রিউমর স্ক্যানারের পাঁচ বছর: গুজব প্রতিরোধে নিরন্তর সংগ্রামের গল্প

চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর গোটা চীন এবং পরবর্তীতে অন্যান্য দেশেও ছড়াতে শুরু করে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস। পরের বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশেও প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়৷ সপ্তাহ ঘুরতেই আসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা। আক্রান্তের কিংবা মৃত্যুর আতঙ্কের পাশাপাশি সে সময়ে গুজবের প্রচারও ছিল লক্ষ্যণীয়, যা জনমনে বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছিল। এমনই এক নাজুক সময়ে যাত্রা শুরু রিউমর স্ক্যানারের। একটি স্বাধীন সাংবাদিকতার উদ্যোগ হিসেবে ১৭ মার্চ যখন রিউমর স্ক্যানারের পথচলা শুরু হয় তখনই এর প্রধান লক্ষ্য ঠিক করা হয়, দেশের চলমান গুজব ও ভুয়া খবর নির্মূল করা এবং সঠিক তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই যাত্রায় শুরুর চ্যালেন্জটাই ছিল করোনা নিয়ে গুজব। করোনা আক্রান্তের ভুয়া খবর, করোনায় মৃত্যুর গুজব এমনকি করোনা মুক্তির নানা ভুয়া টোটকা নিয়ে গুজব ছিল সে সময়ের নিত্যদিনের ঘটনা। রিউমর স্ক্যানার এসব গুজব মোকাবিলায় নিরলসভাবে কাজ করেছে, নেটিজেনদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে সঠিক তথ্য। এই চেষ্টার অংশ হিসেবে আমরা ওয়েবসাইটে ফ্যাক্টচেক প্রকাশেই সীমাবদ্ধ থাকিনি। আমরা চেয়েছি, কম সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ যাতে সংশ্লিষ্ট গুজবের বিষয়ে ওয়াকিবহাল হয়। এর প্রেক্ষিতে আমরা বাংলাদেশের প্রথম ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়েব কন্টেন্টের পাশাপাশি ফেসবুকে ডিজিটাল ব্যানারের মাধ্যমে ফ্যাক্ট চেক স্টোরি প্রকাশ করা শুরু করি। যাত্রা শুরুর দিন থেকে আজ পর্যন্ত ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের অন্যান্য সকল মাধ্যমেই জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোয় নিয়মিত ফ্যাক্টচেক ব্যানার প্রকাশ করে আসছে রিউমর স্ক্যানার৷ 

Screenshot : Facebook 

প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরে ৮৪টি ফ্যাক্টচেক রিপোর্ট প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার। নিয়মিত কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২১ সালের ২৮ জুলাই বাংলাদেশের দ্বিতীয় তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক (আইএফসিএন) এর স্বীকৃতি পায় রিউমর স্ক্যানার। দ্বিতীয় বছরে পূর্বের বছরের তুলনায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেশি ফ্যাক্টচেক রিপোর্ট প্রকাশের রেকর্ড করে এই প্রতিষ্ঠান। 

২০২২ সালের জুনে পদ্মা সেতু চালু হয়। এই সেতুর নির্মাণের সময় থেকে শুরু করে পরবর্তীতে নানা সময়ে অসংখ্য গুজব প্রচার হয়েছে। রিউমর স্ক্যানার নিয়মিত সেসব গুজব শনাক্ত করেছে। সে বছর নিয়মিত ফ্যাক্টচেকের বাইরে প্রচলিত নানা মিথ নিয়ে কাজ শুরু করে রিউমর স্ক্যানার। খাদ্যে টেস্টিং সল্ট ব্যবহার ক্ষতিকারক কিনা, পরীক্ষার আগে ডিম খেলে পরীক্ষা খারাপ হয় কিনা, নবজাতককে মধু খাওয়ানো ঠিক কিনা এমন ২০ টির অধিক প্রচলিত মিথ নিয়ে সে বছর কাজ করেছে রিউমর স্ক্যানার।

বাংলাদেশের পাঠ্যবইগুলোতে ভুলের প্রবণতার বিষয়টি বেশ কয়েক বছর ধরেই সমালোচিত হয়ে আসছে। ২০২২ সালে ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত ‘রিউমর স্ক্যানার’ পাঠ্যবইয়ে থাকা ভুলের বিষয়ে ফ্যাক্টচেক করা শুরু করে। এ পর্যন্ত এ সংক্রান্ত ১৪টি ফ্যাক্টচেক প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৩ সালের নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নানা গুজব নিয়ে নিয়মিত কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সে বছরের ডিসেম্বরে পজিটিভ ইনফ্লুয়েন্সার অ্যাওয়ার্ড লাভ করে রিউমর স্ক্যানার। 

যে কোনো সংঘাত, সংকট কিংবা বৈশ্বিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুজবের প্রবাহ সৃষ্টি একটি সাধারণ ধরণ হয়ে উঠেছে। করোনাকালীন সময়ে এমন প্রবাহ দেখা গিয়েছিল। এরপর রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার সংঘাত, ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের মধ্যকার সংকটসহ এমন নানা ঘটনায় গুজবের রীতিমতো বন্যা দেখেছে বিশ্ব। রিউমর স্ক্যানার এসব গুজবের প্রবাহে তীক্ষ্ণভাবে নজর রেখেছে, নিয়মিত কাজ করেছে সেসব নিয়ে। 

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ডেডিকেটেডলি কোনো জাতীয় সংসদ নির্বাচন কাভার করে দেশের একাধিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে লম্বা একটা সময় ব্যস্ততা ছিল। রিউমর স্ক্যানার চার শতাধিক ফ্যাক্টচেক করেছে শুধু নির্বাচন বিষয়ক ইস্যুতেই। 

বিগত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে টিম হিসেবে আমরা বেশ কিছু জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছি। এর জন্য ডেডিকেটেড বিভাগও এসেছে। ইনভেস্টিগেশন ইউনিট তারই একটি৷ এই বিভাগের অধীনে এখন পর্যন্ত নয়টি রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে আলোচনার ঝড় তোলে এক্সে ভারতীয়দের অপতথ্য নিয়ে আগস্টের একটি প্রতিবেদন। 

গেল বছরের আগস্টে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পূর্বে ও পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্থবিরতার সুযোগে রাজনৈতিক হামলার ঘটনা বেড়ে যায়। সে সময় সংখ্যালঘুরাও আক্রান্ত হন। তবে রিউমর স্ক্যানার সে সময় অনুসন্ধান করে দেখে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাজনৈতিক পরিচয় বা আক্রোশের বশবর্তী হয়েও সে সময় এমন অসংখ্য হামলার ঘটনা ঘটে, যেগুলোকে সাম্প্রদায়িক হামলা বলে প্রচার করা হয়েছে। এসব প্রচারে বড় ভূমিকায় ছিল ভারত থেকে পরিচালিত এক্স অ্যাকাউন্ট এবং ভারতীয় বেশ কিছু গণমাধ্যম। মূলত এভাবেই শুরু হয় ভারতীয়দের অপতথ্যের বন্যা। রিউমর স্ক্যানারের ইনভেস্টিগেশন ইউনিট আগস্টে মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্সে এমন ৫০টি অ্যাকাউন্ট খুঁজে বের করেছিল, যেগুলোতে বাংলাদেশের আগস্টের ঘটনাবলির বিভিন্ন ছবি, ভিডিও এবং তথ্যকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে প্রচার করা হয়। এসব অ্যাকাউন্টের প্রতিটির অন্তত একটি পোস্টে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ও ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ পেয়েছিল রিউমর স্ক্যানার। এই প্রতিবেদন দেশে-বিদেশে আলোচনার জন্ম দেয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে রিউমর স্ক্যানারের এক পরিসংখ্যানে দেখানো হয়, গেল বছর প্রতি আড়াই দিনে ভারতীয়রা বাংলাদেশকে নিয়ে গড়ে একটি করে ভুল তথ্যের প্রচার করেছে। এর মধ্যে ভারতীয় ৭২টি গণমাধ্যম ৩২টি বিষয়ে মোট ১৩৭টি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেগুলোতে বাংলাদেশকে নিয়ে ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই ধরণের বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন পরিসংখ্যান নিয়মিতই প্রকাশ করে আসছে রিউমর স্ক্যানার। সব মিলিয়ে গেল পাঁচ বছরে প্রায় সাত হাজার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। গেল পাঁচ বছরে অসংখ্য বিষয়ে কাজ করেছি আমরা। কাজ করেছি খুব সাধারণ ভুল তথ্য যাচাই থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক, বহুল প্রচারিত মিথসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। কিছু কাজ এমনই কঠিন ছিল যে এর পেছনে দিনের পর দিন সময় দিতে হয়েছে, কখনো সময়টা মাসের পর মাসেও গড়িয়েছে। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করেছি, সময় লাগুক, তবু মানুষকে সত্য জানাতে হবে। দূর করতে হবে বিভ্রান্তি। তাই হাল ছাড়িনি। সেই চেষ্টায় সফল হয়ে একটা পর্যায়ে গিয়ে সমাধান এসেছে।

নিয়মিত কাজের বাইরে গুজবের ফ্যাক্টচেক নিয়ে মিম তৈরি করতে আলাদা একটি উদ্যোগে অল্পদিনেই সাড়া পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার। এখানে উদ্দেশ্যটা জনবান্ধব। মানুষকে মিমের মাধ্যমে গুজব থেকে দূরে রাখতে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে এই প্লাটফর্ম। আমরা গত বছরই সাপ্তাহিক ফ্রি নিউজলেটার চালু করেছি। রিউমর স্ক্যানার শুধু ফ্যাক্টচেকেই ফোকাসড থাকতে চাচ্ছে না। আমাদের এই উদ্যোগগুলো তারই প্রতিফলন। মানুষের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়াটাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, আমরা চাই মানুষ উপকৃত হোক এই উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে৷ সেই প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য সব পথ এবং সব মহলেই বিচরণ করে চলেছি আমরা।

গত ১৭ই মার্চ রিউমর স্ক্যানার পা রেখেছে ৬ষ্ঠ বছরে। বাংলাদেশে গুজব প্রতিরোধে নিরন্তর কাজ করে যাওয়া অন্যতম বৃহত্তম এই উদ্যোগের সঙ্গী কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী আমি, আপনি আমরা সকলেই।

রিউমর স্ক্যানার টিম বিশ্বাস করে, আমাদের এই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা সমাজে কিছুটা হলেও ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। মানুষ সচেতন হচ্ছে, আগ্রহী হচ্ছে তথ্য যাচাইয়ে।   নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে ভুল আর অপতথ্যের বিরুদ্ধে এই লড়াই চলুক নিরন্তর। এগিয়ে যাওয়ার এই গল্প আরো সমৃদ্ধ হোক।


আরও পড়ুন

spot_img