বাংলাদেশে আগামী ১৭ জুন ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। মুসলমানদের অন্যতম প্রধান এই ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে গেল কয়েক বছর ধরেই ইন্টারনেটের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডিজিটাল প্রতারণার নতুন নতুন কৌশল সম্পর্কে জানা যাচ্ছে। এবারও তেমন একটি প্রতারণার বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। দেশের জনগণকে ২৫-৩০ হাজার টাকা ঈদ বোনাস দেওয়ার ভুয়া প্রতিশ্রুতির পোস্ট ফেসবুকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচার করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। এই প্রতারণার ফাঁদকে বিশ্বস্ত করে তুলতে কখনো প্রধানমন্ত্রীর ছবি, কখনো বা গণমাধ্যমের লোগোকে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা দেখে যে কেউ ভেবে নেবেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই হয়ত এই বোনাস দেওয়ার ঘোষণা করেছেন কিংবা এই ঘোষণা মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। এই বিজ্ঞাপনগুলোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বিকাশের ওয়েবসাইটের অনুকরণে তৈরি কিছু নকল ওয়েবসাইটে প্রবেশ করানো হচ্ছে, যেখানে ঈদ উপলক্ষ্যে বড় অঙ্কের বোনাস প্রদানের প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকরা।
গত ০৫ ও ০৬ জুন মেটার অ্যাড লাইব্রেরি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এ সময়ে ১২ হাজারেরও বেশি এমন বিজ্ঞাপন এই ধরণের প্রতারণার উদ্দেশ্যে প্রচার করা হয়েছে। ‘বোনাস পেতে এখানে ক্লিক করুন’ কি-ওয়ার্ড ব্যবহার করে এই বিপুল সংখ্যক বিজ্ঞাপন খুঁজে বের করেছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। নারীদের নামে তৈরি বিভিন্ন ফেসবুক পেজ থেকে এই বিজ্ঞাপনগুলো প্রচার করা হচ্ছে। রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট এমন ২০টি পেজের তালিকা তৈরি করেছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, অধিকাংশ পেজের অ্যাডমিনের অবস্থান ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়ায় দেখানো হচ্ছে। অল্প সংখ্যক পেজের অ্যাডমিনের অবস্থান বাংলাদেশে এবং কেবল একটি পেজের অ্যাডমিনের অবস্থান ভারতে দেখানো হচ্ছে।
ক্রমিক | পেজের নাম | পেজ চালুর তারিখ | অ্যাডমিনদের লোকেশন (জন) |
১ | মাহজাবিন | ১৬ মার্চ, ২০২৪ | ইন্দোনেশিয়া (০৩) |
২ | সাদিয়া আফরিন | ১০ মার্চ, ২০২৪ | ইন্দোনেশিয়া (০২) বাংলাদেশ (০১) |
৩ | নূর আয়েশা | ১১ মার্চ, ২০২৩ | ইন্দোনেশিয়া (০২) বাংলাদেশ (০২) |
৪ | জান্নাতুল মীম | ০৯ মে, ২০২৪ | ইন্দোনেশিয়া (০৩) বাংলাদেশ (০১) |
৫ | জান্নাতুল প্রিয়া | ০৯ মে, ২০২৪ | ইন্দোনেশিয়া (০২) বাংলাদেশ (০১) |
৬ | মেঘলা মিথিলা | ৩১ মার্চ, ২০২৪ | কম্বোডিয়া (০৩) ইন্দোনেশিয়া (০৩) |
৭ | Farzana Yasmin | ১৬ মার্চ, ২০২৪ | ইন্দোনেশিয়া (০৩) |
৮ | Rumpa | ২১ মার্চ, ২০২৪ | কম্বোডিয়া (০৩) ইন্দোনেশিয়া (০৩) |
৯ | Nusrat Anni | ১৪ এপ্রিল, ২০২৪ | ইন্দোনেশিয়া (০২) |
১০ | Farzana Yasmin | ২১ মার্চ, ২০২৪ | ইন্দোনেশিয়া (০৩) |
১১ | Sadia Afrin | ২১ মার্চ, ২০২৪ | ইন্দোনেশিয়া (০৩) |
১২ | Sadia Farhim | ০৬ এপ্রিল, ২০২৪ | ইন্দোনেশিয়া (০৩) |
১৩ | Homayra Hima | ০৬ এপ্রিল, ২০২৪ | ইন্দোনেশিয়া (০৩) বাংলাদেশ (০১) |
১৪ | Jannatul Mawa | ২৯ মার্চ, ২০২৪ | কম্বোডিয়া (০৩) ইন্দোনেশিয়া (০৩) |
১৫ | Mim Jara | ২০ মার্চ, ২০২৪ | কম্বোডিয়া (০৩) ইন্দোনেশিয়া (০৩) বাংলাদেশ (০১) |
১৬ | Afiya Tanjum | ১৪ এপ্রিল, ২০২৪ | ইন্দোনেশিয়া (০২) |
১৭ | Ayesha Tasnim | ১৬ মার্চ, ২০২৪ | কম্বোডিয়া (০৩) ইন্দোনেশিয়া (০৩) বাংলাদেশ (০১) |
১৮ | Farhana Mumu | ১৬ মার্চ, ২০২৪ | কম্বোডিয়া (০৩) ইন্দোনেশিয়া (০৩) ইন্ডিয়া (০১) |
১৯ | Fariya Tumpa | ২৯ মার্চ, ২০২৪ | ইন্দোনেশিয়া (০৩) |
২০ | শান্তা ফারজানা | ১৬ মার্চ, ২০২৪ | ইন্দোনেশিয়া (০৩) |
প্রতারণাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে নানান কৌশল
রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতারকরা তিন ধরনের ডিজিটাল ব্যানার ব্যবহার করে এই বিজ্ঞাপনগুলো প্রচার করছে। প্রতিটি ব্যানারে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। দুটি ব্যানারে প্রধানমন্ত্রীর ছবির পাশাপাশি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের লোগো যুক্ত করা হয়েছে। অন্য একটি ব্যানারে বিকাশে ৩০ হাজার টাকা ক্যাশ ইন হওয়া মেসেজের স্ক্রিনশট ব্যবহার করা হয়েছে।
গত বছরের ১ নভেম্বর গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ন্যাশনাল কার্ড স্কিম ‘টাকা পে’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উক্ত অনুষ্ঠানের একটি ভিডিও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভির ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর ছবি এবং ‘আজ থেকে চালু হচ্ছে ‘টাকা পে’ কার্ড’ শিরোনাম ব্যবহার করে এই ইউটিউব ভিডিওটির থাম্বনেইল তৈরি করা হয়। প্রতারকরা এই থাম্বনেইল বিকৃত করে ‘দেশের সবাইকে দিচ্ছি ২৫ হাজার টাকা ঈদ উপহার’ শীর্ষক নতুন শিরোনাম যুক্ত করে ফেসবুকে প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন চালাচ্ছে।
এই বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পেরে টিভি চ্যানেলটি দর্শকদের উদ্দেশ্যে একটি সতর্কতামূলক পোস্ট দিয়ে নিশ্চিত করে যে, এই ছবিটি তাদের তৈরি নয়। একইভাবে, প্রতারকরা বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইনডিপেনডেন্ট টিভির ইউটিউব চ্যানেলের থাম্বনেইলের ডিজাইন নকল করেও এমন বিজ্ঞাপন চালাচ্ছে।
বিশ্বাস অর্জনের জন্য প্রতারকরা বিজ্ঞাপনগুলোর সাথে বিভিন্ন বিশ্বস্ত ওয়েবসাইটের লিংক যুক্ত করে দিচ্ছে। এক বিজ্ঞাপনে দেশের অন্যতম মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের লিংক প্রিভিউ হিসেবে দেখা যায়। তবে লিংকে প্রবেশ করলে নিয়ে যাওয়া হয় বিকাশের ওয়েবসাইটের অনুকরণে তৈরি নকল ওয়েবসাইটে।
রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয় যে, এই কৌশলগুলো মানুষের বিশ্বাস অর্জনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ বেনামি কোনো ফেসবুক পেজ থেকে প্রচারিত বিজ্ঞাপনকে খুব সহজে গ্রহণ করবে না। তাই প্রতারকরা বিজ্ঞাপনগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর ছবি, গণমাধ্যমের লোগো এবং এমএফএস সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের লিংক ব্যবহার করছে।
প্রতারণার সেকাল একাল
রিউমর স্ক্যানার টিম দীর্ঘদিন ধরে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন প্রতারণামূলক ক্যাম্পেইনের বিরুদ্ধে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। বিশেষ করে উৎসব ও ছুটির সময় এই ধরনের প্রতারণার মাত্রা বাড়ে। পূর্বের বছরগুলোতে নানা উৎসবের নাম করে বিকাশ এবং অন্যান্য মাধ্যম থেকে বিভিন্ন উপহারের প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে প্রতারিত করা হত। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালের ঈদে ৫০ জিবি ফ্রি ইন্টারনেট, ২০২৩ সালে বাংলা নববর্ষে ৫০ জিবি ফ্রি ডাটা, ২৬ মার্চে ২৬০০ টাকা, ২১ ফেব্রুয়ারিতে ২১০০ টাকা, রমজানে ৩০ হাজার টাকার সরকারি ভর্তুকি, ঈদুল আযহায় ৪৯৯৯ টাকার বোনাস এবং ২০২৪ সালের নতুন বছরে ২০২৪ টাকার উপহার এবং রমজানে আড়ং থেকে ৮০ হাজার টাকার উপহারের মতো প্রতারণামূলক ক্যাম্পেইন চালানো হতো।
পূর্বের এসব প্রতারণা মূলত মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তো এবং বিভিন্ন স্প্যাম লিংকে ক্লিক করানো হতো। এই লিংকগুলোর মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের অর্থ এবং তথ্য চুরির চেষ্টা করা হতো, এবং বিকাশ পিন চুরির প্রচেষ্টাও করা হতো। অনেক সময় এই লিংকে ক্লিক করলে সামাজিক মাধ্যমের আইডি হ্যাক করা বা ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মতো ঘটনাও ঘটতো।
কিন্তু বর্তমানে প্রতারণার পদ্ধতিগুলো আরও জটিল এবং বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। মেটার মালিকানাধীন প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই ক্যাম্পেইনগুলো এখন আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। বিজ্ঞাপনগুলোতে ক্লিক করলে ব্যবহারকারীরা একটি ভুয়া বিকাশ ওয়েবসাইটে পৌঁছে যায় যেখানে তাদের একটি ভুয়া ফর্ম পূরণ করতে বলা হয়। ফর্মটিতে ব্যবহারকারীদের নাম, জেলা, বিকাশ ব্যবহারের সময়কাল, বর্তমান ব্যালেন্স এবং বিকাশ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা জিজ্ঞাসা করা হয়। ব্যবহারকারী যখন এই তথ্য প্রদান করে এবং জমা দেয়, তখন তাদের বিকাশের পেমেন্ট গেটওয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ফর্মে পূরণ করা বিকাশের বর্তমান ব্যালেন্স হয়ে যায় পেমেন্টের পরিমাণ। এরপরের দুই ধাপে ওটিপি এবং বিকাশের পিন চাওয়া হয়। যা দিলেই ওই নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ব্যবহারকারীদের অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে নেওয়া হয়।
ফাঁদে পড়ে অর্থ হারাচ্ছেন অনেকেই
রিউমর স্ক্যানারের ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের করা এ সংক্রান্ত তালিকায় থাকা পেজগুলো পর্যবেক্ষণ করে এক ভুক্তভোগীর খোঁজ পাওয়া যায়। ভুক্তভোগী মোঃ মতিউর রহমান জানান, ফেসবুক ব্যবহারের সময় তার ফিডে একটি বিজ্ঞাপন আসে যা তাকে একটি ওয়েবসাইটে নিয়ে যায়। ওয়েবসাইটে আবেদন ফর্ম পূরণের সময় সন্দেহ জাগলে তিনি তার বিকাশ অ্যাকাউন্টের অধিকাংশ টাকা তুলে নেন, কিন্তু অল্প কিছু টাকা রেখে চেষ্টা করেন। ফলশ্রুতিতে, সেই অল্প কিছু টাকা প্রতারকদের বিকাশ মার্চেন্ট অ্যাকাউন্টে ‘Amar Shop (01333817980)’-এ চলে যায়।
অনুরূপভাবে, তাসিন পাটোয়ারি নামের আরেক ভুক্তভোগী মেসেঞ্জার ব্যবহারের সময় বিজ্ঞাপন দেখে ওই সাইটে গিয়ে ১২০০ টাকা খুইয়েছেন। তাসিনের টাকা যায় ‘Asia Electronics (01893-133050)’ নামের এক বিকাশ মার্চেন্ট অ্যাকাউন্টে।
এই প্রতারণার ফাঁদ মেটার মালিকানাধীন একাধিক প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে পড়েছে, যার ফলে সাধারণ মানুষ তাদের কষ্টার্জিত অর্থ হারাচ্ছেন।
কত আয় করছে মেটা?
মেটার বিজ্ঞাপন মানদণ্ড অনুযায়ী, সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বিজ্ঞাপন প্রচারের আগে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির মাধ্যমে পর্যালোচনা করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে মানব পর্যালোচকদের মাধ্যমেও পর্যালোচনা করা হয়। অনুমতি পাওয়ার পরেই বিজ্ঞাপনগুলো ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছায়।
নির্বাচন বা রাজনীতি সম্পর্কিত বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করতে হয়। এই বিজ্ঞাপনগুলোতে “Paid for by” অর্থাৎ “কার মাধ্যমে অর্থায়ন করা হয়েছে” এই ধরনের তথ্য উল্লেখপূর্বক ডিসক্লেইমার প্রদান করতে হয়। যদি এই তথ্যগুলো না থাকে, তবে সেগুলো বাতিল করা হয় এবং ধারাবাহিকভাবে নীতিমালা লঙ্ঘন করলে বিজ্ঞাপনদাতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তার ছবি ব্যবহার করে প্রচারিত বিজ্ঞাপন মেটার নীতিমালা অনুযায়ী রাজনৈতিক ক্যাটাগরিতে পড়ে। তবে মেটার অ্যাড লাইব্রেরিতে দুইদিনের পর্যবেক্ষণে ১২ হাজারেরও বেশি এই ধরনের বিজ্ঞাপন পাওয়া গেছে, যেগুলো রাজনৈতিক ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত হয়নি।
অ্যাড লাইব্রেরিতে এরূপ প্রতারণামূলক কিছু বিজ্ঞাপন নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পাওয়া গেছে। মেটা বলছে, “Paid for by” ডিসক্লেইমার না থাকায় এই বিজ্ঞাপনগুলো নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। তবে নিষ্ক্রিয় হওয়ার আগেই এসব বিজ্ঞাপন পৌঁছেছে সহস্র ব্যবহারকারীর কাছে। অর্থাৎ, মেটার বিজ্ঞাপন নীতিমালাগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
এই ত্রুটির ফলে এই ভুয়া বিজ্ঞাপনগুলো চালানোর জন্য মেটাকে কী পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয়েছে বা কতজন ব্যবহারকারীর কাছে বিজ্ঞাপনগুলো পৌঁছেছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কারণ মেটা শুধু রাজনৈতিক ক্যাটাগরির বিজ্ঞাপনের জন্য এমন তথ্য প্রকাশ করে।
বিজ্ঞাপনদাতাদের মধ্যে যারা ইমপ্রেশন অর্জনের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়, তাদের কমপক্ষে ১ ডলার দৈনিক বাজেটের পরামর্শ দেয় মেটা। রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট মেটার অ্যাড লাইব্রেরিতে দুই দিনে ১২ হাজার বিজ্ঞাপন দেখতে পেয়েছে। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ছয় হাজার ভুয়া বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। এর ভিত্তিতে একটি আনুমানিক হিসাব করলে, একদিনে ছয় হাজার বিজ্ঞাপনের পেছনে কমপক্ষে এক ডলার করে খরচ করা হলেও ছয় হাজার মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশের টাকায় সাত লক্ষ সাত হাজার ৭০০ টাকা (বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার রেট ১১৭.৯৫ ধরে)। অর্থাৎ, প্রতিদিন এমন ভুয়া বিজ্ঞাপনের জন্য মেটা গড়ে সাত লক্ষ টাকা পাচ্ছে।
এছাড়া, কতজনের কাছে এই বিজ্ঞাপন পৌঁছাচ্ছে তা জানতে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট একাধিক ডিজিটাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করেছে। তাদের মতে, ১ ডলারের বিপরীতে সর্বনিম্ন ১-৩ হাজার রিচ পাওয়া যেতে পারে। তবে এ ধরনের প্রলোভনমূলক বিজ্ঞাপন ১৫-২০ হাজার রিচও অর্জন করতে পারে। কারণ মানুষ লোভের বশবর্তী হয়ে বেশি আগ্রহী হয় এবং নিজেরাও শেয়ার করে। সেই হিসাবে, ১ ডলারের বিপরীতে যদি সর্বনিম্ন ১৫০০ মানুষের কাছেও পৌঁছায় তবে এসব ভুয়া বিজ্ঞাপন প্রতিদিন ৯০ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন ছড়াচ্ছে অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমেও
ফেসবুকে বিজ্ঞাপনগুলোর মাধ্যমে প্রতারণার এই প্রচারণা শুধু ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ থাকছে না; এগুলো অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ছে (১,২)। যেমন, ১৭ মে তারিখে উল্লিখিত তিনটি ব্যানারের একটি ব্যানার দিয়ে তৈরি করা একটি ভিডিও (১) টিকটকে প্রচার হতে দেখা যায়। এই প্রতিবেদনের লেখার সময় পর্যন্ত ভিডিওটি প্রায় ১০ লক্ষবার দেখা হয়েছে, এবং প্রায় ১২ হাজার বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।
প্রয়োজন সচেতনতার
অনলাইন প্রতারণার এই ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। এ ধরনের প্রতারণা থেকে সুরক্ষা পেতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, কোনো ফেসবুক বিজ্ঞাপনে ক্লিক করার আগে তার উৎস ও বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করা উচিত। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের ছবি ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হলে সন্দেহ করা জরুরি। সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠান থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বা উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট বা সোশ্যাল মিডিয়া পেজে গিয়ে যাচাই করে নেওয়া উচিত।
দ্বিতীয়ত, যেকোনো ওয়েবসাইটে ব্যক্তিগত তথ্য প্রদান করার আগে সেই ওয়েবসাইটের URL ঠিকানা ভালোভাবে যাচাই করা উচিত। বেসরকারি ওয়েবসাইটের ক্ষেত্রে .com বা .org বা .com.bd এবং সরকারি ওয়েবসাইটের ক্ষেত্রে gov.bd এর মতো ডোমেইন ব্যবহৃত হয় কি না তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি, কারণ অনেক প্রতারকরা নকল ওয়েবসাইট তৈরি করে .net, .xyz বা .info ডোমেইন ব্যবহার করে প্রতারণা চালায়।
তৃতীয়ত, বিকাশ বা অন্য কোনো মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন করার সময় সতর্ক থাকা উচিত। বিকাশ কখনোই তাদের গ্রাহকদের কাছে পিন নম্বর বা ব্যক্তিগত তথ্য চায় না। বিকাশের তরফ থেকে বিভিন্ন সচেতনতা ক্যাম্পেইন চালানো হয় যেখানে তারা গ্রাহকদের এই বিষয়ে সতর্ক করে।
সর্বোপরি, এসব প্রতারণা থেকে রক্ষা পেতে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং অচেনা উৎস থেকে আসা কোনো লোভনীয় প্রস্তাব থেকে দূরে থাকা প্রয়োজন।