ইন্টারনেটে অবাধ তথ্য প্রাপ্তির যুগে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফ্যাক্টচেকিংয়ের প্রয়োজনীয়তা

প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় এখন আমাদের সকলের হাতে হাতে মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট। আর ইন্টারনেটের বদৌলতে পৃথিবীটাই এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৩ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছেন। তাছাড়া বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এর দেওয়া সর্বশেষ তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটি ২৮ লক্ষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, টিকটক ও ইন্সটাগ্রামের বদৌলতে মুহূর্তেই আমাদের চোখের সামনে ভাসছে দেশ বিদেশের নানা খবর। সামাজিক মাধ্যমে একটি তথ্য শেয়ার করলে সেটি মুহূর্তেই পৌঁছে যাচ্ছে কোটি মানুষের নিকট।

ইন্টারনেটে তথ্য প্রাপ্তির এই সহজলভ্যতা যেমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কাজকে সহজ করে দিয়েছে ঠিক তেমনভাবেই এটি আমাদের জন্য ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রতিনিয়ত ইন্টারনেটে প্রচারিত হাজার হাজার তথ্যের মধ্যে কোনটি সত্য কিংবা কোনটি মিথ্যা তা সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের পক্ষে যাচাই করা অনেকক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না। আর তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে না পারার অন্যতম প্রধান একটি কারণ হচ্ছে গণমাধ্যম সাক্ষরতার (মিডিয়া লিটারেসি) অভাব।

আমাদের দেশে পাঠক বা দর্শককে সচেতন করতে সরকারি বা বেসরকারিভাবে গণমাধ্যম সাক্ষরতা বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগই নেই বললেই চলে। পাঠক বা দর্শকদের এই অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রতিনিয়তই প্রচার হচ্ছে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য। এই দৌড়ে পিছিয়ে নেই দেশের মূলধারার গণমাধ্যমগুলোও।

ইন্টারনেটে তথ্য প্রচারের সহজলভ্যতার যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অধিক সংখ্যক পাঠক পাওয়ার আশায় দ্রুত সংবাদ প্রকাশের প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে তথ্য যাচাই ব্যতীত সংবাদ প্রচার করে দেশীয় মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো ক্রমাগতই হারাচ্ছে তাদের পেশাদারিত্ব। 
আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক কর্তৃক স্বীকৃত বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা রিউমর স্ক্যানার চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ও টিকটক এবং মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর ওয়েবসাইটে প্রচারিত সর্বমোট ১১০০ টি ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্যকে শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ২০২২ সালের প্রথম ছয়মাসে ৩২ টি বিষয়ে দেশীয় মূলধারার ৭২ টি গণমাধ্যমের সর্বমোট ২৩২ টি প্রতিবেদনকে ভুল ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।

রিউমর স্ক্যানারে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কিছু গুজব আছে যেগুলো  মানুষ না বুঝে অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রচার করে থাকে। অজ্ঞতা, অদক্ষতা এবং তথ্যের সত্যতা যাচাই প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে এসব গুজব প্রচারিত হয়। অন্যদিকে কিছু গুজব আছে যেগুলো উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচার করা হয়। ইচ্ছেকৃতভাবে প্রচারিত গুজবগুলোর পেছনে থাকে নানা স্বার্থ। এর মধ্যে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বার্থ অন্যতম। এছাড়া উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়ানো অনেক গুজবের পেছনে থাকে ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক এবং মতাদর্শগত স্বার্থ।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১৩ সালে জামায়াত নেতা দেলওয়ার হোসেন সাঈদীকে আলাদত কর্তৃক ফাঁসির আদেশ দেওয়ার পরবর্তী সময়ে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। উক্ত গুজবকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় উত্তাল হয়ে পড়ে গোটা দেশ।

২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে আহত এক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে দাবিতে ফেসবুকে গুজব প্রচারিত হয়। একই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হলে বিদ্যুৎ বন্ধ করে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ভিডিও দাবি করে ফেসবুক ছড়িয়ে পড়ে ভিন্ন ঘটনার পুরোনো ভিডিও। এছাড়া সেময় ঢাবির সুফিয়া কামাল হল ছাত্রলীগ সভাপতি ইফফত জাহান এশা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী মুর্শিদা আক্তারের পায়ের রগ কেটে দিয়েছেন দাবিতে ফেসবুকে গুজব প্রচারিত হয়। একে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ।

Screenshot Source: samakal

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে ঘিরে ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে আওয়ামীলীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হত্যা ও ধর্ষণের গুজব ফেসবুক ছড়িয়ে পড়ে। উক্ত গুজবকে কেন্দ্র করে আন্দোলন রুপ নেয় ব্যাপক সহিংসতায়। এছাড়া নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশি হামলা দাবি করে ফেসবুকে পুরোনো ভিন্ন ঘটনার ছবি প্রচার করা হয়। আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ৪৭ শিক্ষার্থীকে কলেজ থেকে টিসি দিয়ে বের করে দেওয়ার গুজবও প্রচারিত হয়েছিল সেসময়।

Screenshot Source: banglatribune

পদ্মা সেতু নির্মাণকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সবচেয়ে আলোচিত গুজব ছিল সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে। উক্ত গুজবটি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম ছড়ানো হলেও ২০১৯ সালের জুলাই মাসে এই গুজব সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের বদৌলতে ভয়াবহ বিস্তার লাভ করে। সে সময় এই গুজবকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও ঢাকার বাহিরে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে বেশ কয়েকজন মানুষকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়।

Screenshot Source: jagonews24

ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে দেশে বিভিন্ন সময় সহিংসতা, হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রাণও হারিয়েছেন অনেকে। ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামু, ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, ২০১৯ সালে ভোলার বোরহানউদ্দিন কিংবা সর্বশেষ ২০২২ সালে কুমিল্লার শহর এলাকায় সাম্প্রদায়িক উস্কানির মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় হামলা, লুটপাট এবং সহিংসতার নেপথ্যে ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়ানো গুজব। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভুল তথ্য ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসার উস্কানি দেওয়া হয়েছে।

Screenshot Source: BBC

গত জুলাই মাসে মুসলিম প্রধান দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় হিন্দুদের প্রাধান্য দাবিতে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে জানা যায়, শিক্ষা ব্যবস্থায় হিন্দুদের প্রাধান্য দাবিতে শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন পদে হিন্দু কর্মকর্তাদের যে তালিকা প্রচার করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

ইন্টারনেটের যুগে অফলাইনের তুলনায় অনলাইনে রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণা সহজ হওয়ায় রাজনীতি দলগুলো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কাজে ক্রমেই অনলাইন মুখী হচ্ছে। অনলাইনে দলীয় প্রচার প্রচারণা ছাড়াও বিপক্ষ দলের বিভিন্ন কাজের আলোচনা সমালোচনাও পিছিয়ে নেই রাজনৈতিক দলগুলো। অনলাইনে এই প্রচার প্রচারণা ও আলোচনা সমালোচনা করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে মিথ্যা তথ্য প্রচার করছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা।

এছাড়াও অনলাইনে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে গিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর বিষয়ও পরিলক্ষিত হয়। এসব ভুল তথ্য ও প্রোপাগাণ্ডার কারণে অনেকসময় অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হন। এসব তথ্যের ফ্যাক্টচেক প্রকাশের ফলে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলসমূহ উপকৃত হয়ে থাকে।

এক কথায় বলতে গেলে ইন্টারনেট হচ্ছে তথ্যের মহাসাগর। ইন্টারনেট মানুষের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করেছে ঠিকই তবে ইন্টারনেট ব্যবহারের সঠিক জ্ঞানের অভাবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ক্ষতিরও সম্মুখীন হচ্ছে মানুষ। ইন্টারনেটে প্রচারিত ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্র। বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তথ্য জানার অধিকার সমুন্নত রাখার পাশাপাশি ইন্টারনেট নামক তথ্যের সুবিশাল ভাণ্ডারে থাকা কোন তথ্যটি সত্য কিংবা কোন তথ্যটি মিথ্যা তা যাচাইয়ের জন্য ফ্যাক্টচেকিং বা তথ্য যাচাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যুগে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে গুজবের বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলতে দেশের মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে তথ্যযাচাই ও গণমাধ্যম সাক্ষরতা বিষয়ক মৌলিক তথ্য অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি দেশের মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে ফ্যাক্টচেকিং ডেস্ক চালু করা এখন সময়ের দাবি।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img