পুলিশের ৭২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার দাবিটি মিথ্যা

সম্প্রতি পুলিশের ৭২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এবং ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবে একটি ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমনকিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ইউটিউবে প্রচারিত এমন একটি ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশের কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়নি বরং অধিক ভিউ পাবার আশায় চটকদার শিরোনাম ও থাম্বনেইল ব্যবহার করে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্যসূত্র ছাড়াই ভিত্তিহীনভাবে দাবিটি প্রচার করা হচ্ছে।

অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম।

Screenshot: Sabai Sikhi YouTube

১ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের ওই ভিডিওটিতে বলা হয়, ‘এবার পুলিশের ৭২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচনের আগে পুলিশের দমনপীড়ন রোধে এই পদক্ষেপ বলে জানান মার্কিন যুক্তরাষ্টের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে সকল রাজনৈতিক দল ও সংগঠন তাদের নির্বাচনী প্রচারণার সমাবেশ সঠিকভাবে করতে পারে এজন্য পুলিশ বাহিনীকে নমনীয় থাকার আহ্বান জানানো হয়, যাতে সকল রাজনৈতিক দল তাদের মনোভাব প্রকাশ করতে পারে। এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেন, বাংলাদেশকে অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পদ থেকে বহিস্কার করা হবে।’

উক্ত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে প্রাসঙ্গিক একাধিক কি ওয়ার্ড সার্চ করেও আলোচিত দাবির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। এছাড়াও, গণমাধ্যম বা নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রে উল্লিখিত দাবির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তবে প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে  মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে গত ২৫ মে ‘বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot: Prothom Alo

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। গত ২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এক বিবৃতিতে এ ঘোষণা দিয়েছেন।

মার্কিন ভিসা নীতির ঘোষণা নিয়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের ওয়েবসাইটে গত ২৪ মে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot: US Embassy BD

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আজ, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যকে সহায়তা করতে, আমি ইমিগ্রেশন এন্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের ধারা 212(a)(3)(C) (“3C”) এর অধীনে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করছি। এই নীতির অধীনে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপে সক্ষম হবে। এর মধ্যে বর্তমান ও প্রাক্তন বাংলাদেশি কর্মকর্তা/কর্মচারী, সরকারপন্থি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গত ৩ মে, ২০২৩ তারিখে বাংলাদেশ সরকারকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে।

গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজের মধ্যে রয়েছে: ভোট কারচুপি , ভোটারদের ভয় দেখানো , সহিংসতার মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত হবার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দেয়া, এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখা।

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ভোটার, রাজনৈতিক দল, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমসহ সকলের। যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায় তাদের সকলকে আমাদের সমর্থন দিতে আমি এই নীতি ঘোষণা করছি।’

পরবর্তীতে একই বিষয় নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্টোনি ব্লিঙ্কেনের টুইটার অ্যাকাউন্টে গত ২৪ মে প্রকাশিত একটি টুইট বার্তাও খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot: Twitter

তাছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন ভিসা নীতি ঘোষণার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মূলধারার ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম চ্যানেল আই এর টকশো অনুষ্ঠান তৃতীয় মাত্রায় লাইভে যুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।

উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থাপক জিল্লুরের প্রশ্নের জবাবে ডোনাল্ড লু বলেন, “আমি একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, আজ আমরা কাউকে স্যাংশন দিচ্ছি না। সেক্রেটারি অফ স্টেট একটি নতুন নীতির ঘোষণা করেছেন, যা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেই সব ব্যক্তির ভিসা সুবিধায় বিধি–নিষেধ আরোপ করতে পারবে, যারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”

এছাড়াও, বাংলাদেশ পুলিশের ৭২ কর্মকর্তার ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি অধিকতর যাচাইয়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের ওয়েবসাইট (U.S. DEPARTMENT OF THE TREASURY), যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ওয়েবসাইট (USA gov) এবং বাংলাদেশস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এর ওয়েবসাইট পর্যবেক্ষণ করে এ ধরণের নিষেধাজ্ঞা বা তথ্যের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের টুইটার অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশের কারো উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গত ২৪ জুলাই ম্যাথিউ মিলার বলেন, যাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, যুক্তরাষ্ট্র তাদের নাম প্রকাশ করে না। তবে নিষেধাজ্ঞায় পড়া অফিসিয়াল বা সরকারি ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করে।

Screenshot: state.gov, USA

যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র যাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, তাদের মধ্যে অফিসিয়াল বা সরকারি ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো নাম প্রকাশ করে না সেহেতু পুলিশের ৭২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিলে দেশটি নাম প্রকাশ করতো। অর্থাৎ তাদের আমেরিকার ভিসা বাতিলের দাবিটি কোনো ধরনের তথ্যসূত্র ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হচ্ছে। 

অর্থাৎ, উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের যুক্তরাষ্ট্র ভিসা না দেওয়ার ঘোষণা দিলেও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ পুলিশের কোনো কর্মকর্তা কিংবা কোনো ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র তাদের নতুন ভিসা নীতির ঘোষণায় কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, দল বা সংগঠনের কথা উল্লেখ করেনি।

মূলত, সম্প্রতি পুলিশের ৭২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দাবিতে একটি ভিডিও ফেসবুক এবং ইউটিউবে প্রচার করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার ছবি ও খণ্ড খণ্ড ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার করে ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও কোনোপ্রকার গ্রহণযোগ্য তথ্য প্রমাণ ছাড়াই উক্ত দাবিটি প্রচার করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের কোনো পুলিশ কর্মকর্তার ওপরই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি।

প্রসঙ্গত, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‌্যাব ও বাহিনীটির ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

উল্লেখ্য, পূর্বেও রাষ্ট্রপতিসহ বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দাবিতে ভুয়া তথ্য প্রচার করা হলে সেগুলো শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

সুতরাং, ৭২ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img