ষাঁড় কি লাল কাপড় দেখলে রেগে যায়?

গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে সারাবিশ্বেই গরু এক পরিচিত নাম। শান্ত প্রাণী খ্যাত গরু প্রাণীজগতের বোভিডাই (Bovidae) পরিবারের সদস্য। একই পরিবারের আরেক সদস্য ষাঁড় পরিচিত তার ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের কারণে। গরু এবং ষাঁড় নিয়ে বহু বছর ধরে প্রচলিত আছে নানা মিথ বা গুজব যা বিভিন্ন সময়ে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য হিসেবে ছড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়।

গরু ও ষাঁড় নিয়ে কোন মিথটি প্রচলিত

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বর Mohidul Islam নামক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি পোস্ট (আর্কাইভ) করা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, “লাল রং দেখলে পাগলা ষাঁড় খেপে যায় শুনেছি।” 

শুধু সে বছরই নয়, গরু বা ষাঁড় লাল রং দেখলে রেগে যায়- এমন মিথ নিয়ে বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আলোচনার শুরু ২০১১ সালে। সে বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর জানা অজানা কিছু নামক পেজে গরু বা ষাড় গুলি নাকি লাল কাপড় দেখলে ক্ষেপে যায়!! (আর্কাইভ) শিরোনামে একই বিষয়ে একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। 

এই মিথ নিয়ে গেল বেশ কয়েক বছর ধরেই ফেসবুকের বিভিন্ন পোস্টে আলোচনা হচ্ছে। সম্প্রতিও এমন কিছু পোস্ট লক্ষ্য করা গেছে।

একই বিষয়ে আরো কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে। 

গরু ও ষাঁড়ের স্বভাব ঠিক কেমন?

বেশ নিরীহ এবং শান্ত প্রাণী হিসেবেই গরুকে আমরা চিনি। নারী প্রজাতির এই প্রাণী সহজেই পোষ মানে। স্নেহশীল, আবেগপ্রবণ এবং বুদ্ধিমান হিসেবেও নিজেদের চিনিয়েছে এই প্রাণী। গরু দৃঢ় বন্ধনে বিশ্বাসী এবং বন্ধুত্ব গঠনে করে। শুধুমাত্র কিছু পছন্দের সঙ্গীর সাথে তাদের বেশিরভাগ সময় কাটাতে বেছে নেয়। মানুষের সাথেও গরুর সম্পর্ক নিবিড়। যেসব গরু অতীতে দুর্ব্যবহার বা অপব্যবহারের শিকার হয়েছে তারা সময়ের সাথে সাথে সেসব ভুলে গিয়ে ক্ষমা করতে পারে এবং আবার মানুষকে বিশ্বাস করতে শুরু পারে।

Screenshot from dailymail website

অন্যদিকে ষাঁড়ের স্বভাব গরুর ঠিক উল্টো। পুরুষ প্রজাতির এই প্রাণীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে পৃথিবীর নানা স্থানে সার্কাস কিংবা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিতে দেখা যায়। আক্রমণাত্মক স্বভাবের এই প্রাণী গরুর তুলনায় বেশি বুদ্ধিমান। বিভিন্ন প্রতিযোগিতার জন্য যখন ষাঁড়কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তখন এরা ক্ষিপ্র প্রজাতির হয়ে উঠে। 

গরু বা ষাঁড় কি লাল কাপড় দেখলে রেগে যায়? 

২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি West Texas A&M University এর সহকারী অধ্যাপক Dr. Christopher S. Baird এর লেখা একটি কলাম বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, “লাল রং ষাঁড়কে রাগান্বিত করে না। প্রকৃতপক্ষে, ষাঁড় সুস্থ মানুষের তুলনায় আংশিকভাবে বর্ণান্ধ, ফলে তারা লাল রং দেখতে পায় না।”

মার্কিন বিজ্ঞানী টেম্পল গ্র্যান্ডিনের লেখা ‘Improving Animal Welfare’ বইয়ের বরাত দিয়ে একই কলামে বলা হয়েছে, “গবাদিপশুদের চোখের রেটিনায় লাল রং গ্রহণ করার মতো ‘রিসেপ্টর’ নেই।” অর্থাৎ লাল রং গ্রহণ করার মতো ক্ষমতা ওদের চোখের রেটিনায় নেই।

Screenshot from West Texas A&M University website

এ কারণে এই পশুরা শুধু হলুদ, সবুজ, নীল ও বেগুনি রং দেখতে পায়। সুস্থ মানুষের চোখের পেছনের দিকে রং শনাক্ত করার জন্য তিন ধরনের ‘কোন সেল’ (Cone Cell) রয়েছে। যেগুলো লাল, সবুজ ও নীল রং শনাক্তে সাহায্য করে। ষাঁড়ের ক্ষেত্রে লাল রং শনাক্তের ‘কোন সেল’ না থাকায় এরা রংটি দেখতে পায় না। এ অবস্থাকে বলা হয় প্রোটানোপিয়া। যার ফলে লাল রংয়ের কাপড়কে ওরা অনেকটা হলুদাভ ধূসর রংয়ের দেখে। অর্থাৎ, লাল কাপড় দেখে গরু বা ষাঁড় রেগে যাওয়ার তথ্যটির বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। 

Screenshot from color-blindness website

প্রতিযোগিতায় কেন লাল রং দেখে ষাঁড় তেড়ে আসে?

ষাঁড়ের লড়াই (Bull fighting) সম্পর্কে কমবেশি সবাই পরিচিত। স্পেনে বেশ জনপ্রিয় এই খেলা।  এই ধরনের প্রতিযোগিতায় ষাঁড়ের চোখের সামনে এক সাহসী মানুষ (যাকে বলা হয় ম্যাটাডোর) লাল রংয়ের একপ্রস্থ কাপড় নাড়াচাড়া করেন। আর তা দেখে ষাঁড় ক্ষিপ্র গতিতে তেড়ে আসে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম Times of India‘ তে ২০০৩ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “যখন একজন স্প্যানিশ ম্যাটাডোর ষাঁড়টিকে রাগান্বিত করার জন্য একটি লাল জামা পরে, লক্ষ্য করে থাকবেন যে তিনি জোরে জোরে কাপড়টি দোলাচ্ছেন। সেটাই ষাঁড়কে বিরক্ত করে এবং তাকে রাগান্বিত করে, কাপড়ের রং নয়।”

Screenshot from Times of India website

২০২১ সালে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ম্যাটাডোর যখন লাল রংয়ের কাপড়টা নাড়াচাড়া করে, তখন ষাঁড়ের সামনে আসলে হলুদাভ ধূসর রংয়ের এক কাপড়ই নড়ে ওঠে। এটা ঠিক যে এতে ষাঁড়ের মনে একধরনের বিভ্রম তৈরি হয়। সবচেয়ে বড় কথা, বুলফাইটিংয়ের জন্য ষাঁড়গুলোকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। আর ক্ষিপ্র প্রজাতির ষাঁড়ই বেছে নেওয়া হয় বুলফাইটিংয়ের জন্য। এরা এতটাই চড়া মেজাজের হয় যে চোখের সামনে যা-ই ধরা হোক না কেন, তেড়ে আসবেই। আর ম্যাটাডোররাও ষাঁড়দের রাগিয়ে তোলায় ওস্তাদ।”

Screenshot from Prothom Alo website

বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট Live Science এ ২০১২ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “২০০৭ সালে ডিসকভারি চ্যানেলের ‘মিথবাস্টার্স’ অনুষ্ঠানে ষাঁড়দের ওপর তিন ধরনের পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। প্রথম পরীক্ষায় লাল, নীল ও সাদা রংয়ের তিনটি পতাকা রাখা হয়েছিল। ষাঁড় পর্যায়ক্রমে সব কটিকেই আক্রমণ করে। দ্বিতীয় পরীক্ষায় তিনটি পুতুলকে লাল, নীল ও সাদা রংয়ের জামা পরিয়ে রেখে দিলে সব কটিকেই আক্রমণ করে। বরং ষাঁড়গুলো লাল জামা পরা পুতুলটিকে আক্রমণ করে সব শেষে! আর তৃতীয় পরীক্ষায় তিন ম্যাটাডোরকে তিন রংয়ের জামা পরিয়ে ষাঁড়ের সামনে দাঁড় করানো হয়। যাঁদের মধ্যে লাল জামা পরা ব্যক্তিটি স্থির দাঁড়িয়ে ছিলেন আর অন্য দুজন এদিক–সেদিক নড়াচড়া করছিলেন। দেখা যায়, অন্য দুই ম্যাটাডোরকে আক্রমণ করতে ষাঁড় তেড়ে গেলেও লাল জামা পরা ব্যক্তির দিকে ঘুরেও তাকায় না! এ পরীক্ষা থেকেই বোঝা যায়, ষাঁড় আসলে লাল রংয়ের জন্য রেগে যায় না; বরং কাপড়ের নড়নচড়ন ওদের রাগিয়ে তোলে, সেটা যে রংয়ের কাপড়ই হোক না কেন।”

Screenshot from Live Science website

২০১৭ সালে জাতীয় দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “ষাঁড়গুলোকে দিনের আলোয় খুব কমই আসতে দেয়া হয় এবং খেলা শুরু হওয়ার আগে থেকেই পিটিয়ে বা বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করা হয়, যার ফলে তাদের মেজাজ সপ্তমে চড়ে থাকে আগে থেকেই। খেলার সময় স্বল্প সময়ের জন্য যখন তাকে খোলা মাঠে ছেড়ে দেয়া হয় তখন তার সামনে লাল কাপড় বা হ্যাম বার্গার যেটাই নাড়ানো হোক না কেন সে তেড়ে আসবেই। আর খেলার বাইরেও এ ঘটনা হরহামেশাই দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন কারণে ষাঁড় বা গরুর মেজাজ খারাপ থাকলেই তারা হঠাৎই আক্রমণ করে বসতে পারে তা আপনি যে রঙের পোশাকই পরে থাকুন না কেন।”

প্রতিযোগিতায় কেন তাহলে ষাঁড়কে ক্ষেপাতে লাল কাপড় উড়ানো হয়?

চলতি ১৭ জানুয়ারী বিজ্ঞান বিষয়ক ভারতীয় ওয়েবসাইট Science ABC এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ষাঁড়ের লড়াইয়ের মতো প্রতিযোগিতায় ষাঁড়কে ক্ষেপাতে লাল কাপড়ের ব্যবহার মূলত ঐতিহ্যগত অংশ।”

প্রকৃতপক্ষে, এই ধরনের লড়াইয়ে তিনটি পর্যায় রয়েছে এবং শেষ পর্যায়েই শুধু লাল কেপ (এক প্রস্থ কাপড়) ব্যবহার হয়ে আসছে।

Screenshot from Science ABC website

বলা হয়ে থাকে, স্পেনিশ ম্যাটাডোর ফ্রান্সিসকো রোমেরো আঠারশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ষাঁড়ের লড়াইয়ে এই লাল রং সদৃশ মুলেতার (লাল কেপ) প্রচলন করেছিলেন। 

Screenshot from Real Maestranza de Caballería de Ronda

অর্থাৎ, নির্ভরযোগ্য কোনো সঠিক ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া বহু বছর ধরে ফেসবুকে ’গরু বা ষাঁড় লাল কাপড় দেখলে রেগে যায়’ বলে একটি মিথ প্রচার হয়ে আসছে। কিন্তু এই মিথের স্বপক্ষে একটিও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। ষাঁড়ের লড়াইয়ে ষাঁড়কে ক্ষেপাতে লাল এক প্রস্থ কাপড় ব্যবহার হয়। এই লাল রং দেখে ষাঁড়কে ক্ষিপ্র গতিতে তেড়ে আসতে দেখা যায়। কিন্তু গবাদিপশুদের চোখের রেটিনায় লাল রং গ্রহণ করার মতো ‘রিসেপ্টর’ নেই। ফলে তারা লাল রংকে হলুদাভ ধূসর দেখে। বরং কাপড়ের নড়নচড়ন ওদের রাগিয়ে তোলে, সেটা যে রংয়ের কাপড়ই হোক না কেন। তাই লাল কাপড় দেখলে ষাঁড় বা অন্য গবাদিপশুরা রেগে যায় এমন তথ্যের কোনো ভিত্তি নেই। 

তথ্যসূত্র

  1. West Texas A&M University: What is it about red that makes bulls so angry?
  2. Color-blindness: Protanopia
  3. Prothom Alo: ষাঁড় কি লাল রং দেখলে রেগে যায়
  4. Times of India: Why does a bull get angry only when it sees the colour red?
  5. Live Science: Why Do Bulls Charge When they See Red?
  6. কালের কন্ঠ: ষাঁড় কেন আক্রমণ করে ম্যাটাডোরকে?
  7. Science ABC: Do Bulls Really Hate the Color Red or Are they Color Blind?
  8. Real Maestranza de Caballería de Ronda: DYNASTIES

আরও পড়ুন

spot_img