সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভুয়া রাজনৈতিক মন্তব্যে অপতথ্য বাড়ছে 

  • ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে প্রচার হওয়া অপতথ্য বিশ্লেষণ 
  • নির্বাচন কেন্দ্রিক ৩৯টি অপতথ্য শনাক্ত
  • দল হিসেবে বিএনপিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য
  • ব্যক্তি হিসেবে তারেক রহমানকে নিয়ে বেশি অপতথ্য
  • সবচেয়ে বেশি অপতথ্য ফেসবুকে
  • ধরণ হিসেবে ভুয়া ও বিকৃত মন্তব্যের মাধ্যমেই সর্বাধিক অপতথ্য শনাক্ত
  • ভুয়া এবং বিকৃত মন্তব্যের সবচেয়ে বড় শিকারও বিএনপি
  • ২৭টি অপতথ্যের ঘটনায় ১৩টি গণমাধ্যমের নামে ভুয়া ফটোকার্ড প্রচার

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতির মাঠ সরগরম হয়ে উঠেছে। গত বছরের ০৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটে, বিদায় নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর থেকেই আলোচনায় ছিল পরবর্তী নির্বাচনের বিষয়টি। এই নির্বাচন ঠিক কবে হবে তা নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও গত ০৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনও একটি দিনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পরবর্তীতে গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক শেষে এক যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে।

এমন প্রেক্ষাপটে রিউমর স্ক্যানার দেখতে চেয়েছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে নির্বাচন সংক্রান্ত কী ধরণের অপতথ্য ছড়াচ্ছে। রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত গেল পাঁচ মাসের নির্বাচন সংক্রান্ত ফ্যাক্টচেকগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ে দল হিসেবে বিএনপি সবচেয়ে বেশি অপতথ্যের শিকার হয়েছে। একই সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্তা-ব্যক্তিদের নামে ভুয়া এবং সম্পাদিত বক্তব্যের মাধ্যমে সিংহভাগ অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া, গণমাধ্যমের সম্পাদিত ও ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করে অপতথ্যের প্রচারও ছিল লক্ষ্যণীয়। 

তিন ডজনের বেশি অপতথ্য, ফেসবুকেই সিংহভাগ 

চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে নির্বাচন কেন্দ্রিক ৩৯টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার, যা একই সময়ে শনাক্ত হওয়া মোট ভুল তথ্যের (১৪৮৪) প্রায় তিন শতাংশ। শনাক্তকৃত এসব অপতথ্যের মাস ও সপ্তাহভিত্তিক – এই দুই ধরণের উপাত্তই বিশ্লেষণ করেছে রিউমর স্ক্যানার। দেখা যাচ্ছে, এসব অপতথ্যের মাত্র ২৬ শতাংশ প্রথম তিন মাসে ছড়ালেও পরের দুই মাসে বাকি ৭৪ শতাংশ অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮ শতাংশ এপ্রিলে এবং ৩৬ শতাংশ শনাক্ত হয়েছে মে মাসে। 

আবার সপ্তাহভিত্তিক পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, এপ্রিলের প্রথম এবং মে মাসের শেষ সপ্তাহে নির্বাচন কেন্দ্রিক সবচেয়ে বেশি (৭) অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। 

নির্বাচন সংক্রান্ত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ে তথ্যকে বিকৃত করা হয়েছে এমন ঘটনা শনাক্ত হয়েছে ১৯টি, পুরোপুরি মিথ্যা বা ভুয়া ঘটনা সম্বলিত অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে ১৮টি৷ বিভ্রান্তিকর রেটিং দেওয়া হয়েছে একটি। এছাড়া, সার্কাজম বা কৌতুক হিসেবে হাস্যরসাত্মক ঘটনাকে বাস্তব দাবির প্রেক্ষিতে ফ্যাক্টচেক করা হয়েছে একটি। এসব অপতথ্য শনাক্তের ক্ষেত্রে তথ্য যাচাই করা হয়েছে ৩৭টি এবং ভিডিও যাচাই করা হয়েছে দুইটি। 

নির্বাচন সংক্রান্ত অপতথ্য ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে গেল পাঁচ মাসে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে ফেসবুক। শনাক্ত হওয়া ৩৯টি অপতথ্যের ৩৮টিরই হদিশ মিলেছে এই প্লাটফর্মে। এছাড়া, টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে দুইটি করে এবং থ্রেডসে একটি অপতথ্য ছড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ছাড়াও দেশের গণমাধ্যমও নির্বাচন সংক্রান্ত ভুল তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। গত পাঁচ মাসে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে এমন দুইটি ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। 

গণমাধ্যমে নির্বাচন সংক্রান্ত ভুল সংবাদ। Collage: Rumor Scanner 

ভুয়া মন্তব্যের শিকার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা 

রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বদের নামে ভুয়া মন্তব্য প্রচারের প্রবণতা গেল কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে। আবার, কোনো একটি বক্তব্যকে বিকৃত করে প্রচারের মাধ্যমে নেতিবাচক একটি মনোভাব সৃষ্টির চেষ্টাও একইভাবে লক্ষ্যণীয়। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও এই দুই পদ্ধতিতে অপতথ্য প্রচারের বিষয়টি লক্ষ্য করেছে রিউমর স্ক্যানার। নির্বাচন কেন্দ্রিক অপতথ্যের ধরণগুলো খুঁজে বের করতে গিয়ে রিউমর স্ক্যানার দেখতে পেয়েছে, ধরণভেদে ভুয়া মন্তব্যের মাধ্যমে ১৬টি এবং বিকৃত মন্তব্যের মাধ্যমে ১৭টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। পাঁচ মাসে ঠিক কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে এই দুই ধরণ, তা বোঝা যাবে এর শতকরা হার দেখলে। অপতথ্যগুলোর ৭০ শতাংশই ছড়িয়েছে এই দুই ধরণের মাধ্যমে।  

এছাড়া, নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা এবং জনগণকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া সংক্রান্ত ছয়টি করে অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। 

ভুয়া এবং বিকৃত মন্তব্যের সবচেয়ে বড় শিকার (৫০ শতাংশ) হতে হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি)। দলটির নেতাকর্মীদের জড়িয়ে গেল পাঁচ মাসে আটটি ভুয়া মন্তব্য ও সাতটি বিকৃত মন্তব্য প্রচার করা হয়েছে। তবে ঠিক উল্টো চিত্র দেখা গেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে। দলটির কোনো নেতাকর্মীকে নিয়ে এখন অবধি আগামী নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো ভুয়া বা বিকৃত মন্তব্যের হদিশ মেলেনি। 

এছাড়া, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জড়িয়ে পাঁচটি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে জড়িয়ে সাতটি এবং জাতীয় নাগরিক পার্টিকে জড়িয়ে তিনটি ভুয়া ও বিকৃত মন্তব্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। 

অপতথ্য বেশি বিএনপিকে নিয়ে 

নির্বাচন সংক্রান্ত গেল পাঁচ মাসের ফ্যাক্টচেক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে দল হিসেবে বিএনপিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি (১৯) অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। অপতথ্যগুলোর ধরণ বুঝতে এগুলোকে রিউমর স্ক্যানার দুইটি আলাদা ভাগে ভাগ করেছে৷ দলটির পক্ষে যায় এমন অপতথ্যের প্রচারকে ইতিবাচক এবং বিপক্ষে যায় এমন অপতথ্যের প্রচারকে নেতিবাচক হিসেবে ধরে নিয়ে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, এসব অপতথ্যের ৮৪ শতাংশই (১৬) বিএনপির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এসব অপতথ্যের মধ্যে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি (৭) অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৭১ শতাংশই (৫) তার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এছাড়া, দলটির নেতৃবৃন্দের মধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নিয়ে পাঁচটি (সবগুলোই নেতিবাচক), মির্জা আব্বাসকে নিয়ে দুইটি (সবগুলোই নেতিবাচক) এবং আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, সালাহউদ্দিন আহমেদ, রুহুল কবির রিজভী ও জয়নুল আবদিন ফারুককে নিয়ে একটি করে অপতথ্য (সবগুলোই নেতিবাচক) প্রচার করা হয়েছে।

একই সময়ের মধ্যে বিএনপির পর দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি (৭) অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। এসব অপতথ্যের ৮৬ শতাংশই (৬) দলটির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এসব অপতথ্যের মধ্যে দলটির আমীর ডা. শফিকুর রহমানকে জড়িয়ে চারটি (সবগুলোই নেতিবাচক), দলটির নেতা গোলাম পরোয়ারকে জড়িয়ে দুইটি (সবগুলোই নেতিবাচক) এবং দলটির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে একটি (ইতিবাচক) অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। 

গত ফেব্রুয়ারিতে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) পরের তিন মাসে নির্বাচন সংক্রান্ত তিনটি অপতথ্যের (সবগুলোই নেতিবাচক) শিকার হয়েছে। এসব অপতথ্যে জড়ানো হয়েছে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, দলটির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ এবং ডা. তাসনিম জারার নাম। 

পাঁচ মাসে অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগকে জড়িয়ে দুইটি (সবগুলোই ইতিবাচক) এবং গণঅধিকার পরিষদকে জড়িয়ে একটি (নেতিবাচক) অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। 

নির্বাচন সংক্রান্ত অপতথ্যের শিকার হতে হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও। সরকারকে জড়িয়ে পাঁচটি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে যার সবগুলোই সরকারের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এগুলোর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জড়িয়ে চারটি এবং উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে জড়িয়ে একটি অপতথ্য রয়েছে।  

বিশ্বাসযোগ্য হওয়ায় অপতথ্যে গিনিপিগ গণমাধ্যম ফটোকার্ড

যে কোনো সংবাদ বা তথ্য পাওয়ার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম ভাবা হয় গণমাধ্যমকে। প্রযুক্তির এই যুগে গণমাধ্যমগুলো এখন আর টেলিভিশন, পত্রিকার পাতা কিংবা ওয়েবসাইটের চেনা গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাদের দেখা যায় সরব উপস্থিতি। ফটোকার্ডের মাধ্যমে সহজেই মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে জানিয়ে দিচ্ছে দেশ-বিদেশের সর্বশেষ সংবাদ। গণমাধ্যমের এই উদ্যোগের অপব্যবহার করছে অপতথ্য প্রচারকারীরা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গণমাধ্যমের ফটোকার্ডকে কাজে লাগিয়ে ভুয়া এবং অপতথ্যের প্রচার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। আসছে নির্বাচনেও যে এর প্রভাব ভালোভাবেই থাকবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গেল পাঁচ মাসের নির্বাচন সংক্রান্ত ফ্যাক্টচেকগুলো বিশ্লেষণেও এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। পাঁচ মাসে গণমাধ্যমের সম্পাদিত ও ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করে ২৭টি ঘটনায় দেশের মূল ধারার ১৩টি সংবাদমাধ্যমকে জড়িয়ে ২৭টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে অপতথ্য প্রচারে কালের কণ্ঠের নাম সবচেয়ে বেশি (৫) ব্যবহার করা হয়েছে। গণমাধ্যমটির পর যমুনা টিভি (৪) এবং ও কালবেলা ও জনকণ্ঠের (৩টি করে) নাম বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। 

Image: Rumor Scanner

গণমাধ্যমকে জড়িয়ে প্রচারিত এসব অপতথ্যের সিংহভাগই রাজনীতিবিদদের ভুয়া ও সম্পাদিত মন্তব্য সম্বলিত। মাধ্যমটির বিশ্বাসযোগ্যতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে অপতথ্যের প্রচারে রীতিমতো গিনিপিগ বানানো হচ্ছে গণমাধ্যমগুলোকে। সাধারণত ভুয়া ফটোকার্ডকে আসল ভেবে প্রচারের বিষয়টি নিয়মিত লক্ষ্য করা গেলেও এর ঠিক উল্টো ঘটনাও দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। গত ৩০ জানুয়ারি ডিবিসি নিউজের ফেসবুক পেজে বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের মন্তব্য কোট করে ‘নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন, কেউ বাধা হলে প্রতিহত করা হবে’ শিরোনামে একটি ফটোকার্ড প্রকাশের পর ফটোকার্ডটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে এটিকে ভুয়া বলে দাবি করে অভিযোগ করা হয় যে ‘আল বটর গুজব শিবির বাহিনী তাদের অপকর্ম ঢাকতে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের ক্লিন ইমেজ কে বিতর্কিত করতে এই ধরনের ভুয়া ফটোকার্ড বানিয়ে তাদের হীন কার্যক্রম চালাচ্ছে’। অর্থাৎ, আসল ফটোকার্ডকে ভুয়া বলেও প্রচার করা হচ্ছে।

অনেক নেটিজেনই কোনো প্রকার সতর্কবাণী উল্লেখ ছাড়াই সার্কাজম বা ব্যাঙ্গাত্মক হিসেবে ধরে নিয়েও অনেক ফটোকার্ড ফেসবুকে সম্পাদনা করে প্রচার করেন৷ এতে পরবর্তীতে ভুয়া ফটোকার্ডটি ছড়িয়ে গেলে তা আসল দাবিতেও জনমনে বিভ্রান্তি জাগায়, সৃষ্টি করে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া।  

গণমাধ্যমের নকল ফটোকার্ড দেখে বিষয়টি সত্য বলে ভেবে নেন, এমন লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। খোদ সাংবাদিকসহ দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্বরাও প্রায়শই বিভ্রান্ত হয়ে সেসব শেয়ার দেন। অথচ, সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের ফেসবুক পেজ বা ওয়েবসাইটে সংশ্লিষ্ট তথ্য বা ফটোকার্ডটি রয়েছে কিনা তা খুঁজে দেখাটা এমন কোনো কঠিন বিষয় নয়। অনেক ক্ষেত্রে এসব অপতথ্য সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের প্রতি পাঠক এবং দর্শকদের বিশ্বাসে চিড় ধরাতে সক্ষম৷ কিছু ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের এগিয়ে যাওয়াকেও বাধাগ্রস্ত করে দিতে পারে এসব অপতথ্য৷ গণমাধ্যমগুলো ইদানিং তাদের নামে গুজব ছড়ানো হলে পরবর্তীতে তা নিয়ে পোস্ট করে জানাচ্ছে যে এটি তাদের প্রকাশিত কোনো তথ্য বা ফটোকার্ড নয়৷  

সম্মিলিত উদ্যোগে জোর

গণমাধ্যমকে জড়িয়ে অপতথ্যের প্রচারে কীভাবে লাগাম টানা সম্ভব সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মো. মশিহুর রহমানের কাছে। রিউমর স্ক্যানারকে তিনি বলছিলেন, ভুয়া ফটোকার্ড ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে গণমাধ্যমগুলো কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। যেমন, ভেরিফিকেশন লোগো ও ডিজিটাল ওয়াটারমার্ক ব্যবহার, নিজস্ব সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ভুয়া ফটোকার্ডগুলোর ডিবাঙ্ক করা তথ্য নিয়মিত শেয়ার করা ইত্যাদি। এছাড়া, ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন কমিশন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করার পাশাপাশি প্রয়োজনে দ্রুত রেসপন্স করা যায় এমন একটি পদ্ধতি খুঁজে বের করার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম ও মিডিয়া স্টাডিস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাঈদ আল-জামানের কাছে রিউমর স্ক্যানার জানতে চেয়েছিল আগামী নির্বাচনে অপতথ্য মোকাবিলায় গণমাধ্যম কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলছিলেন, “অফলাইন স্পেসে প্রিন্ট মিডিয়া, অর্থাৎ সংবাদপত্রগুলো সাধারণ জনগণকে অপতথ্য সম্পর্কে সচেতন করার জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গা বরাদ্দ রাখতে পারে “ডিজিটাল তথ্য স্বাক্ষরতা” বা “ফ্যাক্ট কর্ণার” হিসেবে, যেখানে নিয়মিত ছোট ছোট শিক্ষণীয় বিষয়াদির সাথে সাথে সাম্প্রতিক একটি-দুটি করে ফ্যাক্টচেক করা অপতথ্য যাবে উদাহরণ হিসেবে। সঙ্গত কারণেই প্রিন্ট মিডিয়া রিয়েল টাইম অপতথ্যের প্রকোপ প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক ভূমিকা রাখতে পারবে না।” 

জনাব সাঈদ বলছিলেন, “টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সার্বক্ষণিক স্ক্রল বা এক কোণায় সারাদিনের ফ্যাক্টচেক হওয়া অপতথ্যগুলো সার্বক্ষণিক উঠতে থাকবে যেন দর্শক যেকোনো সময়েই সেটি দেখতে পায়। রেডিও চ্যানেলগুলোও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে।”

“এর পাশাপাশি গণমাধ্যমগুলোর অনলাইন প্রোফাইলগুলোতেও (যেমন, ফেসবুক পেজে পোস্ট ও রিলস, টিকটক ও ইউটিউবে ভার্টিকেল ভিডিও কন্টেন্ট) নানাভাবে প্রচার করা সম্ভব। মূল কথা হলো গণমাধ্যমগুলোর মতো ব্যাপক বিস্তার ও দর্শকসমৃদ্ধ প্রচারণাযন্ত্রগুলো যদি একযোগে অপতথ্যের বিপক্ষে কাজ করে তাহলে কেবল নির্বাচনের সময়েই নয়, বরং সকল সময়েই অপতথ্যের প্রকোপ অনেকাংশে লাঘব করা সম্ভব।”

গেল পাঁচ মাসে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নামে অসংখ্য ভুয়া মন্তব্য ছড়িয়ে দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। প্রযুক্তির নানা ধরণসহ সামনের দিনগুলোতে এমন অনেক উপায়েই অপতথ্যের প্রচার ও প্রসারের আশঙ্কা করছে রিউমর স্ক্যানার। এ বিষয়ে একমত জাবি শিক্ষক সাঈদ আল-জামানও। ২০২৪ সালের বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে ডিপফেক ভিডিওর ব্যবহারের উদাহরণ টেনে তিনি বলছেন, “সুদূর উত্তর আমেরিকা থেকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল পেরিয়ে দূরপ্রাচ্য পর্যন্ত  ডিপফেকের কবল থেকে রক্ষা হয়নি কোনো নির্বাচনেরই। তবে সম্প্রতি গুগলের অত্যাধুনিক ভিও-৩ ভাষা থেকে ভিডিও তৈরির মডেলের কল্যাণে সামনে যে বিপদ আসছে তার নাম হাইপাররিয়েলিস্টিক ডিপফেক। এই মডেল রিলিজের পর গত চার সপ্তাহে সামাজিক মাধ্যমে এর চর্চা ও বিস্তার পর্যবেক্ষণ করে ধারণা করা যায় সামনের নির্বাচনে এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।” 

জনাব সাঈদ অবশ্য এটাও মানছেন যে আপাতত এটি মোকাবিলায় সতর্কতা ও সচেতনতা ব্যতীত আর তেমন কোনো কার্যকরী উপায় নেই। তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, “রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উচিত যে কোনো ধরণের উস্কানীমূলক তথ্য পুরোপুরি যাচাই ব্যতীত কোনো সিদ্ধান্তে না পৌঁছানো এবং অনাহুত গোলমাল তৈরি না করা। কেননা, মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা ও অসহনশীলতাই নির্বাচনকালীন সময়ে অপতথ্য প্রচারকারীদের সবচেয়ে বড় পুঁজি হবে।”

রাবি শিক্ষক জনাব মশিহুর রহমানের মতে, নির্বাচনকে সামনে রেখে কয়েকটি বিষয়ে দলগুলোর প্রস্তুতির ঘাটতি লক্ষ্যণীয়। প্রথমত, দলগুলোর সম্ভবত নিজস্ব ফ্যাক্টচেকিং ইউনিট বা মনিটরিং টিম নেই। দ্বিতীয়ত, ভুয়া মন্তব্য বা এডিটেড ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে তথ্যভিত্তিক প্রতিক্রিয়ার বদলে দেরিতে পাল্টা বিবৃতি দেয়, অনেকসময় সেগুলো বিশ্বাসযোগ্য হয় না। বিরোধী পক্ষ আবার সেখান থেকে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করে। তৃতীয়ত, দলগুলোর সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবস্থাপনা এখনও দুর্বল ও রক্ষণাত্মক। তার আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে আসন্ন নির্বাচনে অপতথ্যের বিস্তার বাড়বে এবং নিজেরা (রাজনৈতিক দলগুলো) তার শিকারও হতে পারে।

আগামী নির্বাচনে অবশ্যই অপতথ্যকে একটি গুরুতর গণতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা উচিত বলে অভিমত দিয়েছেন অধ্যাপক মশিহুর। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, এটি ভোটারের মত গঠনে প্রভাব ফেলে, রাজনৈতিক বিভাজন, সহিংসতা, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। সর্বোপরি, নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।

প্রায় একই মত সাঈদ আল-জামানেরও। “রাজনৈতিক অপতথ্য নাগরিকের সাথে প্রতারণামূলক একটি বিষয়, যা একইসাথে ব্যক্তি নাগরিকের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতাকে খাটো করে ও বিভ্রান্ত করতে পারে। এ ধরণের বিভ্রান্তি কেবল নির্বাচনই নয়, বরং যেকোনো সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশের জন্যই সংকট তৈরি করে।”, বলছিলেন তিনি।

তবে অপতথ্য নির্বাচনের ফলাফলকে কতটা প্রভাবিত করবে এমন প্রশ্নে এই শিক্ষক বলছেন, “বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভীষণ জটিল। এর একটি কারণ, এখানে দোদূল্যমান বা সুইং ভোটারের হার কম। এজন্য অপতথ্য নির্বাচনের ফলাফলকে দৃশ্যমানভাবে প্রভাবিত করবে, এমনটা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।” 

এই দুই শিক্ষক মনে করছেন, ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে ফ্যাক্টচেকারদের কার্যক্রম বিষয়ে গণমাধ্যম ও দর্শক-শ্রোতা-পাঠকের কাছে গুরুত্ব রয়েছে। এটিকে কাজে লাগানোর কথা জানিয়ে মো. মশিহুর রহমান বলছিলেন, “ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্রুত যাচাইকরণ নির্বাচনকালীন জরুরি হয়ে উঠবে। তারা ভুয়া তথ্য ডিবাংক করার পাশাপাশি পোস্টের সোর্স ট্র্যাক করে ক্যাপাসিটির মধ্যে থেকে প্রাসঙ্গিক কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে পারে। ফ্যাক্টচেক রিপোর্ট ফটোকার্ড, ভিডিও স্টোরি অর্থাৎ মাল্টিপ্ল্যাটফর্ম ও ফরমেটে প্রকাশ করতে পারে। তাদের কার্যক্রম প্রকারন্তরে ভোটারদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি ও মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে সহায়ক হবে।”

এ বিষয়ে সাঈদ আল-জামানের পরামর্শ, “যেহেতু ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলো অপতথ্য বিষয়ে পেশাদারি প্রতিষ্ঠান, সেক্ষেত্রে অপতথ্য মোকাবিলায় নির্বাচনের সকল স্টেকহোল্ডারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দেওয়া উচিত তাদেরকেই (ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে)।”

আরও পড়ুন

spot_img