সম্প্রতি, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সহ ১৪ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দাবিতে একটি ভিডিও ইউটিউবে প্রচার করা হয়েছে।
ইউটিউব এ প্রচারিত এমন কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সহ বাংলাদেশের কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়নি বরং অধিক ভিউ পাবার আশায় চটকদার শিরোনাম ও থাম্বনেইল ব্যবহার করে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্যসূত্র ছাড়াই ভিত্তিহীনভাবে দাবিগুলো প্রচার করা হচ্ছে।
গত ৪ আগষ্ট Sabai Sikhi নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ডিবি হারুন সহ ১৪ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দাবি করে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়।

অনুসন্ধানের শুরুতে ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। এতে দেখা যায়, এটি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার কয়েকটি ছবি ও ভিডিও ক্লিপ নিয়ে তৈরি একটি নিউজ ভিডিও। যেখানে পুরাতন কিছু ভিডিও ক্লিপের সাথে ভিন্ন ভিন্ন সময়ের পুরাতন কিছু ছবি দেখা যায়। রিউমর স্ক্যানার ছবি এবং ভিডিওগুলো যাচাই করে দেখেছে যেগুলোর সাথে প্রচারিত দাবির কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।
প্রথম ভিডিও ক্লিপ যাচাই
১ মিনিট ১৭ সেকেন্ডের এই ভিডিওটির শুরুতে থাকা ভিডিও ক্লিপটি প্রথমে বিশ্লেষণ করা হয়। ভিডিওটিতে বলা হয়,’মানবাধিকার ইস্যুতে এবার সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে চিঠি চালাচালি চলছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে। ইইউ এর ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেফ বোরেল কে লেখা চিঠিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহবান জানানো হয়েছে।’

অর্থাৎ এই ভিডিও ক্লিপটিতে থাকা বিষয়বস্তুর সাথে ক্যাপশন ও থাম্বনেইলে থাকা দাবির কোনো প্রকার মিল নেই।
দ্বিতীয় ভিডিও ক্লিপ যাচাই
প্রচারিত দাবিটির পরবর্তী ভিডিও ক্লিপটির কিছু স্থিরচিত্র রিভার্স সার্চের মাধ্যমে ২০২১ সালের ১১ ডিসেম্বর মূলধারার গণমাধ্যম একাত্তর টিভি’র ইউটিউব চ্যানেলে ‘র্যাবের সাবেক ও বর্তমান ডিজিসহ সাত কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতায়‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটির সাথে আলোচিত ভিডিও ক্লিপটির হুবহু মিল পাওয়া যায়।

কিন্তু উক্ত প্রতিবেদনের সাথে আলোচিত দাবিটির কোনো প্রকার মিল পাওয়া যায়নি।
পাশাপাশি, দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এখন পর্যন্ত সম্প্রতি ডিবি হারুন কিংবা কোনো পুলিশ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তবে প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে গত ২৫ মে ‘বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। গত ২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এক বিবৃতিতে এ ঘোষণা দিয়েছেন।
মার্কিন ভিসা নীতির ঘোষণা নিয়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের ওয়েবসাইটে গত ২৪ মে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আজ, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যকে সহায়তা করতে, আমি ইমিগ্রেশন এন্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের ধারা 212(a)(3)(C) (“3C”) এর অধীনে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করছি। এই নীতির অধীনে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপে সক্ষম হবে। এর মধ্যে বর্তমান ও প্রাক্তন বাংলাদেশি কর্মকর্তা/কর্মচারী, সরকারপন্থি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী , বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গত ৩ মে, ২০২৩ তারিখে বাংলাদেশ সরকারকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে।
গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজের মধ্যে রয়েছে: ভোট কারচুপি , ভোটারদের ভয় দেখানো , সহিংসতার মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত হবার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দেয়া, এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখা।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ভোটার, রাজনৈতিক দল, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমসহ সকলের। যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায় তাদের সকলকে আমাদের সমর্থন দিতে আমি এই নীতি ঘোষণা করছি।’
পরবর্তীতে একই বিষয় নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্টোনি ব্লিঙ্কেনের টুইটার অ্যাকাউন্টে গত ২৪ মে প্রকাশিত একটি টুইট বার্তাও খুঁজে পাওয়া যায়।

তাছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন ভিসা নীতি ঘোষণার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মূলধারার ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম চ্যানেল আই এর টকশো অনুষ্ঠান তৃতীয় মাত্রায় লাইভে যুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থাপক জিল্লুরের প্রশ্নের জবাবে ডোনাল্ড লু বলেন, “আমি একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, আজ আমরা কাউকে স্যাংশন দিচ্ছি না। সেক্রেটারি অফ স্টেট একটি নতুন নীতির ঘোষণা করেছেন, যা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেই সব ব্যক্তির ভিসা সুবিধায় বিধি–নিষেধ আরোপ করতে পারবে, যারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”
এছাড়াও, ডিবি হারুন সহ ১৪ জন পুলিশ কর্মকর্তার ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি অধিকতর যাচাইয়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের ওয়েবসাইট (U.S. DEPARTMENT OF THE TREASURY), যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ওয়েবসাইট (USA gov) এবং বাংলাদেশস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এর ওয়েবসাইট পর্যবেক্ষণ করে এ ধরণের নিষেধাজ্ঞা বা তথ্যের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের টুইটার অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশের কারো উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গত ২৪ জুলাই ম্যাথিউ মিলার বলেন, যাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, যুক্তরাষ্ট্র তাদের নাম প্রকাশ করে না। তবে নিষেধাজ্ঞায় পড়া অফিসিয়াল বা সরকারি ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করে।

যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র যাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, তাদের মধ্যে অফিসিয়াল বা সরকারি ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো নাম প্রকাশ করে না সেহেতু ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সহ ১৪ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিলে দেশটি নাম প্রকাশ করতো। অর্থাৎ তাদের আমেরিকার ভিসা বাতিলের দাবিটি কোনো ধরনের তথ্যসূত্র ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হচ্ছে।
অর্থাৎ, উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের যুক্তরাষ্ট্র ভিসা না দেওয়ার ঘোষণা দিলেও সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ কিংবা কোনো পুলিশ সদস্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি যুক্তরাষ্ট্র।
মূলত, সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সহ ১৪ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দাবি করে একটি ভিডিও ইউটিউবে প্রচার করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার ছবি ও খণ্ড খণ্ড ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার করে ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় তৈরি করা হয়েছে। কোনোপ্রকার গ্রহণযোগ্য তথ্য প্রমাণ ছাড়াই উক্ত দাবিটি প্রচার করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ডিএমপির ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদসহ ১৪ পুলিশ কর্মকতার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি।
প্রসঙ্গত, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাব ও বাহিনীটির ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
উল্লেখ্য, Sabai Sikhi নামের ইউটিউব চ্যানেলটিতে এর আগেও বেশ কয়েকটি মিথ্যা এবং গুজব নিয়ে তৈরি ভিডিও’র অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। যেগুলো নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
তাছাড়া, পূর্বেও রাষ্ট্রপতিসহ বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দাবিতে ভুয়া তথ্য প্রচার করা হলে সেগুলো শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
সুতরাং, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সহ ১৪ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Ekattor TV: র্যাবের সাবেক ও বর্তমান ডিজিসহ সাত কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতায়
- U.S. DEPARTMENT OF THE TREASURY
- USA gov
- Prothom Alo: বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র
- বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস
- Bd US Embassy: বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন উৎসাহিত করতে ভিসা নীতির ঘোষণা
- Zillur Rahman Faebook: Doland Lu Statement on Tritiyo Matra
- BBC News: র্যাব ও তার ছয় কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লংঘনের দায়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ
- Secretary Antony Blinken: Tweet
- Rumor Scanner’s Own Analysis