গত ২৮ আগস্ট শামা ওবায়েদ নামক একটি ফেসবুক পেজ (আর্কাইভ) থেকে করা একটি পোস্টে দাবি করা হয়, “৩১ সদস্য নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে এবং সরকার প্রধান হবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।”
শামা ওবায়েদ বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক। তার ছবি ব্যবহার করেই উক্ত পেজটি পরিচালিত হচ্ছে। রিউমর স্ক্যানার টিম পেজটির ট্রান্সপারেন্সি সেকশন পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে, পেজটি ২০১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর যখন চালু করা হয়েছিল, তখনও একই নামই ছিল। অর্থাৎ, নাম বদল করা হয়নি। পেজটি বাংলাদেশ থেকে ১১ জন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে একজন পরিচালনা করছেন।
পেজটির About সেকশনে দাবি করা হয়েছে, এটি অফিশিয়াল পেজ। তবে পেজটির ইউজার নেমে শামা ওবায়েদের নামের ভুল বানান (samaobud) লক্ষ্য করেছি আমরা।
আলোচিত সেই পোস্ট প্রসঙ্গে ফেরা যাক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কিত সেই পোস্টটির বরাতে সেসময় দেশের একাধিক গণমাধ্যমে (১,২,৩) প্রকাশিত খবরে বলা হয়, পেজটি শামা ওবায়েদের নয়। শামা ওবায়েদের বক্তব্যের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখ করা হয়, “এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। এটি আমার আইডি নয়। ফেইক আইডি থেকে মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।”
ড. মুহাম্মদ ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হচ্ছেন শীর্ষক দাবিটি এই ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ বিষয়টি অনুসন্ধান করে গত ২৬ আগস্ট রিউমর স্ক্যানার একটি ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করেছিল। পড়ুন এখানে।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ০৫ সেপ্টেম্বর একই পেজ থেকে প্রকাশিত একটি পোস্টে (আর্কাইভ) জাতীয় দৈনিক কালবেলার সূত্রে দাবি করা হয়, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘোষণার সাথে সাথে প্রায় ৭০-৮০ লক্ষ প্রবাসী দেশে আসতে প্রস্তুত।”
কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধানে দেখেছে, কালবেলা এমন কোনো খবর প্রকাশ করেনি। পরবর্তীতে এ বিষয়ে আমাদের প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক দেখুন এখানে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর একই পেজে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতার বিষয়ে প্রকাশিত ভুল ছবির বিষয়ে করা পোস্টের (আর্কাইভ) ফ্যাক্টচেক (২০২১ সালে প্রকাশিত) দেখুন এখানে।
মধ্য সেপ্টেম্বরে শামা ওবায়েদের নাম ও ছবি ব্যবহার করে পরিচালিত আরেকটি পেজের (আর্কাইভ) একটি পোস্টে (আর্কাইভ) দাবি করা হয়, “বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মেয়ে জাইমা রহমান লন্ডনের পলিটিক্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১ম স্থান অর্জন করেছেন।” এই পেজটি চলতি বছরের ১৫ মে খোলা হয়েছে।
আমাদের যখন নজরে আসে পোস্টটি, তখন তাতে প্রায় ৪৭ হাজার রিয়েক্টসহ দুই হাজারের অধিক কমেন্ট এবং ১৪০০ এর বেশি শেয়ার হয়েছে। অর্থাৎ, বিশাল সংখ্যক মানুষ এই পোস্টের মাধ্যমে বিষয়টি জেনেছেন।
কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিম ২০২১ সাল থেকেই এই দাবিটি প্রচার হয়ে আসতে দেখলে সে সময়ই অনুসন্ধান করে জানায়, জাইমা রহমান নামে পরিচালিত একটি ভুয়া ফেসবুক পেজ থেকে কোন তথ্যসূত্র ছাড়াই এই দাবিটি প্রচার করা হয়, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এ সংক্রান্ত রিউমর স্ক্যানারের ফ্যাক্টচেক দেখুন এখানে।
রিউমর স্ক্যানার টিম ফেসবুকে বাংলা এবং ইংরেজিতে শামা ওবায়েদ / Shama Obaed লিখে সার্চ করে উপরোক্ত দুইটি ছাড়াও আরও অন্তত অর্ধশতাধিক পেজের সন্ধান পেয়েছে।
তবে এর মধ্যে অন্তত চারটি পেজের About সেকশনে পেজগুলো অফিশিয়াল বলে দাবি করা হয়েছে। পেজগুলো দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
এর মধ্যে প্রথম চারটি পেজের আগে ভিন্ন নাম ছিল, পরে শামা ওবায়েদ নাম রাখা হয়েছে। চতুর্থটির নাম পরিবর্তন না করা হলেও এর ফলোয়ার সংখ্যা এই মুহূর্তে ৩২০০ এর বেশি।
অফিশিয়াল ছাড়াও অন্তত দুইটি পেজের (১, ২) সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা নিজেদের অফিশিয়াল দাবি না করলেও এদের ফলোয়ার সংখ্যা দেখে যে কেউ অফিশিয়াল ভেবে নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে একটির (আর্কাইভ) ফলোয়ার সংখ্যা ৩ লাখ ১৯ হাজারের বেশি, যা শামা ওবায়েদের নামে চালু থাকা অন্য সকল পেজের ফলোয়ার সংখ্যার চেয়ে বেশি। এই পেজটি ২০১৫ সালের ২৬ জুন বর্তমান নামেই (শামা ওবায়েদ) খোলা হয়। এরপর আর নাম পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশ থেকে চারজন বর্তমানে পেজটি পরিচালনা করছেন।
অপর পেজটির (আর্কাইভ) ফলোয়ার সংখ্যা ৮৬ হাজারের বেশি। ২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি চালুর পর এই পেজটিরও নাম আর পরিবর্তন হয়নি। পেজটি বাংলাদেশ ছাড়াও আরও দুইটি দেশ থেকে পরিচালিত হচ্ছে।
এই দুই পেজ ছাড়াও আরো একটি পেজের (আর্কাইভ) সন্ধান পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার টিম৷ ২০১৪ সালের ০৯ ডিসেম্বর চালু হওয়া পেজটি বর্তমানে ভারত থেকে পরিচালিত হচ্ছে। তাছাড়া, এই পেজের About সেকশনেও পেজটিকে শামা ওবায়েদের অফিশিয়াল পেজ বলে দাবি করা হয়েছে। ২ লাখ ৬৪ হাজার ফলোয়ার সংখ্যার পেজটি থেকে গত ২২ এপ্রিলের পর আর কোনো পোস্ট করা হয়নি।
রিউমর স্ক্যানার টিম সার্বিক বিষয়ে জানতে শামা ওবায়েদের সাথে যোগাযোগ করেছিল। তিনি জানালেন, বর্তমানে ভারত থেকে পরিচালিত হওয়া পেজটি তার অফিশিয়াল পেজই ছিল। তবে সেটা হ্যাক হওয়ায় এখন আর তার নিয়ন্ত্রণে নেই।
শামা ওবায়েদ বলছেন, বর্তমানে Shama Obaed নামে তার একটি অফিশিয়াল পেজ (আর্কাইভ) রয়েছে। বাকি সকল পেজই ভুয়া বা তার নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।
এই পেজটির ফলোয়ার সংখ্যা বর্তমানে ৪৭ হাজারের কিছু বেশি। ২০১২ সালে যখন পেজটি চালু করা হয় তখন অবশ্য এর নাম শামা ওবায়েদের নামে ছিল না, নাম ছিল Banglanews24.com। গেল বছরের (২০২২) ৩০ ডিসেম্বর পেজটির নাম বদলে বর্তমান নামটি রাখা হয়। পেজটি বর্তমানে ০৭ জন পরিচালনা করছেন।
শামা ওবায়েদ রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, তার নাম ও ছবি ব্যবহার করে ভুয়া অ্যাকাউন্ট চালু থাকা এবং সেসব অ্যাকাউন্ট থেকে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে তিনি এ বিষয়ে রাজধানীর বনানী থানায় একটি জিডি করেছেন। জিডির একটি কপি তিনি রিউমর স্ক্যানারের কাছেও পাঠিয়েছেন।
জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, তার www.shamaobaed.com বাদে কোন পেজ নেই।
কিন্তু লিংকটি কোনো ফেসবুক পেজের নয়, বরং একটি ওয়েবসাইটের। এই ওয়েবসাইটটি এখন সচল নেই। তবে ইন্টারনেট আর্কাইভে ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর তারিখে পাওয়া সর্বশেষ সচল সংস্করণ থেকে দেখা যায়, ওয়েবসাইটটিতে সে সময় নিয়মিত শামা ওবায়েদসহ বিএনপির বিভিন্ন কার্যক্রমের বিষয়ে খবর প্রকাশিত হত।
শামা ওবায়েদ রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, উপরোল্লিখিত ফেসবুক পেজ ছাড়াও তার ব্যক্তিগত একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, এটির লিংক এখানে (আর্কাইভ)।
আমরা এই অ্যাকাউন্টের বাইরে আরো অন্তত বিশের অধিক অ্যাকাউন্ট পেয়েছি যেগুলো শামা ওবায়েদের নাম ও ছবি ব্যবহার করে চালু রয়েছে।
এর মধ্যে একটি অ্যাকাউন্টে (আর্কাইভ) মূল অ্যাকাউন্টের প্রোফাইল পিকচার এবং কাভার ফটো ব্যবহার করা হয়েছে, যা দেখে এটিকেও মূল অ্যাকাউন্ট ভেবে বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
সুতরাং, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদের নাম ও ছবি ব্যবহার করে একাধিক ভুয়া ফেসবুক পেজ থেকে গেল কয়েক মাসে একাধিক ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এ বিষয়ে গত আগস্টে শামা ওবায়েদ থানায় জিডিও করেছেন। রিউমর স্ক্যানারের কাছে তিনি বলেছেন, তার নিয়ন্ত্রণাধীন বর্তমানে একটি পেজ এবং একটি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তাছাড়া, তার একটি ওয়েবসাইট থাকলেও সেটি সচল নেই এখন।
তথ্যসূত্র
- Shama Obaed: Facebook Page
- Shama Obaed: Facebook Profile
- Statement from Shama Obaed
- Rumor Scanner’s own analysis