- ৭৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত
- ধরণ অনুযায়ী ভিডিওর মাধ্যমে বেশি প্রচারণা (৮৫ শতাংশ)
- আক্রমণকারী এবং পক্ষে প্রচারণা এমন ধরণে ৭৫ শতাংশই ইরানের বলে দাবি
- অন্যদিকে ধ্বংসাত্মক দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ভুয়া ফুটেজের ৭৩ শতাংশই ইসরায়েলের
- ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস দাবির একাধিক ভিডিও প্রচার হলেও ইরানের সুনির্দিষ্ট নাম উল্লেখপূর্বক স্থাপনায় হামলার দাবি তুলনামূলক অনেক কম
পাহাড়ের মধ্যে শত শত নারী-পুরুষের দল ছোটাছুটি করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন একটি ভিডিও অতি সম্প্রতি অন্তত এক কোটি বার দেখা হয়েছে। ভিডিওর ক্যাপশন এবং ফুটেজ বিশ্লেষণে যা বোঝা গেল, তা হল দাবিটি এমন যে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত চলাকালে ইসরায়েলের নাগরিকরা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য এটি। কিন্তু যাচাই করে দেখা গেল, আলোচিত সংঘাতটির সাথে এই ভিডিওর কোনো সম্পর্কই নেই। ভিডিওটি নেপালের। সেখানের পাহাড়ি অঞ্চলে ইয়ারসাগুম্বা নামক ছত্রাক সংগ্রহের দৃশ্য এটি। ইরান ও ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সংঘাতে এমন অসংখ্য ভুয়া ভিডিও ও ছবির প্রচার ছিল লক্ষ্যণীয়।
গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাসহ বিভিন্ন স্থানে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাতের সূত্রপাত হয়। এরপর হামলা, পাল্টা জবাব ও হুমকির মধ্যে ১২ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর যুদ্ধবিরতির খবর আসে। কিন্তু তার পূর্বেই এই সংঘাতে ইরানে সামরিক বাহিনীর বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা-সদস্য, পরমাণু বিজ্ঞানী, বেসামরিক নাগরিকসহ ছয় শতাধিক মানুষ নিহত হন। ইসরায়েলের হামলায় দেশটির বিভিন্ন পরমাণু স্থাপনা ও সামরিক-বেসামরিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। অন্য দিকে ইরানের হামলায় ইসরায়েলে অন্তত ২৮ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কার্যালয়সহ দেশটির বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক স্থাপনায় হামলার দাবি করেছে তেহরান। অর্থাৎ, ১২ দিনের এই সংঘাতে ইরান ও ইসরায়েল উভয় দেশই যে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু আপনি যদি বাংলাদেশের নেটিজেনদের দ্বারা এই সংঘাত কেন্দ্রিক প্রচার হওয়া ভুয়া তথ্যগুলোতে নজর দেন তাহলে আপনি শুধু ইরানের হামলায় ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়েই জানতে পারবেন। অপরপক্ষ অর্থাৎ, ইরানের ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত ছবি বা ভিডিও আপনার নজরে পড়বে কদাচিৎ।
রিউমর স্ক্যানার ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সাম্প্রতিক এই সংঘাতকে কেন্দ্র করে ৭৫টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করেছে। এসব ভুয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব ভুয়া তথ্যে আক্রমণকারী হিসেবে এবং প্রচারণা পক্ষে ছিল এমন ধরণে প্রায় ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই ইরানের নাম এসেছে। অন্যদিকে ধ্বংসাত্মক দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ভুয়া ফুটেজের প্রায় ৭৩ শতাংশই ছিল ইসরায়েলের। ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস দাবির একাধিক ভিডিও এই সংঘাত চলাকালে প্রচার হলেও ইরানের সুনির্দিষ্ট নাম উল্লেখপূর্বক কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা সংক্রান্ত ফুটেজের দাবি পাওয়া যায়নি।
বিশ্লেষণ যা জানাচ্ছে
ইরান-ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সংঘাতে প্রচার হওয়া ভুয়া তথ্যগুলোর মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশই ছিল ভিডিও। ধরণভেদে পুরোনো ভিডিওর প্রচার যেমন ছিল, তেমনি ছিল ভিন্ন ঘটনা বা প্রেক্ষাপটের ভিডিওর প্রচারও। তবে এবার আলোচনায় ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই কনটেন্টের ব্যবহার। ভুয়া তথ্য সম্বলিত ভিডিওগুলোর প্রায় ৩২ শতাংশই ছিল এআই দিয়ে তৈরি। যেমন, সংঘাত থামাতে ইসরায়েলি সৈন্য এবং সাধারণ নাগরিকের অনুরোধের দৃশ্য দাবিতে দুইটি ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ভিডিও দুইটি অন্তত দেড় কোটি বার দেখা হয়েছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, দুইটি ভিডিওর কোনোটিই বাস্তব কোনো দৃশ্যের নয়। গুগলের ভিইও-থ্রি প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই ভিডিওগুলো তৈরি করা হয়েছে। এই Veo হলো গুগলের একটি পরিষেবা। এর মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বাস্তব মনে হয় এমন ভিডিও তৈরি করা সম্ভব। এটি টেক্সট প্রম্পট থেকে বাস্তবসম্মত ভিডিও তৈরি করতে পারে। এই টুল দিয়ে তৈরি ভিডিওতে সাধারণত ‘Veo’ জলছাপ থাকে।
ইরান ও ইসরায়েল এবং শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্যে জড়িয়ে যাওয়ার এই সংঘাতে প্রচার হওয়া ভুয়া তথ্যের ভিডিওগুলোতে একাধিক দেশের পুরোনো ভিডিও ব্যবহার করা হয়েছে। এসব দেশের তালিকায় রয়েছে চীন, মেক্সিকো, লেবানন, সিরিয়া, তুরস্ক, ইউক্রেন, নেপাল, রাশিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, উজবেকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ড ও পাকিস্তান। যেমন, ২০২৪ সালের নভেম্বরে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে একটি বাসভবনে হামলার ঘটনার ভিডিওকে ইরানের ক্ষেপনাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের ডিফেন্স হেডকোয়ার্টার্স ধ্বংস হওয়ার দৃশ্য দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত ভিডিওগুলো অন্তত দুই লক্ষাধিক বার দেখা হয়েছে।
বাংলাদেশে যে কোনো ইস্যুতেই গণমাধ্যমের নকল ও সম্পাদিত ফটোকার্ডের মাধ্যমে ভুয়া তথ্য প্রচারের প্রবণতা রয়েছে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতেও এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। এমন চারটি ভুয়া ফটোকার্ড শনাক্ত হয়েছে যেখানে জড়ানো হয়েছে শিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, শিবির নেতা সাদিক কায়েম, ইরানের প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ভারতের প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে। চারটি গণমাধ্যমের নকল ফটোকার্ডের মাধ্যমে তাদের নামে ভুয়া মন্তব্য প্রচার করা হয়েছে।
ইরানের পক্ষে ইতিবাচক প্রচারণা
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসে সংঘটিত ১২ দিনের এই সংঘাতে ইরান ও ইসরায়েল উভয় পক্ষই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এ সংক্রান্ত বাংলাদেশে ছড়ানো ভুয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, শনাক্ত হওয়া ৭৫টি ভুয়া তথ্যের মধ্যে ৫৬টিতেই আক্রমণকারী হিসেবে ইরানের নাম এবং দেশটির পক্ষে প্রচারণা সংক্রান্ত কনটেন্ট ছিল। এর মধ্যে ৫১টি ভুয়া তথ্যের কনটেন্টেই ইরান কর্তৃক আক্রমণ করা হয়েছে এমন সরাসরি দাবি প্রচার হয়েছে। বাকিগুলোতে ইরানের পক্ষে বিভিন্ন দেশের প্রচার ও মন্তব্যের বিষয় ছিল। সে তুলনায় ইসরায়েল কর্তৃক আক্রমণ সংক্রান্ত ভুয়া তথ্যের কনটেন্টের হার ছিল খুবই নগণ্য (তিন শতাংশের কাছাকাছি)। এ সংক্রান্ত যে দুইটি ভুয়া তথ্য শনাক্ত হয়েছে সেগুলোর সাথে আবার ভারতকে জড়ানো হয়েছে। যেমন, ইসরায়েলের সৈন্যরা ভারতীয়দের টেনে হিঁচড়ে বের করে দিচ্ছে দাবিতে গাজা যুদ্ধবিরোধী ইসরায়েলিদের ছত্রভঙ্গ করার দৃশ্য এবং ইসরায়েলের পক্ষে সংহতি জানাতে গিয়ে ইসরায়েলিদের দ্বারা ভারতীয়দের অপমানিত হওয়ার দাবিতে জেরুজালেমে ধর্ম প্রচাররত খ্রিস্টান নারীর গায়ে এক ইসরায়েলির পানি ছিটানোর দৃশ্য প্রচার করা হয়েছে। সংঘাতের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্র জড়ানোর ফলে দেশটিকে নিয়ে হামলা সংক্রান্ত ভুয়া তথ্যের প্রচার ছিল। তবে একই তালিকায় নাম এসেছে পাকিস্তানেরও। দেশটির হামলায় ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে এমন একটি ভুয়া দাবি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাকিস্তানের পক্ষে মন্তব্য করেছেন দাবিতে একটি ডিপফেক ভিডিওর প্রচার দেখা গেছে।
অপরদিকে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র এবং বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংসের দৃশ্য হিসেবে ইসরায়েলের নাম বেশি এসেছে অধিকাংশ (প্রায় ৭৩ শতাংশ) ভুয়া তথ্যের কনটেন্টে। এমন কনটেন্টও প্রচার হয়েছে যেখানে দাবি করা হচ্ছে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন। আবার একটি ভিডিওর মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে, ইরানের হামলায় নেতানিয়াহুর মাটির নিচে ২৩০ তলা সমপরিমাণ একটি বাংকারে নিরাপদ আশ্রয় নেওয়ার দৃশ্য। অথচ, এটি ২০২১ সালে নির্বাচনে ভোটে অংশগ্রণের সময় নেতানিয়াহুর দৌড়ানোর ভিডিও।
রিউমর স্ক্যানারের বিশ্লেষণ বলছে, সংঘাত চলাকালে ইসরায়েলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার ভুয়া ভিডিও ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়। এমন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার ঘটনার দাবি গণমাধ্যমে আসলেও এ সংক্রান্ত বেশ কিছু ভাইরাল ভিডিও রিউমর স্ক্যানারের নজরে আসে যা ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে। যেমন, ইসরায়েলের অস্ত্রাগারে ইরানের হামলার দৃশ্য দাবিতে চীনের ভিন্ন ঘটনার পুরোনো দৃশ্য প্রচার করা হয়েছে। ডিফেন্স হেডকোয়ার্টার ধ্বংস দাবিতে লেবাননের ভিডিও এবং প্রতিরক্ষা দপ্তর ভবন ধ্বংস দাবিতে এআই দিয়ে তৈরি ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। একইভাবে ইসরায়েলের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস দাবিতে প্রায় দশ বছরের পুরোনো ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। অন্তত দুইটি বিমানবন্দরের ক্ষয়ক্ষতির দৃশ্য দাবিতে এআই দিয়ে তৈরি কনটেন্ট প্রচার করা হয়েছে।
কিন্তু ইরানের ক্ষেত্রে এমন কিছুর প্রচার তেমন দেখা যায়নি৷ ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। এর প্রেক্ষিতে ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ফুটেজ দাবিতে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। তবে যাচাই করে দেখা যায়, এটি ২০২৪ সালে রাশিয়ায় ইউক্রেনের ড্রোন হামলার দৃশ্য। এই একটি বাদে দেশটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত ভুয়া কনটেন্টের প্রচার দেখা যায়নি। ইরান এবং ইসরায়েল ছাড়াও আরো তিনটি দেশের (যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, ভারত) নাম এসেছে ভুয়া এসব তথ্যের প্রচারে, যেখানে এসব দেশে হামলা এবং বিপক্ষে প্রচারণার বিষয়টি তুলে ধরে কনটেন্টগুলোকে নেতিবাচককে উপস্থাপন করা হয়েছে।
দেশভেদে পক্ষপাতদুষ্ট প্রচারণা?
বাংলাদেশের বাইরে অন্য দেশে এই সংঘাত কেন্দ্রিক ভুয়া তথ্যের প্রচারণা কেমন ছিল তা জানতে রিউমর স্ক্যানার ভারতের দুইজন ফ্যাক্টচেকারের সাথে এ বিষয়ে আলাপ করেছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আজতক বাংলা’র ফ্যাক্টচেক বিভাগের সদস্য ঋদ্ধীশ দত্তের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, দেশটিতেও এমন একপাক্ষিক প্রচার ছিল কিনা। তিনি বলছিলেন, “অন্যান্য ইস্যুতে যে ধরনের একপাক্ষিক প্রচার সাধারণত চোখে পড়ে, অদ্ভুতভাবে এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি একপাক্ষিক ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্তত ধরা পড়েনি। তবে হ্যাঁ, ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতির দাবিতে প্রচার বেশি ছিল, শতাংশের হারে বলতে গেলে ৬০-৪০।” একই মত দিয়েছেন ভারতীয় আরেক গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ফ্যাক্টচেকার অঙ্কিতা দেশকারও। “সামাজিক মাধ্যমে প্রচারের ধরণে একটি স্পষ্ট পরিবর্তন দেখা গেছে, যেখানে ইসরায়েল সম্পর্কিত বিভ্রান্তিকর তথ্যের পরিমাণ ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি।”, বলছিলেন তিনি।
এমনটা হওয়ার কারণ হিসেবে ঋদ্ধীশ ইসরায়েলের প্রতি ভারতের তথাকথিত সক্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের একটা অংশের আনুগত্যের বিষয়কে সামনে এনেছেন। ঋদ্ধীশ বলছেন, “ইসরায়েলের কী সাংঘাতিক ক্ষতি হয়ে গেছে এটা সবার সামনে তুলে ধরার তাগিদ ছিল এই ব্যবহারকারীদের মধ্যে। কারণ ইসরায়েলকে এমনভাবে আঘাত করার ক্ষমতা আগে কেউ দেখাতে পারেনি। তাই যারা ইসরায়েলের সমর্থনে কথা বলে তারা কিছুটা বিস্মিতও ছিল।”
অঙ্কিতা দেশকারের কাছে রিউমর স্ক্যানার জানতে চেয়েছিল, এর পেছনে গণমাধ্যমের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রভাব আছে কিনা। অঙ্কিতা মনে করেন, মূলধারার গণমাধ্যম এর জন্য দায়ী নয়। এর পেছনে অ্যালগরিদমকে দায়ী করে অঙ্কিতা বলছেন, “এটি (অ্যালগরিদম) আবেগপ্রবণ বা বিভাজনমূলক কনটেন্টকে আরও বেশি ছড়িয়ে দেয়। ফলে, একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনায় প্রাধান্য পায়।”
ঋদ্ধীশ দত্ত অবশ্য দায়ী করছেন ভারতের সাথে ইরান ও ইসরায়েল এই দুই দেশেরই স্বার্থ জড়িত থাকার বিষয়কে। তিনি বলছেন, “ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের সুসম্পর্ক যেমন বিশ্বে আলোচিত, সে রকমই ইরানের সঙ্গেও ভারতের কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে চাবাহার বন্দরের কারণে, যা ভারত পরিচালিত করে এবং এর মাধ্যমে আফগানিস্তান, রাশিয়ার সঙ্গে বিরাট আমদানি রপ্তানি করে। খুব সম্ভবত এই কারণেই ভারতের গণমাধ্যমও অন্যান্য সময়ের মতো এই সময় যে কোনও একটা দেশের পক্ষ নিয়ে আগ্রাসী ভঙ্গিতে খবর করতে পারেনি, যার একটা বড় প্রভাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও লক্ষ করা গেছে।”
একপাক্ষিক প্রচারণায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল তথ্যের প্রচারে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের কারণ জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাজীব নন্দী জানান, “এর পেছনে একধরনের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পক্ষপাত, আবেগ, আর রাজনৈতিক আইডেন্টিটির জোরালো ভূমিকা আছে। অনেকেই নিরপেক্ষ তথ্য যাচাই না করে আবেগপ্রবণ হয়ে কনটেন্ট শেয়ার করেন। সেই সাথে ফেসবুকের অ্যালগরিদম একবার কোনো ধরণের কনটেন্ট ছড়িয়ে পড়লে, সেটাকেই মানুষ সত্য বলে ধরে নেয়— যেটাকে আমরা বলি ‘ইকো চেম্বার’।”
এই ইস্যুতে অনেক ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকেও একইভাবে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করতে দেখা গেছে। রাজীব নন্দীর মতে, গণমাধ্যম অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবেই একই ন্যারেটিভ গ্রহণ করে নেয়, বিশেষ করে যখন সেটা ‘জনমত’ মনে হয়। ফলে, একপাক্ষিক প্রচারের এই ধারা অনেক সময় মিডিয়াকেও প্রভাবিত করে।
সাধারণ মানুষ গণমাধ্যমের এমন প্রচার থেকেও প্রভাবিত হতে পারে জানিয়ে তিনি বলছেন, “অনেকেই মনে করেন— “গণমাধ্যম বলছে মানে এটা সত্যি”— এমন ভাবনাও মানুষের মধ্যে আছে।”
যুদ্ধবিরতি ঘোষণার প্রেক্ষিতে সংঘাত আপাতত আর ঘটছে না৷ কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে একটি ইস্যুতে এত ভুয়া তথ্যের প্রচার এবং তা নিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ মানুষের মাঝে সূদরপ্রসারি কোনো প্রভাব রাখতে পারে কিনা তা জানতে চাওয়া হয়েছিল এই নিউ মিডিয়া গবেষকের কাছে। তার পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর অন্তত চারটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রিক ফলাফল রয়েছে বলে জানালেন তিনি। প্রথমটি কগনিটিভ বায়াস ও তথ্য ককুনের বিস্তার। রাজীব নন্দী বলছেন, “একপাক্ষিক বা মনঃপূত তথ্য বারবার গ্রহণের ফলে মানুষের চিন্তা-প্রক্রিয়া ‘confirmation bias’ দ্বারা প্রভাবিত হয়। তারা শুধু সেই তথ্যই গ্রহণ করে যেটা তাদের পূর্বধারণাকে সমর্থন করে এবং বিপরীত মত উপেক্ষা করে। এর ফলে একটি ‘information cocoon’ বা তথ্য-আবদ্ধতা তৈরি হয়, যা যুক্তিবোধ ও বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গিকে দুর্বল করে।”
দ্বিতীয়ত, পক্ষপাতদুষ্ট তথ্য মানুষকে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দেয়। রাজীবের মতো, এমন অবস্থায় মানুষ সহনশীলতা হারায়, বিপরীত মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পায় এবং জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে। এটি সামাজিক অস্থিরতা, ঘৃণা-প্রচারণা এবং সহিংস মতাদর্শের উত্থান ঘটাতে পারে।
তৃতীয়ত, যুদ্ধ বা সংঘাত সংক্রান্ত বাস্তবতা অত্যন্ত জটিল এবং বহুস্তর বিশিষ্ট। কিন্তু একপাক্ষিক তথ্যের আধিপত্যের ফলে মানুষ সেসব ঘটনাকে সরলীকৃত ‘ভালো বনাম মন্দ’ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে কূটনৈতিক বাস্তবতা, ভূরাজনীতি, এবং মানবিক সংকটের জটিলতা গৌণ হয়ে যায় বলে অভিমত এই শিক্ষকের।
রাজীব নন্দী বলছেন, “যখন মানুষ বারবার অপতথ্যে প্রভাবিত হয় বা বুঝতে পারে যে প্রচারিত তথ্য বাস্তবতার সঙ্গে মিলছে না, তখন তারা সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠে। এর ফলে গণমাধ্যমের প্রতি আস্থা কমে যায় এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়েও বিভ্রান্তি তৈরি হয়— যা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।”