বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হননি শেখ হাসিনা

সম্প্রতি “ব্রেকিং নিউজ গুগলে পৃথিবীর নিকৃষ্ট লিখে সার্চ দিলেই আসছে হাসিনার নাম” (বানান সংশোধিত) শীর্ষক শিরোনামে একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যম টিকটকে প্রচারিত হয়েছে।

হাসিনা

উক্ত দাবিতে টিকটকে প্রচারিত ভিডিওটি দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

এই দাবিতে টিকটকে প্রচারিত একটি ভিডিও এই প্রতিবেদন প্রকাশ অবধি প্রায় ৫৫ হাজার বার দেখা হয়েছে এবং ৭ শত ১৯ বার শেয়ার করা হয়েছে। এছাড়া ভিডিওটিতে ২ হাজার ২ শত পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, নিকৃষ্ট স্বৈরশাসক/ নিকৃষ্ট শাসক/ একশত বছরে বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট পাঁচজন সরকার প্রধান দাবিতে প্রচারিত তথ্যগুলো সঠিক নয় বরং ‘দ্য স্ট্যাটিস্টিক্স ইন্টারন্যাশনাল’ নামের ভুয়া গবেষণা সংস্থা, অস্তিত্বহীন কিছু সাইট এবং দি টপটেনস.কম নামের একটি সামাজিক যোগাযোগ সাইটের অনির্ভরযোগ্য জরিপের বরাতে করা ভুঁইফোঁড় অনলাইন পোর্টালের সংবাদের সূত্রে ধরে উক্ত তথ্যগুলো দীর্ঘদিন ধরে ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে।

দাবিকৃত ভিডিওটিতে “ব্রেকিং নিউজ গুগলে পৃথিবীর নিকৃষ্ট লিখে সার্চ দিলেই আসছে হাসিনার নাম” (বানান সংশোধিত) শীর্ষক লেখা দেখা যায়।

এ বিষয়টি সম্পর্কে অনুসন্ধানে প্রশ্নোত্তর ভিত্তিক প্লাটফর্ম Quora তে এই সংক্রান্ত প্রশ্নে বাংলাদেশের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান যাচাইয়ের একটি উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়।

উত্তরে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ‘বিভিন্ন বেনামী ওয়েবসাইটে “পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট শাসক হিসাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিহ্নিত করেছে” শিরোনামে বানোয়াট কিছু সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে ‘দ্য স্ট্যাটিস্টিক্স ইন্টারন্যাশনাল’ নামক একটি অস্তিত্বহীন সংস্থার নাম দিয়ে। এসব সংবাদে শেখ হাসিনার নামের সাথে তার ছবিও ব্যবহার করা হয়েছে।

যখন আপনি “পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রধানমন্ত্রী” লিখে সার্চ করছেন গুগল সেটির অর্থ বুঝে আপনাকে ফলাফল দেখাচ্ছে না। বরং “পৃথিবী, সবচেয়ে নিকৃষ্ট, প্রধানমন্ত্রী” — এই শব্দগুলো যেসকল প্রকাশনায় পাওয়া গিয়েছে সেসবকে ও সেসব থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আপনাকে ফলাফল দেখাচ্ছে। যেহেতু আপনি বাংলায় খোঁজ করছেন, তাই ফলাফল প্রদর্শনের ক্ষেত্রে গুগল বাংলায় প্রকাশিত ওয়েবসাইটগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছে।

“পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রধানমন্ত্রী” কি-ওয়ার্ড সম্বলিত বাংলায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কারো সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য ও মানসম্মত প্রকাশনা না থাকায়, ফলাফলে আপনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছবি দেখছেন।’

অর্থাৎ, কিছু অস্তিত্বহীন সংস্থার সূত্রে বিভিন্ন ওয়েবসাইট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে  বিশ্বের নিকৃষ্ট শাসক হিসেবে উল্লেখ করে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ফলে কেউ যখন  সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রধানমন্ত্রী, নিকৃষ্ট শাসক ইত্যাদি কি-ওয়ার্ড ধরে গুগলে অনুসন্ধান করে তখন গুগল তার ডেটাবেইজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব কি-ওয়ার্ড সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ওয়েবসাইটের প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোকে অনুসন্ধানকারীর সামনে উপস্থাপন করে।

দাবিকৃত ভিডিওটি প্লে করার পর এক মহিলা কণ্ঠে সংবাদ পাঠ করতে শোনা যায়। সংবাদ পাঠে দাবি করা হয়, “বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট শাসক হিসেবে প্রথম হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি সিঙ্গাপুরভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা দ্য স্ট্যাটিসটিকস ইন্টারন্যাশনালের জরিপে শেখ হাসিনা বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট শাসক বিবেচিত হয়েছে। নিকৃষ্ট শাসক হিসেবে দ্বিতীয় হয়েছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ এবং তৃতীয় নর্থ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন। দ্য স্ট্যাটিসটিকস ইন্টারন্যাশনালের জরিপে নির্বাচন পদ্ধতি, নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা বিশ্লেষণের পর বিশ্বের নিকৃষ্ট শাসক হিসেবে সরকার প্রধানদের নিয়ে এই মূল্যায়নধর্মী ভর্তি করা হয়। গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ .৫১ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্বের এক নম্বর নিকৃষ্টতম শাসক হিসেবে বিবেচনা করার যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয় বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের আলোচনায়।…”

উক্ত সংবাদ পাঠের সূত্র ধরে, ২০১৮ সালে bdpolitico.com নামের একটি ওয়েবসাইটে  ‘শেখ হাসিনা বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট শাসক’ – দ্য স্ট্যাটিস্টিক্স ইন্টারন্যাশনালে’র রিপোর্ট’  শীর্ষক শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।

এই প্রতিবেদনেও সিঙ্গাপুরভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘দ্য স্ট্যাটিস্টিক্স ইন্টারন্যাশনাল’ এর জরিপের বরাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে একই দাবি করা হয়।

তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে ‘দ্য স্ট্যাটিস্টিক্স ইন্টারন্যাশনাল’ নামে সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোনো গবেষণা সংস্থা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে International Statistical Institute (ISI) নামে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যায়।

নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত পরিসংখ্যানের বোঝাপড়া, বিকাশ এবং অনুশীলনের নেতৃত্ব দেওয়া, সমর্থন এবং প্রচারে কাজ করে থাকে। এদের ওয়েবসাইট ঘুরেও সেরা প্রধানমন্ত্রীর জরিপ সংক্রান্ত কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকৃষ্ট স্বৈরশাসকের তালিকায় প্রথম হওয়ার দাবিতে প্রচারিত এই তথ্যটির উৎস ‘দ্য স্ট্যাটিস্টিক্স ইন্টারন্যাশনাল’ ও একটি ভিত্তিহীন প্রতিষ্ঠান।

মূলত, ‘দ্য স্ট্যাটিস্টিক্স ইন্টারন্যাশনাল’ নামের ভুয়া গবেষণা সংস্থা, অস্তিত্বহীন কিছু সাইট এবং দি টপটেনস.কম নামের একটি সামাজিক যোগাযোগ সাইটের অনির্ভরযোগ্য জরিপকে কেন্দ্র করে ২০১৮ সালে সর্বপ্রথম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কিছু অখ্যাত অনলাইন পোর্টালে নিকৃষ্ট স্বৈরশাসক/ নিকৃষ্ট শাসক/ একশত বছরে বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট পাঁচজন সরকার প্রধানদাবিতে সংবাদ প্রচার করা হয়। ফলে কেউ যখন এসব  কি-ওয়ার্ড ধরে গুগলে অনুসন্ধান করে তখন গুগল তার ডাটাবেইজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব কি-ওয়ার্ড সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ওয়েবসাইটের প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোকে ফলাফল হিসেবে অনুসন্ধানকারীর সামনে উপস্থাপন করে। রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এসব ফলাফলকেই ফেসবুকে দীর্ঘদিন ধরে নিকৃষ্ট প্রধানমন্ত্রী লিখে Google-এ অনুসন্ধান করলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি প্রদর্শিত হওয়ার দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে৷


উল্লেখ্য, পূর্বেও একই দাবি ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার। 

আরও পড়ুন

spot_img