাতি।

Screenshot source: cdph

এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কমিউনিকেশন অফিসার জেমস আল্ডওর্থ (James Aldworth) রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “আকারের তুলনা করা কঠিন, কিন্তু শহরের দিকে এডিস মশা কিউলেক্স মশার চেয়ে ছোট (যা সেপটিক ট্যাঙ্কে বংশবৃদ্ধি করে)”

এডিস মশা কি শুধু পায়ে কামড়ায়?

এডিস মশা শুধু পায়ে কামড়ায় এই ধারণাটি সঠিক নয়। সিডিসি প্রদত্ত একটি ফ্যাক্টশিটে এসেছে, এই মশা গোড়ালি এবং কনুইতেও কামড়ায়। 

এ বিষয়ে জেমস আল্ডওর্থ (James Aldworth) রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “দুর্বল ফ্লায়ার (weak fliers) হওয়ার কারণে, এডিস মশা কম উচ্চতায় উড়তে পছন্দ করে এবং ত্বকে সরাসরি স্পর্শে আসলে শরীরের যেকোনো অংশে কামড়ায়।”

দুইবার কি ডেঙ্গু হওয়া সম্ভব?

ডেঙ্গুতে একবার আক্রান্ত হলে যে আবার আক্রান্তের সম্ভাবনা নেই তা নয়। দ্বিতীয়বারও আপনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন। সিডিসির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, ডেঙ্গু ভাইরাস চার ধরনের হয়। তাই ডেঙ্গু জ্বরও চারবার হতে পারে। তবে যারা আগেও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে রোগটি হলে সেটি মারাত্মক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। 

রিউমর স্ক্যানারের সাথে আলাপকালেও একই তথ্য দিয়েছেন জেমস আল্ডওর্থ। তিনি বলছিলেন, “ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে (DENV 1, DENV 2, DENV 3, DENV 4)। একটি সেরোটাইপ থেকে সংক্রমণ একজন ব্যক্তিকে পরবর্তী সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে না যখন অন্য সেরোটাইপ দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাই একজনের একাধিকবার ডেঙ্গু হতে পারে।”

দুইবার ডেঙ্গু হলে নিশ্চিত মৃত্যু?

দুইবার ডেঙ্গু হলেই যে মৃত্যু নিশ্চিত এমন তথ্যের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন জেমস আল্ডওর্থ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই কর্মকর্তা রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত রোগীদের। তবে এর মানে এই নয় যে, তার মৃত্যু হবেই। অধিকাংশ দেশেই এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে হ্রাস পেয়েছে।” 

এডিস মশা কামড়ালেই কি ডেঙ্গু হয়?

সাধারণ এডিস মশা কামড়ালে ডেঙ্গু হবে না। তবে যে এডিস মশাটি ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস বহন করছে, সেটি কামড়ালে ডেঙ্গু হতে পারে।

জেমস আল্ডওর্থ রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “৭-১০ দিনের ইনকিউবেশন পিরিয়ড অতিবাহিত হওয়ার পর সংক্রমিত এডিস মশাই শুধু ভাইরাস ছড়াতে পারে যখন ভাইরাসটি মশার শরীরে প্রবেশ করে।” 

ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট কমে গেলে পেঁপের পাতার রস খেলে উপকার পায়?

২০১৯ সালে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পৃথিবীর কয়েকটি দেশে ডেঙ্গু রোগীকে পেঁপে পাতার রস খাওয়ানোর উপদেশ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটি খবরের বরাতে বিবিসি বাংলা জানায়, ২০১৭ সালে ভারতে ৪০০ জন ডেঙ্গু রোগীর ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় উঠে আসে যে পেঁপে পাতার রস খাওয়া রোগীদের রক্তকণিকার পরিমাণ অন্য রোগীদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি বেড়েছে এবং তাদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও অপেক্ষাকৃত কম।

বিবিসি বাংলা বলছে, ডেঙ্গুর তীব্রতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে রোগীদের নির্দিষ্ট পরিমাণে পেঁপে পাতার রস খাওয়ার উপদেশ দেয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের ওয়েবসাইটে।

একই প্রতিবেদনে উক্ত বিষয়ে বিবিসি বাংলা ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ মুজিবুর রহমানের মতামত রেখেছে। জনাব মুজিবুর এ প্রসঙ্গে বলেন, “পেঁপে পাতার রস যে ডেঙ্গু নিরসনে ভূমিকা রাখে, এই দাবির কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ডেঙ্গু নিরসনে পেঁপে পাতার রসের ভূমিকার পরীক্ষা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে, কিন্তু পুরোপুরি প্রমাণিত হয়নি যে এটি ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে কার্যকর।”

এ বিষয়ে জেমস আল্ডওর্থও মুজিবুর রহমানের মতের সাথে একমত পোষণ করে  রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, “এ বিষয়ে কিছু রিপোর্ট আছে, কিন্তু তা এখনও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়নি। গবেষণা এখনও চলছে।”

অর্থাৎ, মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু বিষয়ে বহু বছর ধরেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই অনেক ধরনের প্রচলিত মিথ রয়েছে। রোগটির প্রধান বাহক এডিস মশা আকারে বড় হওয়া, এই মশার শুধু দিনে এবং পায়েই কামড়ানো, দুইবার ডেঙ্গ হয় না, হলেও মৃত্যু নিশ্চিত কিংবা ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট কমে গেলে পেঁপের পাতার রস খেলে উপকার পাওয়া নিয়ে বিভিন্ন সময়েই সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে গণমাধ্যমে আলোচনা সমালোচনা দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। তবে এ বিষয়গুলোর কোনোটিই পুরোপুরি সঠিক নয়। আন্তর্জাতিক একাধিক গণমাধ্যম এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে যোগাযোগের পর রিউমর স্ক্যানার নিশ্চিত হয়েছে, এডিস মশা আকারে ছোট এবং পা ছাড়াও অন্যান্য স্থানেও কামড়াতে পারে। একজনের একাধিকবার ডেঙ্গু হতে পারে কিন্তু এতে যে নিশ্চিত মৃত্যু হবে সে তথ্য সঠিক নয়। আবার এডিস মশা কামড়ালেই যে তা থেকে ডেঙ্গু ছড়াবে এমনও নয়। ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস বহনকারী মশাতেই শুধু এ রোগ ছড়ায়। তাছাড়া ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে গেলে পেঁপের পাতার রস খাওয়ার পরামর্শ নিয়ে মতভেদ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, “এ বিষয়ে এখনও গবেষণা চলছে। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে এখনও প্রমানিত নয়।”

সুতরাং, ডেঙ্গু বিষয়ে প্রচলিত ধারণাগুলো পুরোপুরি সত্য নয়।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img