- ফেসবুক ও এক্সে সংবাদ পাঠিকা সারাহ মেহজাবিনের নাম-ছবি দিয়ে একাধিক ভুয়া আইডি-পেজের সন্ধান।
- নিয়মিত বিতর্কিত ও ভুয়া দাবি প্রচার।
- গত সাত মাসে অন্তত ২৫ অপতথ্য শনাক্ত।
- মূল হোতা মো: শিলন রেজা বিশ্বাস নামে ঢাকার এক ব্যক্তি।
- বিতর্কিত পোস্টের জেরে সম্মানহানি ঘটছে সারাহ মেহজাবিনের।
গত মে ও জুনে দুই দফায় ভারতে ভেকুর সঙ্গে এক ব্যক্তিকে ঝুলিয়ে মারধরের ভিডিওকে বাংলাদেশের সীতাকুণ্ডের ঘটনা এবং এটিকে জামাত শিবির ক্যাডার কর্তৃক আওয়ামী লীগ কর্মীকে নির্যাতনের দৃশ্য দাবিতে ছড়ানো হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, এক্সে Sarah Khan নামে সে সময় চালু থাকা একটি অ্যাকাউন্ট থেকেও এই দাবিটি প্রচার করা হয়। রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বেসরকারি ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম একাত্তর টিভির সংবাদ পাঠিকা সারাহ মেহজাবিনের নাম ও ছবি ব্যবহার করে বেশ কয়েক মাস যাবত পেইড সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে ব্লু ভেরিভাই করে নিয়ে ভুয়া ফেসবুক ও এক্স অ্যাকাউন্ট তৈরি করে এগুলোতে নিয়মিত বিতর্কিত পোস্ট করা হচ্ছে, ছড়ানো হচ্ছে অপতথ্য। যা সারাহ মেহজাবিনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে শঙ্কার মধ্যে ফেলছে। এসবের পেছনে থাকা মূল হোতারও সন্ধান পাওয়া গেছে।
এক্স থেকে ফেসবুক: একই সুতোয় গাঁথা
গেল মার্চ থেকেই এক্সে সারাহ মেহজাবিন নামের ভেরিফাইড অ্যাকাউন্টটির প্রচার করা অপতথ্য নিয়মিত শনাক্ত হচ্ছিল। এর প্রেক্ষিতে অ্যাকাউন্টটির বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। চলতি মাসে এই প্রতিবেদন প্রকাশের আগ পর্যন্ত এই একটি অ্যাকাউন্ট থেকেই প্রচার হওয়া অন্তত ১৫টি অপতথ্য শনাক্ত হয়৷
অ্যাকাউন্টটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এটি খোলা হয়েছে চলতি বছরের মার্চে। ১৫ হাজারের অধিক ফলোয়ারসমৃদ্ধ ভেরিফাইড এই অ্যাকাউন্টের লোকেশন দেওয়া রয়েছে ঢাকার মিরপুরের দক্ষিণ কাজিপাড়া।

sarrah1216 ইউজার নেমে বর্তমানে অ্যাকাউন্টটি সচল থাকলেও রিউমর স্ক্যানারের কাছে সংরক্ষিত আর্কাইভ ঘেঁটে দেখা যায়, অন্তত মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত অ্যাকাউন্টতে SarahMahja37308 এই ইউজার নেম ব্যবহার হচ্ছিল। সে সময়ও অ্যাকাউন্টটি ভেরিফাইড ছিল। তখন অ্যাকাউন্টটির নাম ছিল Sarah Mahjabin. পরে নাম বদলে Sarah Khan রাখা হলেও অ্যাকাউন্টের কার্যক্রমে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
এক্সের এই অ্যাকাউন্টের পরিচিতি অংশে একটি ফেসবুক পেজের লিংক দেওয়া আছে। এই লিংকে গিয়ে দেখা যায়, একই ছবি ব্যবহার করে চালু থাকা ২০ হাজারের অধিক ফলোয়ার সমৃদ্ধ এই পেজের নাম ‘সারাহ্’। চলতি বছরের ২১ এপ্রিল চালুর পর পেজটির নাম আর পরিবর্তন হয়নি। পেজটি অবশ্য ভেরিফাইড করা নয়। পেজের ট্রান্সপারেন্সি সেকশন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ছয়টি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পেজটি পরিচালনা করা হচ্ছে।
এই পেজটির গত জুলাইয়ের একটি পোস্টে দেখা যায়, এই পেজটির এডমিন হিসেবে আছে শিলন রেজা নামের একটি অ্যাকাউন্ট।

গত জুনে এক পোস্টে এই পেজে জানানো হয়, সে সময় এক্স থেকে ৩৫.৮৩ ডলার আয় হয়েছে তার।
পেজটির কার্যক্রম পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা যায়, এই পেজ থেকে প্রায়ই Sarah Khan নামে একই নারীর ছবি ব্যবহার করে চালু থাকা আরেকটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পোস্ট শেয়ার করা হয়৷ গত ২০ জুলাই পেজের এক পোস্টে এই অ্যাকাউন্টটি তার নিজের জানিয়ে তাতে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে আহ্বান জানানো হয়। বলা হয়, “আমার এই পেজের অবস্থা বেশি একটা ভালো না। হয়তো যে কোন সময় নষ্ট হয়ে যেতে পারে কারণ কালকে একটা পোস্ট লিখছিলাম ভয়ানক পরিমাণে রিপোর্ট করছে। ইজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে তাই আমার অন্য একাউন্টের লিংক দিলাম যেটা ভেরিফাই করা। শুধুমাত্র স্বাধীনতার স্বপক্ষে শক্তি যারা তারাই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান বাকিদের একসেপ্ট করব না।” (বানান অপরিবর্তিত)
২০১০ সালের ০৫ জানুয়ারি খোলা অ্যাকাউন্টটি মেটা ভেরিফাইড। অ্যাকাউন্টে ৬৫ হাজার ফলোয়ার রয়েছে এবং বাংলাদেশ থেকে একজন অ্যাকাউন্টটি পরিচালনা করছেন৷
এই অ্যাকাউন্টে ২০২৪ সালের জানুয়ারির একটি পোস্টের কমেন্ট নজরে আসে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের। বিড়াল সংক্রান্ত পোস্টটিতে সা রা হ নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে উক্ত পোস্টের সাথে প্রাসঙ্গিক একটি কমেন্ট করা হয়৷ কমেন্টের রিপ্লাইও করা হয় সারাহ খান নামের অ্যাকাউন্ট থেকে। ‘সা রা হ’ নামের অ্যাকাউন্টটিও সারাহ মেহজাবিনের ছবি ব্যবহার করে সচল রয়েছে।

লকড অবস্থায় থাকায় অ্যাকাউন্টটির কার্যক্রম পর্যালোচনা না করা গেলেও অ্যাকাউন্টটি যে কয়েক বছরের পুরোনো তা নিশ্চিত হতে পেরেছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। ২০২২ সালের মে মাসে এবং ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ভিন্ন ভিন্ন দুই ব্যক্তি এই অ্যাকাউন্টকে ট্যাগ করে পোস্ট করেছেন। সে সময়ও একই নামেই অ্যাকাউন্টটি সচল ছিল।

অর্থাৎ, এক্সে একটি অ্যাকাউন্ট এবং ফেসবুকে দুইটি অ্যাকাউন্ট ও একটি পেজের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে।
কে আছে আড়ালে?
সারাহ মেহজাবিনের নাম ও ছবি ব্যবহার করে দিনের পর দিন কারা এসব অ্যাকাউন্ট ও পেজে কার্যক্রম চালাচ্ছে সেটি খুঁজে বের করতে বেশ কিছুদিন ধরেই অনুসন্ধান করছিল রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। এর প্রেক্ষিতে ফেসবুকে ফিল্টারিং এবং কিওয়ার্ড সার্চ পদ্ধতির ব্যবহারে ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর Sunshine Aviary নামে ঢাকার একটি পাখি বেচাকেনা সংক্রান্ত প্রোফাইলের একটি পোস্ট নজরে আসে আমাদের। পোস্টে ‘মো: শিলন রেজা বিশ্বাস’ নামে একটি অ্যাকাউন্টকে মেনশন করা ছিল। এই নামের ওপর ক্লিক করলে সেটি এখন ‘Sarah Khan’ নামের ভেরিফাইড অ্যাকাউন্টটিতে নিয়ে যাচ্ছে। রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট সে সময়ের আরো কিছু পোস্ট বিশ্লেষণ করেও নিশ্চিত হয়েছে যে এই অ্যাকাউন্টের আগের নাম ছিল ‘মো: শিলন রেজা বিশ্বাস’।

তবে নামটি ঠিক কবে পরিবর্তন করা হয়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও অ্যাকাউন্টটি বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট এটা নিশ্চিত হয়েছে যে গেল বছরের মধ্য সেপ্টেম্বরের (৭ সেপ্টেম্বরের একটি পোস্টে পূর্বের নাম ছিল।) পর থেকে অক্টোবরের মধ্যে আগের নাম বদলে ‘Sarah Khan’ রাখা হয়।
Sunshine Aviary এর পোস্টটিতে ‘শীলন NEST’ নামে আরেকটি পেজকে মেনশন করা আছে। এটিতে ক্লিক করলে এখন Citibird নামে একটি পেজে নিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের মে মাসে এই নাম পরিবর্তন করা হয়। এই পেজের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে ঢাকার মিরপুর-১০ এর দক্ষিণ কাজিপাড়া। একই ঠিকানা দেওয়া আছে এক্সে Sarah Khan নামের অ্যাকাউন্টটিতেও। পেজটিতে যোগাযোগের জন্য যে নাম্বার দেওয়া রয়েছে তা ট্রু কলারে ‘শিলন’ নামে পাওয়া যায়।
সারাহ খান নামের অ্যাকাউন্টটির সাথে যে শিলন রেজার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তা আরো নিশ্চিত হওয়া যায়, ২০২৪ সালের জুনে সারাহ খান নামের অ্যাকাউন্টের একটি পোস্ট থেকে। এই পোস্টে Shilon Reza নামের একটি অ্যাকাউন্টকে ট্যাগ করা রয়েছে। যদিও অ্যাকাউন্টটিতে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের পর আর কোনো পোস্ট করতে দেখা যায়নি৷

শিলন রেজার বর্তমান মূল অ্যাকাউন্টটিও খুঁজে বের করেছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। MD Shilon Reza Biswas নামের ভেরিফাইড এই অ্যাকাউন্টটি ২০১১ সালের অক্টোবরে খোলা হয়। শিলন নিজেকে ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি এই অ্যাকাউন্টের পরিচিতি অংশটি পর্যালোচনা করে আরো জানা যাচ্ছে, তিনি ‘ফ্যাক্টচেকিং’ নামের একটি পেজের (যদিও পেজটির আগে পাখিকেন্দ্রিক কিছু নাম ছিল। গত বছরের জুলাইতে সর্বশেষ নাম পরিবর্তন করা হয়।) সিইও এবং Shrevi Pets Care নামে মিরপুরের কাজীপাড়ায় একটি দোকান রয়েছে তার। সারাহ খান নামের ভেরিফাইড অ্যাকাউন্টের ২০২৪ সালের ০৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট প্রদান পরবর্তী সময়ের একটি পোস্টে থাকা ছবিতেও Shrevi Pets Care নাম লেখা থাকার প্রমাণ মিলেছে। শিলনের একটি ফেসবুক পেজ ও ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টেরও সন্ধান মিলেছে।
ওপেন সোর্সে অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের হাতে আসা শিলনের ই-ট্রেড লাইসেন্সে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তার পুরো নাম মো: শিলন রেজা বিশ্বাস। পিতার নাম মো: মনিরুল ইসলাম বিশ্বাস। মায়ের নাম মোছা: বেদেনা খাতুন। স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে মেহেরপুরের নাম উল্লেখ থাকলেও শিলন বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ করেছেন ঢাকার মিরপুরের কাজীপাড়া।
ভুয়া অ্যাকাউন্টগুলো পর্যালোচনা করে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট বেশ কিছু পোস্ট খুঁজে পেয়েছে যেগুলোতে শিলন ও সারাহ মেহজাবিনের একসাথে তোলা কথিত কিছু ছবি যুক্ত রয়েছে। পোস্টগুলো দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে।

ছবিগুলোতে শিলনকে সারাহর ছোট ভাই হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্তত দুইটি ছবিতে দুইজন মেয়ে শিশুকেও দেখা যাচ্ছে। এদেরকেও সারাহর বোন হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। আসল সারাহ মেহজাবিনের সাথে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের আলাপকালে তিনি জানিয়েছেন যে তার কোনো ছোট ভাই নেই। এই ব্যক্তিকে তিনি কখনো দেখেননি। এমনকি সাথের দুই মেয়ে শিশুকেও তিনি চেনেন না। পরিবারে তার একজন বড় ভাই আছেন।
ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি বলে প্রতীয়মান হয়েছে। শুধু এই ছবিগুলোই নয়, এই অ্যাকাউন্টগুলোতে সারাহর একাধিক এআই দিয়ে ছবি তৈরি করে প্রচার করার প্রমাণ মিলেছে।
কী ধরণের কার্যক্রম চালাচ্ছে অ্যাকাউন্টগুলো?
সারাহ মেহজাবিনের নাম ও ছবি ব্যবহার করে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে Sarah Khan নামের ফেসবুক ও এক্সের দুইটি অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিতই নানা বিষয়ে পোস্ট হচ্ছে। অনুসন্ধানের স্বার্থে দৈবচয়নভিত্তিতে নির্দিষ্ট একদিনের এই দুই অ্যাকাউন্টের কার্যক্রম পর্যালোচনা করেছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, শুধু ২৫ সেপ্টেম্বরেই ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টটিতে ২৫টি পোস্ট করা হয়৷ একইদিনে এক্স অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা হয় ২০টি৷ দুই অ্যাকাউন্টের পোস্টগুলো সাধারণত একই এবং ২/১ মিনিটের ব্যবধানেই করা হয়। তবে এক্সে সেদিনের পোস্টের পরিমাণ কম হওয়ার কারণ ফেসবুকে করা আটটি পোস্ট এক্সে করা হয়নি। আবার এক্সে করা হয়েছে কিন্তু ফেসবুকে করা হয়নি এমন পোস্টের সংখ্যা একটি।

এসব পোস্টের মধ্যে ছয়টিতে সারাহ মেহজাবিনের এআই দিয়ে তৈরি ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। মাসে গড়ে প্রতিদিন এমন ৫/৬ টি পোস্টে সারাহর একাধিক এআই দিয়ে তৈরি ছবি যুক্ত থাকছে।
শনাক্ত হওয়া অপতথ্যের ধরণ বিশ্লেষণে যা জানা যাচ্ছে
সারাহ খান নামের এক্স ও ফেসবুকের দুইটি অ্যাকাউন্ট এবং সারাহ্ নামের ফেসবুক পেজ থেকে গত ২৩ মার্চ থেকে ০১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ছড়ানো ২৫টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এসব অপতথ্য বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট দেখতে পায়, অপতথ্যগুলোর মাধ্যমে ক্রমাগত বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সমালোচনা করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে ভিন্ন দেশের কিংবা ভিন্ন ঘটনার পুরোনো ভিডিও। যেমন, দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতি দাবিতে ভারতের, বিডার চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী কর্তৃক তার স্ত্রীকে নির্যাতনের দৃশ্য দাবিতে ভিয়েতনামের ভিডিও, ২০২৪ সালের মার্চের আগের সরকারের আমলের ভিডিওকে একজন নিরাপত্তাকর্মী এক নারী পোশাক শ্রমিককে মারধরের চলতি বছরের দৃশ্য হিসেবে প্রচার করা হয়েছে।
গেল বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় গর্ভবতী নারী পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার একটি দাবি সেসময় প্রচার হচ্ছিল সামাজিক মাধ্যমে। এমন কোনো ঘটনা যে ঘটেনি তা সে সময়ই ফ্যাক্টচেক করে জানায় রিউমর স্ক্যানার। তবু এই অপতথ্য নিয়মিত প্রচার হয়ে আসছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি ভুয়া ছবি। সে ছবি ব্যবহার করে ঘটনাটিকে সত্যি দাবি করে গত এপ্রিলে সারাহ খান নামের এক্স অ্যাকাউন্টটিতেও পোস্ট করা হয়।
নারীদের হেয় করে আপত্তিকর কনটেন্টের প্রচারও দেখা গেছে এসব অ্যাকাউন্টে। জাতীয় নাগরিক পার্টির নেত্রী তাসনিম জারার হাফ প্যান্ট পরিহিত সম্পাদিত ছবি দিয়ে চালানো হয় অপপ্রচার। তাছাড়া, বৈশ্বিক বিভিন্ন ঘটনাবলির প্রেক্ষিতেও অপতথ্যের প্রচার ছিল এসব অ্যাকাউন্টে।
এছাড়া, সশস্ত্র বাহিনীকে জড়িয়ে ভুয়া প্রেস রিলিজসহ সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনায় নিয়মিত অপতথ্যের প্রচার লক্ষ্য করা গেছে এসব অ্যাকাউন্টে।
নকল সারাহ আছে আরো
উপরোক্ত পেজ এবং অ্যাকাউন্ট বাদে Sarah Mehjabeen নামে আরেকটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের হদিশ মিলেছে। এটিতেও সারাহ মেহজাবিনের ছবি নিয়মিত পোস্ট করা হয়। ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই চালু হওয়া এই অ্যাকাউন্টের ফলোয়ার প্রায় ১০ হাজার। সৌদি আরব থেকে একজন এই প্রোফাইলটি ব্যবহার করছেন।

রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের অনুসন্ধানে জানা যায়, অ্যাকাউন্টটির পূর্বের নাম ছিল Sanjida Aktar Shanta। অ্যাকাউন্টটি থেকে মেঘের দেশ নামে একটি ফেসবুক পেজের পোস্ট নিয়মিত শেয়ার করা হয়। এই পেজটি খোলা হয় ২০২৩ সালের ১৪ জুলাই। সে সময় নাম ছিল Mamunur Rashid. ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নাম বদল করা হয়। এই পেজে নিয়মিত এক নারীর ছবি ব্যবহার করে পোস্ট করা হয়৷ রিভার্স সার্চ করে দেখা যাচ্ছে, উক্ত নারীর প্রকৃত নাম Nudrat Fariha Oishee। বাংলাদেশি এই তরুণী বর্তমানে নিউইয়র্কে থাকেন।
আসল সারাহর খোঁজে
এক্সে সারাহ মেহজাবিন নামের ভেরিফাইড অ্যাকাউন্টসহ এ সংক্রান্ত অন্যান্য অ্যাকাউন্ট ও পেজের বিষয়ে অনুসন্ধানে একই নামে চালু থাকা ইনস্টাগ্রামে এবং ফেসবুকের একটি অ্যাকাউন্টে থাকা এক নারীর চেহারার সাথে আলোচিত ছবির নারীর চেহারার মিল পাওয়া যায়। সারাহ মেহজাবিন নামের এই নারী পেশায় একজন সংবাদ পাঠিকা। রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট যখন এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে সে সময় তিনি নিউজ২৪ চ্যানেলে কর্মরত ছিলেন। চলতি মাসে তিনি একাত্তর টিভিতে যোগ দিয়েছেন। এই দুইটি অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১ লক্ষ ৩১ হাজার ফলোয়ার সমৃদ্ধ ইনস্টাগ্রামের অ্যাকাউন্টটি খোলা হয় ২০১৪ সালের জুলাইতে৷ অন্যদিকে, ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি খোলা হয় তারও দুই বছর আগে, ২০১২ সালের জুলাইতে। এর সাথে একই নামে তার আরেকটি ফেসবুক পেজ ও একটি থ্রেডস অ্যাকাউন্টেরও সন্ধান পাওয়া যায়। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের দুই অ্যাকাউন্ট ও পেজটির পোস্টগুলো বিশ্লেষণ করে সারাহকে নিয়মিত নিজের ছবি, পারিবারিক ও বিভিন্ন ট্যুরের ছবি প্রচার করতে দেখা যাচ্ছে। তবে কখনোই বাংলা ভাষায় কোনো পোস্ট দিতে দেখা যায়নি তাকে। সারাহ রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটকে নিশ্চিত করেছেন যে এই চারটি ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার আর কোনো অ্যাকাউন্ট নেই।
সারাহ মেহজাবিন বলছেন, তিনি ভুয়া অ্যাকাউন্টের বিষয়ে অবগত ছিলেন। এর প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি অ্যাকাউন্টের বিষয়ে সাধারণ ডায়েরী (জিডি) করেন। জিডির কপি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ভাটারা থানায় জিডিটি করা হয়। সারাহ জিডিতে উল্লেখ করেন, ঐ অ্যাকাউন্টটি থেকে রাজনৈতিক খবর প্রচার করে তার সম্মানহানি ঘটানো হচ্ছে। সারাহ রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটকে জানিয়েছেন, পরবর্তীতে উক্ত অ্যাকাউন্টটি ডিজেবল হয়।
সারাহ মেহজাবিন যে এই বিষয়টি নিয়ে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন তার উদাহরণ পাওয়া যায় একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে। সম্প্রতি সারাহ খান নামের ফেসবুকের ভেরিফাইড অ্যাকাউন্টের একটি পোস্টের স্ক্রিনশট ব্যবহার করে ফেসবুকে সারাহ মেহজাবিনের সমালোচনা করা হয়, তাকে আখ্যা দেওয়া হয় নাস্তিক হিসেবে। এমনকি সমালোচনা হয় তার কর্মস্থল নিয়েও।

অভিযোগ দায়েরে সোচ্চার হতে পরামর্শ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
সারাহ মেহজাবিনের বিষয়টি নিয়ে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট আলাপ করেছিল সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসিম উদ্দিন খানের সাথে। তিনি বলছেন, এই ধরণের ঘটনাগুলোয় অপরাধের ধরণ অনুযায়ী শাস্তি নির্ধারণ হয়। এসব ভুয়া আইডির বিষয়ে যত দ্রুত সম্ভব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানালে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়৷ তিনি এসব বিষয়ে অভিযোগ জানাতে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দিয়েছেন।
কাজের পদ্ধতি
এই অনুসন্ধানটি করা হয়েছে রিউমর স্ক্যানারের বিশেষায়িত বিভাগ ‘রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট’ এর অধীনে। এই ইউনিট গত মার্চ থেকে নিয়মিত সংবাদ পাঠিকা সারাহ মেহজাবিনের নাম ও ছবি ব্যবহার করে চালু থাকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট ও পেজগুলোর কার্যক্রমের ওপর নজর রাখছিল। ওপেন সোর্স পদ্ধতির ব্যবহারে করা দীর্ঘ এই অনুসন্ধানে খুঁজে বের করা হয়েছে এসব ভুয়া অ্যাকাউন্ট ও পেজের পেছনে থাকা মূল ব্যক্তিকে। প্রতিবেদনটি প্রকাশের নিমিত্তে চলতি বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে উক্ত অ্যাকাউন্টগুলো থেকে শনাক্ত হওয়া প্রতিটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করা হয়েছে, পর্যালোচনা করা হয়েছে অ্যাকাউন্টগুলোর কার্যক্রম। যোগাযোগ করা হয়েছে ভিক্টিমের সাথে, বক্তব্য নেওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও।
Feature Design: Md. Shahajalal Mia