গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে এনসিপির জুলাই পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংঘর্ষে অন্তত ৫ জন নিহত হন। এরই প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে “পুলিশের গুলিতে ‘আর্মি’ হতে চাওয়া ছোট্ট জাবিরের মৃত্যু” শীর্ষক শিরোনামের একটি ফটোকার্ড প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, সম্প্রতি গোপালগঞ্জে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায় জাবির ইব্রাহিম নামের শিশু।
উল্লেখ্য যে, কিছু পোস্টের ক্যাপশনে পুলিশের গুলিতে এবং কিছু পোস্টের ক্যাপশনে সেনাবাহিনীর গুলিতে জাবিরের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করা হয়।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত শিশু জাবির ইব্রাহিম সম্প্রতি গোপালগঞ্জে হওয়া সংঘর্ষে নিহত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে সে গত বছরের ০৫ আগস্টে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত পোস্টগুলো পর্যবেক্ষণ করলে তাতে সংযুক্ত ফটোকার্ডে ‘রূপালী বাংলাদেশ” নামক সংবাদমাধ্যমের নাম ও লোগো পাওয়া যায়। উক্ত তথ্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করলে গত ১৬ জুলাই ও ১৮ জুলাইয়ে “রূপালী বাংলাদেশ” এর ফেসবুক পেজে আলোচিত ফটোকার্ডগুলো প্রচার হতে দেখা যায়। উক্ত ফটোকার্ড পোস্টগুলোর মন্তব্য বিভাগ পর্যবেক্ষণ করলে তাতে এ বিষয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের লিঙ্কের সংযুক্তি পাওয়া যায়।
“পুলিশের গুলিতে ‘আর্মি’ হতে চাওয়া জাবিরের মৃত্যু” শীর্ষক শিরোনামে গত ১৬ জুলাইয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “গত বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিজের পরিবারের চোখের সামনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় ছোট্ট জাবির।…বাবা কবির হোসেন জানান, ‘(গত বছরের ৫ আগস্ট) সন্ধ্যার দিকে আমরা একটি সেতুর উপর ছিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দ শুনে সবাই দৌড়াতে থাকে। আমি জাবিরের ডান হাত ধরে ছিলাম। তখন একটি গুলি এসে তার পায়ে লাগে। কিছুদূর যাওয়ার পর সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে।’ জাবিরকে প্রথমে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকের অবহেলার অভিযোগ করেন পরিবার। পরে ঢাকা স্পেশালাইজড হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা জাবিরকে মৃত ঘোষণা করেন। শহীদ জাবির ইব্রাহিমের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মনিয়ন্দ ইউনিয়নের তুলাই শিমুল গ্রামে।”
এছাড়াও, জাবির ইব্রাহিমের বিষয়ে নানা সময়ে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলো, ইত্তেফাক, কালবেলা, দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসসহ একাধিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হতে দেখা যায়। উক্ত প্রতিবেদনগুলোতেও বলা হয়, গত বছরের ৫ আগস্ট মা–বাবার সঙ্গে ঢাকার উত্তরার জসীমউদ্দীন সড়কে আনন্দমিছিলে থাকার সময় গুলিতে প্রাণ হারায় শিশু জাবির ইব্রাহিম (৬)।
সুতরাং, গত বছরের ০৫ আগস্টে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া শিশু জাবির ইব্রাহিম সম্প্রতি গোপালগঞ্জে হওয়া সংঘর্ষে মারা গিয়েছে দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত সেনাসদস্যরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে দাবিতে গত ১৮ জুলাই রাত থেকে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসুবকে প্রচার করা হচ্ছে। দাবি করা হচ্ছে, ভিডিওটিতে সেনা সদরদপ্তরের গতকাল রাতের চিত্র দেখা যাচ্ছে। যেখানে সড়কে আগুন দেওয়ার পাশাপাশি মাঝে মাঝে গুলির শব্দও শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রচারিত ভিডিওটির সাথে সেনা সদর দপ্তরে কথিত আওয়ামী লীগ সমর্থিত সেনাসদস্যদের বিদ্রোহ ঘোষণা দাবির কোনো সম্পর্ক নেই। এছাড়া প্রচারিত ভিডিওটি সেনা সদর দপ্তরেরও নয়। প্রকৃতপক্ষে, এটি গত বছর জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশের গুলি ছোঁড়ার ভিডিও।
অনুসন্ধানের শুরুতে কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে গণমাধ্যম কিংবা অন্যকোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে সেনাবাহিনীতে কোনো গ্রুপের বিদ্রোহ ঘোষণা করার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির বিষয়ে অনুসন্ধানে ভিডিওটির কয়েকটি কী-ফ্রেম রিভার্স সার্চের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আপলোডকৃত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
Video Comparison by Rumor Scanner
ভিডিওটির শিরোনামে দাবি করা হয়, এটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার ভিডিও ফুটেজ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি সহায়তায় ছাত্রলীগের হামলার দাবি করে পোস্টটিতে বলা হয়, ‘হামলার এক পর্যায়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায় তখনই পুলিশ এসে অতর্কিত ভাবে গুলিবর্ষণ শুরু করে।’
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, সেদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দিবাগত রাত ১ টা ৫০ মিনিটের দিকে বহিরাগতসহ ছাত্রলীগের প্রায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মী হামলা চালায়। এসময় হামলা থেকে বাচতে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনর ভেতর আশ্রয় নিলে সেখানেও তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
Screenshot: Dhaka Post
প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়, পরবর্তীতে হল থেকে দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী বের হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পালিয়ে যায়। তবে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। পুলিশের ছোড়া গুলিতে চারজন সাংবাদিকসহ ছয়জন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন বলেও প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়।
পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ফেসবুক পেজ JU Insiders পর্যালোচনা করে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই মধ্যরাতে পুলিশের গুলি করার বিষয়ে পেজটিতে করা একাধিক পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। পোস্টগুলো দেখুন এখানে এবং এখানে। এছাড়াও মূলধারার গণমাধ্যম ডেইলি স্টারের ফেসবুক পেজে সেরাতে পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীদের আহত হওয়ার বিষয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনও খুঁজে পাওয়া যায়।
পূর্বেও একই ভিডিওকে গত মে মাসে যাত্রাবাড়ী এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলি ছোঁড়ার ভিডিও দাবিতে প্রচার করা হলে সেসময় এ নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার।
সুতরাং, গত জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলি ছোঁড়ার ভিডিওকে সেনা সদর দপ্তরের কথিত আওয়ামী লীগ সমর্থিত সেনাসদস্যদের বিদ্রোহ ঘোষণা করার দৃশ্য দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
Bangladesh Nationalist Party-BNP Facebook Page Post
গত ১৬ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে দলটির নেতাকর্মীরা গোপালগঞ্জে যান। তারা পৌঁছানোর আগেই সমাবেশস্থলে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এরপরও সমাবেশ করেন দলটির নেতাকর্মীরা। তবে কর্মসূচি শেষে ফেরার সময় স্থানীয় আওয়ামী সমর্থকদের হামলায় তারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তবে পরবর্তীতে বিকেলেই সেনাবাহিনীর এপিসি (আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার) ব্যবহার করে তাদের গোপালগঞ্জ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দিরভর সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত পাঁচজন জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে।
উল্লিখিত ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে সম্প্রতি ‘গোপালগঞ্জের মানুষের ধাওয়া খেয়ে নৌ বাহিনীর পলায়ন।’ ক্যাপশনে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, গোপালগঞ্জে মানুষের ধাওয়ায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যদের পলায়নের কোনো ঘটনা ঘটেনি। প্রকৃতপক্ষে, মুন্সিগঞ্জে মেঘনা নদীতে নির্ধারিত স্থানের বাইরে গিয়ে বালু উত্তোলনের ঘটনায় এলাকাবাসীর সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষের পুরোনো ভিডিওকে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ইউটিউব চ্যানেলে গত ১৯ জুন ‘মুন্সিগঞ্জের মেঘনায় বালু উত্তোলন নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়৷ উক্ত ভিডিওতে সংযুক্ত একটি ভিডিও ক্লিপের দৃশ্যাবলীর সাথে প্রচারিত ভিডিওটির সাদৃশ্য রয়েছে।
Comparison: Rumor Scanner
ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ভিডিওটির ০১:১৩ থেকে ০১:২৪ সেকেন্ড পর্যন্ত সংযুক্ত ভিডিও ক্লিপের অংশটির সাথে প্রচারিত ভিডিওটির হুবহু মিল রয়েছে।
ভিডিওটির বিরবণী থেকে জানা যায়, গত ১৯ জুন মুন্সিগঞ্জে মেঘনা নদীতে সরকার কর্তৃক ইজারাকৃত বালুমহালের নির্ধারিত স্থানের বাইরে গিয়ে বালু উত্তোলনের অভিযোগে স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে ইজারাদারের শ্রমিকদের সংঘর্ষ হয়। এটি সেই ঘটনার দৃশ্য।
সুতরাং, মুন্সিগঞ্জে মেঘনা নদীতে বালু উত্তোলনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকাবাসী-শ্রমিকদের সংঘর্ষের ভিডিওকে গোপালগঞ্জের মানুষের ধাওয়ায় নৌবাহিনীর পলায়ন দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
গত ১৬ জুলাই ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেতাকর্মীরা গোপালগঞ্জে যান। তবে তাদের পৌঁছানোর আগেই সমাবেশস্থলে হামলা ও ভাঙচুর ঘটে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত অন্তত পাঁচজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এই প্রেক্ষাপটে, গোপালগঞ্জে লাশ পড়ে থাকার দৃশ্য দাবিতে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
এরূপ দাবিতে ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে ।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, আলোচিত ভিডিওটি গোপালগঞ্জের নয়। বরং, এটি গত বছরের আগস্টে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান চলাকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি ভিডিও।
এই বিষয়ে অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি বাংলার ইউটিউব চ্যানেলে গত ৯ জুলাই গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশি হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পাওয়া যায়। সেখানে দেখানো ভিডিওর দৃশ্যের সঙ্গে আলোচিত ভিডিওটির স্থান মিলে যায়।
Comparison: Rumor Scanner.
বিবিসির প্রতিবেদনে দেখানো ভিডিওটি একটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ হিসেবে প্রতীয়মান হয়, যেখানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তারিখ ও দুপুর ২টা ৫৩ মিনিটের সময় দেখা যায়।
এছাড়া, গত ১৪ জানুয়ারি প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলি ও হত্যাকাণ্ডের প্রামাণ্যচিত্র’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও একই স্থানের ভিডিও দেখানো হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গুলির তীব্রতা কমে এলে বেঁচে যাওয়া আতঙ্কিত মানুষরা একটি সরু গলিতে আহত ও নিহতদের সহায়তা করতে শুরু করেন।
প্রতিবেদনের প্রতিবেদনের ওই অংশে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরা এক রক্তাক্ত ব্যক্তির মরদেহ দেখা যায়, যা আলোচিত ভিডিওতেও দেখা গেছে।
Comparison: Rumor Scanner.
অর্থাৎ, ভিডিওটি গোপালগঞ্জের নয়; এটি গত বছরের আগস্টে যাত্রাবাড়ী এলাকার দৃশ্য।
সুতরাং, গত বছরের যাত্রাবাড়ীর ভিডিওকে গোপালগঞ্জে লাশ পড়ে থাকার দৃশ্য দাবি করে প্রচার করা হয়েছে, যা মিথ্যা।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে দিনভর হামলা, সংঘর্ষ এবং ভাংচুরের ঘটনায় গত বুধবার (১৬ জুলাই) রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্ক ও লঞ্চঘাট এলাকা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংঘর্ষে এখন অবধি অন্তত ৫ জন নিহত হয়েছেন। দিরভর সংঘর্ষের পর ঐদিন সন্ধ্যায় গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করে প্রশাসন। হামলাকারীদের গ্রেফতারে জেলা জুড়ে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে যৌথবাহিনী।
এরই প্রেক্ষিতে, অভিযানে গোপালগঞ্জ থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং র্যাব কর্তৃক অস্ত্র উদ্ধারের দৃশ্য দাবিতে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, অস্ত্র উদ্ধারের এই ভিডিওটি গোপালগঞ্জের নয় এবং ভিডিওটি সাম্প্রতিক সময়েরও নয়। প্রকৃতপক্ষে, ভিডিওটি গত বছরের আগস্টে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী থানায় লুট হওয়া অস্ত্র সেনাবাহিনীর মাধ্যমে উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তরের ঘটনার।
এই বিষয়ে অনুসন্ধানে মূলধারার জাতীয় দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার লৌহজং প্রতিনিধি শওকত হোসেনের ফেসবুক প্রোফাইলে গত ১৮ আগস্ট প্রকাশিত পোস্টে একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর সাথে আলোচিত ভিডিওর মিল রয়েছে।
Video Comparison By Rumor Scanner
পোস্টের ক্যাপশন অনুযায়ী, ভিডিওটি মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী থানায় লুট হওয়া অস্ত্র সেনাবাহিনী উদ্ধার করে থানায় হস্তান্তরের দৃশ্যের।
উক্ত সূত্র ধরে অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে একই দিন আজকালের খবরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত বছরের ০৫ আগস্ট সরকার পতনের পর, মুন্সীগঞ্জ সদর থানা ও ট্র্যাফিক পুলিশ কার্যালয় থেকে লুট হওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গত ১৮ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জেলা সার্কিট হাউজ কক্ষে উদ্ধার হওয়া এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ লুট হাওয়া বিভিন্ন সরঞ্জাম পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে সেনাবাহিনী। উদ্ধারকৃত এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ বিভিন্ন সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে রাইফেল,পিস্তল,শর্টগান সহ বিভিন্ন ধরনের মোট ১৪০টি আগ্নেয়াস্ত্র,৩ হাজার ৯৩৪ রাউন্ড গোলাবারুদ। এছাড়াও উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৯ হাজার ৫০০ টাকার,নগদ অর্থ ও পুলিশের পোষাক সামগ্রী। একই দিন জেলার টঙ্গীবাড়ী থানা থেকে লুট হওয়া ৭৯টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৩ হাজার ৮৯১টি গোলাবারুদ উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
একই তথ্য একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেও (১,২,৩) উঠে এসেছে।
আমরা বিষয়টি আরও নিশ্চিত হতে ভিডিওটি প্রথম ফেসবুকে পোস্ট করা সাংবাদিক শওকত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি নিশ্চিত করেন ঘটনাটি গত বছরের আগস্ট মাসে মুন্সিগঞ্জের।
সুতরাং, যৌথ বাহিনীর অভিযানে গোপালগঞ্জ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের এই দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, “রণক্ষেত্র সেনা সদরদপ্তর | শোনা যাচ্ছে আওয়ামী পন্থী সেনা জওয়ানরা বিদ্রোহ করেছে, মুহুর্মুহু গুলির শব্দে আকাশ ভারি হয়ে গেছে”।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটি সেনা সদরের নয় এবং সাম্প্রতিক সময়েরও নয় বরং, এটি গত বছরের ০৪ আগস্ট ঢাকার মিরপুরে সেনাবাহিনীর অবস্থানের ভিডিও।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির একাধিক কী-ফ্রেম রিভার্স সার্চ করে মূলধারার গণমাধ্যম ‘যমুনা টিভি’র ইউটিউব চ্যানেলে “রাজধানীর মিরপুরের রাতের চিত্র | Student Protest” শীর্ষক শিরোনামে গত ০৪ আগস্টে প্রচারিত একটি ভিডিও পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওটির সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির তুলনা করলে সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
Comparison : Rumor Scanner
উল্লেখ্য যে, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি যমুনা টিভিতে প্রদর্শিত দৃশ্যের মিররড বা প্রতিবিম্ব সংস্করণ হিসেবে দেখা যায়। এছাড়াও, যমুনার টিভিতে প্রচারিত উক্ত ঘটনার ভিডিওটি গতবছরের ০৪ আগস্টে বিভিন্ন ফেসবুক অ্যকাউন্ট থেকেও প্রচার হতে দেখা যায়।
অনুসন্ধানের শুরুতে কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে গণমাধ্যম কিংবা অন্যকোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে সেনাবাহিনীতে কোনো গ্রুপের বিদ্রোহ ঘোষণা করার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, গত বছরের ০৪ আগস্ট মিরপুরে সেনাবাহিনীর অবস্থানের দৃশ্যকে সম্প্রতি সেনা সদরে কথিত আওয়ামী পন্থী সেনাদের বিদ্রোহের দৃশ্য দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
গত ১৬ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মার্চ টু গোপালগঞ্জ কর্মসূচির অংশ হিসেবে দলটির নেতাকর্মীরা গোপালগঞ্জে যান। তারা পৌঁছানোর আগেই সমাবেশস্থলে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এরপরও সমাবেশ করেন দলটির নেতাকর্মীরা। তবে পরবর্তীতে বিকেলেই সেনাবাহিনীর এপিসি (আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার) ব্যবহার করে তাদের গোপালগঞ্জ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দিরভর সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত পাঁচজন জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস)-এর সহ-মুখপাত্র ফারদিন হাসানের একটি ফেসবুক পোস্ট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ১৮ জুলাই মধ্যরাতে দেওয়া পোস্টে তিনি দাবি করেন, “এনসিপির পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে একটি মিলিশিয়া বাহিনী প্রস্তুতি নেয় গণঅভ্যুত্থানের নায়কদের হত্যা করার। এই জঙ্গি কার্যক্রমের জন্য তিনদিনব্যাপি একটা ট্রেনিং ক্যাম্পও করে তারা। কিন্তু সমাবেশের দিন তাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।” এই পোস্টের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একটি ছবি প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, এটি গোপালগঞ্জে মুজিব বাহিনীর ট্রেনিংয়ের দৃশ্য।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ছবিটি বাংলাদেশের নয় বরং ২০১২ সালে ভারতের মধ্যাঞ্চলের ছত্তিশগড় রাজ্যের মাওবাদী সদস্যদের প্রশিক্ষণকালীন সময়ের ছবি এটি।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে ফ্রান্সভিত্তিক সংবাদ সংস্থা এএফপির জাপানভিত্তিক সংবাদপত্র এএফপিবিবি’র একটি প্রতিবেদনে মূল ছবিটির সন্ধান মেলে। ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে ছবিটি সম্পর্কে বলা হয়, ২০১২ সালের ৮ জুলাই ভারতে ছবিটি তোলা হয়৷ সে সময় মধ্য ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যে মাওবাদী সদস্যদের প্রশিক্ষণের সময়ের দৃশ্য এটি।
Comparison: Rumor Scanner
২০১২ সালের আগস্টে বিবিসির একটি প্রতিবেদনেও একই ছবির সন্ধান পাওয়া যায়।
সুতরাং, গোপালগঞ্জে ‘মুজিব বাহিনী’ ট্রেনিং নিচ্ছে দাবিতে ভারতের মাওবাদীদের ট্রেনিং ক্যাম্পের পুরোনো ছবি প্রচার করা হচ্ছে; যা মিথ্যা।
সম্প্রতি, “সবাইকে অবাক করে দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই প্রথম প্রকাশ্যে সিলেটে টেইক ব্যাক আওয়ামী লীগ, মিছিল শিক্ষার্থীদের” শিরোনামে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সিলেটে শিক্ষার্থীদের মিছিলে ‘টেইক ব্যাক আওয়ামী লীগ’ বলে স্লোগান দেয়া হয়নি বরং, শিক্ষার্থীদের ‘ব্যান ব্যান, আওয়ামিলীগ’ শীর্ষক স্লোগানের ভিডিওকে সাম্প্রতিক সময়ে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে, আলোচিত ভিডিওটি থেকে প্রাপ্ত ইমেজ রিভার্স সার্চের মাধ্যমে সৈয়দ মিসবাউল হক মোহন নামক একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টে চলতি বছরের ০৯ মে আলোচিত ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর সঙ্গে আলোচিত দাবিতে থাকা ভিডিওটির হুবহু সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
Video Comparison by Rumor Scanner
উক্ত ভিডিওর প্রথম সারিতে থাকা এক ব্যক্তির সাথে ভিডিওটি প্রচারকারী সৈয়দ মিসবাউল হক মোহন নামের ঐ ব্যক্তির চেহারায় মিল খুঁজে পাওয়া যায়। একই সাথে জানা যায় তিনি, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ, সিলেট মহানগর শাখার যুগ্ন সাধারন সম্পাদক এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, সিলেট জেলা শাখার সহ-সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
পরবর্তীতে, বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তাদের সেদিনের স্লোগানটি ছিল- “ব্যান ব্যান, আওয়ামিলীগ, নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ আওয়ামিলীগ।”
পাশাপাশি, সৈয়দ মিসবাউল হক মোহন রিউমর স্ক্যানারকে মূল ভিডিওটি সরবরাহ করেছেন। ভিডিওটির মেটাডাটা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভিডিওটি চলতি বছরের ০৯ মে তারিখে ধারণ করা হয়েছে।
অর্থাৎ, প্রচারিত ভিডিওতে ‘টেইক ব্যাক আওয়ামী লীগ’ শীর্ষক কোনো স্লোগান ব্যবহার করা হয়নি তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে দিনভর হামলা, সংঘর্ষ এবং ভাংচুরের ঘটনায় গত বুধবার (১৬ জুলাই) রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্ক ও লঞ্চঘাট এলাকা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংঘর্ষে এখন অবধি অন্তত ৫ জন নিহত হয়েছেন। দিরভর সংঘর্ষের পর ঐদিন সন্ধ্যায় গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করে প্রশাসন। হামলাকারীদের গ্রেফতারে জেলা জুড়ে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে যৌথবাহিনী।
এরই প্রেক্ষিতে “গোপালগঞ্জে ছাত্রলীগ যুবলীগ ও আওয়ামীলীগ নেতাদের সেনাবাহিনী দারা ট্রেনিং চলছে” শিরোনামে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটির সাথে গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনী কর্তৃক আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ(নিষিদ্ধ) নেতাদের শাস্তি দেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। ভিডিওটি সাম্প্রতিক সময়েরও নয়। ভিডিওটি অন্তত গত ১৪ এপ্রিল থেকে ইন্টারনেটে বিদ্যমান রয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে ‘Ashik’ নামের একটি টিকটক অ্যাকাউন্টে চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল প্রকাশিত ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর সঙ্গে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওর সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
Video Comparison by Rumor Scanner
তবে অনুসন্ধানে ভিডিওটির স্থান এবং প্রেক্ষাপট সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
গত ১৪ এপ্রিলে টিকটকে ভিডিওটি আপলোডকারী ঐ ব্যক্তির তথ্যমতে, এটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি ধর্মীয় রীতি পালনের দৃশ্য। ভিডিওটিতে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে সনাতনীদের একটি ধর্মীয় সঙ্গীত বাজতে শোনা যায়।
অর্থাৎ, এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে প্রচারিত ভিডিওটি গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে সংঘর্ষের ঘটনা পরবর্তী সময়ের নয়।
সুতরাং, পুরনো ও ভিন্ন ঘটনায় ধারণকৃত একটি ভিডিওকে গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ(নিষিদ্ধ) নেতাদের শাস্তি দিচ্ছে দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশে প্রচার হয়েছে এমন ১৭৯৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। গত বছর একই সময়ের তুলনায় যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে রিউমর স্ক্যানার ভুল তথ্য শনাক্ত করেছিল ১৩৮০টি। এ বছর প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে ভুল তথ্য প্রচারের হার বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। রাজনৈতিক বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ, আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা আর বৈশ্বিক একাধিক ঘটনার প্রেক্ষিতে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ভুল তথ্য প্রচারের হার বেড়েছে৷ এই সময়ে একক ব্যক্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্যের শিকার হয়েছেন অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়েল সংঘাতকে ঘিরে একক ইস্যু হিসেবে বেশি ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। তাছাড়া, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপতথ্যে জড়িয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নাম। রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে গত ছয় মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
মেটার প্লাটফর্মগুলোয় ভুয়া তথ্যের বন্যা
মেটার অধীনে থাকা দুই প্লাটফর্ম ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামে গেল ছয় মাসে যথাক্রমে ১৬৬১ ও ২৫৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। জানুয়ারি থেকে জুনের প্রতিটি দিন কমপক্ষে গড়ে নয়টির বেশি ভুল তথ্য প্রচারিত হয়েছে ফেসবুকে। এছাড়া, ইউটিউবে ৩১১টি, এক্সে ২৫৭টি এবং টিকটকে ১৩৩টি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ছাড়াও দেশের গণমাধ্যমও ভুল তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। গত ছয় মাসে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে ভুল তথ্য, ছবি এবং ভিডিও সম্বলিত ফ্যাক্টচেক করা হয়েছে ৯০টি৷ এছাড়া, একই সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে অন্তত ২৫টি ঘটনায় বাংলাদেশকে জড়িয়ে অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে রিউমর স্ক্যানারে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ে পুরোপুরি মিথ্যা বা ভুয়া ঘটনা সম্বলিত ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে ১১২৫টি৷ এছাড়া, বিভ্রান্তিকর রেটিং দেওয়া হয়েছে ৩৮৬টি। বিকৃত রেটিং পেয়েছে ২৭৮টি। এছাড়া, সার্কাজম বা কৌতুক হিসেবে হাস্যরসাত্মক ঘটনাকে বাস্তব দাবির প্রেক্ষিতে ফ্যাক্টচেক করা হয়েছে ছয়টি। এসব ভুল তথ্য শনাক্তের ক্ষেত্রে তথ্য যাচাই করা হয়েছে ৭০৯টি, ছবি যাচাই করা হয়েছে ৩৩৬টি এবং ভিডিও যাচাই করা হয়েছে ৭৫০টি।
দ্বিতীয় প্রান্তিকে রাজনীতি-আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ভুল তথ্য বেড়েছে
প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চে ভুল তথ্য শনাক্ত হয় ৮৩৭টি। তবে পরের প্রান্তিকে (এপ্রিল থেকে জুন) তা প্রায় ১৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫৮টিতে। প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে ফেসবুকে ভুল তথ্য শনাক্তের হারও বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। একই অবস্থা মেটার দুই প্লাটফর্ম ইনস্টাগ্রাম এবং থ্রেডসেও। এই দুই প্লাটফর্মে যথাক্রমে ১৮০ ও ১০০ শতাংশ হারে ভুল তথ্য শনাক্তের হার বেড়েছে। এছাড়া, ইউটিউবে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ভুল তথ্য প্রচারের হার বেড়েছে প্রায় ৫১ শতাংশ। ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে এক্সে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে এই প্লাটফর্মে ভুল তথ্য শনাক্তের হার কমেছে ৪১ শতাংশ। তবে দুই প্রান্তিকে প্রায় সমান পরিমাণ ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে টিকটকে।
প্রান্তিক ভিত্তিক এই হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় প্রান্তিকে জাতীয় ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে ভুল তথ্য শনাক্তের হার কমেছে যথাক্রমে প্রায় ১৪ ও ৪৪ শতাংশ। বিপরীত চিত্র দেখা গেছে, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোতে। প্রথম প্রান্তিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ৩৪৬টি অপতথ্য শনাক্ত হলেও পরের তিন মাসে পাঁচ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৬৪টি। একইভাবে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনাবলির কারণে প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে এই বিভাগে ভুল তথ্য শনাক্তের হার বেড়েছে প্রায় ৩১২ শতাংশ! প্রায় ৮৭ শতাংশ হারে বেড়েছে বিনোদন ও সাহিত্য অঙ্গনে ভুল তথ্য প্রচারের পরিমাণও। এই অঙ্গনে গেল ছয় মাসে সর্বাধিক ভুল তথ্যের (৭) শিকার হয়েছেন অভিনেত্রী সাদিয়া আয়মান। উল্টো চিত্র ছিল শিক্ষা এবং খেলাধুলায়। এই দুই ক্যাটাগরিতে যথাক্রমে প্রায় ২৯ এবং ১৪ শতাংশ হারে হ্রাস পেয়েছে ভুল তথ্যের পরিমাণ। ক্রীড়াঙ্গনে দুই প্রান্তিক মিলিয়ে সর্বাধিক ভুল তথ্য (৯) শনাক্ত হয়েছে ক্রিকেটার তামিম ইকবালকে জড়িয়ে।
আ’লীগ ও বিএনপি-জামায়াত: ইতিবাচক-নেতিবাচক প্রচারণার এপিঠ ওপিঠ
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়া অপতথ্যগুলোয় সবচেয়ে বেশি নাম এসেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। যদিও গত মে মাসে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সব সংগঠনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। দলটি, দলটির বিভিন্ন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন এবং নেতাকর্মীদের জড়িয়ে গত ছয় মাসে ২৪১টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার৷ এর মধ্যে শুধু দল হিসেবেই আওয়ামী লীগের নাম জড়িয়েছে ৫৯ অপতথ্যে। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এসব অপতথ্যের প্রায় ৮৬ শতাংশই দলটির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই সময়ের মধ্যে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে সর্বাধিক অপতথ্য (৮৫) প্রচার করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে বিএনপিকে জড়িয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (১৮৩) অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে শনাক্ত হওয়া ৪৭টি অপতথ্যের মধ্যে প্রায় ৯৪ শতাংশই দলটির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই সময়ের মধ্যে দলটির বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জড়িয়ে সর্বাধিক অপতথ্য (২৪) শনাক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় সাড়ে ৮৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জড়িয়ে ২১টি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫২ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
গেল ছয় মাসে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও এই দলটির অঙ্গ সংগঠন এবং নেতাকর্মীদের জড়িয়ে ১৪২টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এর মধ্যে দল হিসেবে জামায়াতকে জড়িয়ে প্রচার হয়েছে এমন অপতথ্য ছিল ৫৫টি। এসবের প্রায় ৯৩ শতাংশই দলটির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই সময়ের মধ্যে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান সবচেয়ে বেশি (২২) অপতথ্যের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নাহিদ ইসলামকে আহবায়ক করে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি)। দলটিকে জড়িয়ে পরের চার মাসে ৮৬টি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে এনসিপিকে জড়িয়ে প্রচার হয়েছে এমন অপতথ্য ছিল ১৭টি; যার সবগুলোতেই দলটিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে জড়িয়ে ১১টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এসবের সবগুলোতেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে এনসিপির নেতাকর্মীদের মধ্যে গত ছয় মাসে সর্বাধিক অপতথ্য (২৭) ছিল দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহকে নিয়ে। এই ২৭টির মধ্যে মাত্র একটি ছাড়া বাকিগুলোতে তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ভুল তথ্যের নিয়মিত শিকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার
গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত বছরের ০৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গেল বছর এই সরকারকে জড়িয়ে প্রচার হওয়া ১৩৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার। একই সময়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ছড়ায় ১১০টি ভুল তথ্য। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এই সরকারকে জড়িয়ে ৬৯টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে। এসবের মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশ ভুয়া তথ্যের উপস্থাপনই ছিল সরকারের জন্য নেতিবাচক। এছাড়া, গেল ছয় মাসে ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ১১২টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৮৮ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গত জুন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারকে জড়িয়ে ২০৪টি ভুল তথ্যের প্রচার করা হয়েছে। একই সময়ে ড. ইউনূসকে জড়িয়ে প্রচার করা হয়েছে ২২২টি ভুল তথ্য।
Collage: Rumor Scanner
এছাড়া এই সরকারের ১২ জন উপদেষ্টা এবং প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে জড়িয়ে গেল ছয় মাসে সর্বমোট ৬৮টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ড. আসিফ নজরুলকে জড়িয়ে ১৪টি এবং জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে জড়িয়ে ১১টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা এবং সশস্ত্র বাহিনীও ভুয়া তথ্যের লক্ষ্যবস্তু
দেশে সশস্ত্র এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জড়িয়ে এ বছরের প্রথম ছয় মাসে ১১৪টি ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার৷ গত বছর একই সময়ের তুলনায় এই হার বেড়েছে প্রায় ৭৮ শতাংশ। এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে সর্বোচ্চ ৭৪টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। গেল বছর একই সময়ে এই বাহিনীকে জড়িয়ে শনাক্ত হয়েছিল ৪২টি ভুল তথ্য। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে সেনাবাহিনীকে নিয়ে ভুল তথ্যের প্রচার বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ। বাহিনীটির বর্তমান প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে নিয়ে গত ছয় মাসে ২৫টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
এছাড়া বাংলাদেশ পুলিশকে নিয়ে ৩০টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে এই ছয় মাসে। গেল বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় যা বেড়েছে প্রায় ১৫০ শতাংশ!
এছাড়া, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলমকে নিয়ে একটি, ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীকে নিয়ে দুইটি, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলামকে নিয়ে একটি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে।
এর বাইরে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে নিয়ে চারটি, বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে নিয়ে একটি, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) নিয়ে দুইটি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) নিয়ে তিনটি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার৷
নির্বাচন সামনে, জানান দিচ্ছে অপতথ্যের প্রবাহ
বাংলাদেশে বেশ জোরেশোরে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বিশেষ করে গত মাসে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাব্য একটি সময়ের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে জানানোর পর সংসদ নির্বাচনের ত্রয়োদশ সংস্করণ নিয়ে আলোচনা যেন এখন সর্বত্র। এই প্রেক্ষাপটে গত মাসেই রিউমর স্ক্যানার একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, প্রথম পাঁচ মাসে দল হিসেবে বিএনপি সবচেয়ে বেশি অপতথ্যের শিকার হয়েছে। একই সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্তা-ব্যক্তিদের নামে ভুয়া এবং সম্পাদিত বক্তব্যের মাধ্যমে সিংহভাগ অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া, গণমাধ্যমের সম্পাদিত ও ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করে অপতথ্যের প্রচারও ছিল লক্ষ্যণীয়। সব মিলিয়ে গেল ছয় মাসে নির্বাচন সংক্রান্ত ৬৬টি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৪২ শতাংশই জুন মাসে শনাক্ত হয়েছে। অর্থাৎ, নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ নিয়ে একটি ধারণা সামনে আসার পর এই ইস্যুতে অপতথ্য বাড়তে শুরু করেছে।
গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাসহ বিভিন্ন স্থানে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাতের সূত্রপাত হয়। এরপর হামলা, পাল্টা জবাব ও হুমকির মধ্যে ১২ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর যুদ্ধবিরতির খবর আসে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন ভুল তথ্য ছড়ায়, নিয়মিত প্রচার হয় পুরোনো ও ভিন্ন ঘটনার ভিডিও। ভুয়া ভিডিও তৈরিতে ব্যবহার হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিও। এই ইস্যুতে ৭৬টি ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশ এবং বিদেশের একক কোনো ঘটনা প্রবাহে এটিই সর্বোচ্চ ভুল তথ্য শনাক্তের পরিমাণ। এসব ভুয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব ভুয়া তথ্যে আক্রমণকারী হিসেবে এবং প্রচারণা পক্ষে ছিল এমন ধরণে প্রায় ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই ইরানের নাম এসেছে। অন্যদিকে ধ্বংসাত্মক দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ভুয়া ফুটেজের প্রায় ৭৩ শতাংশই ছিল ইসরায়েলের। ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস দাবির একাধিক ভিডিও এই সংঘাত চলাকালে প্রচার হলেও ইরানের সুনির্দিষ্ট নাম উল্লেখপূর্বক কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা সংক্রান্ত ফুটেজের দাবি পাওয়া যায়নি।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে তার পদত্যাগের ভাবনার কথা জানান। জানা যায়, এ সময় তিনি সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা বলেন। এরই প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র এ বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। একইসাথে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভুয়া তথ্যের প্রবাহও লক্ষ্য করে রিউমর স্ক্যানার। ২২ থেকে ২৫ মে এই চারদিনে ড. ইউনূস পদত্যাগের গুঞ্জনকে ঘিরে অন্তত ১৬টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে একক কোনো ঘটনা প্রবাহে এটিই সর্বোচ্চ ভুল তথ্য শনাক্তের পরিমাণ।
দেশে চলতি বছর প্রথম ছয় মাসে সময়ে সময়ে এমন নানান ইস্যুতে সরগরম ছিল ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যম। এ সংক্রান্ত ৩৪টি ইস্যুতে ৩৯৩টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
ভিইও থ্রি নিয়ে চিন্তা
প্রযুক্তির দিন দিন যেমন উন্নতি ঘটছে, তেমনি প্রসার ঘটছে এআই দিয়ে ভুয়া তথ্যের প্রচারেরও। সময়ের সাথে নিখুঁতভাবে ভুয়া ভিডিও বানিয়ে ফেলার বিষয়টি রপ্ত করে ফেলছে এআই প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিতে সর্বশেষ আলোচনার জন্ম দিয়েছে গুগলের নতুন পরিষেবা ভিইও থ্রি (VEO 3)। এর মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বাস্তব মনে হয় এমন ভিডিও তৈরি করা সম্ভব। এটি টেক্সট প্রম্পট থেকে বাস্তবসম্মত ভিডিও তৈরি করতে পারে। এই টুল দিয়ে তৈরি ভিডিওতে সাধারণত ‘Veo’ জলছাপ থাকে। গত মে মাসে গুগল এই পরিষেবাটি উন্মুক্ত করে। এর পরপরই এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ভুয়া ভিডিও বানিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। গত মাসে এই প্রযুক্তি দিয়ে বানানো অন্তত আটটি ভুয়া ভিডিও শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
Collage: Rumor Scanner
সব মিলিয়ে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১২৩টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে, যাতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। একই সময়ে ২২টি ডিপফেক ভিডিও শনাক্ত করা হয়েছে।
সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ও ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচারে লাগাম
সাম্প্রদায়িক অপতথ্য প্রচারের বিষয়টি গেল কিছু মাস ধরেই আলোচনায় রয়েছে। এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে এমন ৭৮টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার। তবে পরের তিন মাসে তা প্রায় ৬৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। গেল ছয় মাসে শনাক্ত হওয়া ১০৬টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্যের মধ্যে ৬৩টি ঘটনাতেই (৫৯ শতাংশ) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় পরিচয়ধারী অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এছাড়া, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ সম্পর্কিত ২৫টি ঘটনায় ভারতের ৩১টি সংবাদমাধ্যমে ৩৮টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি (৯) অপতথ্য প্রচারের দরুন এই তালিকায় সবার উপরে আছে আজতক বাংলা।
Collage: Rumor Scanner
ফটোকার্ডের অপব্যবহার চলছেই
বিগত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে অপতথ্যের প্রচারে শক্তিশালী ও বহুল প্রচলিত মাধ্যম হয়ে উঠেছে গণমাধ্যমের ফটোকার্ড। এর সাথে গণমাধ্যমের নাম, লোগো এবং আনুষঙ্গিক উপাদান ব্যবহার করে নিয়মিতই অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে গণমাধ্যমের নাম, লোগো, শিরোনাম এবং নকল ও ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করে ৩০৮টি ঘটনায় দেশি ও বিদেশি ৬১টি সংবাদমাধ্যমকে জড়িয়ে ৩৩৩টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে ভুল তথ্য প্রচারে মূল ধারার গণমাধ্যম যমুনা টিভির নাম সবচেয়ে বেশি (৫১) ব্যবহার করা হয়েছে। এই তালিকার দ্বিতীয় স্থানে জনকণ্ঠ (২৬) এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে কালের কণ্ঠ (২৫)।
কাজের পদ্ধতি
এই পরিসংখ্যানটি রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর উপর ভিত্তি করে প্রকাশ করা হয়েছে। পরিসংখ্যান প্রকাশের নিমিত্তে নিয়মিত গত ছয় মাসের প্রতিটি প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে একটি নির্দিষ্ট ডাটাবেজের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এরপর তথ্য-উপাত্তগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এসব তথ্য-উপাত্ত তুলনা করা হয়েছে চলতি বছরের প্রথম দুই প্রান্তিক এবং গত বছরের প্রথম ছয় মাসের তথ্য উপাত্তের সাথে। পরবর্তীতে সেগুলোকে ইনফোগ্রাফিক এবং লেখার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।
রাজনৈতিক এবং সরকারের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে ছড়ানো ভুল তথ্যগুলো উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুইটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে এই পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে। কোনো ভুল তথ্যের মাধ্যমে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা দলের ইতিবাচক অবস্থান বোঝানোর চেষ্টা থাকে তাহলে সেই ভুল তথ্যকে ইতিবাচক এবং এর বিপরীতে কোনো ভুল তথ্যের মাধ্যমে যদি ব্যক্তি বা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে সেই ভুল তথ্যকে নেতিবাচক হিসেবে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে ভুল তথ্য প্রচারের সময়, পরিস্থিতি এবং পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।