আজ (৩০ জুলাই) দুপুর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাধিক পোস্টে পুলিশের সাথে একজন বৃদ্ধের কয়েকটি ছবি প্রচার করে ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, “এই বৃদ্ধ লোক কে দেখে কি কোনো ভাবে মনে হয় তিনি জুলাই আগস্টে ছাত্রদের সাথে ঝামেলা করেছে,তার বয়স ১২০ বছর,অথচ তাকে গ্রেফতার করা হলো”।
অর্থাৎ, দাবি করা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করার কারণে প্রায় ১২০ বছর বয়সী এই বৃদ্ধকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।

এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
এরূপ দাবিতে ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে।
এরূপ এক্সে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ছবিতে প্রদর্শিত প্রায় ১২০ বছর বয়সী এই বৃদ্ধকে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করার কারণে পুলিশ গ্রেফতার করেনি বরং, ২০০৩ সালের এক হত্যা মামলায় আলোচিত বৃদ্ধ ইদ্রিস শেখ কারাগারে আছেন। এই মামলায় বৃদ্ধ ইদ্রিস শেখের রায়ও হয়েছে ২০১৫ সালে।
অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবিগুলো নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে মূলধারার গণমাধ্যম ‘প্রথম আলো’র ইউটিউব চ্যানেলে আজ (৩০ জুলাই) “লাঠি হাতে আদালতে শতবর্ষী ইদ্রিস শেখ, প্রিজন ভ্যানে বাবাকে দেখেই কেঁদে ফেললেন ছেলে” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে প্রদর্শিত দৃশ্যের সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবিগুলোর মিল পাওয়া যায় এবং নিশ্চিত হওয়া যায় যে প্রচারিত ছবিগুলো মূলত উক্ত ঘটনার ভিডিওটি থেকেই নেওয়া হয়েছে।

ভিডিওটিতে বলা হয়, প্রচারিত দৃশ্য গত ২৯ জুলাইয়ের। প্রদর্শিত বৃদ্ধের নাম ইদ্রিস শেখ। বৃদ্ধ ও বৃদ্ধের ছেলের দাবি অনুসারে ইদ্রিস শেখের বয়স ১২০ বছর। এছাড়াও, ভিডিওটিতে ইদ্রিসের আত্মীয়কে বলতে শোনা যায়, ২০০৩ সালের একটি হত্যা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইদ্রিস শেখ কারাগারে আছেন।
পরবর্তীতে উক্ত তথ্যের সূত্র ধরে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে ‘প্রথম আলো’র ওয়েবসাইটে “আসামি শতবর্ষী ইদ্রিস শেখের আদালতে হাজিরা ও প্রিজন ভ্যানে যাত্রা” শীর্ষক শিরোনামে আজ (৩০ জুলাই) এ বিষয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘ইদ্রিস শেখ হাজতখানার ভেতরে ঢুকে যান। তখন হাজতখানার সামনেই অপেক্ষা করতে থাকেন তাঁর ছেলে বাবুল শেখ। বাবুল তখন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমারই বয়স এখন ৭০ বছর। আমরা পাঁচ ভাই–বোন ছিলাম। আমার আরও তিন ভাই মারা গেছে। আমার বাবার বয়সী কোনো লোক এলাকায় বেঁচে নেই। বহু বছর আগে একটি খুনের মামলায় আমার বাবাকে জড়ানো হয়েছিল। সেই মামলার ঘানি টেনে চলেছেন উনি।’
প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, মামলার নথিপত্রের তথ্যমতে, ইদ্রিস শেখদের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর থানার শেখেরটেক এলাকায়। ২২ বছর আগে সেখানকার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় জনৈক শামসুল হক হাওলাদার ও সিরাজুল হক মোল্লার পরিবারের মধ্যে বিরোধ ছিল। নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন শামসুল হক হাওলাদার। পূর্ববিরোধ ও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০০৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি শেখেরটেক এলাকায় শামসুল হক হাওলাদার ও সিরাজুল হক মোল্লার অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। শামসুল হক হাওলাদারের লোকজন ৩০ থেকে ৩৫ জনকে গুলি করে। ঘটনাস্থলেই সৈয়দ আলী ও সুলেমান মোল্লা নামে দুজন নিহত হন। গুরুতর জখম হন আরও ৩০ জন। এই ঘটনায় সৈয়দ আলী ও সুলেমান মোল্লার পরিবার রাজৈর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে।
এই মামলাটি তদন্ত করে সে বছরের আগস্ট মাসে শামসুল হক হাওলাদারসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। সেই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালের ১০ নভেম্বর মাদারীপুরের আদালত অভিযোগ গঠন করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ২০১০ সালে মামলাটি চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গেজেট হওয়ার পর ২০১০ সালে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল-১ আদালতে বদলি হয়। প্রায় পাঁচ বছর সাক্ষ্য গ্রহণ ও যুক্তি–তর্ক শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর রায় দেন বিচারক শাহেদ নুর উদ্দিন। রায়ে এ মামলায় চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় একজনকে। আর ইদ্রিস শেখসহ নয়জনকে দেওয়া হয় ১০ বছর করে কারাদণ্ড। ইদ্রিস শেখের বিরুদ্ধে গুরুতর জখম করার অভিযোগ আনা হয়। রায়ের বিবরণ অনুযায়ী, রায়ের দিন ইদ্রিস শেখ আদালতে উপস্থিত ছিলেন।”
অর্থাৎ, ২০০৩ সালের এক হত্যা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আটক আছেন। তাছাড়া, তার কারাবাসের রায়ও জুলাই আন্দোলনের আগেই হয়েছে।
সুতরাং, ২০০৩ সালের এক হত্যা মামলায় ইদ্রিস শেখ নামের এক বৃদ্ধের কারাগারে আটক থাকার ঘটনাকে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করেছে দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।