পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র “১৯৯৪ সালের ১০ এপ্রিল যমুনা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপনের দিন এই আওয়ামী লীগ হরতাল ডেকেছিল, আওয়ামী লীগ সেদিন যমুনা সেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল” শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য বিভিন্ন সময়ে বিএনপি নেতাদের বরাতে গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
যমুনা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর (বর্তমান বঙ্গবন্ধু সেতু) স্থাপনের দিনের আওয়ামী লীগ ঘোষিত হরতাল নিয়ে বিএনপি নেতাদের বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্য দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৯৯৪ সালের ১০ এপ্রিল যমুনা সেতুর (বর্তমান বঙ্গবন্ধু সেতু) ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপনের দিন যমুনা সেতুর সেতু নির্মাণের বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগের হরতাল ডাকেনি বরং দলীয় কর্মসূচিতে ২ জন ছাত্রকে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে সেই সময় আওয়ামী লীগ রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহবান করেছিল। এছাড়া একইদিনে জাতীয় পার্টিও হরতাল ডেকেছিল।
অনুসন্ধানের মাধ্যমে জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাকে ১৯৯৪ সালের ১০ এপ্রিল “আজ সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহবান” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, “বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচী চলাকালে ২ জন ছাত্রকে হত্যার প্রতিবাদ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবীতে আওয়ামী লীগ রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী আজ রবিবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহবান করিয়াছে। পৃথকভাবে জাতীয় পার্টিও আজ সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকিয়াছে।”
অর্থাৎ ১০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের হরতাল আহবান ছিল তাদের সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচী চলাকালে ২ জন ছাত্রকে হত্যার প্রতিবাদ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবীতে।
সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে ১৯৯৪ সালের ৭ এপ্রিল একই পত্রিকায় “আজ আওয়ামী লীগের সচিবালয় ঘেরাও” কর্মসূচি শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
এই প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে কারচুপি, জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ, দুর্নীতি, রাষ্ট্রপরিচালনায় অযোগ্যতা-অদক্ষতার কারণে অবিলম্বে বিএনপি সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে এই এই কর্মসূচি আহবান করে দলটি।
অর্থাৎ সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচির মধ্যে যমুনা সেতু কেন্দ্রিক কোনো বিরোধিতা ছিল না।
একই পত্রিকার ১৯৯৪ সালের ৮ এপ্রিল “সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচী পালনকালে জন নিহত ॥ আহত শতাধিক” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কড়া বেষ্টনীর মধ্যে সশস্ত্র ব্যক্তিদের গুলিতে দুইজন ছাত্র নিহত হয়। এই ঘটনায় আওয়ামী লীগ ১০ ও ২৬শে এপ্রিল হরতাল আহবান করে। একইদিনে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরাও নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে। সেখানে কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও জাতীয় পার্টিও ১০ ও ২৬ শে এপ্রিল দিনব্যাপী হরতাল আহবান করে।
পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালের ২৬ এপ্রিলের প্রকাশিত ইত্তেফাক পত্রিকায় “আজ দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহবান” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
এই প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনের ঘোষিত ফলাফল বাতিল ও গ্রহণযোগ্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহবান করেছে।
উল্লেখিত প্রতিবেদনগুলোর কোথাও আওয়ামী লীগ সরকারের যমুনা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের বিরোধিতার তথ্য পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায়, কেবল আওয়ামী লীগ নয়, একইদিনগুলোতেও জাতীয় পার্টিও হরতাল আহবান করেছিল।
মূলত, তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে কারচুপি, জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ, দুর্নীতি, রাষ্ট্র পরিচালনায় অযোগ্যতা-অদক্ষতার কারণে অবিলম্বে বিএনপি সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে যমুনা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উদ্বোধনের আগেই সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়। একইদিনে জাতীয় পার্টিও নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে। তবে আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে দুইজন ছাত্র নিহত হন। এই ঘটনায় আওয়ামী লীগ ১৯৯৪ সালের ১০ এপ্রিল ও ২৬ এপ্রিল হরতাল পালনের ঘোষণা দেয়। আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টিও একইদিনগুলোতে হরতাল পালন করে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী কাজী সলিমুল হক কামালকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়েত ইসলামী বিএনপির বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে পুনরায় ভোটগ্রহণের দাবি তুলে।
সুতরাং, ১৯৯৪ সালের ১০ এপ্রিল যমুনা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপনের দিন আওয়ামী লীগ যমুনা সেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে হরতাল ডেকেছিল দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Daily Ittefaq (10 April, 1994): আজ সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহবান
- Daily Ittefaq (7 April, 1994): আজ আওয়ামী লীগের সচিবালয় ঘেরাও
- Daily Ittefaq (8 April, 1994): সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচী পালনকালে জন নিহত ॥ আহত শতাধিক
- Daily Ittefaq ( 26 April, 1994): আজ দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহবান