সম্প্রতি, “বিটিএসের জিমিনের মতো হতে অস্ত্রোপচার, মারা গেলেন অভিনেতা” শীর্ষক শিরোনাম সহ সমজাতীয় বিভিন্ন শিরোনামে একটি সংবাদ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক একাধিক গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।
যা দাবি করা হচ্ছে
- কানাডীয় অভিনেতা সেইন্ট ভন কলুচি বিটিএস ব্যান্ডের সদস্য জিমিনের একজন ভক্ত। তাই তিনি নিজের চেহারাকে জিমিনের মতো করতে প্লাস্টিক সার্জারির সহায়তা নেন।
- নিজের চেহারা জিমিনের মতো করতে মোট ১২ বার অস্ত্রোপচার করেন এবং প্রায় আড়াই কোটি টাকা খরচ হয়। গত নভেম্বরে কলুচির চেহারায় জিমিনের মতো চোয়াল প্রতিস্থাপনের কথা ছিলো। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থা ভালো না থাকায় সার্জারি করা হয়নি।
- অবশেষে ২২ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ার একটি হাসপাতালে চোয়াল প্রতিস্থাপনের জন্য অস্ত্রোপচার করা হলে তাঁর শরীরে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া শুরু হলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ২৩ এপ্রিল সকালে মারা যান তিনি।
সংবাদটি দেশীয় গণমাধ্যমে
উক্ত দাবিতে সংবাদ প্রকাশ করেছে এমন দেশীয় গণমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার, সময় টিভি, বিডিনিউজ২৪, আজকের পত্রিকা, কালের কণ্ঠ, প্রতিদিনের বাংলাদেশ (ইউটিউব), চ্যানেল আই, দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস, আরটিভি, ঢাকা মেইল, যুগান্তর, ঢাকা টাইমস, ঢাকা পোস্ট, জুম বাংলা, ডেইলি বাংলাদেশ, ডেইলি মেসেঞ্জার, ডেলটা টাইমস, বাহান্ন নিউজ, বায়ান্ন.কম, মর্নিং টাইমস, ঢাকা টুডে।
সংবাদটি ভারতীয় গণমাধ্যমে
ভারতীয় গণমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস, এনডি টিভি, ইকোনোমিক টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া টুডে, টাইমস নাও নিউজ, বিজনেস টুডে, দ্য প্রিন্ট, কইমই, লেটেস্টলি, ট্রিবিউন ইন্ডিয়া, বলিউড লাইফ, আনন্দবাজার, স্পোর্টসকিডা, মাতৃভুমি। এছাড়াও glamsham, ট্রেন্ডদেখো, rozanaspokesman (পাঞ্জাবী ভাষায়)
সংবাদটি বিদেশী ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে, টিএমজি (আমেরিকা), খালিজ টাইমস (আরব আমিরাত), ইনডিপেন্ডেন্ট (যুক্তরাজ্য), মেট্রো (যুক্তরাজ্য), মালয় মেইল (মালয়েশিয়া), গিসট্রেল (আফ্রিকা) , রিপাবলিক নিউজ (যুক্তরাষ্ট্র), মিরর (যুক্তরাজ্য), গল্ফ নিউজ (আরব আমিরাত), ডেইলি ট্রাস্ট (নাইজেরিয়া), পাঞ্চ (নাইজেরিয়া), ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস (সিঙ্গাপুর), নিউ ইয়র্ক পোস্ট এর পেজ সিক্স (যুক্তরাষ্ট্র), এসিই শোবিজ (যুক্তরাষ্ট্র), breezyscroll (যুক্তরাষ্ট্র), নেপালনিউজ (নেপাল), thanhnien (ভিয়েতনাম), vietnamnet (ভিয়েতনাম), showbuzz.dnevnik.hr (ক্রোয়েশিয়া), Rzeczpospolita (পোল্যান্ড)। এছাড়াও, ভারতীয় অখ্যাত পোর্টালের বরাতে আইএমডিবি এর নিউজ সেকশনেও এটি প্রকাশিত হয়েছিল।
কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যম আলোচিত দাবিটি তাদের সাইটে প্রকাশ করলেও সেগুলোর আর্কাইভ লিংক খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কানাডার টরোন্টো সান, দক্ষিণ কোরিয়ার newsis.com, ভারতীয় WION এবং নিউজ ১৮ গণমাধ্যম গুলো সংবাদ উক্ত দাবিতে সংবাদ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সেগুলো পরবর্তীতে তারা ডিলিট করে দিয়েছে। এ সংবাদ চারটির কোনো সরাসরি আর্কাইভ লিংক পাওয়া যায়নি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের নিজেদের পেজ থেকে প্রকাশ করা কিছু পোস্ট দেখুন প্রথম আলো (ফেসবুক), বিডিনিউজ২৪ (ফেসবুক), সময় টিভি (ফেসবুক), কালের কণ্ঠ (ফেসবুক), চ্যানেল আই (ফেসবুক), ডেইলি ক্যাম্পাস (ফেসবুক), প্রতিদিনের বাংলাদেশ (ফেসবুক), দ্য ফ্রন্ট পেজ (ফেসবুক)।
ইউটিউবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের নিজেদের চ্যানেল থেকে প্রকাশ করা কিছু পোস্ট দেখুন ঢাকা পোস্ট (ইউটিউব)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বিটিএস ব্যান্ড এর সদস্য জিমিনের মতো হতে অস্ত্রোপচার করে কানাডীয় অভিনেতা সেইন্ট ভন কলুচির মৃত্যুর ঘটনাটি সত্য নয় বরং এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দ্বারা তৈরি কল্পিত এক অভিনেতার গল্প এবং একইসাথে তার ছবি দাবিতে প্রচারিত ছবিও প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি।
যেভাবে গল্পটি শুরু
গত ২৪ এপ্রিল যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গণমাধ্যম ‘The Daily Mail’-এ “EXCLUSIVE: Canadian actor, 22, dies after spending $220,000 on TWELVE plastic surgeries to play BTS’s KPOP star Jimin for upcoming US drama” শীর্ষক শিরোনামে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম ডেইলি মেইল থেকে সূত্র নিয়ে তথ্যটি প্রচার করা শুরু করে। পরবর্তীতে ডেইলি মেইল এই নিউজটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। প্রত্যাহার নিয়ে কানাডার iheartradio এর প্রতিবেদন দেখুন এখানে।
পরবর্তীতে, ডেইলি মেইলের সম্পাদক জানিয়েছেন যে আলোচিত নিউজটির প্রতিবেদক সাংবাদিক রুথ বাশিনস্কির সাথে প্রতারণা করা হয়েছে এবং এটি একটি ভুয়া খবর ছিল।
অনুসন্ধান
কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে গত ২৮ এপ্রিল ‘Al Jazeera’ তে “Reports said actor died after surgery to look Korean. Was he AI?” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, সেইন্ট ভন কলুচি (চরিত্রটি) প্রকৃতপক্ষে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে সাজানো একটি (গল্প) প্রতারণার অংশ। এই প্রতারণামূলক গল্প দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্য, ভারত ও মালয়েশিয়ার বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বোকা বানানো হয়েছে।
পাশাপাশি, গত ২৮ এপ্রিল আমেরিকা ভিত্তিক ম্যাগাজিন ‘Variety’ তে “Reports of Actor ‘Saint Von Colucci’ Dying of Cosmetic Surgeries to Resemble BTS Singer Jimin Appear to Be Elaborate Hoax That Used AI” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়, “কানাডিয়ান অভিনেতা সেইন্ট ভন কলুচি বিটিএস গায়ক জিমিনের মতো হতে চাওয়ার ঘটনাটি কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করে প্রতারণা করা হয়েছে।”
এছাড়াও, থাইল্যান্ডের গণমাধ্যম “ম্যানেজার ডেইলি” এর “‘Godfather of AI’ resigns from Google, warns of AI dangers (অনূদিত)” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “গত সপ্তাহে প্র্যাঙ্কস্টাররা ডেইলি মেইল এবং দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট সহ সারা বিশ্বের মিডিয়া আউটলেটগুলিকেও প্রতারিত করেছে। ডেইলি মেইল কথিত কানাডিয়ান অভিনেতা “সেইন্ট ভন কলুচি” সম্পর্কে একটি গল্প প্রকাশ করে এবং পরবর্তীতে মুছে দেয়.”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে গত ২৫ এপ্রিল আলোচিত ঘটনাস্থল (দাবি) সেই দক্ষিণ কোরিয়ার-ই ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ‘Raphael Rashid’ (যিনি আল জাজিরাতেও লিখেন) এর একটি টুইট পাওয়া যায়। সেখানে তিনি সেইন্ট ভন কলুচি ঘটনাটি মিথ্যা উল্লেখ করেন।
‘Raphael Rashid’ এর টুইটের থ্রেড থেকে জানা যায়, “সেইন্ট ভন কলুচির জনসংযোগ দপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি বিভ্রান্তিকর ছিলো।”
দাবির সাথে যতগুলো ছবি প্রচার করা হয়েছে
আলোচ্য দাবির সাথে এবং সেইন্ট ভন কলুচির ছবি দাবিতে বেশ কয়েকটি ছবি প্রচার করা হয়েছে।
তবে ছবিগুলোর কোনোটিতেই তার মুখমন্ডলের ছবি স্পষ্ট না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছবিগুলো এআই সহ বিভিন্ন প্রযুক্তিগত উপায়ে তৈরি করা বলে ডিবাঙ্ক করা প্রতিবেদন (১, ২, ৩) ও পোস্ট থেকে জানা গেছে। কিছু ছবির ক্ষেত্রে উৎস-ই শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
অধিকাংশ ছবির উৎস কলুচির নামে খোলা একটি ইনস্টাগ্রাম একাউন্ট। যেটি এখন আর সচল নেই।
‘Raphael Rashid’ এর একই টুইটের থ্রেড-এ আরো জানানো হয়, “সেইন্ট ভন কলুচির ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দ্বারা তৈরি।”
বানোয়াট তথ্যটি প্রচারে প্রেস রিলিজের আশ্রয়
আল জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, “বানোয়াট গল্পটি এই সপ্তাহের শুরুতে শুরু হয়েছিল যখন বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকরা একটি প্রেস রিলিজ পেয়েছিলেন যাতে ঘোষণা করা হয়েছিল যে ভন কলুচি ২৩ এপ্রিল সিউলের একটি হাসপাতালে মারা গেছেন। প্রেস রিলিজটি আনাড়ি-শব্দের ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল। HYPE নামক একটি পাবলিক রিলেশনস বা জনসংযোগ সংস্থার থেকে এটি পাঠানো হয়েছিল। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে অনেকগুলো অসঙ্গতি ছিল।” যেমনঃ
- নথিতে অনেক ওয়েব লিঙ্ক লোড হয় না। যার মধ্যে ভন কলুচির ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টের একটি লিঙ্ক রয়েছে সেটিও অকার্যকর
- প্রেস রিলিজে উল্লিখিত হাসপাতালের অস্তিত্ব নেই।
- HYPE-এর ওয়েবসাইট, যা লন্ডন এবং টরন্টোতে WeWork (কো-ওয়ার্কিং স্পেস প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা) সদর দফতর হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা অসমাপ্ত বলে মনে হচ্ছে এবং এটি ভন কলুচির মৃত্যুর প্রতিবেদনের কয়েক সপ্তাহ আগে নিবন্ধিত হয়েছিল।
- যখন আল জাজিরা উল্লিখিত নম্বরের মাধ্যমে HYPE-এ কল করার চেষ্টা করেছিল, তখন কেউ ফোন রিসিভ করেনি। আল জাজিরাকে পরে ঐ নম্বর থেকে একটি টেক্সট বার্তা পাঠানো হয়েছিল যাতে বলা হয়েছিল, “Wtf do u want”।
- বেশ কয়েকজন কে-পপ তারকাদের জন্য গান লেখা সত্ত্বেও (দাবি) ভন কলুচির একটি উল্লেখযোগ্য অনলাইন উপস্থিতি ছিল না এবং কেউ তার মৃত্যুতে প্রকাশ্যে শোক প্রকাশ করেনি।
- “T1K T0K H1GH SCH00L” অ্যালবাম সহ ভন কলুচির সঙ্গীতগুলো (দাবি) কোনো মূলধারার মিউজিক স্ট্রিমিং সাইটে পাওয়া যায়না৷
এছাড়াও একই প্রতিবেদনে আর একটি পুরোনো প্রেস রিলিজের বিষয়ে আরো কিছু অসঙ্গতির কথা তুলে ধরা হয়। যেমনঃ
- গত বছর প্রচারিত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে, ভন কলুচিকে “ইউরোপের শীর্ষ হেজ ফান্ড কোম্পানি আইবিজি ক্যাপিটালের সিইও জিওভানি লামাসের দ্বিতীয় পুত্র” হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল। কিন্তু জিওভানি লামাসের-ও অনলাইনে কোনো অফিসিয়াল উপস্থিতি পাওয়া যায়না। আর আইবিজি ক্যাপিটালের ক্ষেত্রে অনুসন্ধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা রাজ্যে অবস্থিত একটি বিনিয়োগ সংস্থা হিসেবে পাওয়া যায়, ইউরোপের নয়।
- কলুচির ইনস্টাগ্রাম একাউন্টটি এই সপ্তাহে পুনরায় সক্রিয় করা হয়েছিল, এবং তার মৃত্যুর দুই দিন পরে একটি মন্তব্য সম্পাদনা করা হয়েছিল। পরে মন্তব্যটি মুছে ফেলা হয়েছে।
- ইন্টারনেটে সেইন্ট ভন কলুচির মৃত্যুর সংবাদ প্রথম প্রকাশ করেছিল যে ডেইলি মেইল অনলাইন কোন ব্যাখ্যা বা প্রত্যাহার বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই বুধবার তার নিবন্ধটি নিঃশব্দে সরিয়ে নিয়েছে।
- আল জাজিরার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে সিউলে কানাডিয়ান দূতাবাস মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
- দক্ষিণ কোরিয়ার মিডিয়া জানিয়েছে যে, প্লাস্টিক সার্জারির জটিলতার কারণে মারা যাওয়া অভিনেতার সম্পর্কিত কোনো কেস রিপোর্ট পায়নি পুলিশ।
ভ্যারাইটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে,
- সাংবাদিকগণ “Nylas” নামক একটি বটের মাধ্যমে তাদের ইনবক্সে এই রিলিজগুলি পেয়েছেন। বটটি অনলাইন পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট MuckRack থেকে ইমেল ঠিকানাগুলি সংগ্রহ করেছে৷
- আর একটি প্রেস রিলিজ “GoPapaMedia” এর সাথে সংযুক্ত একটি PR থেকে পাঠানো হয়েছিল, যার ডোমেনটি কানাডার টরন্টোতে “সাইট লুচি” এর অধীনে নিবন্ধিত হয়েছিল।
- সেন্ট ভন কলুচির পরিচয় যাচাই করার জন্য দ্য হাইপ; পিআর-কে ভ্যারাইটি অসংখ্য ইমেল এবং কল করেছে কিন্তু কোনোটির-ই উত্তর দেওয়া হয়নি।
অনুসন্ধানে গত ৩ মে ‘Next Shark‘ নামক একটি ওয়েবসাইটে “সেন্ট ভন কলুচির পরিবার তার বিষয়ের তথ্যকে ‘ভিত্তিহীন’ হিসেবে প্রতিবেদন করায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করার পরিকল্পনা করছেন (অভিযোগ) [অনূদিত]” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
লজিক্যালি ফ্যাক্ট’স এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, “নেক্সটশার্ক উল্লেখ করেছে যে, যখন তারা আরও তথ্যের জন্য পিআর সংস্থাগুলির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল, তখন কেবল রুথম্যানের মেইল এড্রেসটিতে মেইল গিয়েছিল। বাকিগুলোর ক্ষেত্রে “মেইল ঠিকানা পাওয়া যায়নি” নোটিশ সহ মেইল ফেরত এসেছে।
সবচেয়ে বড় পয়েন্ট হলোঃ প্রেস রিলিজে সেন্ট ভন কলুচিকে ‘intubated’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একজন শিল্পীর পিআর বা ম্যানেজমেন্ট টিম কখনই এরকম শব্দ ব্যবহার করবে না বলে জানিয়েছেন সঙ্গীত এবং পপ সংস্কৃতি বিষয়ক ম্যাগাজিন রোলিং স্টোন এর ইন্ডিয়া সংস্করণের সহকারী সম্পাদক ঋদ্ধি চক্রবর্তী (ভ্যারাইটির সাথে তিনি এই মন্তব্যটি করেছেন)।”
অনুসন্ধানে আরো যে সকল বিষয়ে অসঙ্গতি
- ইন্টারনেটে কোথাও তার স্পষ্ট কোনো ছবিও পাওয়া যায়না। যেগুলো পাওয়া যায় কোনোটিতেই তার মুখচ্ছবি বোঝা যায় না।
- অধিকাংশ ক্ষেত্রে-ই বিভিন্ন দেশের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে উইকিপিডিয়া নিবন্ধ থাকলেও তিনি কানাডিয়ান (দাবি অনুযায়ী) অভিনেতা হওয়ার পরও তাকে নিয়ে উইকিপিডিয়ায় কোনো নিবন্ধ পাওয়া যায়নি।
- বিভিন্ন পোর্টালে তার ইনস্টাগ্রাম একাউন্ট (১, ২) দাবি করা হলেও সেগুলো এখন আর সচল নেই অথবা শুধুমাত্র ক্রিয়েট করেই রাখা হয়েছে। কোনো এক্টিভিটি নেই।
- একটি পোর্টালে তার ওয়েবসাইটের (saintvoncolucci.com) বিষয়ে উল্লেখ করা হলেও সেটিতেও প্রবেশ করা যায়না। এমনকি সাইটটির কোনো আর্কাইভও পাওয়া যায়না।
- বিভিন্ন প্রতিবেদনে সেইন্ট ভন কলুচির সহযোগী বা প্রচারক হিসেবে Eric Blake এর নাম পাওয়া গেলে তাকে বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ে রিউমর স্ক্যানারের পক্ষ থেকে তাকে মেসেজ করা হলেও তিনি এখনও রিপ্লাই করেননি।
- তার মৃত্যুর সংবাদ প্রচারের আগে অর্থাৎ ২৪ এপ্রিলের আগে (আর্কাইভ) ইন্টারনেটে einpresswire নামক একটি সাইটে সেইন্ট ভন কলুচিকে নিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলেও সেটি কর্তৃপক্ষ ডিলিট করে ফেলেছে।
অর্থাৎ, বিটিএস ব্যান্ড সদস্য জিমিনের মতো হতে কানাডিয়ান অভিনেতা সেইন্ট ভন কলুচির অস্ত্রোপচার করার পর মারা যাওয়ার ঘটনাটি বানোয়াট। সেইন্ট ভন কলুচি নামের কারো অস্তিত্ব পাওয়া যায়না এবং দাবির সাথে প্রচারিত ছবি-ও এআই জেনারেটেড। অনেক প্রতিষ্ঠান এখন বানোয়াট গল্পের বিষয়টি প্রচার হয়ে গেছে স্বীকার করে তাদের স্টোরি আপডেট করেছে।
কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা কি কোনো পূর্ব ঘটনা থেকে গল্পটি তৈরি করেছে
কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তাকে একদম নির্দিষ্ট ইনপুট না দিয়ে একটি গল্প তৈরি করতে বললে উভয় ধরণের ঘটনা-ই ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি একদম নতুন একটি গল্প তৈরি করতে পারে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরোনো কোনো গল্পকে নতুনভাবেও উপস্থাপন করতে পারে। ফলে প্রশ্ন তৈরি হয় আলোচিত দাবিটির অনুরূপ কোনো ঘটনা আগে থেকেই ইন্টারনেটে বিদ্যমান রয়েছে কিনা। এর উত্তর হলো হ্যাঁ।
অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম NBCNews-এ ২০২২ সালের ৩১শে আগষ্ট “ইনফ্লুয়েন্সার অলি লন্ডন বিটিএস তারকা জিমিনের মতো হওয়ার জন্য অপারেশন করার বিষয়টি নিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন (ভাবানুবাদ)” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “ব্রিটিশ প্রভাবশালী এবং ইউটিউবার অলি লন্ডন কোরিয়ান পপ আইডলের মতো দেখতে হওয়ার জন্য কয়েক ডজন অপারেশনের বিষয়ে তিনি বিটিএস তারকা জিমিন এবং এশিয়ান সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তারা ৩২টি অপারেশন করেছে, যার মধ্যে ছয়টি নাকের অস্ত্রোপচার, চোখের অস্ত্রোপচার এবং একটি কপাল লিফ্ট।”
মূলত, আলোচিত বানোয়াট ঘটনাটি বটসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সাংবাদিকদের ইমেইল সংগ্রহ করে ইমেইল ঠিকানাগুলোতে প্রেস রিলিজ আকারে পাঠানো হয়েছিল। এরপরে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। পরবর্তীতে ডেইলি মেইলের থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যমে দাবিটি ছড়িয়ে পড়ে। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায় উক্ত দাবিতে প্রচারিত সংবাদ গুলো সত্য নয় বরং সেইন্ট ভন কলুচির গল্পটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দ্বারা সাজানো একটি প্রতারণার অংশ। যদিও ডেইলি মেইল তাদের ভুল বুঝতে পেরে পরবর্তীতে সংবাদটি ডিলিট করে ফেলে।
উল্লেখ্য, ভারতীয় এক পোর্টালের বরাতে আইএমডিবি এর নিউজ সেকশনেও বানোয়াট এই খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল। একইভাবে গল্পটিকে বানোয়াট হিসেবে প্রমাণ করে প্রকাশিত প্রতিবেদনও আইএমডিবি-তে ভ্যারাইটির বরাতে প্রকাশ হয়েছিল। পাশাপাশি আমেরিকা ভিত্তিক সাইট টিএমজি, ভারতীয় সাইট “লেটেস্টলি” তাদের প্রথমে প্রকাশিত ভুল বুঝতে পেরে পরবর্তীতে দাবিটিকে বানোয়াট হিসেবেও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
এছাড়াও, সংবাদটিকে সন্দেহমূলক হিসেবে অথবা বানোয়াট দাবি করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বেশকিছু সংবাদ মাধ্যম ও ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান। যেমনঃ লজিক্যালি ফ্যাক্টস (ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান), cnews.fr, leparisien.fr, জাগরণ, নিউজ ইন ফ্রান্স, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
প্রসঙ্গত, পূর্বেও গণমাধ্যমে ভুল তথ্যের মাধ্যমে সংবাদ পরিবেশন করলে তা শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার। দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
সুতরাং, বাংলাদেশ, ভারত সহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং পোর্টালে “বিটিএস সদস্য জিমিনের মতো হতে কানাডিয়ান অভিনেতা সেইন্ট ভন কলুচি ১২ অস্ত্রোপচার করার পর মারা গেছেন” শীর্ষক দাবি প্রচার করা হয়েছেঃ যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।