ইসরাইলের মসজিদে ফেরেশতা নেমে আসার দৃশ্য দাবিতে সিজিআই-অ্যানিমেশন ভিডিও প্রচার

সম্প্রতি, ‘ইসরাইলের মসজিদে হঠাৎ করে ফেরেশতা নেমে আসার কারণ কি’ শীর্ষক শিরোনামে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে( আর্কাইভ), এখানে( আর্কাইভ),এখানে(আর্কাইভ) এবং এখানে(আর্কাইভ)।

যা দাবি করা হচ্ছে

ইসরাইলের মসজিদুল আল আকসাতে এক নারীকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নির্যাতনকালে আকাশ থেকে ফেরেশতা নেমে এসেছিলো। প্রচারিত ভিডিওটি ঐ ঘটনাতেই ধারণ করা হয়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ইসরাইলের মসজিদুল আল আকসাতে হঠাৎ করে ফেরেশতা নেমে আসতে দেখা যায়নি বরং ফেরেশতা দাবিতে প্রচারিত ক্লিপটি ইউটিউবের পুরোনো একটি ভিডিও থেকে নেওয়া। যা  ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সিজিআই পদ্ধতিতে তৈরীকরা হয়েছে।

অনুসন্ধানের শুরুতে ভিডিওটির কি-ফ্রেম থেকে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে, GabeHashTV নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারিতে ‘TWO ANGELS CAUGHT ON CAMERA FLYING IN BRAZIL (EXPLAINED)’ শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। 

ভিডিওটিতে দেখানো ফুটেজের সাথে আলোচিত ভিডিওর ফেরেশতা দাবিতে উপস্থাপিত ক্লিপটির হুবহু মিল পাওয়া যায়।

Video Comparison: Rumor Scanner 

ভিডিওটিতে ব্যবহৃত সাবটাইটেল পর্যবেক্ষণ  করে জানা যায়, জেসন কার্লোস নামক একজন ইউটিউবার ২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী তার ইউটিউব চ্যানেলে ব্রাজিলের আকাশে দুটি ফেরেশতা ক্যামেরা বন্দি করার দাবিতে একটি ভিডিও প্রচার করেন। কিন্তু তিনি যখন জানতে পারেন তার ভিডিওটি স্যোশাল মিডিয়ায় সত্য ঘটনা দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে তখন তিনি তার আপলোড করা ভিডিওটি কিভাবে তৈরি করা হয়েছে তা বিস্তারিত জানিয়ে আরেকটি ভিডিও প্রকাশ করেন।  ভিডিওটি তৈরির বিভিন্ন প্রক্রিয়া বিস্তারিত দেখিয়ে ২০১৪ সালে ৬ ডিসেম্বর তিনি দ্বিতীয় ভিডিওটি পোস্ট করেন।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চের সাধ্যমে Jessen Carlos নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ANJOS FILMADOS NO CÉU ! শীর্ষক শিরোনামে একটি ভিডিও পাওয়া যায়। যার ইংরেজি অনুবাদ ANGELS FILMED IN HEAVEN!। ভিডিওটি ২০২২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আপলোড করা হয়।

পূর্বের ভিডিওর তথ্য অনুযায়ী জেসন কার্লোস নামের ব্যক্তির চ্যানেলে ২০১৪ সালে ভিডিওটি না পাওয়া গেলেও প্রাপ্ত ভিডিওর কমেন্ট সেকশনে এক ব্যক্তির প্রশ্নে Jessen Carlos জানান ভিডিওটি তার শিল্পকর্ম। 

Screenshot: Youtube

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে এই ভিডিওটি একই দাবিতে আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়লে জনপ্রিয় ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান Snopes এ বিষয়ে একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। 

Screenshot: Snopes

পাশাপাশি, আলোচিত ভিডিওটির ৩ মিনিট ২৩ সেকেন্ড থেকে ৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে মসজিদুল আল আকসাতে ফেরেশতা নেমে আসার প্রেক্ষাপট উপস্থাপন করতে গিয়ে  বলা হয়েছে, “সবার আগে আমরা কথা বলি সেই ভিডিও নিয়ে যেখানে একজন মহিলার উপর ইজরাইলি পুলিশ অত্যাচার করছিল তখন কি এমন ঘটনা ঘটলো যেটা দেখে সেখানে উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে গেল। বন্ধুরা সেই সময় একজন মুসলিম মহিলা সম্পূর্ণ আহত অবস্থায় মহান আল্লাহ তায়ালা রাব্বুল আলামিনের কাছে সাহায্য চাইছিল। বন্ধুরা ঘটনাটির শুরু তখন থেকে যখন মসজিদ আল আকসায় মুসলমানরা ইবাদাত করছিলো আর ইহুদি পুলিশ সেই সময় তাদের উপর হামলা করে বসে, সেই সময় ইহুদি পুলিশ যে শুধুমাত্র পুরুষদের উপর অত্যাচার করছিলো তা কিন্তু নয় সেখানে উপস্থিত সকল মহিলাদের উপরে অনেক ধরণের অত্যাচার করেছিলো ইহুদি সন্ত্রাসি পুলিশগুলো। আর সেই সময়ে ইহুদি সন্ত্রাসী পুলিশগুলো একজন সুন্দরী মুসলিম বোনকে মসজিদ আল আকসার এক সাইডে নিয়ে যায় এবং উনার সাথে খারাপ কাজ করার চেষ্টা করে। কিন্তু শুধু উনারা সেই মহিলার সাথে খারাপ কাজ করার চেষ্টা করছিলো তা কিন্তু নয় বরং ইহুদি পুলিশদের মধ্যে একজন সেই মহিলাকে ভিডিও করছিলো। সেই ইহুদি পুলিশগুলো সেই মহিলাকে খুব খারাপ ভাবে থাপ্পড় মারছিলো এবং তার মুখের হিজাব খুলে নিচ্ছিলো। এই অবস্থায় সেই মহিলা মহান আল্লাহ তা’য়ালা রাব্বুল আলামিনের কাছে চিৎকার করে করে সাহায্য চাইছিলো। বন্ধুরা এরপরে বিস্তারিত জানার আগে ভিডিওটিতে এখনো লাইক দেননি এখনি একটি লাইক দিয়ে দিন। বন্ধুরা সেই দুইজন ইহুদি সন্ত্রাসী পুলিশ মহিলাকে কাপড় ছাড়া করতে চাইছিলো, ঠিক সেই সময় এমন একটি ঘটনা ঘটে যে ঘটনার জন্য তারা একবারও আন্দাজ করতে পারেনি। আর সেই মুহুর্তে যে ঘটনা ঘটেছিলো সেই ঘটনাটি সেইখানে উপস্থিত অন্য একজন ইহুদি পুলিশ তার মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করে সেই মহিলা মহান আল্লাহ তা’য়ালার কাছে সাহায্য চাইছিলো, চিৎকার করে করে কান্না করছিলো, ঠিক সেই সময় হঠাৎ করে একজন সাদা দাড়িওয়ালা মানুষ সেখানে চলে আসেন আর তিনি ইজরায়েলি পুলিশগুলোর দুই হাত ধরে বলতে থাকেন, “আল্লাহ তায়ালার এই বান্দিকে ছেড়ে দিন।” সেই দুইজন সন্ত্রাসী ইহুদি পুলিশ সেই বৃদ্ধকে অনেক বকাঝকা করে এবং শেষ পর্যন্ত একজন ইহুদি পুলিশ সেই মানুষটিকে তার হাতের আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে সেই বৃদ্ধকে মেরে ফেলে আর এই ঘটনা দেখে সেখানে উপস্থিত সকলেই অনেক ভয় পেয়ে যায়। সেই বৃদ্ধ মারা যাবার আগে বলছিলো “তোমাদের লজ্জা করেনা বার বার তোমরা মুসলমানদের উপর এভাবে অত্যাচার করো এবং এভাবে এই মসজিদ দখলের চেষ্টা করো। দেখবে একদিন তোমাদের এমন পরিস্থিতি হবে যেটা তোমরা কোনদিন কল্পনা করতে পারো নি। আর সেদিন তোমরা কোথাও পালিয়ে যেতে পারবে না। কেননা যারাই মুসলমানদের উপর অত্যাচার করেছে তাদের এমন পরিস্থিতি হয়েছে যা তারা কখনো ভাবতেও পারেনি।” কিন্তু বন্ধুরা হঠাৎ করেই একটি উজ্জল আলো সেখানে আসলো এবং সেই আলো সবার চোখ ঝলসিয়ে দিচ্ছিলো। সেই মানুষগুলো কিছুক্ষণ পর্যন্ত কিছুই দেখতে পাচ্ছিলোনা। কিন্তু সেই মহিলা বলেছে আমি সেখানে এমন একটি জিনিস দেখতে পাই যেটা দেখতে পাখির মতো এবং আমি সেখানে এমন একটি শব্দ শুনতে পায় যা পাখির ডানার মতো শব্দ ছিলো। কিন্তু আমি সেটি অতিরিক্ত উজ্জল আলোকিত হওয়ায় স্পষ্ট দেখতে পায়নি তবে আমার এতোটুকু মনে হচ্ছিলো তার দুটো ডানা ছিলো এবং সেটি দেখতে পাখির মতো কিন্তু পাখি নয় কেননা তার মানুষের মতো শরীর ছিলো। বন্ধুরা এই ঘটনাটা সেই সময়ে সেখানে উপস্থিত প্রতিটি ইহুদি পুলিশ দেখে্ছে। কিন্তু এই ঘটনাটা কি ছিলো সেটা কেউ বুঝতে পারিনি। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরেই সেই মহিলা দেখতে পারে যে বৃদ্ধ মানুষটিকে কিছুক্ষণ আগেই ইহুদি পুলিশগুলো আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হত্যা করেছিলো সেই বৃদ্ধ মানুষের শরীর সেখানে নেই এবং তিনি বুঝতে পারলেন নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তায়ালা রাব্বুল আলামিন কোন ফেরেশতাকে বৃদ্ধ মানুষের রূপ ধরে তাকে সাহায্য করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। কেননা বন্ধুরা সেই বৃদ্ধ মানুষটির লাশ সেখান থেকে হারিয়ে যায় তারপরেই এই উজ্জ্বল আলোটি দেখা গিয়েছিলো। আর সেই উজ্জ্বল আলোকিত আলোটি দেখে এবং সেই অদ্ভুত প্রাণীটিকে দেখে  ইহুদি পুলিশগুলো সেখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এবং সেই মহিলার সম্মান রক্ষা পায়। বন্ধুরা আপনারা জানলে অবাক হয়ে যাবেন সেই সময় ইহুদি পুলিশগুলো যে মহিলার উপর অত্যাচার করছিলো এবং সম্মান নষ্ট করার চেষ্টা করছিলো তারা বর্তমানে কয়েকসপ্তাহ ধরে হসপিটালে ভর্তি রয়েছে। সেই উজ্জ্বল আলো দেখার পর তাদের শরীরে এমন একটি অবস্থা হয়ে গেছে যে ডক্টর তাদের কোন চিকিৎসা করতে পারছে না। তাদের এতোদিন হয়ে যাবার পরেও তাদের ঠিকঠাক করে জ্ঞান ফিরছে না। প্রিয় বন্ধুরা এটি এমন একটি ঘটনা যে ঘটনা ইহুদিদের নাড়িয়ে দিয়েছে।” উপরোক্ত দাবির সূত্র ধরে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বা নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রে উল্লিখিত দাবির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

অর্থাৎ, মসজিদুল আল আকসায় ফেরেশতা দেখতে পাওয়া এবং ঐ ঘটনার সাথে জড়িয়ে ইসরাইলি পুলিশ দ্বারা মুসলিম নারী নির্যাতনের দাবিটি সঠিক নয়।

মূলত, সম্প্রতি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘ইসরাইলের মসজিদে হঠাৎ করে ফেরেশতা নেমে আসার কারণ কি’ শীর্ষক শিরোনামে ইসরাইলের মসজিদুল আল আকসাতে এক নারীকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নির্যাতনকালে আকাশ থেকে ফেরেশতা নেমে আসার দাবিতে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, আলোচিত ভিডিওটি সিজিআই প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি এবং আলোচিত ভিডিওতে উল্লিখিত ঘটনার কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রমাণ নেই। 

উল্লেখ্য, পূর্বেও সিজিআই পদ্ধতিতে তৈরি একাধিক ভিডিও বাস্তব দাবিতে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে সেগুলো শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

সুতরাং, ইসরাইলের মসজিদুল আল আকসায় ফেরেশতা দেখতে পাওয়ার দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img