সম্প্রতি, পাকিস্তানে মৃত নারীদের ধর্ষণ থেকে রক্ষা করতে কবরে তালা দেয়া হচ্ছে শীর্ষক একটি সংবাদ গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে একটি ছবি প্রচারের মাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, “পাকিস্তানে কবর থেকে মহিলাদের দেহ তুলে ধর্ষণ করা হচ্ছে। মৃতদেহকে ধর্ষকদের হাত থেকে বাঁচাতে তাই কবরস্থলের চারপাশে লোহার খাঁচা তৈরি করে দিচ্ছেন উদ্বিগ্ন বাবা-মায়েরা”।

উক্ত দাবিতে সংবাদ প্রকাশ করেছে এমন দেশীয় গণমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে সময়ের আলো, চ্যানেল আই, ঢাকা পোস্ট, বাংলাভিশন, নিউজ২৪, আমাদের সময়, বিবার্তা২৪, ঢাকা টাইমস, মানবজমিন, চ্যানেল২৪, জনকণ্ঠ, ডেইলি বাংলাদেশ, দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস, বাহান্ন নিউজ, সংবাদ প্রকাশ, বাংলাদেশ মোমেন্টস।

ভারতীয় গণমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস, নিউজ১৮,অপইন্ডিয়া, দ্য প্রিন্ট, ইন্ডিয়া টিভি, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, বাংলা হান্ট, কলকাতা টিভি, জি২৪ ঘন্টা, এইদিন প্রভৃতি।
একই দাবিতে গণমাধ্যমের ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।

টুইটারে প্রকাশিত একই দাবির কিছু টুইট এখানে, এখানে এবং এখানে।

ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ধর্ষণের হাত থেকে নারীদের রক্ষা করতে পাকিস্তানে নারীদের কবর গ্রিল দিয়ে তালাবদ্ধ করার দাবিটি সঠিক নয় বরং যে ছবিটি পাকিস্তানের হিসেবে প্রচার করে উক্ত দাবিটি করা হয়েছে সেটি মূলত ভারতের হায়দ্রাবাদের একটি কবরস্থানের একটি কবর গ্রিলবদ্ধ করার ছবি এবং এই ছবির সাথে ধর্ষণ প্রতিরোধের কোনো সম্পর্ক নেই।
পাকিস্তানে কি মৃত নারীদের ধর্ষণ থেকে রক্ষা করতে কবর তালাবদ্ধ করা হচ্ছে?
সংবাদগুলোতে পাকিস্তানে মৃত নারীদের ধর্ষণ থেকে রক্ষা করতে কবরে তালা দেয়া হচ্ছে শীর্ষক দাবি করা হয়েছে। বিষয়টির সত্যতা অনুসন্ধানে Harris Sultan নামের টুইটার অ্যাকাউন্টের একটি ভাইরাল টুইট খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে সবুজ গ্রীল দিয়ে কবরকে তালাবদ্ধ করার সেই ছবি সংযুক্ত করে ছবিটিকে পাকিস্তানের দাবি করে নারীদের ধর্ষণ থেকে বাঁচাতে কবর তালাবদ্ধ করা হচ্ছে বলে প্রচার করা হয়।
ইংরেজি ভাষায় লেখা টুইটে দাবি করা হয়, “পাকিস্তান এমন একটি শৃঙ্গাকার, যৌন হতাশগ্রস্থ সমাজ তৈরি করেছে যে লোকেরা এখন তাদের মেয়েদের কবরে তালা লাগাচ্ছে যাতে তারা ধর্ষণের শিকার না হয়। আপনি যখন বোরকাকে ধর্ষণের সাথে যুক্ত করেন, তখন এই বিষয়টিই আপনাকে কবরে নিয়ে যায় (অনূদিত)।”

উপরোক্ত টুইট থেকে ছবি এবং তথ্য নিয়ে ভারতীয় বেশকিছু সংবাদমাধ্যম এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের বেশকিছু সংবাদমাধ্যমেও বিষয়টির ওপর সংবাদ প্রচারিত হয়।
পাকিস্তানে ধর্ষণ এড়াতে কবর তালাবদ্ধ করার কোনো ঘটনা সত্যি ঘটেছে কি না তা প্রাসঙ্গিক কিওয়ার্ড অনুসন্ধানে পাকিস্তানের কোনো মিডিয়ায় এরূপ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ভারতের ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা বুম এ বিষয়ে পাকিস্তানি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছে। তারা ধর্ষণ এড়াতে পাকিস্তানে কবরে তালা দেয়া হচ্ছে শীর্ষক কেনো তথ্য সম্পর্কে জানাতে পারেননি।

ছবিটির বিষয়ে অনুসন্ধান
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে ছবিটি নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করেও এর অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে অনুসন্ধানে Gabbar নামের টুইটার অ্যাকাউন্টের একটি টুইট খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত টুইটে গ্রীল দিয়ে কবর তালাবদ্ধ করার ছবিটি ভারতের হায়দ্রাবাদের ছবি হিসেবে উল্লেখ করে উক্ত কবর ও তার অবস্থানের আরো কিছু ছবি যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে একটি মসজিদের ছবিও রয়েছে।

উক্ত টুইটের মন্তব্যের ঘরে Sayed Salman নামের এক ব্যক্তির মন্তব্য থেকে কবরস্থানটির অবস্থান জানা যায়।
জনাব সায়েদ সালমান লিখেছেন, উক্ত মসজিদটি তার বাড়ির কাছেই অবস্থিত। এটির নাম সালার-ই-মুলক মসজিদ, যার অবস্থান হায়দ্রাবাদের সান্তোষ নগরের দারাব জাং কলোনিতে।

স্থান সংক্রান্ত উক্ত তথ্যের৷ ভিত্তিতে গুগল ম্যাপসে অনুসন্ধানে উক্ত কবরটি গুগল স্ট্রিট ভিউয়ে পাওয়া যায় এবং এর মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় তালাবদ্ধ কবর এর এই ছবিটি পাকিস্তানের নয় বরং ভারতের হায়দ্রাবাদের মাদন্নোপেট এলাকার দারাব জং কলোনি এলাকার একটি কবরস্থানের ছবি।

হায়দ্রাবাদের এই কবরটি ঠিক কী কারণে গ্রিলবদ্ধ করা হয়েছে সেই কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে পরবর্তীতে একটি ভিডিও টুইট খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে এক ব্যক্তি উক্ত কবরস্থানের ঐ কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কবরস্থান সংলগ্ন মসজিদের মুয়াজ্জিনকে সাথে নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে স্পটে গিয়ে কথা বলে ভিডিও করছেন।

উক্ত মুয়াজ্জিনের বক্তব্য থেকে জানা যায়, কবরটি প্রায় দুই বছর পুরোনো। উক্ত কবরের ওপর যাতে আর কোনো কবর কেউ দিয়ে না ফেলে সেজন্য উক্ত কবরস্থানে সমাহিত ব্যক্তির পরিবার গ্রীল দিয়ে তালাবদ্ধ করেছে।
মুয়াজ্জিন বলেছেন, “অনেক লোক এখানে আসে এবং অনুমতি ছাড়াই পুরোনো কবরের উপর লাশ দাফন করে। যাদের আগে থেকেই এখানে কবরস্থ করা হয়েছে, তাদের কাছের মানুষেরা ফাতেহা পড়তে আসলে তাদের অভিযোগ থাকে। অন্যরা যেন এভাবে এক লাশের ওপর অন্য লাশ দাফন করতে না পারে সেজন্য তারা সেখানে গ্রিল লাগিয়ে দিয়েছে।”
ভারতের ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা অল্ট নিউজও বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছে এবং সরেজমিন থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে। রিউমর স্ক্যানার টিম সংস্থাটির সহপ্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ জুবায়ের এর সাথে যোগাযোগ করে তাদের সোর্সের মাধ্যমে প্রাপ্ত ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করে গ্রিলবদ্ধ কবরটি সম্পর্কে অধিকতর নিশ্চিত হয়েছে।

অর্থাৎ, পাকিস্তানে মৃত নারীদের ধর্ষণ থেকে বাঁচাতে গ্রীল দ্বারা তালাবদ্ধ করার দাবিটি মিথ্যা এবং যে ছবিটি প্রচারে মাধ্যমে উক্ত দাবিটির সৃষ্টি সে ছবিটি পাকিস্তানের কোনো কবরস্থানের নয় বরং এটি ভারতের হায়দ্রাবাদের একটি কবরস্থানের।
একই সংবাদের সাথে ভিন্ন ছবি প্রচার
কতিপয় সংবাদমাধ্যম (চ্যানেল আই, দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস) সবুজ রঙের গ্রীলবদ্ধ কবরের ভাইরাল ছবিটির পরিবর্তে নিম্নোক্ত ভিন্ন ছবিটি ব্যবহার করেছে। কেউ কেউ এই ছবিটিকে সরাসরি পাকিস্তানের দাবি করেছে আবার কেউ কোনোকিছুই উল্লেখ করেনি।

তবে অনুসন্ধানে দেখা যায় ছবিটি পাকিস্তানের কোনো কবরস্থানের ছবি নয় বরং এটি ফ্রি স্টক ইমেজ সাইট পিক্সাবে তে আপলোড করা আলজেরিয়ার একটি কবরস্থানের পুরোনো ছবি।

নেক্রোফিলিয়া সম্পর্কে কিছু তথ্য
মৃতদের সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করাকে নেক্রোফিলিয়া বলে। নেক্রোফিলিয়া এক ধরণের মানসিক যৌন ব্যাধি। যারা এই ব্যাধিতে আক্রান্ত তাদের বলা হয় নেক্রাফাইল, যারা মৃতদেহের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে।
মৃতদেহের প্রতি যৌন আগ্রহ বা যৌন সম্পর্ক স্থাপন একটি বিরল প্যারাফিলিয়া, যা কেবল প্রায় একচেটিয়াভাবে পুরুষদের মধ্যে দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে, তারা নিজেরাই ভুক্তভোগীকে হত্যা করে, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়, মর্গ, শ্মশান বা কবরের মাধ্যমে মৃতদেহগুলোতে সহজে তারা পেয়ে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে ১৯৮৯ সালে ১২২ জন নেক্রাফাইল ব্যক্তির তথ্য পর্যালোচনা করে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ঐ গবেষণায় বলা হয়, ‘বাধা দেবে না বা প্রত্যাখ্যান করবে না’ মূলত এমন যৌন সঙ্গী পাওয়ার বাসনা থেকে মরদেহের সাথে যৌন সংসর্গ করে থাকে নেক্রোফাইলরা।
পাকিস্তানে কি নেক্রোফিলিয়া বেড়েছে?
দেশীয় এবং ভারতীয় বেশকিছু মিডিয়ায় পাকিস্তানি পোর্টাল ডেইলি টাইমস এর বরাতে পাকিস্তানে নেক্রোফিলিয়া বৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখ করেছে। পরবর্তীতে অনুসন্ধানে গত ২৮ এপ্রিল ডেইলি টাইমস এর সেই প্রতিবেদনটি খুঁজে দেখা যায় সেটি একটি সম্পাদকীয়।

সম্পাদকীয়টি পাকিস্তানে নারীদের প্রতি সহিংসতা নিয়ে লেখা। সাথে এতে নেক্রোফিলিয়ার বিষয়েও উল্লেখ করা হয়েছে। সম্পাদকীয়তে এ বিষয়টি লিখতে গিয়ে লেখক হারিস সুলতান নামের সেই ব্যক্তির ভুয়া টুইটের তথ্যটিও যুক্ত করেছে।
সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানে নেক্রোফিলিয়ার বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করলেও এ দাবির সমর্থনে প্রমাণ হিসেবে কোনো ডাটা উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ পাকিস্থানে নেক্রোফিলিয়া বৃদ্ধি পেয়েছে এটি সম্পাদকীয় লেখকের মতামত বা মন্তব্য হিসেবে সেখানে পাওয়া গেছে। পাকিস্তানেনে ক্রোফিলিয়া বৃদ্ধি পেয়েছে কি না তা অনুসন্ধানে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো ডাটা পাওয়া যায়নি।
মূলত, হারিস সুলতান নামের একজন টুইটার ব্যবহারকারী গ্রীলবদ্ধ কবরের একটি ছবিকে পাকিস্তানের হিসেবে উল্লেখ করে ছবিটির ওপর ভিত্তি করে ‘ধর্ষণ থেকে নারীদের বাঁচাতে পাকিস্তানে কবর তালাবদ্ধ করা হচ্ছে’ শীর্ষক দাবিটি প্রচার করে। তার উক্ত টুইটকে সূত্র ধরে ভারতীয় বেশকিছু সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশেও বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি পাকিস্তানের একটি পোর্টালে টুইটটির তথ্যের ভিত্তিতে একটি সম্পাদকীয় লেখা হয়। তবে যে ছবিটির ওপর ভিত্তি করে উক্ত টুইট এবং সংবাদ প্রকাশিত হয় সেই ছবিটি পাকিস্তানের নয় বরং ভারতের হায়দ্রাবাদের একটি কবরস্থানের ছবি। বিষয়টি মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় হারিস সুলতান তার আলোচিত টুইটটি ডিলিট করে দেন।
সুতরাং, ভারতের হায়দ্রাবাদের একটি কবরস্থানের ছবিকে পাকিস্তানের দাবি করে মৃত নারীদের ধর্ষণ থেকে বাঁচাতে পাকিস্তানের পিতামাতারা কবর তালাবদ্ধ করছেন শীর্ষক যে সংবাদটি প্রচার করা হয়েছে সেটি মিথ্যা।