সম্প্রতি, “সবাইকে অবাক করে দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই প্রথম প্রকাশ্যে সিলেটে টেইক ব্যাক আওয়ামী লীগ, মিছিল শিক্ষার্থীদের” শিরোনামে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সিলেটে শিক্ষার্থীদের মিছিলে ‘টেইক ব্যাক আওয়ামী লীগ’ বলে স্লোগান দেয়া হয়নি বরং, শিক্ষার্থীদের ‘ব্যান ব্যান, আওয়ামিলীগ’ শীর্ষক স্লোগানের ভিডিওকে সাম্প্রতিক সময়ে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে, আলোচিত ভিডিওটি থেকে প্রাপ্ত ইমেজ রিভার্স সার্চের মাধ্যমে সৈয়দ মিসবাউল হক মোহন নামক একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টে চলতি বছরের ০৯ মে আলোচিত ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর সঙ্গে আলোচিত দাবিতে থাকা ভিডিওটির হুবহু সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
Video Comparison by Rumor Scanner
উক্ত ভিডিওর প্রথম সারিতে থাকা এক ব্যক্তির সাথে ভিডিওটি প্রচারকারী সৈয়দ মিসবাউল হক মোহন নামের ঐ ব্যক্তির চেহারায় মিল খুঁজে পাওয়া যায়। একই সাথে জানা যায় তিনি, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ, সিলেট মহানগর শাখার যুগ্ন সাধারন সম্পাদক এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, সিলেট জেলা শাখার সহ-সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
পরবর্তীতে, বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তাদের সেদিনের স্লোগানটি ছিল- “ব্যান ব্যান, আওয়ামিলীগ, নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ আওয়ামিলীগ।”
পাশাপাশি, সৈয়দ মিসবাউল হক মোহন রিউমর স্ক্যানারকে মূল ভিডিওটি সরবরাহ করেছেন। ভিডিওটির মেটাডাটা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভিডিওটি চলতি বছরের ০৯ মে তারিখে ধারণ করা হয়েছে।
অর্থাৎ, প্রচারিত ভিডিওতে ‘টেইক ব্যাক আওয়ামী লীগ’ শীর্ষক কোনো স্লোগান ব্যবহার করা হয়নি তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে দিনভর হামলা, সংঘর্ষ এবং ভাংচুরের ঘটনায় গত বুধবার (১৬ জুলাই) রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্ক ও লঞ্চঘাট এলাকা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংঘর্ষে এখন অবধি অন্তত ৫ জন নিহত হয়েছেন। দিরভর সংঘর্ষের পর ঐদিন সন্ধ্যায় গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করে প্রশাসন। হামলাকারীদের গ্রেফতারে জেলা জুড়ে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে যৌথবাহিনী।
এরই প্রেক্ষিতে “গোপালগঞ্জে ছাত্রলীগ যুবলীগ ও আওয়ামীলীগ নেতাদের সেনাবাহিনী দারা ট্রেনিং চলছে” শিরোনামে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটির সাথে গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনী কর্তৃক আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ(নিষিদ্ধ) নেতাদের শাস্তি দেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। ভিডিওটি সাম্প্রতিক সময়েরও নয়। ভিডিওটি অন্তত গত ১৪ এপ্রিল থেকে ইন্টারনেটে বিদ্যমান রয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে ‘Ashik’ নামের একটি টিকটক অ্যাকাউন্টে চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল প্রকাশিত ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর সঙ্গে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওর সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
Video Comparison by Rumor Scanner
তবে অনুসন্ধানে ভিডিওটির স্থান এবং প্রেক্ষাপট সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
গত ১৪ এপ্রিলে টিকটকে ভিডিওটি আপলোডকারী ঐ ব্যক্তির তথ্যমতে, এটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি ধর্মীয় রীতি পালনের দৃশ্য। ভিডিওটিতে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে সনাতনীদের একটি ধর্মীয় সঙ্গীত বাজতে শোনা যায়।
অর্থাৎ, এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে প্রচারিত ভিডিওটি গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে সংঘর্ষের ঘটনা পরবর্তী সময়ের নয়।
সুতরাং, পুরনো ও ভিন্ন ঘটনায় ধারণকৃত একটি ভিডিওকে গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ(নিষিদ্ধ) নেতাদের শাস্তি দিচ্ছে দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশে প্রচার হয়েছে এমন ১৭৯৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। গত বছর একই সময়ের তুলনায় যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে রিউমর স্ক্যানার ভুল তথ্য শনাক্ত করেছিল ১৩৮০টি। এ বছর প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে ভুল তথ্য প্রচারের হার বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। রাজনৈতিক বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ, আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা আর বৈশ্বিক একাধিক ঘটনার প্রেক্ষিতে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ভুল তথ্য প্রচারের হার বেড়েছে৷ এই সময়ে একক ব্যক্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্যের শিকার হয়েছেন অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়েল সংঘাতকে ঘিরে একক ইস্যু হিসেবে বেশি ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। তাছাড়া, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপতথ্যে জড়িয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নাম। রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে গত ছয় মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
মেটার প্লাটফর্মগুলোয় ভুয়া তথ্যের বন্যা
মেটার অধীনে থাকা দুই প্লাটফর্ম ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামে গেল ছয় মাসে যথাক্রমে ১৬৬১ ও ২৫৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। জানুয়ারি থেকে জুনের প্রতিটি দিন কমপক্ষে গড়ে নয়টির বেশি ভুল তথ্য প্রচারিত হয়েছে ফেসবুকে। এছাড়া, ইউটিউবে ৩১১টি, এক্সে ২৫৭টি এবং টিকটকে ১৩৩টি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ছাড়াও দেশের গণমাধ্যমও ভুল তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। গত ছয় মাসে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে ভুল তথ্য, ছবি এবং ভিডিও সম্বলিত ফ্যাক্টচেক করা হয়েছে ৯০টি৷ এছাড়া, একই সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে অন্তত ২৫টি ঘটনায় বাংলাদেশকে জড়িয়ে অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে রিউমর স্ক্যানারে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ে পুরোপুরি মিথ্যা বা ভুয়া ঘটনা সম্বলিত ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে ১১২৫টি৷ এছাড়া, বিভ্রান্তিকর রেটিং দেওয়া হয়েছে ৩৮৬টি। বিকৃত রেটিং পেয়েছে ২৭৮টি। এছাড়া, সার্কাজম বা কৌতুক হিসেবে হাস্যরসাত্মক ঘটনাকে বাস্তব দাবির প্রেক্ষিতে ফ্যাক্টচেক করা হয়েছে ছয়টি। এসব ভুল তথ্য শনাক্তের ক্ষেত্রে তথ্য যাচাই করা হয়েছে ৭০৯টি, ছবি যাচাই করা হয়েছে ৩৩৬টি এবং ভিডিও যাচাই করা হয়েছে ৭৫০টি।
দ্বিতীয় প্রান্তিকে রাজনীতি-আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ভুল তথ্য বেড়েছে
প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চে ভুল তথ্য শনাক্ত হয় ৮৩৭টি। তবে পরের প্রান্তিকে (এপ্রিল থেকে জুন) তা প্রায় ১৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫৮টিতে। প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে ফেসবুকে ভুল তথ্য শনাক্তের হারও বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। একই অবস্থা মেটার দুই প্লাটফর্ম ইনস্টাগ্রাম এবং থ্রেডসেও। এই দুই প্লাটফর্মে যথাক্রমে ১৮০ ও ১০০ শতাংশ হারে ভুল তথ্য শনাক্তের হার বেড়েছে। এছাড়া, ইউটিউবে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ভুল তথ্য প্রচারের হার বেড়েছে প্রায় ৫১ শতাংশ। ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে এক্সে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে এই প্লাটফর্মে ভুল তথ্য শনাক্তের হার কমেছে ৪১ শতাংশ। তবে দুই প্রান্তিকে প্রায় সমান পরিমাণ ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে টিকটকে।
প্রান্তিক ভিত্তিক এই হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় প্রান্তিকে জাতীয় ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে ভুল তথ্য শনাক্তের হার কমেছে যথাক্রমে প্রায় ১৪ ও ৪৪ শতাংশ। বিপরীত চিত্র দেখা গেছে, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোতে। প্রথম প্রান্তিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ৩৪৬টি অপতথ্য শনাক্ত হলেও পরের তিন মাসে পাঁচ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৬৪টি। একইভাবে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনাবলির কারণে প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে এই বিভাগে ভুল তথ্য শনাক্তের হার বেড়েছে প্রায় ৩১২ শতাংশ! প্রায় ৮৭ শতাংশ হারে বেড়েছে বিনোদন ও সাহিত্য অঙ্গনে ভুল তথ্য প্রচারের পরিমাণও। এই অঙ্গনে গেল ছয় মাসে সর্বাধিক ভুল তথ্যের (৭) শিকার হয়েছেন অভিনেত্রী সাদিয়া আয়মান। উল্টো চিত্র ছিল শিক্ষা এবং খেলাধুলায়। এই দুই ক্যাটাগরিতে যথাক্রমে প্রায় ২৯ এবং ১৪ শতাংশ হারে হ্রাস পেয়েছে ভুল তথ্যের পরিমাণ। ক্রীড়াঙ্গনে দুই প্রান্তিক মিলিয়ে সর্বাধিক ভুল তথ্য (৯) শনাক্ত হয়েছে ক্রিকেটার তামিম ইকবালকে জড়িয়ে।
আ’লীগ ও বিএনপি-জামায়াত: ইতিবাচক-নেতিবাচক প্রচারণার এপিঠ ওপিঠ
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়া অপতথ্যগুলোয় সবচেয়ে বেশি নাম এসেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। যদিও গত মে মাসে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সব সংগঠনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। দলটি, দলটির বিভিন্ন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন এবং নেতাকর্মীদের জড়িয়ে গত ছয় মাসে ২৪১টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার৷ এর মধ্যে শুধু দল হিসেবেই আওয়ামী লীগের নাম জড়িয়েছে ৫৯ অপতথ্যে। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এসব অপতথ্যের প্রায় ৮৬ শতাংশই দলটির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই সময়ের মধ্যে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে সর্বাধিক অপতথ্য (৮৫) প্রচার করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে বিএনপিকে জড়িয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (১৮৩) অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে শনাক্ত হওয়া ৪৭টি অপতথ্যের মধ্যে প্রায় ৯৪ শতাংশই দলটির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই সময়ের মধ্যে দলটির বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জড়িয়ে সর্বাধিক অপতথ্য (২৪) শনাক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় সাড়ে ৮৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জড়িয়ে ২১টি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫২ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
গেল ছয় মাসে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও এই দলটির অঙ্গ সংগঠন এবং নেতাকর্মীদের জড়িয়ে ১৪২টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এর মধ্যে দল হিসেবে জামায়াতকে জড়িয়ে প্রচার হয়েছে এমন অপতথ্য ছিল ৫৫টি। এসবের প্রায় ৯৩ শতাংশই দলটির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই সময়ের মধ্যে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান সবচেয়ে বেশি (২২) অপতথ্যের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নাহিদ ইসলামকে আহবায়ক করে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি)। দলটিকে জড়িয়ে পরের চার মাসে ৮৬টি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে এনসিপিকে জড়িয়ে প্রচার হয়েছে এমন অপতথ্য ছিল ১৭টি; যার সবগুলোতেই দলটিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে জড়িয়ে ১১টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এসবের সবগুলোতেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে এনসিপির নেতাকর্মীদের মধ্যে গত ছয় মাসে সর্বাধিক অপতথ্য (২৭) ছিল দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহকে নিয়ে। এই ২৭টির মধ্যে মাত্র একটি ছাড়া বাকিগুলোতে তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ভুল তথ্যের নিয়মিত শিকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার
গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত বছরের ০৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গেল বছর এই সরকারকে জড়িয়ে প্রচার হওয়া ১৩৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার। একই সময়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ছড়ায় ১১০টি ভুল তথ্য। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এই সরকারকে জড়িয়ে ৬৯টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে। এসবের মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশ ভুয়া তথ্যের উপস্থাপনই ছিল সরকারের জন্য নেতিবাচক। এছাড়া, গেল ছয় মাসে ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ১১২টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৮৮ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গত জুন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারকে জড়িয়ে ২০৪টি ভুল তথ্যের প্রচার করা হয়েছে। একই সময়ে ড. ইউনূসকে জড়িয়ে প্রচার করা হয়েছে ২২২টি ভুল তথ্য।
Collage: Rumor Scanner
এছাড়া এই সরকারের ১২ জন উপদেষ্টা এবং প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে জড়িয়ে গেল ছয় মাসে সর্বমোট ৬৮টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ড. আসিফ নজরুলকে জড়িয়ে ১৪টি এবং জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে জড়িয়ে ১১টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা এবং সশস্ত্র বাহিনীও ভুয়া তথ্যের লক্ষ্যবস্তু
দেশে সশস্ত্র এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জড়িয়ে এ বছরের প্রথম ছয় মাসে ১১৪টি ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার৷ গত বছর একই সময়ের তুলনায় এই হার বেড়েছে প্রায় ৭৮ শতাংশ। এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে সর্বোচ্চ ৭৪টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। গেল বছর একই সময়ে এই বাহিনীকে জড়িয়ে শনাক্ত হয়েছিল ৪২টি ভুল তথ্য। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে সেনাবাহিনীকে নিয়ে ভুল তথ্যের প্রচার বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ। বাহিনীটির বর্তমান প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে নিয়ে গত ছয় মাসে ২৫টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
এছাড়া বাংলাদেশ পুলিশকে নিয়ে ৩০টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে এই ছয় মাসে। গেল বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় যা বেড়েছে প্রায় ১৫০ শতাংশ!
এছাড়া, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলমকে নিয়ে একটি, ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীকে নিয়ে দুইটি, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলামকে নিয়ে একটি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে।
এর বাইরে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে নিয়ে চারটি, বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে নিয়ে একটি, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) নিয়ে দুইটি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) নিয়ে তিনটি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার৷
নির্বাচন সামনে, জানান দিচ্ছে অপতথ্যের প্রবাহ
বাংলাদেশে বেশ জোরেশোরে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বিশেষ করে গত মাসে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাব্য একটি সময়ের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে জানানোর পর সংসদ নির্বাচনের ত্রয়োদশ সংস্করণ নিয়ে আলোচনা যেন এখন সর্বত্র। এই প্রেক্ষাপটে গত মাসেই রিউমর স্ক্যানার একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, প্রথম পাঁচ মাসে দল হিসেবে বিএনপি সবচেয়ে বেশি অপতথ্যের শিকার হয়েছে। একই সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্তা-ব্যক্তিদের নামে ভুয়া এবং সম্পাদিত বক্তব্যের মাধ্যমে সিংহভাগ অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া, গণমাধ্যমের সম্পাদিত ও ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করে অপতথ্যের প্রচারও ছিল লক্ষ্যণীয়। সব মিলিয়ে গেল ছয় মাসে নির্বাচন সংক্রান্ত ৬৬টি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৪২ শতাংশই জুন মাসে শনাক্ত হয়েছে। অর্থাৎ, নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ নিয়ে একটি ধারণা সামনে আসার পর এই ইস্যুতে অপতথ্য বাড়তে শুরু করেছে।
গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাসহ বিভিন্ন স্থানে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাতের সূত্রপাত হয়। এরপর হামলা, পাল্টা জবাব ও হুমকির মধ্যে ১২ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর যুদ্ধবিরতির খবর আসে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন ভুল তথ্য ছড়ায়, নিয়মিত প্রচার হয় পুরোনো ও ভিন্ন ঘটনার ভিডিও। ভুয়া ভিডিও তৈরিতে ব্যবহার হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিও। এই ইস্যুতে ৭৬টি ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশ এবং বিদেশের একক কোনো ঘটনা প্রবাহে এটিই সর্বোচ্চ ভুল তথ্য শনাক্তের পরিমাণ। এসব ভুয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব ভুয়া তথ্যে আক্রমণকারী হিসেবে এবং প্রচারণা পক্ষে ছিল এমন ধরণে প্রায় ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই ইরানের নাম এসেছে। অন্যদিকে ধ্বংসাত্মক দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ভুয়া ফুটেজের প্রায় ৭৩ শতাংশই ছিল ইসরায়েলের। ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস দাবির একাধিক ভিডিও এই সংঘাত চলাকালে প্রচার হলেও ইরানের সুনির্দিষ্ট নাম উল্লেখপূর্বক কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা সংক্রান্ত ফুটেজের দাবি পাওয়া যায়নি।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে তার পদত্যাগের ভাবনার কথা জানান। জানা যায়, এ সময় তিনি সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা বলেন। এরই প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র এ বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। একইসাথে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভুয়া তথ্যের প্রবাহও লক্ষ্য করে রিউমর স্ক্যানার। ২২ থেকে ২৫ মে এই চারদিনে ড. ইউনূস পদত্যাগের গুঞ্জনকে ঘিরে অন্তত ১৬টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে একক কোনো ঘটনা প্রবাহে এটিই সর্বোচ্চ ভুল তথ্য শনাক্তের পরিমাণ।
দেশে চলতি বছর প্রথম ছয় মাসে সময়ে সময়ে এমন নানান ইস্যুতে সরগরম ছিল ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যম। এ সংক্রান্ত ৩৪টি ইস্যুতে ৩৯৩টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
ভিইও থ্রি নিয়ে চিন্তা
প্রযুক্তির দিন দিন যেমন উন্নতি ঘটছে, তেমনি প্রসার ঘটছে এআই দিয়ে ভুয়া তথ্যের প্রচারেরও। সময়ের সাথে নিখুঁতভাবে ভুয়া ভিডিও বানিয়ে ফেলার বিষয়টি রপ্ত করে ফেলছে এআই প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিতে সর্বশেষ আলোচনার জন্ম দিয়েছে গুগলের নতুন পরিষেবা ভিইও থ্রি (VEO 3)। এর মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বাস্তব মনে হয় এমন ভিডিও তৈরি করা সম্ভব। এটি টেক্সট প্রম্পট থেকে বাস্তবসম্মত ভিডিও তৈরি করতে পারে। এই টুল দিয়ে তৈরি ভিডিওতে সাধারণত ‘Veo’ জলছাপ থাকে। গত মে মাসে গুগল এই পরিষেবাটি উন্মুক্ত করে। এর পরপরই এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ভুয়া ভিডিও বানিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। গত মাসে এই প্রযুক্তি দিয়ে বানানো অন্তত আটটি ভুয়া ভিডিও শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
Collage: Rumor Scanner
সব মিলিয়ে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১২৩টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে, যাতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। একই সময়ে ২২টি ডিপফেক ভিডিও শনাক্ত করা হয়েছে।
সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ও ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচারে লাগাম
সাম্প্রদায়িক অপতথ্য প্রচারের বিষয়টি গেল কিছু মাস ধরেই আলোচনায় রয়েছে। এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে এমন ৭৮টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার। তবে পরের তিন মাসে তা প্রায় ৬৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। গেল ছয় মাসে শনাক্ত হওয়া ১০৬টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্যের মধ্যে ৬৩টি ঘটনাতেই (৫৯ শতাংশ) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় পরিচয়ধারী অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এছাড়া, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ সম্পর্কিত ২৫টি ঘটনায় ভারতের ৩১টি সংবাদমাধ্যমে ৩৮টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি (৯) অপতথ্য প্রচারের দরুন এই তালিকায় সবার উপরে আছে আজতক বাংলা।
Collage: Rumor Scanner
ফটোকার্ডের অপব্যবহার চলছেই
বিগত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে অপতথ্যের প্রচারে শক্তিশালী ও বহুল প্রচলিত মাধ্যম হয়ে উঠেছে গণমাধ্যমের ফটোকার্ড। এর সাথে গণমাধ্যমের নাম, লোগো এবং আনুষঙ্গিক উপাদান ব্যবহার করে নিয়মিতই অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে গণমাধ্যমের নাম, লোগো, শিরোনাম এবং নকল ও ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করে ৩০৮টি ঘটনায় দেশি ও বিদেশি ৬১টি সংবাদমাধ্যমকে জড়িয়ে ৩৩৩টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে ভুল তথ্য প্রচারে মূল ধারার গণমাধ্যম যমুনা টিভির নাম সবচেয়ে বেশি (৫১) ব্যবহার করা হয়েছে। এই তালিকার দ্বিতীয় স্থানে জনকণ্ঠ (২৬) এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে কালের কণ্ঠ (২৫)।
কাজের পদ্ধতি
এই পরিসংখ্যানটি রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর উপর ভিত্তি করে প্রকাশ করা হয়েছে। পরিসংখ্যান প্রকাশের নিমিত্তে নিয়মিত গত ছয় মাসের প্রতিটি প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে একটি নির্দিষ্ট ডাটাবেজের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এরপর তথ্য-উপাত্তগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এসব তথ্য-উপাত্ত তুলনা করা হয়েছে চলতি বছরের প্রথম দুই প্রান্তিক এবং গত বছরের প্রথম ছয় মাসের তথ্য উপাত্তের সাথে। পরবর্তীতে সেগুলোকে ইনফোগ্রাফিক এবং লেখার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।
রাজনৈতিক এবং সরকারের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে ছড়ানো ভুল তথ্যগুলো উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুইটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে এই পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে। কোনো ভুল তথ্যের মাধ্যমে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা দলের ইতিবাচক অবস্থান বোঝানোর চেষ্টা থাকে তাহলে সেই ভুল তথ্যকে ইতিবাচক এবং এর বিপরীতে কোনো ভুল তথ্যের মাধ্যমে যদি ব্যক্তি বা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে সেই ভুল তথ্যকে নেতিবাচক হিসেবে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে ভুল তথ্য প্রচারের সময়, পরিস্থিতি এবং পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গতকাল ১৬ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মার্চ টু গোপালগঞ্জ কর্মসূচির অংশ হিসেবে দলটির নেতাকর্মীরা গোপালগঞ্জে যান। তারা পৌঁছানোর আগেই সমাবেশস্থলে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এরপরও সমাবেশ করেন দলটির নেতাকর্মীরা। তবে পরবর্তীতে বিকেলেই সেনাবাহিনীর এপিসি (আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার) ব্যবহার করে তাদের গোপালগঞ্জ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দিরভর সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ৪ জন নিহত হন।
এরই প্রেক্ষাপটে, রাতের একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে এটি অবরুদ্ধ এনসিপি নেতাকর্মীদের ওপর দ্বিতীয় দফায় হামলার দৃশ্য।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, আলোচিত ভিডিওটি গতকাল অর্থাৎ, ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে অবরুদ্ধ এনসিপির নেতাকর্মীদের ওপর স্থানীয় আওয়ামী সমর্থকদের দ্বিতীয় দফায় হামলার কোনো দৃশ্যের নয়। প্রকৃতপক্ষে, ২০২১ সালে গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হওয়া সংঘর্ষের ভিডিওকে আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি পর্যালোচনা করে রিউমর স্ক্যানার এতে dhakawave.com লেখা একটি লোগো দেখতে পায়।
পরবর্তীতে প্রাপ্ত লোগোর সূত্র ধরে অনলাইনভিত্তিক গণমাধ্যম ঢাকাওয়েভ-এর ফেসবুক পেজ Dhakawave Digital পর্যবেক্ষণ করে পেজটিতে ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর প্রচারিত মূল ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়।
Video Comparison by Rumor Scanner
ভিডিওটির ক্যাপশনের দাবি অনুযায়ী, এটি ২০২১ সালে গোপালগঞ্জে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের হওয়া দফায় দফায় সংঘর্ষ চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের টিয়ারশেল নিক্ষেপের সময় ধারণ করা হয়। ভিডিওতে। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গেটের বাইরে অবস্থানরত পুলিশকে ধাওয়া দিতেও দেখা যায়। আলোচিত ভিডিওতে মূলত সেই অংশটুকুই দেখানো হয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেবছর ২১ নভেম্বর রাতে মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসের মসজিদের সামনের রাস্তার ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্রিকেট খেলছিলেন। এসময় মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা তাঁদের সেখানে খেলতে নিষেধ করায় উভয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে উভয় প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা সংঘটিত হয়ে দফায় দফায় সংঘর্ষে লিপ্ত হন। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, ৫ পুলিশ সদস্য, সাংবাদিকসহ অন্তত ২০ জন আহত হন বলেও প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়। মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ জাকির হোসেন মেডিকেল কলেজের ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করাকে কেন্দ্র করে এ সংঘর্ষের সূচনা হওয়ার অভিযোগ করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়।
অর্থাৎ, প্রচারিত ভিডিওটি গতকাল ১৬ জুলাইয়ের নয়।
সুতরাং, ২০২১ সালে গোপালগঞ্জের বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সংঘর্ষের ভিডিওকে গতকাল গোপালগঞ্জে অবরুদ্ধ এনসিপি নেতাকর্মীদের ওপর দ্বিতীয় দফায় হামলার ভিডিও দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
গতকাল (১৬ জুলাই) গোপালগঞ্জে এনসিপির জুলাই পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংঘর্ষে অন্তত ৪ জন নিহত হন। উক্ত ঘটনার পর গতকাল রাত ৮ টা থেকে থেকে আজ সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করা হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে, “সন্ধ্যার পর থেকে গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর তাণ্ডব শুরু করেছে, রেহাই পায়নি ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা ও মা বোনেরা । শীর্ষক দাবিতে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত ভিডিওটি সাম্প্রতিক সময়ে গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনী কর্তৃক জনতাকে মারধরের দৃশ্যের নয় বরং, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ এর বনানীর বাড়িতে লুটপাটের চেষ্টাকালে সেনাবাহিনীর প্রতিহত করার ভিডিও দাবিতে ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ইন্টারনেটে বিদ্যমান রয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে ভিডিওর কী-ফ্রেমের রিভার্স ইমেজ সার্চ করে ‘Injamamul Hoq’ নামক ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ২০২৪ সালের ১০ই আগস্ট প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওর মিল রয়েছে।
Comparison: Rumor Scanner
উক্ত ভিডিওর ক্যাপশনে দাবি করা হয়, “২০২৪ সালের ৭ আগস্ট রাত ১১টায় বনানীর ৮ নম্বর রোডে আওয়ামী যুবলীগ নেতা শেখ পরশের বাসভবনে বস্তির কিছু লোক ডাকাতি ও লুটতরাজের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করে। ঘটনার সময় তাৎক্ষণিকভাবে খবর পেয়ে বনানী থানা বিএনপির ২ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইমান হোসেন নূর, পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর সহায়তা চান। সেনাবাহিনীর সদস্যরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে ডাকাতদের প্রতিহত করতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে তারা শেখ পরশের বাড়িটি বনানী সোসাইটির নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে বুঝিয়ে দেন।”
সেসময় একই দাবিতে বিভিন্ন ইউটিউব অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিওটি (১, ২, ৩) পোস্ট হতে দেখা যায়।
প্রাপ্ত তথ্যের সূত্র ধরে গুগল ম্যাপের সহায়তায় বনানী ৮ নাম্বার রোডের স্ট্রিটভিউ পর্যালোচনার মাধ্যমে আলোচিত ভিডিওর বাড়ির সাথে স্ট্রিটভিউয়ের বাড়ির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রচারিত ভিডিওতে থাকা বাড়ির বিপরীত পাশের বাড়ির দেয়ালে আওয়ামী লীগ ও পরশের ছবি সম্বলিত বিভিন্ন পোস্টার দেখতে পাওয়া যায়।
Screenshot: Google Maps
উল্লেখ্য, ভিডিওতে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত ব্যক্তির নাম মোঃ ইমান হোসেন নূর, তিনি বনানী থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক। আলোচিত ভিডিওতে থাকা ব্যক্তির সাথে উক্ত ব্যক্তি চেহারা ও শারীরিক গঠনের মিল রয়েছে।
College: Rumor Scanner
অর্থাৎ, এটি নিশ্চিত যে আলোচিত ভিডিওটি গত আগস্ট মাসে রাজধানীর বনানীতে ধারণ করা।
সুতরাং, ২০২৪ সালে আগস্ট মাসে বনানীর একটি বাড়িতে লুটপাটের চেষ্টাকালে সেনাবাহিনীর প্রতিহত করার দৃশ্যকে সাম্প্রতিক সময়ে গোপালগঞ্জে জনতার ওপর সেনাবাহিনীর হামলার ভিডিও দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
গতকাল (১৬ জুলাই) গোপালগঞ্জে এনসিপির জুলাই পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংঘর্ষে অন্তত ৪ জন নিহত হন। এরই প্রেক্ষিতে, বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ফেসবুকে পোস্ট করে, “গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর গুলিতে ইতোমধ্যে ৮-১০ জন সাধারণ মানুষের নিহত হওয়ার খবরে জনমনে চরম ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। বৃহত্তর ফরিদপুর—ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও শরীয়তপুর—সব জেলা থেকে সাধারণ মানুষ এখন একতাবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। এই মুহূর্তে গোপালগঞ্জে আশ্রয় নেওয়া এনসিপি নেতারা যে পথেই পালানোর চেষ্টা করবে, সেই সব রাস্তাঘাট আগে থেকেই ঘিরে ফেলুন। জনগণের হত্যাকারীদের যেন পালিয়ে যাওয়ার একটিও সুযোগ না থাকে!” শীর্ষক মন্তব্য করেছেন এমন একটি দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত পোস্টটি রুহুল কবির রিজভী করেননি বরং তার নাম ব্যবহার করে পরিচালিত একটি ফেক পেজের এই পোস্টকে রুহুল কবির রিজভীর আসল পোস্ট ভেবে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে আলোচিত দাবিটির সপক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
রুহুল কবির রিজভী’র নামে পরিচালিত উক্ত ফেসবুক পেজটি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়া অবধি তাতে প্রায় ১৯,০০০ ফলোয়ার রয়েছে এবং এটি ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট তৈরি করা হয়েছে।
Screenshot: Facebook
উক্ত ফেসবুক পেজটি পর্যবেক্ষণ করে এটি রিজভীর ফেসবুক পেজ কিনা তা নিয়ে সন্দেহ হয় রিউমর স্ক্যানার টিমের। পরবর্তীতে এ বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, এটি রুহুল কবির রিজভীর নামে পরিচালিত একটি ভুয়া ফেসবুক পেজ। ফেসবুকে রুহুল কবির রিজভীর কোনো অফিশিয়াল পেজ নেই। (১,২)
সুতরাং, গোপালগঞ্জের সংঘর্ষে নিহত ইস্যুতে রুহুল কবির রিজভীর নামে পরিচালিত ফেক ফেসবুক পেজের পোস্টকে রুহুল কবির রিজভীর মন্তব্য দাবিতে ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
গোপালগঞ্জে গতকাল (১৬ জুলাই) জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা ও সমাবেশে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। সমাবেশ শেষে এনসিপির নেতাকর্মীরা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। এরপর সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানে করে গোপালগঞ্জ ছাড়েন এনসিপির নেতারা। দিনভর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংঘর্ষে অন্তত ৪ জন নিহত হন।
এরই প্রেক্ষিতে, গতকাল (১৬ জুলাই) গোপালগঞ্জের ঘটনায় নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সেনাবাহিনীর পায়ে ধরে এনসিপির নেতাকর্মীদের আকুতি করার দৃশ্য দাবিতে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে।
ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, কয়েকজন ব্যক্তি সেনাবাহিনীর সদস্যদের পায়ে ধরে রেখেছেন।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সেনা সদস্যদের পা ধরে কয়েকজন ব্যক্তির আকুতি জানানোর এই ভিডিওটি গোপালগঞ্জের নয় বরং, এটি গত মে মাসে চার দফা দাবি আদায়ে সশস্ত্র বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যদের আন্দোলনের ঘটনার ভিডিও।
অনুসন্ধানে ‘Asif Creation’ নামক একটি ফেসবুক পেজ থেকে গত ১৮ মে প্রচারিত একটি ভিডিও পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর সাথে আলোচিত ভিডিওর মিল রয়েছে।
Video Comparison By Rumor Scanner
উক্ত পোস্টের ক্যাপশনে দাবি করা হয়, প্রচারিত ভিডিওটি সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যদের কর্তৃক চাকরিরত সদস্যদের পায়ে ধরার দৃশ্যের।
উক্ত সূত্র ধরে অনুসন্ধানে মূলধারার গণমাধ্যম বাংলাদেশ প্রতিদিনের ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিও পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওতে সাংবাদিককে বলতে শোনা যায়, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সশস্ত্র বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যরা চার দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন। সেইসব সেনাবাহিনীর গাড়ি আটকে দেয় এবং গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েন।
ভিডিওটিতে দেখা যায়, আন্দোলনকারীরা সেনাসদস্যদের পায়ে ধরেছেন এবং ধারাভাষ্যে একই বর্ণনা সাংবাদিককেও দিতে শোনা যায়। এছাড়া ভিডিওটিতে ‘জাতীয় প্রেস ক্লাব’ নামফলক যুক্ত ভবনও দেখা যায়।
Image By Rumor Scanner
অর্থাৎ, প্রচারিত ভিডিওটি গতকালের গোপালগঞ্জের দৃশ্যের নয়।
এরপর প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে অনলাইন সংবাদমাধ্যম জাগো নিউজে গত ১৮ মে “কর্মকর্তাদের গাড়ির সামনে শুয়ে পড়লেন চাকরিচ্যুত সেনা সদস্যরা” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চার দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন করছেন সশস্ত্র বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যরা। এর অংশ হিসেবে গত ১৮ মে বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবে তাদের বৈঠক হয় সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তবে বৈঠক ফলপ্রসূ না হওয়ায় তারা কর্মকর্তাদের গাড়ি আটকে গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েন।
সুতরাং, গত মে মাসে চার দফা দাবি আদায়ে সশস্ত্র বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যদের আন্দোলনের ঘটনার ভিডিওকে গোপালগঞ্জে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য এনসিপি নেতাদের সেনাবাহিনীর সদস্যদের পায়ে ধরে আকুতি জানানোর দৃশ্য দাবিতে প্রচার করা হয়েছে, যা মিথ্যা।
গতকাল (১৬ জুলাই) গোপালগঞ্জে এনসিপির জুলাই পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংঘর্ষে অন্তত ৪ জন নিহত হন।
এরই প্রেক্ষিতে আজ (১৭ জুলাই) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, “গোপালগঞ্জ ইউনূসের নির্দেশে গণহত্যার প্রতিবাদ খুলনায় বিক্ষোভ মিছিল করে আওয়ামী লীগ৷”
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটি গত ১৬ জুলাইয়ে গোপালগঞ্জে সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে খুলনায় বিক্ষোভ মিছিলের দৃশ্যের নয় বরং, গত ২০ এপ্রিলে খুলনায় হওয়া আওয়ামী লীগের এক ঝটিকা মিছিলের ভিডিও আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির একাধিক কি-ফ্রেম নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে মূলধারার গণমাধ্যম চ্যানেল২৪ এর ইউটিউব চ্যানেলে “খুলনায় আওয়ামী লীগের মিছিল, নেতা-কর্মীদের খুঁজছে পুলিশ ” শীর্ষক শিরোনামে গত ২০ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি ভিডিও পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওটির সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির তুলনা করলে সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
Comparison : Rumor Scanner
এছাড়াও, “খুলনার জিরো পয়েন্টে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ঝটিকা মিছিল” শীর্ষক শিরোনামে মূলধারার গণমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের ইউটিউব চ্যানেলেও গত ২০ এপ্রিলে আলোচিত মিছিলের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ হতে দেখা যায়।
উক্ত তথ্যের সূত্র ধরে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে আরেক মূলধারার গণমাধ্যম ‘কালের কণ্ঠ’ এর ওয়েবসাইটে “খুলনায় ‘কয়েক মিনিট’ মিছিল দিলেন আ.লীগ নেতাকর্মীরা” শীর্ষক শিরোনামে এ বিষয়ে গত ২০ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটিতে সংযুক্ত ছবির সাথেও আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটিতে প্রদর্শিত দৃশ্যের সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
মিছিলটির বিষয়ে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “খুলনায় ঝটিকা মিছিল করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। রবিবার (২০ এপ্রিল) সকালে শহরতলীর জিরোপয়েন্ট এলাকা থেকে এ ঝটিকা মিছিল বের হয়। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই মিছিলটি শেষ হয়। এতো দ্রুত মিছিলটি শেষ হয়েছে যে মিছিলকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।” এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে প্রচারিত ভিডিওটি গত ২০ এপ্রিলের।
সুতরাং, গত ২০ এপ্রিলে খুলনায় হওয়া আওয়ামী লীগের এক ঝটিকা মিছিলের দৃশ্যকে গত ১৬ জুলাইয়ে গোপালগঞ্জে সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে খুলনায় বিক্ষোভ মিছিলের দৃশ্য দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে এবছর জুলাই মাস জুড়ে দেশের প্রতিটি জেলায় পদযাত্রা করছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। উক্ত কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জ যায় দলটির নেতাকর্মীরা। তবে কর্মসূচিটির নাম দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা দেওয়া হলেও গোপালগঞ্জের কর্মসূচিটিকে তারা মার্চ টু গোপালগঞ্জ হিসেবে অভিহিত করেন। এনসিপির এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গতকাল গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। যাতে অন্তত ৪ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি অনেকে আহতও হন। উক্ত সংঘর্ষের সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ সমর্থকরা দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মাঠে নামেন দাবিতে কয়েকটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে।
অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের একই ছবি ফেসবুকে প্রচার করে ভিন্ন দাবি করতেও দেখা যায়। পোস্টটিতে দাবি করা হয়, অস্ত্রধারী এই ব্যক্তিরা এনসিপির সদস্য। যারা গতকাল পুলিশ ও সেনাবাহিনীদের সাথে একত্র হয়ে গোপালগঞ্জ বাসীদের ওপর হামলা চালায়। এমন পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
উক্ত ছবিগুলোর পাশাপাশি দেশীয় অস্ত্র হাতে কয়েকজন ব্যক্তির ছবিও ফেসবুকে প্রচার করা হয়। ছবিগুলো প্রচার করে দাবি করা হয়, এই ছবিগুলোও গতকাল গোপালগঞ্জে ধারণ করা। যাতে গতকাল এনসিপির নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণকারী আওয়ামী সমর্থকদের দেখা যাচ্ছে। এমন পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের ছবিগুলো গতকাল গোপালগঞ্জের সংঘর্ষের সময়ের নয়। প্রকৃতপক্ষে, গতবছর কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন জুলাইয়ের বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা-কর্মীদের হামলার ছবিকে আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তিন ব্যক্তির ছবিগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধানে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে মূলধারার গণমাধ্যম দৈনিক যুগান্তর ও খবরের কাগজ-এর ওয়েবসাইটে ২০২৪ সালের জুলাই ও সেপ্টেমর মাসে চট্টগ্রামে সংঘর্ষে নিহত ৩ এবং অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করা সেই ফিরোজ গ্রেফতার শিরোনামে প্রকাশিত দুটি পৃথক পৃথক প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনগুলোতে ব্যবহৃত ছবিগুলোর সাথে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ব্যক্তিদের ছবির হুবহু মিল লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায়, ছবিগুলো গতবছর অর্থাৎ, ২০২৪ সালে জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সময় ধারণ করা হয়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি করা যুবকরা ছাত্রলীগের কর্মী।
Image Comparison by Rumor Scanner
অপরদিকে আরেক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, হেলমেট পরিহিত অবস্থায় গুলি করতে দেখা ব্যক্তির নাম মো. ফিরোজ। তিনি চট্টগ্রাম নগরীর যুবলীগ কর্মী। চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি করে সায়মন ওরফে মাহিন নামের দোকান কর্মচারী হত্যার ঘটনায় হওয়া মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আলোচিত পোস্টে দেখতে পাওয়া দেশীয় অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের ছবির সাথে উক্ত প্রতিবেদনে ব্যবহৃত দুটি ছবির হুবহু মিল রয়েছে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ছবিগুলো গতবছর জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন ঢাকার সায়েন্সল্যাব এলাকায় ১৬ জুলাই ধারণ করা হয়। ছবিগুলোতে দেখতে পাওয়া অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।
সুতরাং, গতবছরের জুলাই মাসে আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পুরোনো ছবিকে গোপালগঞ্জে অস্ত্রধারী আওয়ামী লীগ ও এনসিপি সমর্থকদের ছবি দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
গতকাল (১৬ জুলাই) গোপালগঞ্জে এনসিপির জুলাই পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংঘর্ষে অন্তত ৪ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে একজনের নাম রমজান কাজী বলে একাধিক গণমাধ্যমের সূত্রে জানা যায়। এই প্রেক্ষাপটে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে এক যুবককে বলতে শোনা যায়, “প্রয়োজনে জীবন দিব, আমার ভাই রক্ত দিয়েছে, আমিও রক্ত দিব।” ভিডিওটি আওয়ামী লীগের একজন সমর্থকের বক্তব্য দাবিতে প্রচার করা হয়।
পরবর্তীতে, ভিডিওতে থাকা ওই যুবকের একটি স্থিরচিত্র সংযুক্ত করে কিছু গণমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, তিনিই গোপালগঞ্জের সংঘর্ষে নিহত কোটালীপাড়ার রমজান কাজী। এই দাবিতে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন: সমকাল, জনকণ্ঠ, মানবকণ্ঠ।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত ভিডিওতে থাকা ব্যক্তি গতকাল গোপালগঞ্জে নিহত রমজান কাজী নন। বরং, এটি গত বছরের ৪ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে সিরাজগঞ্জে ধারণ করা একটি ভিডিও, যেখানে হৃদয় নামের এক আন্দোলনকারীকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়।
এই বিষয়ে অনুসন্ধানে ‘Bondhu Mahol বন্ধু মহল’ নামের একটি ফেসবুক পেজে ২০২৪ সালের ২৭ জুন প্রকাশিত এক পোস্টে হুবহু একই ভিডিও পাওয়া যায়। সেখানে ওই যুবককে “জুলাই যোদ্ধা হৃদয়” হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়।
Comparison: Rumor Scanner.
‘হৃদয়’ নামের সূত্র ধরে ‘Jubayer Hasan Jihad’ নামের একটি ফেসবুক প্রোফাইলে ১৭ জুলাই প্রকাশিত একটি পোস্ট পাওয়া যায়। সেখানে ভিডিওর ওই যুবককে রমজান কাজী দাবি করে সমকালের একটি প্রতিবেদন শেয়ার করা হয়। পোস্টের ক্যাপশনে জনাব জিহাদ জানান, ৪ নম্বর ছবিতে থাকা ব্যক্তি হৃদয়, যার বাড়ি সিরাজগঞ্জ। তিনি আরও উল্লেখ করেন, একজন জীবিত মানুষকে রমজান কাজী দাবি করে গোপালগঞ্জের নিহত ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
রিউমর স্ক্যানার জনাব জিহাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারে, ভিডিওটি গত বছরের এবং ভিডিওর ওই ব্যক্তি ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট জুলাই আন্দোলন চলাকালে সিরাজগঞ্জের জামতলী এলাকায় ছাত্রলীগের হামলায় আহত হন।
পরবর্তীতে হৃদয়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে নিশ্চিত হওয়া যায়, ভিডিওতে থাকা ব্যক্তি তিনিই। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ভিডিওটি গত বছরের ৪ আগস্ট ধারণ করা হয় এবং সম্প্রতি একটি ফেসবুক পেজে প্রচারের মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
সুতরাং, সিরাজগঞ্জে জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া হৃদয় নামের এক ব্যক্তির পুরোনো ভিডিওকে গোপালগঞ্জে নিহত রমজান কাজী দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।