মস্তিষ্কের রোগ হিসেবে পরিচিত এক নাম স্ট্রোক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) দেওয়া তথ্যমতে, সারাবিশ্বে যে রোগগুলোর কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় তার মধ্যে স্ট্রোকের অবস্থান দ্বিতীয়। একইসাথে সর্বাধিক পঙ্গুত্ব বরণ করা রোগের মধ্যে এই রোগের অবস্থান তৃতীয়। স্ট্রোকের বিষয়ে মানুষের সচেতনতা ও নির্ভরযোগ্য সূত্রের অভাবের সুযোগে এই রোগকে ঘিরে ইন্টারনেট দুনিয়ায় প্রায়ই নানা রকম বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে দেখা যায়।
স্ট্রোক ঘিরে বিভ্রান্তিকর যে তথ্য প্রচলিত
১. বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক Daily Sun এর ওয়েবসাইটে ২০২০ সালের ২৯ মে ‘Why do strokes often happen in bathroom?‘ (আর্কাইভ) শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বরাতে বলা হয়, “গোসলের সময় নিয়মের ক্রম না মেনে মাথায় প্রথমে পানি দিলে স্ট্রোকের মতো রোগের শঙ্কা থাকে।”
২. ভারতীয় সংবাদমাধ্যম Zee news ২০১৮ সালের ২৪ জুন বাথরুমে স্ট্রোকের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন (আর্কাইভ) প্রকাশ করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, “বিশ্বের একাধিক গবেষণা এবং পরিসংখ্যানের রিপোর্ট অনুযায়ী, স্নানের সময় স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে।”
পরবর্তীতে একই তথ্যসম্বলিত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন – ঢাকা পোস্ট (আর্কাইভ), ঢাকা টাইমস (আর্কাইভ), যায়যায়দিন (আর্কাইভ), NEWS24 (আর্কাইভ), জনকণ্ঠ (আর্কাইভ), আমাদের সময় (আর্কাইভ),বাংলাদেশ প্রতিদিন (আর্কাইভ), নয়া দিগন্ত (আর্কাইভ)।
একই তথ্যসম্বলিত ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন – news18 (আর্কাইভ)।
একই তথ্য সম্বলিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কিছু পোস্ট দেখুন এখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে এবং এখানে।
স্ট্রোক কেন হয়?
স্ট্রোকের সাথে রক্ত চলাচলের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ঠিকভাবে কাজ করার জন্য শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মতো রক্তের মাধ্যমে মস্তিষ্কেরও অক্সিজেন ও পুষ্টির দরকার হয়। কিন্তু এই রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হলে মস্তিষ্কের কোষগুলো মারা যেতে শুরু করে। ফলে ব্রেন ইনজুরি, শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে যাওয়া এমনকি মৃত্যুর আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে। এই অবস্থাটিই স্ট্রোক নামে পরিচিত। ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা NHS বলছে, সাধারণত দুই রকম স্ট্রোক হতে পারে। একটি হ্যামারেজিক স্ট্রোক, এটির কারণে রক্তক্ষরণ হয়। অন্যটি হলো স্কিমিক স্ট্রোক, এতে রক্তক্ষরণ হয় না।
হ্যামারেজিক স্ট্রোক হয় মূলত উচ্চ রক্তচাপের কারণে। রক্তনালীর বেলুনের মতো প্রসারণ (aneurysm) বা মস্তিষ্কে অস্বাভাবিকভাবে গঠিত রক্তনালী ফেটে যাওয়ার কারণেও হ্যামারেজিক স্ট্রোক হতে পারে। স্কিমিক স্ট্রোক হয় যখন একটি রক্তের পিন্ড রক্ত ও অক্সিজেনের প্রবাহকে বাধা দেয়। এই বাধা সাধারণত এমন জায়গায় তৈরি হয় যেখানে ধমনীগুলো সময়ের সাথে সাথে সংকীর্ণ হয়, যাকে প্ল্যাক (plaque) বলা হয়। ইস্কেমিক স্ট্রোকের আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হল এক ধরনের অনিয়মিত হৃদস্পন্দন যাকে বলা হয় অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন (atrial fibrillation)।
বাথরুমে বেশি স্ট্রোক হয়?
২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জাপানের একদল গবেষক ১৯৩৯ জন স্ট্রোকের রোগীর উপর চালানো এক গবেষণায় দেখতে পান, এদের মধ্যে ৭৮ জন গোসলের সময় স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এই ফলাফলের ভিত্তিতে তারা যে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন সেখানে তারা উল্লেখ করেন, অল্প কিছু রোগীকেই তারা বাথটাবে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে পড়ে থাকার ব্যাপারে জানতে পেরেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, “গোসল-সংক্রান্ত স্ট্রোক রোগীদের বেশিরভাগই বাথটাবের বাইরে ধসে পড়েছিল বলে যে অনুসন্ধান করা হয়েছে তা থেকে বোঝা যায় যে বাথটাবে ডুবে যাওয়ার দুর্ঘটনায় স্ট্রোকের জড়িত থাকার সংখ্যা কম হতে পারে।“
এ বিষয়ে জানতে গবেষক দলটির প্রধান জোযি ইনামাসু’র (Joji Inamasu) সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে রিউমর স্ক্যানার। তবে এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত তার পক্ষ থেকে সাড়া মেলে নি।
বাথরুমে স্ট্রোক বেশি হওয়া বিষয়ক তথ্যের পক্ষে কোনো গবেষণা প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায় নি। সংবাদমাধ্যমগুলোতে এই সংক্রান্ত প্রতিবেদনে সূত্র হিসেবে নির্দিষ্ট কোনো গবেষণার বিষয়ে উল্লেখ না করে ‘বিভিন্ন গবেষণা’ উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, NEWS24 বলেছে, “বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, স্ট্রোক সাধারণত বাথরুমেই বেশি হয়ে থাকে।”
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম Zee News এ প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে,”বিশ্বের একাধিক গবেষণা এবং পরিসংখ্যানের রিপোর্ট অনুযায়ী, স্নানের সময় স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে।” অর্থাৎ, এই প্রতিবেদনেও নির্দিষ্ট কোনো গবেষণা সূত্র উল্লেখ করা হয় নি।
চিকিৎসকরা ধারণা করে থাকেন, বাথরুমেই স্ট্রোক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জাতীয় দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে ২০১৮ সালের ২৮ মার্চ ঢাকা সিটি ফিজিওথেরাপি হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও চিফ কনসালটেন্ট ডা. এম ইয়াছিন আলী তার লেখা একটি কলামে বাথরুমে বেশি স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে কিছু কারণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “যারা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভোগেন তারা টয়লেটে গিয়ে স্বাভাবিক বাথরুম না হওয়ায় শরীরের ওপর অতিরিক্ত প্রেসারের কারণে স্ট্রোক করে থাকেন। যাদের উচ্চ রক্তচাপ ও নিম্ন রক্তচাপের সমস্যায় ভোগেন তারা বাথরুমে স্ট্রোক করেন।” এছাড়া তিনি ডায়াবেটিস, রক্তে উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল, অ্যালকোহল গ্রহণকেও বাথরুমে বেশি স্ট্রোকের জন্য দায়ী করেন। উক্ত লেখায় জনাব ইয়াছিন এসব কারণের পেছনে কোনো তথ্যসূত্র উল্লেখ করেন নি।
গোসলে মাথায় প্রথমে পানি দিলে স্ট্রোক হতে পারে?
অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের বৃহত্তম স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান Monash Health এর নিউরোসায়েন্স রিসার্চের প্রধান থান পান (Thanh Phan) বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, “বেশিরভাগ স্ট্রোক মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার কারণে হয়। এই জমাট হৃদপিণ্ড বা বড় রক্তনালী (যেমন ক্যারোটিড ধমনী) থেকে আসে। অন্যান্য সাধারণ কারণ হল রক্তনালী ফেটে যাওয়া।” এএফপি ফ্যাক্ট চেক‘কে তিনি জানান, “গোসলের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো ক্রমধারা ঠিক করার ব্যাপারে বলা হয় হয়েছে এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই।“
একই মত দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার স্ট্রোক ফাউন্ডেশনের ক্লিনিক্যাল কাউন্সিলের চেয়ার প্রফেসর ব্রুস ক্যাম্পবেল (Bruce Campbell)।
এই বিষয়ে জানতে আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশনের সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার। প্রতিষ্ঠানটির কাস্টমার কেয়ার স্পেশালিষ্ট হোপ ই. (Hope E.) রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, “বেশিরভাগ স্ট্রোক অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন, ধমনী শক্ত হয়ে যাওয়া এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো অবস্থার কারণে হয়। এর বাইরেও বিশেষ করে ভাস্কুলার এবং হেমাটোলজিক ডিসঅর্ডারের মতো কারণও রয়েছে। গোসলের সময় মাথা আগে ভিজিয়ে রাখার সাথে স্ট্রোকের সম্পর্কের বিষয়ে কোনো প্রমাণ বা গবেষণা আমাদের কাছে নেই।”
এ বিষয়ে জানতে ইংল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান Stroke Association এর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে রিউমর স্ক্যানার। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে রিউমর স্ক্যানারকে জানানো হয়, “গোসল করার সময় শরীরের আগে মাথা ভেজালে স্ট্রোক হয়” এই দাবির সমর্থনে আমরা কোনো প্রমাণ সম্পর্কে অবগত নই।”
গোসলের ক্ষেত্রে কোনো নির্দেশনা আছে?
স্ট্রোকের রোগীদের গোসলের ক্ষেত্রে আমেরিকান স্ট্রোক এসোসিয়েশন বেশ কিছু নির্দেশনা দিলেও মাথায় আগে বা পরে পানি ঢালা কিংবা গোসলের নির্দিষ্ট কোনো ক্রমধারা অনুসরণের বিষয়ে কোনো তথ্য দেয় নি। গোসলের ঝরণা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে নির্দেশনায় বলা হয়েছে, গোসল সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে ছোট একটি বাথ বেঞ্চের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।
অর্থাৎ, বিগত কয়েক বছর ধরেই গোসলে মাথায় আগে পানি ঢাললে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায় এমন দাবির প্রচলন হয়ে আসছে। কিন্তু গবেষণা ও বিশেষজ্ঞদের বরাতে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, এই দাবির কোনো সত্যতা নেই। আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশন রিউমর স্ক্যানারকে এ বিষয়ে নিশ্চিত করেছে। এমনকি গোসলের সময় কোনো ক্রমধারার মেনে চলার ব্যাপারেও কোনো নির্দেশনা দেয় নি আমেরিকান স্ট্রোক এসোসিয়েশন।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি সূঁচ ফুটিয়ে আঙুলে ও কানে রক্তপাতে স্ট্রোক রোধ বিষয়ক বিভ্রান্তিকর তথ্যের বিষয়ে ফ্যাক্ট ফাইল প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। পড়ুন এখানে।
সুতরাং, গোসলে আগে মাথায় পানি ঢাললে স্ট্রোক হয় এমন দাবি সঠিক নয়।
তথ্যসূত্র
- WHO: Stroke, Cerebrovascular accident
- BBC : Stroke: স্ট্রোকের কারণ, লক্ষণ ও ঝুঁকি এড়ানোর উপায়
- NHS : Causes -Stroke
- Jugantor: যে ৫ কারণে বাথরুমে বেশি স্ট্রোক হয়
- National Library of Medicine : Clinical Characteristics of Stroke Occurring while Bathing
- AFP Fact Check : Wetting your head before your body while showering does not cause stroke, experts say
- Statement from American Heart Association
- American Stroke Association : Bathing Tips for Survivors