সেনাপ্রধান কর্তৃক আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দায়িত্ব নেওয়ার ভুয়া তথ্য প্রচার

গত ০৭ ডিসেম্বর Bd VIP News নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ‘নির্বাচনের দায়িত্ব নিলো সেনাপ্রধান। সারাদেশে সেনা মোতায়েন শুরু। ক্ষেপেছে সিইসি’ শীর্ষক শিরোনাম এবং ‘নির্বাচনের দায়িত্ব নিলো সেনাপ্রধান, ক্ষেপেছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার’ শীর্ষক থাম্বনেইল ব্যবহার করে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়েছে।

সেনাপ্রধান

ভিডিওটি দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া অবধি ভিডিওটি প্রায় ১ লক্ষ ৯ হাজার বার দেখা হয়েছে। এছাড়া ভিডিওটিতে প্রায় ২ হাজার ৮ শত পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।

পরবর্তীতে এই ভিডিওটি কয়েকটি ফেসবুক পেজ থেকে প্রচার করা হয়। পোস্টগুলো দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণে সেনাপ্রধান দায়িত্ব নেননি এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের ক্ষিপ্ত হওয়ার বিষয়টিও সঠিক নয়। তবে আজ (১৭ ডিসেম্বর) আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। প্রকৃতপক্ষে অধিক ভিউ পাবার আশায় চটকদার শিরোনাম ও থাম্বনেইল ব্যবহার করে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই আলোচিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।

অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ভিডিও পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এটি ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি পুরোনো ঘটনার ভিডিও ক্লিপ এবং ছবি নিয়ে তৈরি একটি ভিডিও প্রতিবেদন, যেখানে সেনাপ্রধান, প্রধান নির্বাচন কমিশন এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের পুরোনো কিছু কার্যক্রমের দৃশ্য দেখানো হয়।

ভিডিওটি’র সংবাদপাঠ অংশে বলা হয়, “দর্শক বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পেয়েছেন সেনাবাহিনী৷ সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে প্রত্যেকটি জেলায় জেলায় টহল দিচ্ছেন। প্রত্যেকটি জেলায় পৌছে গেছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। দর্শক এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার কারণে তিনি ক্ষেপে গিয়েছেন। এদিকে বিএনপিকে নির্বাচনে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন সেনা সদস্যরা…..”

উক্ত বিষয়গুলো নিয়ে প্রাসঙ্গিক একাধিক কি ওয়ার্ড সার্চ করেও গণমাধ্যম কিংবা অন্যকোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে দাবিগুলোর সত্যতা পাওয়া যায়নি।

তবে আলোচিত ভিডিওটিতে প্রদর্শিত সেনাপ্রধান শফিউদ্দিন আহমেদের বক্তব্যের অংশটি পর্যবেক্ষণ করে তার সাথে আলোচিত ভিডিওটিতে প্রচারিত দাবির মিল পাওয়া যায়নি। আলোচিত ভিডিওটিতে সেনাপ্রধান কর্তৃক আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলা হলেও ভিডিওটিতে প্রদর্শিত সেনাপ্রধানের বক্তব্যে তিনি মাঠ পর্যায়ে সৈনিকদের কার্যক্রম প্রসঙ্গে কথা বলেন; যার সাথে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো যোগসূত্র নেই।

এছাড়াও, আলোচিত ভিডিওটিতে প্রদর্শিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের বক্তব্যের অংশটির কিছু স্থিরচিত্র রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে মূলধারার ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম সময় টিভি’র ইউটিউব চ্যানেলে চলতি বছরের ১০ জুলাই ‘সিইসির কাছে সাংবাদিকদের যত প্রশ্ন’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot: Somoy TV

এই ভিডিওটির সাথে আলোচিত ভিডিওটির প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের বক্তব্যের অংশের হুবহু মিল পাওয়া যায়।

Video Comparison by Rumor Scanner

তবে এই ভিডিওটি সাম্প্রতিক সময়ের নয় এবং এর সাথে আলোচিত ভিডিওটিতে প্রচারিত দাবির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

তবে মূল ধারার অনলাইন সংবাদমাধ্যম নিউজবাংলা২৪ এর ওয়েবসাইটে গত ১৭ ডিসেম্বর “নির্বাচনে সেনা মোতায়েনে রাষ্ট্রপতির সম্মতি” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন।

উক্ত প্রতিবেদনে ইসি সচিবকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সিইসি সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক রাষ্ট্রপতির কাছে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য অনুরোধ করেছেন। রাষ্ট্রপতি বিষয়টি শুনেছেন, আশ্বাস দিয়েছেন যে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে শিগগির সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন।

অর্থাৎ, সেনাবাহিনীকে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। নির্বাচনে পরিচালনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর মাঠে নামার অনুমতির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।

মূলত, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবিতে বিএনপি-জামায়াতসহ আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে আন্দোলন করে আসছে। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের তথ্য প্রচার হয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ০৭ ডিসেম্বর Bd VIP News নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ‘নির্বাচনের দায়িত্ব নিলো সেনাপ্রধান। সারাদেশে সেনা মোতায়েন শুরু। ক্ষেপেছে সিইসি’ শীর্ষক শিরোনাম এবং ‘নির্বাচনের দায়িত্ব নিলো সেনাপ্রধান, ক্ষেপেছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার’ শীর্ষক থাম্বনেইল ব্যবহার করে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত দাবিগুলো সঠিক নয়। তবে আজ (১৭ ডিসেম্বর) আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের জন্য নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন রাষ্ট্রপত। তবে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনীর মাঠে থাকার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে অধিক ভিউ পাবার আশায় ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার কয়েকটি পুরোনো ভিডিও ক্লিপ ও ছবি যুক্ত করে তাতে চটকদার থাম্বনেইল ও শিরোনাম ব্যবহার করে কোনোপ্রকার নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই আলোচিত দাবিগুলো প্রচার করা হয়েছে। 

উল্লেখ্য, পূর্বেও চটকদার শিরোনাম ও থাম্বনেইল ব্যবহার করে বিভিন্ন ভুয়া তথ্য প্রচারের প্রেক্ষিতে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। এমন কয়েকটি প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

সুতরাং, সেনাপ্রধান কর্তৃক আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ  নির্বাচনের দায়িত্ব নেওয়ার দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত তথ্যগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img