ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ফাঁদে প্রতারিত বেকাররা: টার্গেট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান

বর্তমানে দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কয়েক বছর ধরেই ভুয়া নিয়োগের ফাঁদ পাতা হচ্ছে। এই ফাঁদে পড়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। একইসাথে এসব ক্ষেত্রে তথ্য চুরির শঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। এবার সরকারি ও বেসরকারি চার ধরণের প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া নিয়োগ সংক্রান্ত অভিনব প্রতারণার সন্ধান পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার। রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, দেশের ০৭টি সিটি কর্পোরেশন, অন্তত ২০টি পৌরসভা, অন্তত ৬০টি হাসপাতালে এবং অন্তত ২০টি পাসপোর্ট অফিসের নাম, লোগো ব্যবহার করে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জীবনবৃত্তান্ত প্রথমে ইমেইল পাঠানোর অনুরোধ করে এবং পরে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণার জাল পেতেছে এর সাথে জড়িত চক্রগুলো। কথিত নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিগুলোকে বিশ্বস্ত করে তুলতে ব্যবহার করা হয়েছে জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকার লোগোও। 

সাত সিটি কর্পোরেশনে ভুয়া নিয়োগের ফাঁদ

দেশে বর্তমান সিটি কর্পোরেশন রয়েছে ১২টি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ এবং গাজীপুর বাদে বাকি সিটি কর্পোরেশনগুলো চলতি বছর ভুয়া নিয়োগের ফাঁদে পড়েছে। এদের মধ্যে তারিখ বদলে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের নামে দুইবার একই ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। 

ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির
Screenshot collage: Rumor Scanner 

রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ২৪ ফেব্রুয়ারির তারিখে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রথম বিজ্ঞপ্তির শিকার হয় খুলনা সিটি কর্পোরেশন। সে সময় এই বিজ্ঞপ্তিতে এই সিটি কর্পোরেশনের ছয়টি পদে নিয়োগের তথ্য উল্লেখ করা হয়। পদগুলো হলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা, পরিচ্ছন্ন পরিদর্শন, ইপিআই সুপারভাইজার, হিসাবরক্ষক, সহকারী হিসাবরক্ষক এবং এম এল এস এস। এসব পদের বিপরীতে কতজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে তা উল্লেখ না করা হলেও শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে পদভেদে জেএসসি থেকে স্নাতক পাশ পর্যন্ত। 

বিজ্ঞপ্তির পরের অংশে ছয়টি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যার একটিতে বলা হয়েছে, প্রার্থীদের পাঠানো জীবন বৃত্তান্ত যাচাই বাছাই করার পর খুদে বার্তা বা এসএমএস পাঠানো হবে। এই এসএমএস পাওয়ার চার ঘন্টার মধ্যেই ব্যাংক ড্রাফট করতে হবে। সাধারণত কোনো সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাংক ড্রাফটের জন্য এত কম সময় বেঁধে দেওয়া হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। এমনকি জীবনবৃত্তান্ত পাঠাতে বলা হয়েছে জিমেইল পরিসেবার একটি মেইল ঠিকানায় ([email protected])। 

আমরা দুইটি বিষয়ে অনুসন্ধান করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছি। প্রথমত, প্রথম আলোর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারির (আবেদনের শেষ তারিখ) প্রিন্ট সংস্করণ যাচাই করে এমন কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির হদিশ পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত, রিউমর স্ক্যানার এই বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে জানতে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সানজিদা বেগমের সাথে কথা বলেছে। তিনি জানিয়েছেন, তারা এমন কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেননি। এরপর গত ৩০ মার্চ পর্যন্ত আরও ছয়টি সিটি কর্পোরেশনের নামে একই কায়দায় সাতটি ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে ফেসবুক। 

এই বিজ্ঞপ্তিগুলো প্রচারের পর সংশ্লিষ্ট একাধিক সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে ফাতিমা এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নামে যে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি প্রচার করা হয়েছে তাতে ভুয়া ইমেইলের পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনের নামে ভুয়া ওয়েবসাইট উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার। বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সচিব এই ভুয়া নিয়োগের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার কথা জানিয়েছেন। 

সিটি কর্পোরেশনে ভুয়া নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিগুলোর ক্ষেত্রে ‘সিটি কর্পোরেশন’ নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। লকড অবস্থায় থাকা অ্যাকাউন্টটিতে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের লোগো দেওয়া আছে প্রোফাইল ছবিতে। অ্যাকাউন্টধারী নিজের দুইটি পরিচয় উল্লেখ করেছেন অ্যাকাউন্টটির অ্যাবাউট সেকশনে। সচিব যুগ্ম সচিব এবং নির্বাহী কর্মকর্তা, অতিরিক্ত দায়িত্ব। অবশ্য আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, যখন যে সিটি কর্পোরেশনের নামে এই অ্যাকাউন্ট থেকে ভুয়া বিজ্ঞপ্তি ছাড়া হয় তখন সেই সিটি কর্পোরেশন বিষয়ক তথ্য অ্যাকাউন্টে দেওয়া হতো। এতে করে উক্ত অ্যাকাউন্টধারীর নিজেকে বিস্তস্ত প্রমাণের একটা চেষ্টা ছিল বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। গত ৩০ মার্চ সর্বশেষ বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নামেই ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। এজন্য উক্ত সিটি কর্পোরেশন সংক্রান্ত তথ্য দেয়া হয়েছে অ্যাকাউন্টে।   

এই বিজ্ঞপ্তিগুলো নজরে আসার পর জীবন বৃত্তান্ত পাঠানোর জন্য দেওয়া ইমেইলে যোগাযোগ করেছেন এমন তিনজনের খোঁজ পেয়েছি আমরা। রংপুর, বরিশাল এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের বিজ্ঞপ্তিগুলো দেখে তারা উক্ত মেইলে জীবন বৃত্তান্ত পাঠিয়ে দেন। 

তিন সিটি কর্পোরেশনের জন্য দেওয়া ইমেইল ঠিকানা ভিন্ন হলেও রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট অনুসন্ধানে দেখেছে, এই ব্যক্তিদের একই নাম্বার (09638763186) থেকে মেসেজ দেওয়া হয়েছে। মেসেজে উক্ত ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট পদে নির্বাচিত হয়েছেন জানিয়ে ৩০৫ টাকা ব্যাংক ড্রাফট করার জন্য আরেকটি মোবাইল নাম্বার (+8801612079312) দেওয়া হয়েছে। তিন ব্যক্তিকেই এই নাম্বারেই ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা নগদের মাধ্যমে ৩০৫ টাকা পাঠাতে বলা হয়েছে। 

Screenshot collage: Rumor Scanner 

পৌরসভার নামে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও একই ধাঁচে প্রতারণা 

গত ১৯ মার্চ তারিখে প্রকাশিত দেশের দুই পৌরসভা গাইবান্ধা এবং পটুয়াখালীর নামে দুইটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নজরে আসে আমাদের। রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট বিজ্ঞপ্তি দুইটি বিশ্লেষণ করে দেখতে পায়, দুই পৌরসভাতেই ছয়টি পদে নিয়োগের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। পদগুলো যথাক্রমে সহকারী কর আদায়কারী, সহকারী কর নির্ধারক, ইপিআই সুপারভাইজার, হিসাবরক্ষক, সহকারী হিসাবরক্ষক এবং এম এল এস এস। আমাদের প্রথম খটকা লাগে এখানেই। দুই পৌরসভা একই দিনে একই পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়াটা শুধুই কি কাকতালীয় কোনো ব্যাপার? সিটি কর্পোরেশনগুলোর ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মতো এই দুই বিজ্ঞপ্তিতেও ‘প্রথম আলো’র লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। যথারীতি এই দুই বিজ্ঞপ্তিও পত্রিকাটির কোনো প্রিন্ট সংস্করণে পাওয়া যায়নি। 

এই দুই বিজ্ঞপ্তিতে আরো কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়ে আমাদের নজরে৷ যেমন, দুইটি বিজ্ঞপ্তিতেই স্বাক্ষরকারী ব্যক্তির নাম ও পদবী ভিন্ন থাকলেও স্বাক্ষর একই ছিল৷ গাইবান্ধা পৌরসভার ক্ষেত্রে জীবন বৃত্তান্ত পাঠাতে দেওয়া ইমেইল ঠিকানা [email protected]। পটুয়াখালী পৌরসভার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে [email protected] এই ইমেইল ঠিকানা। অর্থাৎ, পার্থক্য শুধু একটি সংখ্যা। দুই পৌরসভার পক্ষ থেকেই বিজ্ঞপ্তিগুলো ভুয়া বলে জানানো হয়েছে। থানায় জিডিও করা হয়েছে। কিন্তু পৌরসভার নামে এমন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার থেমে থাকেনি। 

গত ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত আরও অন্তত ১৮টি পৌরসভার নামে একই কায়দায় ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এসেছে ফেসবুকে। 

Screenshot collage: Rumor Scanner

এই ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলো শুরুতে ‘পৌরসভা কার্যালয়’ নামে একটি ফেসবু্ক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচারের পর চাকরি এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার গ্রুপগুলোতে শেয়ার করেছেন অনেকে। এই অ্যাকাউন্টটি যে ভুয়া তাও সহজেই বোঝা যায় এর ইউজার নাম (https://www.facebook.com/nill.akasherpori.14019) এবং সময়ে সময়ে অ্যাবাউট সেকশনের তথ্য পরিবর্তন দেখে। এখন যেমন এতে ‘ভোলা পৌরসভা’র লোগো এবং পরিচয় হিসেবে পৌরসভাটির ‘নির্বাহী কর্মকর্তা অতিরিক্ত দায়িত্ব’ শীর্ষক পদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, সর্বশেষ ভোলা পৌরসভার নামেই ভুয়া বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে এই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। একইভাবে যখন যে পৌরসভার নামের ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়া হয়, তখন সেই পৌরসভা সম্পর্কিত তথ্য দেওয়া হয় এতে। 

রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট মাগুরা বাদে (পৌরসভাটির পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত সতর্কবার্তা দেওয়া হলেও দাবিকৃত পোস্টের অস্তিত্ব মেলেনি) এ সংক্রান্ত বাকি যে ১৯টি পৌরসভার নামে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে তার সবগুলোই বিশ্লেষণ করে দেখেছে। সবগুলোতেই একই পদের বিষয়েই উল্লেখ রয়েছে। ইমেইল ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে সর্বমোট ছয়টি। এর মধ্যে [email protected] এই মেইল ব্যবহার করে সর্বাধিক পাঁচটি পৌরসভার নামে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে।  

রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট চারটি পৌরসভার (জয়পুরহাট, কক্সবাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ভোলা) ক্ষেত্রে এই ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে ইমেইলে আবেদন করেছেন এমন পাঁচজন ব্যক্তির খোঁজ পেয়েছে। তারা ইমেইলে আবেদন করার পর প্রত্যেককে 09638763186 এই নাম্বার থেকে মেসেজ পাঠানো হয়েছে। একজন শুধু +8801812216166 এই নাম্বার থেকে মেসেজ পেয়েছেন। তবে সকলকেই +8801332333186 এই নাম্বারে ৩০৫ টাকা নগদের মাধ্যমে পাঠাতে বলা হয়েছে। 

Screenshot collage: Rumor Scanner

অর্থাৎ, একই নাম্বার থেকে মেসেজ পাওয়া এবং একই নাম্বারেই অর্থ পাঠানোর এই ধরণ দেখে পৌরসভাগুলোর ভুয়া নিয়োগের এই প্রতারণার পেছনে একই ব্যক্তিই যে আছেন তা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে। 

সরকারি বেসরকারি হাসপাতালেও একই ফাঁদে একাধিক চক্র?

সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার নামে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলো এ বছর প্রচার করা হলেও সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালের নামে প্রায় একই কায়দায় অন্তত ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকেই নিয়মিত এমন ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণার ফাঁদ পাতা হচ্ছে ফেসবুকে। 

Screenshot collage: Rumor Scanner

২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে গত ১৬ মে পর্যন্ত দেশের অন্তত ৩২টি জেলার অন্তত ২৬টি সরকারি ও ৩৪টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের নামে ভুয়া নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। ২০২২ (১১) ও ২০২৩ (১৯) সালের তুলনায় চলতি বছর (৩০) ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচারের হার বেড়েছে। চলতি বছর প্রচার হওয়া ৩০টি হাসপাতালের ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মধ্যে ২০টিই সরকারি প্রতিষ্ঠান।  

২০২২ সাল থেকে প্রচার হওয়া এসব ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের জন্য ১৯টি ইমেইল ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা ওপেন সোর্স অনুসন্ধানে তিনটি ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির (নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল, পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতাল, দিনাজপুর ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতাল) বিপরীতে ইমেইলে আবেদন করেছে এমন তিন ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছি। তারা ইমেইলে জীবন বৃত্তান্ত পাঠানোর পর তাদেরকে +8801812216166 এবং +8809638753000 এই দুই নাম্বার থেকে মেসেজ পাঠানো হয়েছে। বলা হয়েছে +8801882714051 এবং +8801332333186 এই নাম্বারের মাধ্যমে যথাক্রমে ২২৫ টাকা ও ৩০৫ টাকা ফি প্রদান করতে। 

রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট অন্তত দুইটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টেরও সন্ধান পেয়েছে যারা অন্তত গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে হাসপাতাল সম্পর্কিত এই ধরণের ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলো বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে নিয়মিত পোস্ট করে আসছেন। এর মধ্যে Md Habib নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে গত বছরের মে মাস থেকে এবং Angel Ava নামে অপর একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে নিয়মিত ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট করার প্রমাণ মিলেছে। এই দুই অ্যাকাউন্টই আবার একটি অপরটির ফ্রেন্ডলিস্টে রয়েছে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর নাম ও লোগো ব্যবহার করে ‘Hospital Authority’ নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একই কায়দায় ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে।  

পাসপোর্ট অফিসও শিকার হয়েছিল ভুয়া নিয়োগ প্রতারণার

২০২২ সালে দেশের অন্তত ২০টি জেলার পাসপোর্ট অফিসের নামেও ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচারের তথ্য পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। সে বছরের অন্তত এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এসব নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ফেসবুকে প্রচার করা হয়। এসব ক্ষেত্রে ০৯টি ইমেইল ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এসব ইমেইল ঠিকানার মধ্যে ছয়টিতেই dghs শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু dghs মানে হচ্ছে Directorate General of Health Services যা কিনা সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইংরেজি নাম। এর সাথে পাসপোর্ট অফিসের কোনো সম্পর্কই থাকার কথা নয়। 

২০২২ সালে চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিসের নামে এ সংক্রান্ত ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচারের প্রেক্ষিতে এটিকে ভুয়া উল্লেখ করে চট্টগ্রামের বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক এবং আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক ও ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক জানান, “পাসপোর্ট অফিসের নিয়োগ আসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যালয় থেকে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। যেখানে নিয়োগের যাবতীয় তথ্যসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার নাম ও স্বাক্ষর থাকবে। তবে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টারটি তৈরি করা হয়েছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। ব্যবহার করা হয়েছে মোবাইলের ফ্রন্ট।”

জিডি হচ্ছে, তবু ধরাছোঁয়ার বাইরে প্রতারক চক্র 

সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে সমজাতীয় পদ্ধতি অবলম্বন করে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ফেসবুকে আসার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়েই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান স্বপ্রণোদিত হয়ে থানায় জিডি বা সাধারণ ডায়েরি করেছেন। রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট এমন বেশ কয়েকটি জিডির কপি হাতে পেয়েছে। এর মধ্যে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের নামে গত ডিসেম্বর এবং এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুই দফায় এমন ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হলে দুইবারই থানায় জিডি করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। জিডিগুলোর বিষয়ে জানতে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার উত্তর (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মোঃ আজবাহার আলী শেখের সাথে কথা বলেছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। তিনি বলছিলেন, “জিডিগুলোর বিষয়ে কোনো সমাধানে আসা যায়নি। এ বিষয়ে এই মুহূর্তে কোনো আপডেটও নেই।” 

একই ধরণের ভুয়া নিয়োগের শিকার হয়ে থানায় জিডি করেছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন এবং ভোলা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। গত ৩০ এপ্রিল মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা হাসপাতালের নাম ব্যবহার করে একই ধরণের ভুয়া নিয়োগের বিষয়ে থানায় জিডি করেন হাসপাতালটির অফিস সহকারী কাম ডাটা এন্ট্রি অপারেটর সোহেল রানা। এ বিষয়ে পরবর্তীতে কোনো আপডেট পাওয়া গেছে কিনা বা থানা থেকে কিছু জানিয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে জনাব রানা আমাদের জানিয়েছেন, তিনি এ বিষয়ে থানা থেকে আর কোনো আপডেট পাননি। আমরা গণমাধ্যমেও এই ধরণের ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো অভিযানের তথ্য পাইনি। 

তবে গত এপ্রিলে সজল দাস নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে হবিগঞ্জ পুলিশের নামে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচারের প্রেক্ষিতে হবিগঞ্জ ডিবি পুলিশ রামপ্রসাধ চন্দ নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে। 

সচেতন হওয়া কি খুব কঠিন? 

ডিজিটাল জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে প্রচার করা ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলো ফেসবুকে দেখে অনেক চাকরিপ্রত্যাশীই প্রতারকদের ফাঁদে পা দিয়ে আর্থিক প্রতারণার শিকার হন। অনেক ক্ষেত্রে নিজের জীবন বৃত্তান্ত ইমেইলে পাঠিয়ে দেওয়ার কারণে ব্যক্তিগত অনেক তথ্যই প্রতারকদের হাতে চলে যায়৷ এতে করে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। এজন্য যে কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নজরে আসার পর শুরুতেই এটি আসল কিনা তা যাচাই করে নেওয়া জরুরি। রিউমর স্ক্যানার টিমের এ সংক্রান্ত যাচাই প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা বলে, এই কাজটি কঠিন নয়। 

এই ধরণের বিজ্ঞপ্তি যে প্রতিষ্ঠানের নামে দেওয়া হয় শুরুতে সেই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট, অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে কিনা খুঁজে দেখুন। সেখানে না পেলে সন্দেহ বাড়ান। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে যোগাযোগের জন্য নাম্বার দেওয়া থাকে। তাতে কথা বলে সত্যতা যাচাই করুন। সাধারণত সকল প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেই যে ইমেইল ঠিকানা দেওয়া হয়, তাতে প্রতিষ্ঠানটির নাম বা নামের কিছু অক্ষর থাকে। আপনার নজরে আসা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া ইমেইল ঠিকানায় তার প্রতিফলন ঘটছে কিনা যাচাই করুন। 

রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে ‘ভুয়া নিয়োগ’ সেকশনে নিয়মিতই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সংক্রান্ত ভুয়া বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে ফ্যাক্টচেক প্রকাশিত হচ্ছে। সেখানেও একবার ঢুঁ মেরে দেখতে পারেন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে কোনো ফ্যাক্টচেক রয়েছে কিনা৷ 

এসবের মাধ্যমে সমাধানে না পৌঁছাতে পারলে সরাসরি রিউমর স্ক্যানারেই যোগাযোগ করতে পারেন। আমাদেরকে ইমেইল (http://[email protected]), হোয়াটসঅ্যাপ (+8801751589458) কিংবা ফেসবুক পেজের (https://www.facebook.com/RumorScanner) মাধ্যমে সহজেই জানাতে পারেন এ বিষয়ে। 

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img