দুর্গাপূজায়ও থেমে ছিল না অপতথ্যের প্রবাহ 

সদ্যই শেষ হয়েছে সনাতন ধর্মাবলাম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। পূজাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই কমবেশি সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার থেকে শুরু করে অপতথ্য, ভুল তথ্য এবং সর্বোপরি গুজব প্রচারের হার বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়৷ এ বছরও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি৷ চলতি বছর দুর্গাপূজা সম্পর্কিত ১৫টি অপতথ্য শনাক্ত করে ১৪টি ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ অক্টোবরের মধ্যে এসব অপতথ্য শনাক্ত করা হয়। 

Collage: Rumor Scanner 

শনাক্ত হওয়া অপতথ্যগুলোর মধ্যে ভিডিও কেন্দ্রিক ঘটনা ছিল সবচেয়ে বেশি, আটটি। এছাড়া ছবি কেন্দ্রিক চারটি এবং তথ্য কেন্দ্রিক তিনটি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার৷ 

সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম মনিটরিং করে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, দুর্গাপূজা সংক্রান্ত অপতথ্যগুলোর প্রতিটিই ফেসবুকে প্রচার হয়েছে৷ এছাড়া এক্সে (সাবেক টুইটার) চারটি এবং ইনস্টাগ্রামে একটি অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। 

দুর্গাপূজা সংক্রান্ত শনাক্ত হওয়া অপতথ্যের ফ্যাক্টচেকগুলো দেখুন –

ক্রমিকদাবিফ্যাক্টলিংক
সম্প্রতি ঢাকার দোহারের জয়পাড়া দুর্গা মন্দিরে মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।ঘটনাটি মূলত ২০২৩ সালের।ঢাকার দোহারে মন্দির ভাঙচুরের ঘটনাটি সাম্প্রতিক সময়ের নয়, ২০২৩ সালের 
নরসিংদীতে পূজা মণ্ডপের প্যান্ডেলের তেরপাল কেটে ফেলেছে দুবৃর্ত্তরা।বৃষ্টির কারণে বৃষ্টির পানির চাপ সামলাতে না পেরে পূজা মণ্ডপের তেরপাল খুলে গিয়েছিল।নরসিংদীতে পূজা মণ্ডপের প্যান্ডেলের তেরপাল কেটে ফেলার গুজব 
ফরিদপুরে সম্প্রতি মন্দিরে ভাংচুরের ঘটনায় হিন্দু যুবক গ্রেফতার।২০২৩ সালের ভিন্ন ঘটনার ছবি ও তথ্যকে সাম্প্রতিক দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।২০২৩ সালে ফরিদপুরে মন্দির ভাঙচুরে হিন্দু যুবক গ্রেফতারের ঘটনা সাম্প্রতিক দাবিতে প্রচার 
বাংলাদেশের দুর্গাপূজায় মূর্তি ভাংচুরের দৃশ্য।এটি মূলত ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর চাঁদপুরের ঘটনা। দুর্গাপূজার মূর্তি ভাঙচুরের সাম্প্রতিক সময়ের ছবি দাবিতে পুরোনো ছবি প্রচার 
পূজা মণ্ডপে ইসলামিক গানের ভিডিওটি এডিটেড।এডিটেড নয়, ভিডিওটি আসল।চট্টগ্রামের পূজামণ্ডপে ইসলামি গানের ভিডিওটি এডিটেড নয়, আসল 
প্রতীমার সামনে মুসলিম ব্যক্তিদের মোনাজাতের ছবি। ছবিটি এডিটেড বা সম্পাদিত। পূজামণ্ডপের সামনে মোনাজাতের সম্পাদিত ছবি দিয়ে সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার 
প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে মুসলিম ব্যক্তিরা ইসলামিক বাণী প্রচার করছেন। ২০২৩ সালে ভারতে পূজার সময়ে দেওবন্দের লোকেরা আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার ভিডিও।প্রতিমার সামনে ইসলামিক বাণী প্রচারের ভিডিওটি বাংলাদেশের নয়, ভারতের 
পূজা মণ্ডপে শিবিরের বাকবিতণ্ডার ভিডিও।ভিডিওটি ভারতের কলকাতার।ভারতের পূজামণ্ডপে বাগবিতণ্ডার ভিডিও বাংলাদেশের দাবিতে প্রচার 
বাংলাদেশের পূজা মণ্ডপে একজন নারী শিল্পীর “দে দে পাল তুলে দেন” গান পরিবেশনের ভিডিও।ভিডিওটি ভারতের ব্যাঙ্গালোরের ২০১৮ সালের।দুর্গাপূজার মঞ্চে সংগীত পরিবেশনের এই ভিডিওগুলো ভারতের 
১০বাংলাদেশে পূজার মঞ্চে গানের একটি দল দে দে পাল তুলে গান পরিবেশন করা হয়েছে।ভিডিওটি সাম্প্রতিক সময়েরই তবে ভারতের কলকাতার।দুর্গাপূজার মঞ্চে সংগীত পরিবেশনের এই ভিডিওগুলো ভারতের 
১১পূর্বে দুর্গাপূজার সময় বাংলাদেশ থেকে ভারতে উপহার (বিনামূল্যে) হিসেবে ইলিশ পাঠানো হতো।রপ্তানি পণ্য হিসেবেই ইলিশ পাঠানো হতো।পূর্বে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ইলিশ উপহার (বিনামূল্যে) হিসেবে নয়, রপ্তানি পণ্য হিসেবেই যেত 
১২বোরখা পরে হিন্দু মেয়ে দুর্গাপূজা করতে এসেছে।এটি ভারতীয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের স্ক্রিপ্টেড ভিডিও। সাজানো ভিডিওকে দুর্গাপূজার সত্য ঘটনা দাবিতে প্রচার 
১৩মুসলিম ব্যক্তির মন্ডপে প্রনামের ভিডিও।ভিডিওটি ভারতের।মণ্ডপে মুসলিম ব্যক্তির প্রণামের ঘটনাটি বাংলাদেশের নয়, ভারতের 
১৪দুর্গাপূজা থেকে ফেরার পথে দুই হিন্দু মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে।‘বিষাক্ত মদপানে’ তাদের মৃত্যু হয়েছে।ফরিদপুরে বিষাক্ত মদপানে দুই হিন্দু তরুণীর মৃত্যুকে সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড দাবিতে প্রচার 
১৫বরিশালে প্রতিমা ভাঙচুরের পরে ব্যানারের মাধ্যমে পূজা উদযাপন করা হয়েছেমণ্ডপে হামলা ভাঙচুর হয়নি। প্রতিমা বানানো-ই হয়নি।বরিশালে প্রতিমা ভাঙচুরের পর ব্যানারের মাধ্যমে পূজা উদযাপনের তথ্যটি গুজব 

দুর্গাপূজা সংক্রান্ত অপতথ্যগুলোর প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি অপতথ্যের প্রচারে ভারতের পুরোনো ও সাম্প্রতিক ঘটনাকে বাংলাদেশের দুর্গাপূজার সময়ের ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন পাঁচটি ঘটনার দুইটি কলকাতার সাম্প্রতিক দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানের, একটি আসামের সাম্প্রতিক দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানের, একটি ব্যাঙ্গালোরের ২০১৮ সালের দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানের এবং একটি ২০২৩ সালে কানপুরের ভিডিও। এছাড়া ভারতের একটি স্ক্রিপ্টেড বা সাজানো ঘটনাকে বাস্তব ঘটনা দাবিতেও প্রচার করা হয়েছে। বাংলাদেশের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এই দাবি প্রচারে কোনো স্থান উল্লেখ না থাকায় নেটিজেনরা ঘটনাটি বাংলাদেশের বলেই ভেবে নিচ্ছেন; যা বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। 

Table: Rumor Scanner 

এবারের পূজায় ছড়ানো অপতথ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে এমন ঘটনার একটি ঘটেছিল চট্টগ্রামে। গত ১০ অক্টোবর রাতে শহরের জেএম সেন হলের পূজামণ্ডপে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ইসলামি ভাবধারার সংগীত পরিবেশনের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনা নিয়ে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তা দ্রুত ভাইরাল হয় এবং ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। অনেকেই ভিডিওটি নিয়ে সমালোচনা করলেও, কিছু মানুষ এর সত্যতা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, মূল ভিডিওতে ভিন্ন ধরনের গান পরিবেশিত হয়েছিল, যা পরে এডিট বা সম্পাদনা করে ইসলামি সংগীত যুক্ত করা হয়েছে। 

Collage: Rumor Scanner

রিউমর স্ক্যানার বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করে দেখেছে, গান পরিবেশনের ভিডিওটি এডিটেড নয় বরং আসল। চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির ব্যানারে ওই রাতে ছয়জন যুবক পূজামণ্ডপের অনুষ্ঠানে দুটি গান পরিবেশন করেন। এর মধ্যে একটি ছিল আলোচিত ‘শুধু মুসলমানের লাগি’ নামের গান এবং অন্যটি একটি বাউল গান।

এছাড়া পূজামণ্ডপে পাঞ্জাবি-টুপি পরা কয়েকজন ব্যক্তি মোনাজাত করছেন এমন একটি ছবি নিয়েও সামাজিক মাধ্যমে বেশ সমালোচনা হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। 

Collage: Rumor Scanner 

তবে যাচাই করে দেখা যায়, ২০২৩ সালে কয়েকজন আলেমের চরমোনাই হুজুরের কবরের সামনে করা দোয়ার একটি ছবিকে সম্পাদনা করে পূজামণ্ডপের ছবিতে প্রতিস্থাপন করে এই অপপ্রচার চালানো হয়েছে।  

আরও পড়ুন

spot_img