সম্প্রতি ‘পুকুর পাড়ে ৩২ বাচ্চাসহ রাসেল ভাইপার মেরে ফেললো স্থানীয়রা’ শীর্ষক দাবিতে একটি ভিডিও প্রতিবেদন গণমাধ্যম বরাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।
গণমাধ্যমের ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু ভিডিও দেখুন চ্যানেল২৪ (আর্কাইভ), আরটিভি (আর্কাইভ), ভোরের পাতা (আর্কাইভ), ডিবিসি নিউজ (আর্কাইভ)।
গণমাধ্যমের ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত এমন কিছু ভিডিও দেখুন ডিবিসি নিউজ (আর্কাইভ), যমুনা টিভি (আর্কাইভ)।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন প্রতিবেদন দেখুন চ্যানেল২৪, আরটিভি, ভোরের পাতা, ঢাকা পোস্ট, সমকাল, বৈশাখী টিভি, সময়ের আলো, দৈনিক আমাদের সময়, যুগান্তর, জাগো নিউজ, বাংলাদেশ টুডে, আমাদের সময়, একুশে সংবাদ, বিডি২৪লাইভ।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্থানীয় কর্তৃক পুকুর পাড়ে ৩২ টি বাচ্চাসহ রাসেল ভাইপার সাপ মেরে ফেলার তথ্যটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে সেখানে মারা যাওয়া সাপগুলোর মধ্যে একটি রাসেল ভাইপার এবং বাকি সাপের বাচ্চাগুলো নির্বিষ ঢোঁড়া সাপের বাচ্চা।
দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে ওপেন সোর্স অনুসন্ধানে বণ্যপ্রাণী, সাপের কামড় নিয়ে সচেতনতা ও পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ডীপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের ফেসবুক গ্রুপে গত ৩ মে একটি ফেসবুক পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিষ্ঠানটির জুনিয়র এক্সিকিউটিভ শাহাদাত হোসেন সোহান ফেসবুক পোস্টটিতে জানান,
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গায় ৩২টি বাচ্চাসহ বিষধর রাসেল ভাইপার সাপ মেরে ফেলার ঘটনার সত্যতা অনুসন্ধানে Deep Ecology and Snake Conservation Foundation এর বিশেষজ্ঞ দল সংযুক্ত ছবি, ভিডিও পর্যালোচনা করে নিশ্চিত হয় যে প্রচারিত সংবাদ অসত্য।
প্রকৃতপক্ষে ঘটনাস্থলে ১টি বিষধর চন্দ্রবোড়া সাপ ( Russell’s viper) এবং ৩১ টি নির্বিষ ঢোঁড়া (Checkered keelback ) সাপের বাচ্চা গ্রামবাসীর হাতে মারা পড়ে। অর্থাৎ প্রচারিত ৩২টি চন্দ্রবোড়া সাপ পাওয়া যাওয়ার সংবাদটি সঠিক নয়।
পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে অধিকতর অনুসন্ধানে রাসেল ভাইপার ও ঢোঁড়া সাপের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে জানতে রিউমর স্ক্যানার থেকে শাহাদাত হোসেন সোহানের সাথে যোগাযোগ করে।
তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, দেহের আকার এবং রঙ থেকে সাপ দুইটিকে পরিস্কারভাবে আলাদা করে চেনা যায়। এসময় তিনি রাসেল ভাইপার ও ঢোঁড়া সাপের বাচ্চার মধ্যে পার্থক্যসূচক কিছু ছবিও রিউমর স্ক্যানারকে সরবরাহ করেন৷
তার সরবরাহকৃত এসব ছবির সঙ্গে প্রচারিত সাপের বাচ্চার ছবির মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
রাসেল ভাইপার ও ঢোঁড়া সাপ একসাথে থাকতে পারে কি না এমন প্রশ্নে তিনি জানান, এখানে কয়েকটি বিষয় আছে। যেমন, একসাথে না কাছাকাছি পাওয়া গেছে এটা একটা বিষয়। ঢোঁড়া সাপ পানির আশেপাশেই বাসা করে। সব সাপ মানুষকে এড়িয়ে চলে, রাসেল ভাইপার মানুষের উপস্থিতিতে আশ্রয়ের জন্য আড়াল হতে পারে এবং কাকতালীয়ভাবে সেখানে ঢোঁড়া সাপের বাচ্চার উপস্থিতি পাওয়া যায় এবং একসাথে ৪০-৫০টা ঢোঁড়া সাপের বাচ্চা খুবই কমন ব্যাপার। অপরদিকে রাসেলস ভাইপার ডিম পারে না, সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে। প্রসবের সময় বাচ্চা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। ফলে রাসেল ভাইপারের বাচ্চা একসাথে থাকার সম্ভাবনা কম। সর্বোপরি, ডীপ ইকোলজি নিশ্চয়তা দিচ্ছে এই ছবির বাচ্চাসাপ গুলো ঢোঁড়া সাপ।
পাশাপাশি সাপ বিষয়ক সচেতনতা নিয়ে কাজ করা স্নেক অ্যাওয়ারনেস নামে ফেসবুক গ্রুপে একই বিষয়ে আরেকটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়।
গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা ও ভেনম রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশের রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট রফিক ইসলাম এই পোস্টটিতে লিখেন, ছবিতে প্রাপ্ত বয়ষ্ক সাপটি বিষধর চন্দ্রবোড়া সাপ এটা সত্য, তবে বাচ্চাগুলো সম্পূর্ণ নির্বিষ জলঢোঁড়া (Checkered Keelback) এর বাচ্চা। এইগুলোর দংশনে মৃত্যু ঝুঁকি নেই, যেগুলোকে বিষধর বলে মানুষের কাছে পরিচয় করানো হচ্ছে।
এছাড়া রিউমর স্ক্যানার থেকে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনিও রিউমর স্ক্যানারকে তথ্যগুলো নিশ্চিত করে বলেন, এখন ঢোঁড়া সাপের বাচ্চা পাওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ চন্দ্রোবোড়া সাপের বাচ্চা দেয়ার সময় এখনই নয়, সামনে আসছে। তাই বলা যাচ্ছে, এখন রাসেল ভাইপারের বাচ্চা পাওয়ার বিষয়টির সম্ভাবনা নেই, অস্বাভাবিক।
পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে অধিকতর অনুসন্ধানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও সাপের বাচ্চাগুলোকে Checkered Keelback (ঢোঁড়া সাপ) এর বলে নিশ্চিত করেছেন।
গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদে বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন্যপ্রাণী ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তার বক্তব্য প্রসঙ্গে যা জানা যাচ্ছে
গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদগুলোতে চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্থানীয় কর্তৃক সাপ মেরে ফেলার ঘটনায় সাপগুলোর পরিচয়ের ব্যাপারে বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন্যপ্রাণী ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা তন্ময় আচার্য্যের বক্তব্য ব্যবহার করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, এই বিষয়ে আমাকে একজন ফোন দিয়েছিল। উনি স্থানীয় একজন সাংবাদিক। তিনি আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে রাসেল ভাইপার সাপের তিনটি ছবি পাঠিয়ে জানতে চান এটি কোন প্রজাতির। আমি তাকে এটি রাসেল ভাইপার বলে নিশ্চিত করি।
পরবর্তীতে তাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্থানীয় কর্তৃক মেরে ফেলা সাপগুলোর ছবি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, সেখানে মারা যাওয়া বড় সাপটি রাসেল ভাইপার। ছোটগুলোর ছবি স্পষ্ট নয়, তবে বড়টির সাথে যদি কোনটার মিল থাকে দেখতে, তাহলে ওগুলো রাসেল ভাইপারের বাচ্চা হতে পারে।
অর্থাৎ তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্থানীয় কর্তৃক মেরে ফেলা সাপগুলোর মধ্যে কেবল একটি সাপকে রাসেল ভাইপার বলে নিশ্চিত করে স্থানীয় একটি গণমাধ্যমে বক্তব্য দিলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার এই বক্তব্যকেই সবগুলো সাপ রাসেল ভাইপার দাবিতে প্রচার করা হয়।
মূলত, গত পহেলা মে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের একটি পুকুরে ৩২ টি বাচ্চা সাপসহ একটি বড় সাপের দেখা মিললে পুকুর মালিক ও স্থানীয়রা সাপগুলোকে মেরে ফেলে। এ ঘটনায় মেরে ফেলা সাপগুলোর মধ্যে বড় সাপটিকে রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া ও বাচ্চা সাপগুলোকে রাসেল ভাইপারের বাচ্চা হিসেবে দাবি করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার করা হয়। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বড় সাপটি রাসেল ভাইপার হলেও মেরে ফেলা সাপের বাচ্চাগুলো রাসেল ভাইপারের ছিল না। প্রকৃতপক্ষে সাপের বাচ্চাগুলো ছিল Checkered Keelback ( ঢোঁড়া সাপ)। অপরদিকে গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদগুলোতে বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের যে কর্মকর্তার উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে, তিনিও রিউমর স্ক্যানারকে জানান যে, বড় সাপটি রাসেল ভাইপারের। তবে ছোটগুলোর ছবি স্পষ্ট না হওয়ায় সেগুলো চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান সাপের বাচ্চাগুলোকে Checkered Keelback ( ঢোঁড়া সাপ) এর বলেই নিশ্চিত করেছেন।
সুতরাং, চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্থানীয় কর্তৃক পুকুর পাড়ে ৩২ টি বাচ্চাসহ রাসেল ভাইপার সাপ মেরে ফেলা হয়েছে দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদটি সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Deep Ecology and Snake Conservation Foundation Facebook Post: https://www.facebook.com/groups/959896627527624/permalink/2165653933618548/?mibextid=Nif5oz
- Snake Awareness Facebook Post: https://www.facebook.com/groups/1445728405628658/permalink/2334709623397194/?mibextid=Nif5oz
- Contact with Junior Executive of Deep Ecology and Snake Conservation Foundation
- Contact with Founder of Snake Awareness
- Contact with Head of Zoology Department, Jahangir Nagar University
- Contact with Wildlife and Biodiversity Conservation Officer, Wildlife Management and Nature Conservation Division, Department of Forests