অযোধ্যায় মসজিদ নির্মাণে রোনালদোর ৪৫ কোটি টাকা দেওয়ার গুজব

সম্প্রতি, পর্তুগিজ ফুটবল তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টের একটি পোস্টের স্ক্রিনশট এবং তার ছবি সম্বলিত একটি ফটোকার্ড ইন্টারনেটে প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, “ভারতের সর্ব্বোচ্চ বড় মসজিদ নির্মাণের জন্য ৪৫ কোটি টাকা দিয়েছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবং তার সাথে রমজানের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন”। 

মসজিদ

ফেসবুকে প্রচারিত এমন একটি পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

টিকটকে প্রচারিত এমন একটি ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ

টিকটকে প্রচারিত ভিডিওটিতে এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া অবধি প্রায় ১৫ হাজার ৪০০ পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে এবং শেয়ার হয়েছে ২০৭ বার। 

ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত একটি পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

ইনস্টাগ্রামের পোস্টটি এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া অবধি প্রায় ১০ লক্ষ বার দেখা হয়েছে। ভিডিওতে প্রায় ৬৫ হাজার ৮০০ পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে এবং শেয়ার করা হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ বার। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতের অযোধ্যায় মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ মসজিদ নির্মাণে পর্তুগিজ ফুটবল তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কর্তৃক ৪৫ কোটি টাকা দেওয়ার তথ্যটি সঠিক নয় বরং কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই উক্ত দাবিটি প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া আসন্ন রমজান উপলক্ষ্যে তিনি কোনো শুভেচ্ছা বার্তাও পাঠাননি বরং ২০২৩ সালে রমজান উপলক্ষ্যে তার এক্স অ্যাকাউন্টে (সাবেক টুইটার) শুভেচ্ছা জানানোর একটি স্ক্রিনশটের সাথে তার ছবি যুক্ত ফটোকার্ডটিকে সাম্প্রতিক দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। 

দাবির সম্ভাব্য সূত্রপাত 

অনুসন্ধানে ‘Faishal786’ নামক একটি ইউটিউব চ্যানেলে গত ২২ ফেব্রুয়ারি “CRISTIANO RONALDO Ayondhya mein banne wali masjidke lie 45 carod diye #CR7 #cristianoronaldo” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। তবে ভিডিওটিতে কোনো তথ্যসূত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। 

ভিডিওতে বলা হয়, ফুটবলের রাজা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো অযোধ্যায় নির্মিতব্য ভারতের সবচেয়ে বড় মসজিদের জন্য ৪৫ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। 

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কি মসজিদ নির্মাণে ৪৫ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন?  

বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ, এক্স অ্যাকাউন্ট (সাবেক টুইটার) এবং ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

এছাড়া, প্রাসঙ্গিক একাধিক কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে ভারতসহ আন্তজার্তিক কোনো গণমাধ্যমে আলোচিত দাবির সত্যতা সম্পর্কিত কোনো তথ্য কিংবা সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

তবে অনুসন্ধানে ভারতীয় গণমাধ্যম ‘Hindustan Times’ এর ওয়েবসাইটে গত ২২ জানুয়ারি “Muslim body reveals date for Ayodhya mosque construction, new crowdfunding plan” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারতের অযোধ্যায় মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ মসজিদ নামে মসজিদটি নির্মাণে ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। আদালতের রায়ে অযোধ্যার বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির এবং কিছু দূরে মুসলমানদের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণের কথা রয়েছে। মসজিদটির নাম ঠিক করা হয়েছে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নামে। 

এর সূত্র ধরে অনুসন্ধানে অযোধ্যায় নির্মিতব্য মসজিদের ট্রাস্টটির নামে খোলা ফেসবুক পেজে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দান সম্পর্কিত কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

পরবর্তীতে দাবিটির অধিকতর সত্যতা যাচাইয়ে উত্তর প্রদেশের মুসলিম সুন্নি ওয়াক্ফ বোর্ডের চেয়ারম্যান জুফার আহমদ ফারুকীর সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। 

এই মসজিদ নির্মাণে ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনলাদো কোনো অনুদান দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, অযোধ্যার মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ মসজিদের জন্য গঠিত ইন্দো ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন ট্রাস্টে প্রসিদ্ধ আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বরা উল্লেখযোগ্য অনুদান দিয়েছেন দাবিতে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত খবরটি ভুয়া এবং ভিত্তিহীন। আমরা এখন পর্যন্ত ভারতের বাইরে থেকে কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে (অযোধ্যা মসজিদ নির্মাণে) কোনো দান পাইনি।

অর্থাৎ, কোনো প্রকার নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ছাড়াই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর অযোধ্যায় নির্বিতব্য মসজিদের ৪৫ কোটি টাকা দেওয়ার দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।

আসন্ন রমজান উপলক্ষ্যে কি রোনালদো কোনো শুভেচ্ছা বার্তা জানিয়েছেন? 

দাবিটির বিষয়ে অনুসন্ধানে সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলো পর্যবেক্ষণে কোনো পোস্ট বা শুভেচ্ছা বার্তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

তবে আলোচিত ফটোকার্ডে চ্যানেল ২৪ এর লোগোর সূত্র ধরে অনুসন্ধানে চ্যানেল ২৪ এর খেলাধুলা বিষয়ক বুলেটিন বিভাগ  ‘স্পোর্টস ২৪’ ফেসবুক পেজে ২০২৩ সালের ২৩ মার্চ “মুসলিম সম্প্রদায়কে রমজানের শুভেচ্ছা জানালেন রোনালদো” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ফটোকার্ড খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ফটোকার্ডের সাথে আলোচিত দাবিতে যুক্ত ফটোকার্ডের হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়।  

Photocard Comparison : Rumor Scanner 

উক্ত সূত্র ধরে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর এক্স অ্যাকাউন্টে (সাবেক টুইটার) একই দিনে একটি টুইট খুঁজে পাওয়া যায়৷ 

উক্ত টুইটের মাধ্যমে তিনি ২০২৩ সালের রমজান উপলক্ষ্যে মুসলমান সম্প্রদায়কে রমজানের শুভেচ্ছা জানান।

অর্থাৎ, আলোচিত ফটোকার্ডে যুক্ত টুইটটি ২০২৩ সালের। 

মূলত, ভারতের অযোধ্যায় চলতি বছরের মে মাসে মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ নামে একটি নতুন মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশনের (আইআইসিএফ) উন্নয়ন কমিটির প্রধান হাজী আরাফাত শাইখ মসজিদ নির্মাণ প্রকল্পটি তদারক করছেন। পবিত্র রমজান মাস শেষ হলে আগামী মে মাসের দিকে মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু হবে বলে জানা যায়। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পর্তুগিজ ফুটবল তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর একটি টুইট বার্তা এবং ছবি সহ একটি ফটোকার্ড প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, ভারতের সর্ব্বোচ্চ বড় মসজিদ নির্মাণের জন্য ৪৫ কোটি টাকা দিয়েছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবং তার সাথে রমজানের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তবে রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধানে দেখেছে যে, কোনো প্রকার নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ছাড়াই অযোধ্যায় মসজিদ নির্মাণের জন্য রোনালদোর টাকা দেওয়ার দাবিটি প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে রমজান মাস উপলক্ষ্যে মুসলমান সম্প্রদায়কে শুভেচ্ছা জানানোর একটি টুইট সাম্প্রতিক দাবিতে আলোচিত দাবিতে যুক্ত করে প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া ইন্টারনেটে ছড়ানো এই অনুদানের দাবিটি মিথ্যা এবং মসজিদটি নির্মাণের জন্য এখন অবধি ভারতের বাইরে থেকে কোনো অনুদান পাননি বলে উত্তর প্রদেশের মুসলিম সুন্নি ওয়াক্ফ বোর্ডের চেয়ারম্যান জুফার আহমদ ফারুকী রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেছেন।

উল্লেখ্য, পূর্বেও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে নিয়ে বিভিন্ন গুজব প্রচার হলে সেসময় বিষয়গুলো নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। প্রতিবেদনগুলো দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

সুতরাং, ভারতের অযোধ্যায় মসজিদ নির্মাণে রোনালদোর ৪৫ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া এবং আসন্ন রমজানে তার সবাইকে শুভেচ্ছা জানানোর দাবিতে প্রচারিত তথ্যগুলো মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র 

আরও পড়ুন

spot_img