বুধবার, অক্টোবর 29, 2025

শেখ হাসিনার মৃত্যু দাবিতে বানোয়াট সূত্র ও তথ্যপ্রমানহীন পোস্টে সয়লাব ইন্টারনেট

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিনই দেশ ত্যাগ করে পাশ্বর্বর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তবে এরমধ্যে বেশ কয়েকবার তার অডিওবার্তা প্রচার ও কলে দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে অংশগ্রহণ করার তথ্য আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ সূত্রে পাওয়া যায়। কিন্তু গত কয়েকদিন যাবৎ ইন্টারনেটে তিনি মারা গেছেন দাবিতে বেশ কয়েকটি অপতথ্য ছড়িয়ে পড়তে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।

গত ২২ অক্টোবর ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর বেঁচে নাই’ শিরোনামে প্রথম যমুনা টেলিভিশনের ডিজাইন সংবলিত একটি ফটোকার্ড প্রচার হতে দেখা যায়। 

তবে গণমাধ্যমটির ফেসবুক পেজে উল্লিখিত সময়ে প্রকাশিত ফটোকার্ডগুলো পর্যবেক্ষণ করে ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর বেঁচে নেই’ শিরোনাম সংবলিত কোনো ফটোকার্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়াও, যমুনা টেলিভিশনের ওয়েবসাইট কিংবা ইউটিউব চ্যানেলেও উক্ত দাবির পক্ষে কোনো সংবাদ বা ফটোকার্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি।

পাশাপাশি, যমুনা টিভির ফেসবুক পেজে প্রচারিত ফটোকার্ডগুলোর সাথে আলোচিত ফটোকার্ডগুলোতে ব্যবহৃত ফন্টের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।


পরবর্তীতে ২৬ অক্টোবর শেখ হাসিনা দিল্লিতে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন দাবিতে ফেসবুকে আরেকটি পোস্ট হতে দেখা যায়। কিন্তু উক্ত দাবিতে প্রচারিত পোস্টগুলোতে কোনো প্রকার নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

২৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের একটি কথিত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা গিয়েছেন দাবিতে আরেকটি পোস্ট ব্যাপকভাবে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রচারিত পোস্টটিতে তার মরদেহের দৃশ্য দাবিতে একটি ছবিও প্রচার করা হয়।

ছবিটির বিষয়ে অনুসন্ধানে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের ওয়েবসাইটে গত ৮ মার্চ Denied wheelchair by Air India, woman falls at Delhi airport, lands in ICU শিরোনামে প্রচারিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। শেখ হাসিনার মরদেহের ছবি দাবিতে প্রচারিত ছবির সাথে উক্ত প্রতিবেদনে ব্যবহৃত একটি ছবির মিল রয়েছে।

উভয় ছবিতেই একই বয়স্ক মহিলাকে হাসপাতালের বিছানায় চোখ বন্ধ অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখা যায়। তবে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবিতে দেখতে পাওয়া ছবিটির মহিলার চেহারার শেখ হাসিনার চেহারার সাথে কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে ব্যবহার বয়স্ক মহিলার একাধিক ছবি পর্যালোচনার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তাদের প্রতিবেদনে ব্যবহৃত বয়স্ক মহিলার ছবিটিই আসল। শেখ হাসিনার মরদেহের ছবি দাবিতে প্রচারিত ছবিটি কিছু সম্পাদনা করে ওই মহিলার চেহারা শেখ হাসিনার চেহারার আদলে তৈরি করা হয়েছে। 

এছাড়াও প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, আলোচিত ছবিটিতে দেখতে পাওয়া বয়স্ক মহিলা একজন ভারতীয় নারী। গত ৪ মার্চ তিনি তার পরিবারের সাথে ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে ব্যাঙ্গালুুরুতে বিমান ভ্রমণের উদ্দেশ্যে দিল্লি বিমানবন্দর যান। এসময় বিমানবন্দরে তার চলাচলের জন্যে আগে থেকেই বুকিং দেওয়া হুইলচেয়ার এয়ার ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা বিকল্প ব্যবস্থার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনো বিকল্প না পাওয়ায় ওই বয়স্ক মহিলাকে পায়ে হেঁটে চলাচল করতে হয়। যার ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে যান। পরবর্তীতে তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয় বলেও প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়। আলোচিত ছবিটি তার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন তোলা হয়। উক্ত ঘটনায় ওই বয়স্ক নারীর নাতনি ক্ষোভ প্রকাশ করে একটি এক্স (সাবেক টুইটার)- পোস্ট করেন বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়। যার ফলে এই ঘটনাটি পরবর্তীতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

২৮ অক্টোবর শেখ হাসিনা মারা যাওয়ার দাবিতে যমুনা টেলিভিশনের ডিজাইন সম্বলিত আরেকটি ফটোকার্ড ফেসবুকে প্রচার করা হয়। তবে উক্ত ফটোকার্ডটির বিষয়ে অনুসন্ধানেও গণমাধ্যমটির ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইট এবং ইউটিউব চ্যানেল পর্যালোচনা করে এমন কোনো ফটোকার্ড বা সংবাদের সন্ধান মেলেনি।

একই দাবিতে ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়াকে সূত্র উল্লেখ করে আরেকটি আরও একটি ফটোকার্ড ফেসবুকে প্রচারিত হতে দেখা যায়। 

তবে অনুসন্ধানে টাইমস অব ইন্ডিয়ার ফেসবুক পেজ কিংবা ওয়েবসাইটে এমন দাবি সংবলিত কোনো প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়নি। 


দেশিয় গণমাধ্যম বাংলাভিশনও একই দিনে শেখ হাসিনার মৃত্যু দাবিতে একটি ফটোকার্ড প্রচার করেছে বলে ফেসবুক একটি পোস্টে দাবি করা হয়।

তবে গণমাধ্যমটির ফেসবুক পেজে উল্লিখিত সময়ে প্রকাশিত ফটোকার্ডগুলো পর্যবেক্ষণ করে উক্ত দাবি সংবলিত কোনো ফটোকার্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়াও, তাদের ওয়েবসাইট কিংবা ইউটিউব চ্যানেলে উক্ত দাবির পক্ষে কোনো সংবাদ বা ফটোকার্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি।উল্লিখিত পোস্টগুলো ছাড়াও শেখ হাসিনার মৃত্যুর দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কথিত সূত্রের বরাতে বেশকিছু টেক্সট পোস্টও দেখতে পাওয়া যায়। পাশাপাশি তার মৃত্যুর দাবিতে স্যাটায়ার ধর্মী ফেসবুক পেজ ইকবাল টিভির প্রচারিত একটি ফটোকার্ড পরবর্তীতে সিরিয়াস পোস্ট দাবিতে ফেসবুকে ছড়িয়ে পরতেও দেখা যায়।

এছাড়াও আরেক ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের সূত্রে ফেসবুকে শেখ হাসিনার মারা যাওয়ার দাবিটি প্রচারিত হয়। কিন্তু গণমাধ্যমটির ফেসবুক, ওয়েবসাইটসহ কোনো প্ল্যাটফর্মে-ই এমন কোনো সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা যায়নি।

শেখ হাসিনার মরদেহের ছবি দাবিতে ফেসবুকে আরেকটি ছবিও প্রচারিত হতে দেখা যায়। প্রচারিত ছবিটিতে একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটি লাশ স্ট্রেচারে করে নিয়ে যেতে দেখা যায়।

ছবিটির বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, ছবিটি ২০২১ সালে থাইল্যান্ডের পথুম থানি প্রদেশে তোলা হয়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রকোপের সেসময় দেশটির হাসপাতালগুলো মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়ে যায়। তাই হাসপাতালের মর্গ লাশে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে দেশটির হাসপাতালগুলো ফ্রিজিং কন্টেইনারে লাশ সংরক্ষণ করতো। আলোচিত ছবিতে দেখতে পাওয়া লাশটিও হাসপাতাল থেকে কন্টেইনারে নেওয়া হচ্ছে বলে জানা যায়।

সর্বশেষ গতকাল অর্থাৎ, ২৮ অক্টোবর রাতে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার নামে পরিচালিত একটি ভুয়া পেজে শেখ হাসিনার মৃত্যুতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শোকবার্তা প্রকাশ করেছে দাবিতে একটি বিজ্ঞপ্তি পোস্ট করা হয়।

তবে অনুসন্ধানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে এমন কোনো শোকবার্তা প্রচারিত হতে দেখা যায়নি। বরং, উক্ত শোকবার্তাটি ভুয়া জানিয়ে দলটির পেজে একটি পোস্ট করা হয়।

এছাড়াও দলটির ফেসবুক পেজ, শেখ হাসিনা পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয়ের ফেসবুক পেজ ও কন্যা সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলের এক্স অ্যাকাউন্টে শেখ হাসিনার মারা যাওয়ার দাবির সপক্ষে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত আজ দুপুরে একটি পোস্ট করে জানান, তার সাথে আজ শেখ হাসিনার কথা হয়েছে। গতকাল আরাফাতের বাবার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তিনি (শেখ হাসিনা) যোগাযোগ করেন বলেও তার পোস্টে সে উল্লেখ করেন।

পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ফ্রান্স ২৪,, রয়টার্স এবং ইনডিপেনডেন্ট আজ (২৯ অক্টোবর) শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার সংবলিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গণমাধ্যমগুলো দাবি করে, গত ৫ আগস্টের পর এটাই শেখ হাসিনার গণমাধ্যমে দেওয়া প্রথম সাক্ষাৎকার। যদিও রয়টার্স তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে তারা ইমেইলের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নিয়েছে। 

সুতরাং, শেখ হাসিনার মৃত্যুর দাবি নিয়ে ইন্টারনেটে প্রচারিত ১০টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এসব অপতথ্যের প্রচারে ব্যবহার করা হয়েছে একাধিক গণমাধ্যমের ভুয়া ফটোকার্ড, গণমাধ্যমের ভুয়া সূত্র, ভিন্ন নারীর ছবি বিকৃতি, ভিন্ন ব্যক্তির লাশের ছবি ও ভুয়া শোকবার্তা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img