গোপালগঞ্জের সহিংসতার বিষয়ে জাতিসংঘ কোনো মন্তব্য করেনি

গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে এনসিপির জুলাই পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংঘর্ষে অন্তত ৫ জন নিহত হন। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে দাবি প্রচার করা হয়েছে যে “গোপালগঞ্জ গণহত্যার প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘ”।

এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, গোপালগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনার বিষয়ে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এখন অবধি কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস রিসার্চ ফাউন্ডেশন (আইসিআরএফ) নামের একটি সংস্থার পক্ষ থেকে গোপালগঞ্জের ঘটনাকে গণহত্যা উল্লেখ করে জাতিসংঘের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানা যায়।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে আলোচিত দাবিটির সপক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। গোপালগঞ্জের ঘটনায় জাতিসংঘ গণহত্যার প্রমাণ পেয়েছে এরূপ তথ্য জাতিসংঘ বা জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট কারোর পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হলে তা মূলধারার গণমাধ্যমে প্রচার করা হতো। এছাড়া, জাতিসংঘের মূল ওয়েবসাইট ও 

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) এর ওয়েবসাইট পর্যবেক্ষণ করেও আলোচিত দাবিটির সপক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

তবে অনুসন্ধানে ভারতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘ফার্স্ট পোস্ট’ এর ওয়েবসাইটে “Bangladesh: Gopalganj violence reaches UN with ‘genocide’ allegations, Army’s role questioned” শীর্ষক শিরোনামে গত ১৭ জুলাইয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “১৬ জুলাই বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজ জেলা গোপালগঞ্জে শুরু হওয়া সংঘর্ষ এখন জাতিসংঘ পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা অভিযোগের ভিত্তিতে “গণহত্যা” হিসেবে বর্ণিত হচ্ছে। জাতিসংঘের নৈতিকতা দপ্তরে লেখা এক চিঠিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ গবেষণা ফাউন্ডেশন (ICRF) নামক একটি স্বাধীন বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা, ঐতিহ্য ধ্বংস এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো তুলে ধরেছে।… চিঠিতে ICRF দাবি করেছে, এনসিপি নেতারা হাজার হাজার সমর্থক নিয়ে গোপালগঞ্জে প্রবেশ করে, এবং তাদের সমাবেশের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কবরস্থানকে অবমাননা ও ধ্বংস করা।… ICRF গোপালগঞ্জ সংকট নিয়ে একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে। সংগঠনটি জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন, যেমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় জবাবদিহি করা হয়।..” (অনূদিত)

জাতিসংঘে আইসিআরএফের চিঠি দেওয়ার বিষয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘নিউজ১৮’ এর ওয়েবসাইটেও প্রতিবেদন প্রকাশ হতে দেখা যায়। উল্লেখ্য যে, ‘ফার্স্টপোস্ট’ এর প্রতিবেদনে চিঠিটির একাংশের ছবিও সংযুক্ত করা হয় যেখানে ‘আইসিআরএফ’ এর লোগোরও সংযুক্তি পাওয়া যায়। পরবর্তীতে উক্ত তথ্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করলে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস রিসার্চ ফাউন্ডেশন (আইসিআরএফ) নামে কোনো স্বনামধন্য সংস্থা পাওয়া যায়নি। তবে, অনুসন্ধানে এই নাম এবং লোগো সম্বলিত একটি ফেসবুক পেজ পাওয়া যায়। ফেসবুক পেজটিতে সংস্থাটির একটি ওয়েবসাইটেরও সংযুক্তি পাওয়া যায় কিন্তু ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। ফেসবুক পেজটি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, পেজটি মূলত যুক্তরাজ্য, বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়া থেকে পরিচালিত হয়। পেজটিতে চলতি বছরে কেবলমাত্র দুইটি পোস্ট করা হয়েছে যার মধ্যে একটি পোস্টে আওয়ামী লীগের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের লাইভ ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে।

অধিকতর অনুসন্ধান করলে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নিঝুম মজুমদারের লিংকড-ইনের প্রোফাইলে দেখা যায়, নিঝুম মজুমদার আইনগত বিশ্লেষক (Legal Analyst) হিসেবে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ এ প্রায় ১১ বছর ধরে কর্মরত আছেন।

উল্লেখ্য, মূলধারার গণমাধ্যম ‘দ্য ডেইলি স্টার’ এর ওয়েবসাইটে গত ২৫ জুলাইয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) রাজনৈতিক সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও গুলিতে পাঁচ নাগরিক নিহত, বহু সংখ্যক আহত এবং পরবর্তীতে গণআটক-গ্রেপ্তার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংস্থাটির চার সদস্যের প্রতিনিধি দল দুই দিনব্যাপী প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান শেষে বলছে, গোপালগঞ্জে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। এছাড়া, রাজনৈতিক সমাবেশে হামলার ঘটনা নাগরিকের সভা-সমাবেশের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে।

এছাড়া, মূলধারার গণমাধ্যম ‘সমকাল’ এ গত ২৬ জুলাইয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের সূত্রে জানা যায়, গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, প্রাণহানি এবং গণগ্রেপ্তার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ১১ জন পর্যবেক্ষণকারী নাগরিক। ২২ জুলাই গোপালগঞ্জ সফর শেষে শনিবার (২৬ জুলাই) এক বিবৃতিতে তারা সুষ্ঠু তদন্ত, মানবাধিকার রক্ষা এবং সংবিধান অনুযায়ী সভা-সমাবেশের অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। পর্যবেক্ষণকারী এই নাগরিকেরা হলেন- আলোকচিত্রী শহীদুল আলম, সাংবাদিক তাসনিম খলিল, শিল্পী বীথি ঘোষ, লেখক ফিরোজ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা, মোশাহিদা সুলতানা এবং রুশাদ ফরিদী, আইনজীবী সারা হোসেন ও মানজুর আল মতিন এবং অধিকার কর্মী নাফিউল আলম সুপ্ত।

তবে, কোথাও গোপালগঞ্জে গণহত্যার প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘ শীর্ষক তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

অর্থাৎ, গোপালগঞ্জের ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ অভিযোগ করে চিঠি পাঠানো হলেও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ‘গণহত্যা’ জানিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি। 

সুতরাং, গোপালগঞ্জে গণহত্যার প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘ শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img