যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক এমপি মন্ত্রীদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং পুনরায় নির্বাচনের দাবিতে ভুয়া তথ্য প্রচার 

গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে সর্বোচ্চ ২২২টি সংসদীয় আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তবে গত ১৮ জানুয়ারি ভিডিও শেয়ারিং প্লাটফর্ম ইউটিউবে “এমপি মন্ত্রীদের ভিসায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। নতুন নির্বাচনের দাবি যুক্তরাষ্ট্রের। Political Analysis” শীর্ষক শিরোনাম এবং “এমপি মন্ত্রীদের ভিসায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নতুন নির্বাচনের দাবি যুক্তরাষ্ট্রের” শীর্ষক থাম্বনেইলে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। 

ভিসা নিষেধাজ্ঞা

ইউটিউবে প্রচারিত এমন একটি ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ইউটিউবের লিংক শেয়ার করে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া অবধি ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিওটি দেখা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৮৪ হাজার বার। ভিডিওটিতে প্রায় ২ হাজার ৩০০ পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক এমপি মন্ত্রীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় নির্বাচনের দাবিও করেনি বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্তদের নাম প্রকাশ করা হয়না। প্রকৃতপক্ষে ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় ভিন্ন ঘটনার একাধিক ছবি ও একটি ভিডিও ক্লিপের সাথে বানোয়াট দাবি যুক্ত করে আলোচিত দাবি সম্বলিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।

দাবিগুলো নিয়ে অনুসন্ধানের শুরুতেই আলোচিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম৷ উক্ত ভিডিওতে কলাম লেখক ডঃ জাহেদ উর রহমান এর একটি ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। কিন্তু ভিডিওর কোথাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক এমপি মন্ত্রীদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা কিংবা পুনরায় নির্বাচনের দাবি সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা দৃশ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। 

আলোচিত ভিডিওটিতে থাকা ডঃ জাহেদ উর রহমানের ভিডিওটির অনুসন্ধানে ‘Zahed’s Take’ নামক ইউটিউব চ্যানেলে গত ১৮ জানুয়ারি ‘আমেরিকা ইউরোপ কি চলে গেল সরকারের পক্ষে? Zahed’s Take। জাহেদ উর রহমান। Zahed Ur Rahman’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। এই ভিডিওটিই আলোচিত ভিডিওটিতে যুক্ত করা হয়েছে। 

Video Comparison : Rumor Scanner 

ভিডিওতে ডঃ জাহেদ উর রহমান যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের মধ্যকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গণমাধ্যম প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদন পাঠ করে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন। 

পরবর্তীতে দাবিতে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক এমপি মন্ত্রীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে অনুসন্ধানে কালবেলার ওয়েবসাইটে ২০২৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর  “বাংলাদেশে ভিসা নিষেধাজ্ঞা শুরু করেছে আমেরিকা” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার ওইদিন এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছেন বলে জানা যায়। তবে উক্ত বিবৃতিতে কোনো ব্যক্তির নাম প্রকাশ করা হয়নি। 

উক্ত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশের বিষয়ে অনুসন্ধানে দৈনিক যুগান্তরে গত ২৪ সেপ্টেম্বর “যে কারণে ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্তদের নাম প্রকাশ করে না যুক্তরাষ্ট্র” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।

উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কেন ভিসা নিষেধাজ্ঞা ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করা হয় না- এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু বলেন, ভিসানীতির আওতায় ভিসা নিষেধাজ্ঞা যাদের দেওয়া হবে, তাদের নাম প্রকাশ করা হয় না। কারণ কাউকে ভিসা না দেওয়াসহ যে কোনো ভিসা রেকর্ড মার্কিন আইন অনুযায়ী গোপনীয় তথ্য। তিনি আরও বলেন, সাক্ষ্যপ্রমাণ ভালোভাবে পর্যালোচনা করার পর আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

বর্তমান সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সম্পর্কের বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।

চিঠিতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারত্বের পরবর্তী অধ্যায় শুরুর পর্বে আমি বলতে চাই, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, মানবিক সহায়তা, বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ আরও অনেক ইস্যুতে আমাদের প্রশাসন একসঙ্গে কাজ করার ঐকান্তিক ইচ্ছা আমি তুলে ধরছি।’

জো বাইডেন বলেছেন, ‘সমস্যা সমাধানে একসঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের দীর্ঘ ও সফল ইতিহাস রয়েছে। আর আমাদের এই সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে দুই দেশের জনগণের শক্তিশালী সম্পর্ক।’

জো বাইডেন তাঁর চিঠিতে আরো লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সমর্থন এবং একটি অবাধ ও মুক্ত ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অভিন্ন স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এর আগে গত ৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার এক বিবৃতিতে বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণ ও গণতন্ত্রের প্রতি তাদের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করে। যুক্তরাষ্ট্র দেখেছে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বেশিরভাগ আসনেই জয়লাভ করেছে।

বিবৃতি তিনি আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের হাজারো সদস্যদের গ্রেপ্তার ও নির্বাচনের অনিয়মের খবরে উদ্বিগ্ন। অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র একমত যে, এই নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু হয়নি এবং সব দল এতে অংশ না নেওয়ায় আমরা হতাশ।”

পরবর্তীতে, গত ১৮ জানুয়ারি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বের অবস্থান পুনব্যক্ত করে বলেন,বিরোধী রাজনৈতিক হাজারো নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার এবং নির্বাচনের দিন অনিয়মের খবরে তাঁরা এখনো উদ্বিগ্ন। তাঁরা অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে এই মত পোষণ করেন যে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় তাঁরা দুঃখিত। নির্বাচনের সময় ও পরবর্তী সময়ে সংঘটিত সহিংসতার নিন্দা জানান তাঁরা।

তবে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এসব বক্তব্য-বিবৃতির কোথাও নির্বাচন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পুনরায় নির্বাচনের দাবি কিংবা এমপি মন্ত্রীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার দাবি সম্বলিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

মূলত, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার ২০২৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে তাদেরকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে বলে প্রচার হয়ে আসছে। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি “এমপি মন্ত্রীদের ভিসায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নতুন নির্বাচনের দাবি যুক্তরাষ্ট্রের” শীর্ষক দাবিতে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়। ভিডিওটি নিয়ে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত দাবিগুলো সঠিক নয়। বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে একাধিকবার দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন অবধি এমপি মন্ত্রীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কোনো তথ্য বা তালিকা প্রকাশ করেনি। এছাড়া, পুনরায় নির্বাচনের দাবিও জানায়নি যুক্তরাষ্ট্র। 

উল্লেখ্য, পূর্বেও বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রচারের প্রেক্ষিতে একাধিক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। এমন কয়েকটি প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক এমপি মন্ত্রীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং দেশটি কর্তৃক পুনরায় নির্বাচনের দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত তথ্যগুলো মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img