সম্প্রতি ‘নির্বাচন কমিশনকে আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে’ শীর্ষক দাবিতে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমনকিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি বরং গত ২৪ মে বাংলাদেশকে নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টোনি ব্লিঙ্কেনের করা একটি টুইটের তথ্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে এই দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।
গুজবের সূত্রপাত
অনুসন্ধানের শুরুতে নির্বাচন কমিশনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম।

ভিডিওটিতে প্রদর্শিত ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ‘ইউএস ফরেইন সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেন উনি আজকে টুইট করেছেন বিশেষ ল আনছে তারা, ভিসা রেস্ট্রিকশন আনছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনারদেরকে নিয়ে।’
তবে এই ভিডিওটি প্রকাশের তারিখে(২২ জুলাই) মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টোনি ব্লিঙ্কেনের অফিশিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে এ সম্পর্কিত কোনো টুইট খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তবে প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড অনুসন্ধানে এই ভিডিওটির দীর্ঘ সংস্করণ বা মূল ভিডিওটি Mo Rahman Masum নামের একটি ফেসবুক (আর্কাইভ) পেজে গত ২৪ মে খুঁজে পাওয়া যায়।

ভিডিওটিতে প্রদর্শিত এই ব্যক্তি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টোনি ব্লিঙ্কেনের একটি টুইটের বিষয়ে উল্লেখ করেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টোনি ব্লিঙ্কেনের টুইটে কী আছে
উপরোক্ত ভিডিওটি প্রকাশের তারিখে অর্থাৎ গত ২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টোনি ব্লিঙ্কেনের অফিশিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশের নতুন ভিসানীতি নিয়ে প্রকাশিত একটি টুইট খুঁজে পাওয়া যায়।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টোনি ব্লিঙ্কেন নতুন ভিসানীতির ঘোষণায় টুইট বার্তায় বলেন, নতুন নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র।
পরবর্তীতে প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে গত ২৫ মে ‘বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। গত ২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এক বিবৃতিতে এ ঘোষণা দিয়েছেন।
এছাড়াও, মার্কিন ভিসা নীতির ঘোষণা নিয়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের ওয়েবসাইটে গত ২৪ মে প্রকাশিত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আজ, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যকে সহায়তা করতে, আমি ইমিগ্রেশন এন্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের ধারা 212(a)(3)(C) (“3C”) এর অধীনে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করছি। এই নীতির অধীনে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপে সক্ষম হবে। এর মধ্যে বর্তমান ও প্রাক্তন বাংলাদেশি কর্মকর্তা/কর্মচারী, সরকারপন্থি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী , বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গত ৩ মে, ২০২৩ তারিখে বাংলাদেশ সরকারকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে।
গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজের মধ্যে রয়েছে: ভোট কারচুপি , ভোটারদের ভয় দেখানো , সহিংসতার মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত হবার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দেয়া, এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখা। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ভোটার, রাজনৈতিক দল, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমসহ সকলের। যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায় তাদের সকলকে আমাদের সমর্থন দিতে আমি এই নীতি ঘোষণা করছি।’
তাছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন ভিসা নীতি ঘোষণার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মূলধারার ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম চ্যানেল আই এর টকশো অনুষ্ঠান তৃতীয় মাত্রায় লাইভে যুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থাপক জিল্লুরের প্রশ্নের জবাবে ডোনাল্ড লু বলেন, “আমি একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, আজ আমরা কাউকে স্যাংশন দিচ্ছি না। সেক্রেটারি অফ স্টেট একটি নতুন নীতির ঘোষণা করেছেন, যা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেই সব ব্যক্তির ভিসা সুবিধায় বিধি–নিষেধ আরোপ করতে পারবে, যারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”
পাশাপাশি, নির্বাচন কমিশনের ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি অধিকতর যাচাইয়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের ওয়েবসাইট (U.S. DEPARTMENT OF THE TREASURY), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ওয়েবসাইট (USA gov) এবং বাংলাদেশস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এর ওয়েবসাইট পর্যবেক্ষণ করে এ ধরণের নিষেধাজ্ঞা বা তথ্যের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ, উপরোক্ত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের যুক্তরাষ্ট্র ভিসা না দেওয়ার ঘোষণা দিলেও সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন কমিশন বা বাংলাদেশের কারো ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র তাদের নতুন ভিসা নীতির ঘোষণায় কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, দল বা সংগঠনের কথা উল্লেখ করেনি।
মূলত, গত ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ আসনে সংসদ সদস্যের শূন্য পদে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন চলাকালে বনানীতে এক ভোটকেন্দ্রের বাহিরে নৌকার ব্যাজ পরিহিত লোকদের হাতে মারধরের শিকার হন নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম। উক্ত বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই সম্প্রতি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দাবি করে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত দাবিটি সঠিক নয় বরং গত ২৪ মে বাংলাদেশকে নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টোনি ব্লিঙ্কেনের করা একটি টুইটের তথ্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে উক্ত দাবিটি প্রচার করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন কমিশন বা বাংলাদেশের কারো ওপরই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি।
প্রসঙ্গত, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাব ও বাহিনীটির ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
উল্লেখ্য, পূর্বেও রাষ্ট্রপতিসহ বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দাবিতে ভুয়া তথ্য প্রচার করা হলে সেগুলো শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে
সুতরাং, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- U.S. DEPARTMENT OF THE TREASURY
- USA gov
- Prothom Alo: বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র
- বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস
- Bd US Embassy: বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন উৎসাহিত করতে ভিসা নীতির ঘোষণা
- Zillur Rahman Faebook: Doland Lu Statement on Tritiyo Matra
- BBC News: র্যাব ও তার ছয় কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লংঘনের দায়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ
- Secretary Antony Blinken: Tweet
- Rumor Scanner’s Own Analysis